পাকিস্তান গঠনে অগ্রণী ছিল আহমাদিয়ারা

0
556

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছিল বিরোধীদের দ্বারা সৃষ্টি করা বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোলের মধ্যেই।  বিতর্কের মাঝামাঝি বিশেষ ভাবে উচ্চারিত হল আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নাম। আহমাদিয়া সম্প্রদায় ইসলামের একটি উপদল যারা ইসলামী দেশগুলিতে প্রায়শই নিপীড়িত হয়ে থাকে কারণ ইসলামী জাতিগুলি সম্প্রদায়টিকে “যথেষ্ট মুসলিম” হিসেবে স্বীকারই করে না।

এই সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যাচার দুঃখজনক হলেও এটি একান্তভাবেই ইসলামী সম্প্রদায়ের এক অভ্যন্তরীণ সমস্যা। পাকিস্তানের আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায় যে এই সম্প্রদায়টিই পাকিস্তান গঠনের সর্বাগ্রে ছিল যার সম্বন্ধে প্রচার বিশেষ ছিল না বললেই চলে।

পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান আইনজীবী মুহম্মদ জাফরুল্লাহ খান ছিলেন আহমদিয়া গোষ্ঠীভূক্ত। ১৯৪০ সালের লাহোর রেজোলিউশনটি খানেরই রচিত ছিল। পাকিস্তান গঠনে তাঁর ভূমিকার বিষয়ে মন্তব্য করে একজন ভাষ্যকার লিখলেন,

[T]here needs to be a realisation that Jinnah was the ‘lawyer’ for the case of Pakistan. He argued for it and won. However, Jinnah was never the visionary or a revolutionary strategic thinker to guide the course of the nation. If anybody at all in Muslim League was a strategic thinker, it was Sir Zafarullah Khan, who was also the author of the Lahore Resolution, which for the first time chalked out the idea of Pakistan. Khan, however, belonged to the then Islamic sect of Ahmadis and thus his role over the years was kept a secret, until recently when documents and letters written by Lord Linlithgow revealed the centrality of his role. Hence, there should be a little less stress on ‘Jinnah’s Pakistan’, because honestly, there is none; and scratching out Jinnah’s vision forcefully has only served to confuse the people and obfuscate the roadway to progress”.

“একটি উপলব্ধি হওয়া খুবই দরকারী যে জিন্নাহ সাহেবই পাকিস্তান- মামলার আইনজীবী ছিলেন। এই উক্তির স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে জয়লাভ করলেন তিনি। তবে রাষ্ট্রের গতিপথ নির্ধারণের জন্য কোনও স্বপ্নদ্রষ্টা বা বৈপ্লবিক  কৌশলী চিন্তাবিদ ছিলেন না জিন্নাহ। মুসলিম লীগে যদি কৌশলী চিন্তাবিদ কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি ছিলেন স্যার জাফরুল্লাহ খান যিনি লাহোর রেজোলিউশনের রচয়িতাও ছিলেন, যা প্রথমবারের মতো পাকিস্তান গঠনের ধারণার খসড়া তৈরি করেছিল। যেহেতু খান ইসলামের অন্তর্গত তদানীন্তন আহমাদী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন, তাঁর এই ভূমিকা গোপন রাখা হয়েছিল বেশ কিছু বছর ধরে। লর্ড লিনলিথগোর লেখা নথি এবং চিঠিগুলিই তাঁর ভূমিকার প্রধানতার কথা প্রকাশ করেছিল প্রথমবার। সুতরাং ‘জিন্নাহর পাকিস্তান’ এই ধারণার বাধ্যবাধকতা কিছুটা কম হওয়া উচিত, কারণ সত্যি বলতে গেলে এই ধারণার কোনও ভিত্তিই নেই এবং জোর করে জিন্নাহ-র দূরদর্শিতার কথা প্রমাণের চেষ্টা জনগণকে কেবলমাত্র বিভ্রান্তই করেছে এবং বাধা সৃষ্টি করে, ব্যর্থ করেছে অগ্রগতির পথে যেতে।”

