শ্যামাপ্রসাদের পুনরাগমন হবে কি পশ্চিমবঙ্গে? বিজেপির ব্রিগেড নিঃসন্দেহে সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে 

0
3508

দেবজিৎ সরকার

 

শ্যামাপ্রসাদ থেকে মমতা

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গঠনের রূপকার। যখন সমগ্র যুক্তবঙ্গ মুসলিম লীগের শাসনাধীনে চলে যাচ্ছে এবং ফলে এই যুক্তবঙ্গের পাকিস্তানে যাওয়া একটা সময়ের অপেক্ষা মাত্র, তখন শ্যামাপ্রসাদ রুখে দাঁড়ালেন। হিন্দু বাঙ্গালীদের কাশ্মীরের পণ্ডিতদের দশা হবার আগেই এই ক্রান্তদ্রষ্টা মনীষী বঙ্গকে ভাগ করে হিন্দু বাঙ্গালীর জন্য হোমল্যাণ্ড বানানোর কাজ করেন। তাঁর মনীষাকে সম্মান জানিয়ে সমগ্র হিন্দু বাঙ্গালী সাথে যোগ দেয়, যেমন পণ্ডিত যদুনাথ সরকার, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, অতুল্য ঘোষ, ডঃ বিধান চন্দ্র রায়, বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।  এই আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ সালের ২০ই জুন পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি হয়।  

 পশ্চিমবঙ্গ  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পশ্চিমবঙ্গ এই মনীষীর সাহচর্য বেশীদিন পায় নি।  ১৯৫২ সালে যখন কাশ্মীরকে ভারত বিভাজনকামী শক্তি আত্মসাৎ করার সুযোগ খুঁজছিল, এই চক্রান্তের প্রতিবাদ করতে শ্যামাপ্রসাদ কাশ্মীরে যান। তাঁকে বন্দী করে জেলে রাখা হয়। শ্যামাপ্রসাদ কিভাবে যে সেই জেলে মারা গেলেন, তার প্রকৃত আখ্যান হয়তো কোন দিনই জানা যাবে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে শ্যামাপ্রসাদের মনীষার স্পর্শ থেকে বঙ্গবাসী বঞ্চিতই থেকে গেল।

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কংগ্রেসের জমানার অবসানে এসেছে দীর্ঘ কমিউনিষ্ট শাসন। তারপর এসেছে তৃণমূল শাসন, তাও দশ বছর হয়ে গেল। যে বাঙ্গালী একদিন ভারতের শিখরে ছিল কি শিক্ষায়, কি দেশপ্রেমে, কি অর্থনীতিতে, আজ সেই বাঙ্গালী সব বিষয়েই অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আজ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা করুণ। যে বাঙ্গলার যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন ঐতিহাসিকদের শিরোমণি, তাঁদের ইতিহাস আজ আর বাঙ্গালীকে পড়ানোই হয় না। যে বাঙ্গালী গর্ব করতেন আপন শিক্ষামানের, সেই বাঙ্গলার মাধ্যমিক পরীক্ষায় নির্দেশিকায় বলা হয় যে বানান ভুলের জন্য কোন নম্বর কাটা হবে না! এই বাংলা শ্যামাপ্রসাদকেই প্রায় ভুলে গেছিল বিবিধ অপপ্রচারে আবহে। যে বাংলা ছিল দেশপ্রেমে শিখরে, সেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আজ ভারত বিভাজনকারী শক্তির ভাষা বলেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শ্লোগান জয় বাংলা মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় শ্লোগান। তিনি ভারতে এক নয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আপন সাংবিধানিক পদমর্যাদা অগ্রাহ্য করেই তিনি এই ডাক দিয়েছেন। কার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন? ভারতের রাজধানী দিল্লীতে সংখ্যাধিক্য জনগণের সমর্থনপ্রাপ্ত, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে অধিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধ!!  একটি কর্মসূচিতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বিদেশ, অর্থ এবং প্রতিরক্ষা দফতরই কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা উচিত।’’ সমস্যা হচ্ছে, এই কথা শেষবারের মতো শোনা গিয়েছিল ডাইরেক্ট একশন ডের নায়ক হুসেন শাহিদ সুরাবর্দির কণ্ঠে। কোথাও যেন সামগ্রিক পরিস্থিতি, অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে দেশপ্রেমিকদের কাছে। সহস্র সহস্র নিরীহ হিন্দুর জল্লাদ সুরাবর্দীর জন্মদিনে তাঁর নাম করে  আসে শুভেচ্ছা। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় মেধাবী বাঙ্গালী যুবককে যেতে হয় জেলে।

