অতি দর্পে হতা লঙ্কাঃ,
অতি মানে চ কৌরবাঃ,
অতি দানে বলির্বদ্ধঃ,
সর্বমত্যন্ত গর্হিতম্।। (মহামতি কৌটিল্য)
– অতি দর্পেই লঙ্কেশ রাবণের পতন, অতি অভিমানেই দুর্যোধনের মতিভ্রম ও কুরুবংশের বিনাশ, অতি দান করার প্রবণতাই বলি রাজার সর্বনাশের মূল, অতি সর্বক্ষেত্রেই পরিত্যাজ্য – অতি প্রাচীন, প্রখ্যাত শ্লোক যা রচিত হয়েছিল মনুষ্যসমাজের চিন্তা, আচরণ, ব্যাপ্তিকে কেন্দ্র করেই সর্বযুগে, সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু তাও ভুল হয়, মানুষ অতির ফাঁদে পড়ে নিজস্ব দুর্বলতা বা রিপুর প্রকোপেই। তিনিও অতির ফাঁদে পড়েছেন – অতি যা বিনাশের ধ্বনি শোনায় কিন্তু সব দেখেও কিছু করতে পারেন না; হয়তো করতে চান ও না কারণ মানুষ মরণশীল কিন্তু ভাবে সে অমর। তিনি – অর্থাৎ শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (যদিও তিনি আজকাল মমতা নামটি ব্যবহার করতেই বেশী আগ্রহী) এক ফাঁদের মধ্যেই অবস্থান করছেন। যদিও সেটি মরণফাঁদে বা তাঁর পতনের ফাঁদে পরিণত হবে কিনা তা লেখা আছে একমাত্র ভবিষ্যতের গর্ভেই কিন্তু তবুও নির্দ্বিধায় বলা যায় সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর। ইংরেজীতে যদি বলা যায়, তাহলে – the picture is not rosy at all…
যদি গত কয়েকদিনের ঘটনাবলীর ওপরে নজর রাখা যায় তাহলে বোঝা যাবে বর্তমানের যে ধর্ণাকে কে কেন্দ্র করে রাজ্যের তথা জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা একেবারে অনভিপ্রেত বা অকস্মাৎ ঠিক বলা যায়না। ‘৪৭ থেকে বর্তমান মুহূর্ত পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে যে অর্থনৈতিক দুর্নীতি বা তার কলঙ্ক দেখা যায়নি তা নয়। ১৯৮৮ সালে বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারী ও তজ্জনিত তৎকালীন প্রতিবাদী মন্ত্রী (আরএসপি) শ্রী যতীন চক্রবর্তীর বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ চিরদিনই সিপিআইএম তথা বামফ্রন্টের কাছে একটি অস্বস্তির কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে ঘটা সারদা সহ অন্যান্য চিটফান্ডের কেলেঙ্কারীর সম্মুখে তা যেন সত্যযুগের বলে ধ্বনিত হয়। পরবর্তীকালে নারদা কেলেঙ্কারী (২০১৪ সালে ঘটিত একটি স্টিং অপারেশন) ও তার দ্বারা প্রদর্শিত ভিডিও অনুযায়ী বঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ঘুষ খাওয়া রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন তোলে যদিও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই প্রত্যাবর্তন করে।
সমস্যা এখানে মূলত দুটি – ১) চিটফান্ড কেলেঙ্কারী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ না হওয়া; ২) কেলেঙ্কারী সংক্রান্ত তদন্তের ভার কেন্দ্র্রীয় সরকারের বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার ওপরে অর্পিত হওয়া যা ইতিমধ্যে অনেক সময়েই রাজ্য রাজনীতিতে তুফান তুলেছে। বেশ কিছু তৃণমূল কংগ্রেস নেতা গ্রেফতারও হয়েছেন। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত বিজেপির সাথে তৃণমূলের দ্বৈরথ এক্ষেত্রে একটি সার্থক catalyst বা অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুটি রাজনৈতিক দলের বিচারধারা সম্পর্কিত বিরোধী অবস্থান এই ক্রমবর্ধমান তিক্ততা তৎসহ উত্তেজনার মূল কারণ।
জনমানসে প্রতিক্রিয়া? তৃণমূলের সভ্য, সমর্থক ব্যতিরেকে সবাই দ্বিধাবিভক্ত। তবে, মমতার এই প্রতিক্রিয়া আশ্চর্য ঠেকেছে – বিশেষত, একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী কি প্রকারে আপন সাংবিধানিক মর্যাদা কার্যত জলাঞ্জলী দিয়ে তাঁর নিজের পার্টির সমর্থকদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান করেন। বিশেষত, প্রতিপক্ষটি যখন ভারতের রাজধানী দিল্লীতে সংখ্যাধিক্য জনগণের সমর্থনপ্রাপ্ত, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে অধিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতবর্ষের সাংবিধানিক ইতিহাসেও এটি অত্যুত্তম। এর পূর্ব দৃষ্টান্ত হল ৭০ র দশকে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের (জেপি) আহ্বান। কিন্তু সেই সময় জেপি কোন সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তাহলে?
পরিশেষে, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছিল এক ঐতিহাসিক পালাবদল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের গণ-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসীন হলেন মমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তবে প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারী, স্বজনপোষণ ও মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগে বারংবার উত্তপ্ত হয় রাজ্যের রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষে রক্তে লাল হয় মাটি। তার সঙ্গেই যুক্ত হয় মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক তছরুপ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় হাহাকার; অর্থনৈতিক স্থবিরতা বঙ্গমাতার যন্ত্রণাই বৃদ্ধি করেছে কেবল। বর্তমানে উৎসবে শ্রেষ্ঠতম আর অন্যান্য সবকিছুতেই নিকৃষ্টতম পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ হয়ে উঠেছে এক সম্পূর্ণ ব্যর্থ রাজ্যের সার্থক প্রতিমূর্তি। এর দায় একান্তভাবেই রাজ্য সরকারের। আর তার সাথে ঘোরতরভাবে সম্পৃক্ত হল বাঙ্গালী হিন্দু জনজাতি। বাঙ্গালী হিন্দুর যে জাতিগত নির্মূলীকরণের তৃতীয় বা সর্বশেষ অধ্যায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে, দ্বিতীয় অধ্যায় আসাম রাজ্যে, তার প্রথম অধ্যায় ইতিমধ্যে প্রারম্ভ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। রাষ্ট্র শ্রেষ্ঠ হয় নৃপতির গুণে; নিকৃষ্ট হয় অপগুণে। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, ক্রমশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ।
[প্ৰবন্ধটি ইতিপূর্বে ভারতের আসাম রাজ্যের প্রখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্র “দৈনিক প্রান্তজ্যোতি” তে প্রকাশিত হয়েছে।]