খান আবদুল ওয়ালি খানের লেখা “ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস” বই এর বিষয়ানুসারে, ভাইসরয় লর্ড লিথিংগ্লো জাফরুল্লাহ খানের সহায়তা চেয়েছিলেন যিনি তখন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং দেশ বিভাগের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব এনেছিলেন। ভাইসরয় লিখেছেন, “আমার নির্দেশের পরে জাফরুল্লাহ এই বিষয়ে একটি স্মারকলিপি লিখেছিলেন। ‘টু ডোমিনিয়ন স্টেটস’ দুটি দেশের আধিপত্য। আমি ইতিমধ্যেই সেটি পাঠিয়ে দিয়েছি আপনার বিচার-বিবেচনার জন্য। আমি আরও বিশদ ব্যাখ্যার আশা করে তাঁকে জানিয়েছি। তিনি জানিয়েছেন, শীঘ্রই ব্যবস্থা নিচ্ছেন তিনি। তবে তিনি উদ্বিগ্ন, তাঁর দ্বারা পরিকল্পিত এই প্রস্তাবনার কথা তিনি প্রকাশ্যে আনতে চান না, কিন্তু তিনি আমাকে প্রস্তাবনাটি নিয়ে আমার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার  এবং আপনাকে সবকিছু জানানো ও পাঠাবার সবরকমের অধিকারও দিয়েছেন, আমাকে। অনুলিপিগুলি জিন্নাহ-র কাছে পাঠানো হয়েছে এবং আমার মনে হয় স্যার আকবর হায়দারের কাছেও গেছে সেই প্রস্তাবনা। জাফরুল্লাহ সাহেব যদিও তাঁর লেখক- কৃতি স্বীকার করতে অস্বীকার করেছেন, তাঁর দলিলটির  প্রচারের কাজের ভার পুরোপুরি ভাবে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে মুসলিম লীগ।”

জাফরুল্লাহ খান পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। কাশ্মীর ইস্যুতেও তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত, তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তিনি যে দানবের সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিলেন তা যখন তাঁর দেশবাসীকেই গিলে ফেলতে উদ্যত হলো।

তবে, অনেকের মতেই তিনি পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পিতা হিসাবে বিবেচিত হন।

কেবল জাফরুল্লাহ খান একাই ছিলেন না, তৎকালীন আহমদিয়া- খলিফা, মির্জা বশির-উদ্-দীন মাহমুদ আহমদও পাকিস্তান গঠনের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে, আহমদিয়াদের তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’কে ভোট দেওয়ার জন্য এবং পাকিস্তান গঠনের দাবিতে যে নির্বাচন হয়েছিল, তার পক্ষ সমর্থনের পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি।

মির্জা মাহমুদের নির্দেশে গঠিত হয়েছিল  ‘ফুরকান ফোর্স’, স্বেচ্ছাসেবীদের একটি যুদ্ধ দল ‘ইউনিফর্মড ফাইটিং ফোর্স’ যা ছিল পুরোপুরিভাবে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকেদের সমন্বয়ে তৈরি। এই যুদ্ধ দল ১৯৪৭- ৪৮ সালে কাশ্মীরের অধিকারের জন্য প্রথম যুদ্ধের সময় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছিল  এমনকি এই যুদ্ধের ব্যয়ও বহন করেছিল আহমদিয়া সম্প্রদায়। মির্জা মাহমুদ ‘সর্ব ভারতীয় কাশ্মীর কমিটি’র ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৩১ সালে এবং আহমদিয়ারা কাশ্মীরি মুসলিম পরিচয়কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, বিংশ শতাব্দীতে।

কেবল তা-ই নয়, মুহাম্মদ ইকবাল, যিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘আধ্যাত্মিক পিতা’ হিসাবে পরিচিত, তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়েই ছিলেন একজন আহমদিয়া। তিনি দৃঢ়ভাবে তাঁর সমর্থন জানিয়েছিলেন, একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে এবং ‘উম্মাহ’র প্রতি তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। তাঁর পরবর্তী জীবনে তিনি এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। সর্বজনবিদিতভাবে জানা যায় যে তিনি ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আহমদিয়া নেতৃত্বের সংস্পর্শে ছিলেন, যখন তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত ‘সর্বভারতীয় কাশ্মীর কমিটি’র প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে  সর্বাধিক সক্ষম নেতা আহমদী খলিফার পক্ষে কথা বলেছিলেন। তাঁর পিতা-মাতা ও বড় ভাইয়েরা কিন্তু আহমদিয়া সম্প্রদায় ভুক্তই রয়ে গেছিলেন।

অপইণ্ডিয়ার সৌজন্যে। মূল প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ করেছেন ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য।