 

বিজেপির উত্থান

কিন্তু কাল চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ। সব কিছুরই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই বিজেপির উল্কাসদৃশ অভ্যুত্থান হচ্ছে। কোন বিজেপি? সেই বিজেপি যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হাত ধরে। তখন পার্টির নাম ছিল বিজেপি। সেই বিজেপি যে পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘোষ, যিনি কোন পরীক্ষায় কোনদিন দ্বিতীয় হন নি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৫ অবধি তিনি ছিলেন জনসংঘের প্রধান নেতা তথা ভারতের বিরোধী দলনেতা। এই পার্টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত ছিলেন পণ্ডিত বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী। শ্যামাপ্রসাদের আত্মা আছেন বিজেপিতে। এত বরেণ্য নেতা থাকা সত্ত্বেও এই বিজেপি বঙ্গে ছিল একটি প্রান্তিক শক্তি। সেকুলারদের কথায় সাম্প্রদায়িক বলে ধিক্কৃত। 

শ্রী দিলীপ ঘোষ বিজেপির দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে থাকে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৪০ শতাংশের বেশী ভোট ও ১৮টি লোকসভা আসন জিতে বিজেপি আপন পদচিহ্ন দৃঢ়ভাবে বঙ্গ রাজনীতিতে দেয়। তারপর যত দিন গেছে বিজেপি ধীরে ধীরে বঙ্গে ক্ষমতায় আসার উপযুক্ত প্রতিভাত হয়েছে। মমতা সরকারের বিশিষ্ট মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগদান বুঝিয়ে দিয়েছে, জনমত কোন দিকে ঢলে আছে।

যে সিপিএম সবাইকে সাম্প্রদায়িকতার শংসাপত্র প্রদান করত, যারা কংগ্রেসকে বুর্জোয়া শক্তির দালাল বলত, তারা আজ কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে আছে। তারা আজ আল্লাহের কাছে ভাইরাসে পঞ্চাশ কোটি ভারতীয়ের মৃত্যুকামনা করা পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর সাথে জোট করছে। ২৮ ফেব্রুয়ারীর ব্রিগেডে দেখা গেল কমিউনিষ্ট পার্টির সভায় মঞ্চের উপরে ও নীচে পীরজাদার দাপদ। তিনি মঞ্চে উঠছেন বলে লোকসভার বিরোধী দলনেতাকেও বক্তৃতা থামাতে হল। তিনি অনুষ্ঠান ছাড়া মাত্রই প্রায় ৪০% লোক সভা ছেড়ে চলে গেল।

বিজেপির ৭ই মার্চের ব্রিগেডের তাৎপর্য

ভিড়ের দিক দিয়ে এই ব্রিগেড আগের সব ব্রিগেডকে ছাপিয়ে গেছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারীর ব্রিগেডে পিছনের দিকে ঘাস দেখা যাচ্ছিল। এই ব্রিগেডে জনসমুদ্রের লোকের কালো মাথা ছাড়া কিছু দেখার জো নেই। মাঠের মধ্যে ভিড়ের চাপে ব্যারিকেড ভেঙ্গে পড়ছে। মাঠের বাইরে যানবাহন রুদ্ধ। আর এখানেই গল্পের শেষ নয়। এখন ট্রেন সেভাবে চালু হয়নি। বাস ভাড়া নিতে গেলে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের চোখ রাঙানিতে বাসমালিকেরা ইচ্ছে থাকলেও বাস ভাড়া নিতে চান না। অনেক সময় অগ্রিম টাকা নিয়েও তাঁরা বাস দিতে পারেন না। এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিরোধী দলের এই ভিড় বুঝিয়ে দেয়, হাওয়া কোন দিকে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই জনতার চরিত্র। এই জনতা শহর বা শহরতলী থেকে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এঁরা এসেছেন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। এঁদের ভোটেই রাজ্য-রাজনীতির মীমাংসা হয়। তার সাথে সাথে এই জনতার উৎসাহও বিপুল কারণ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসাটা কঠিন।  সেই উৎসাহ ইভিমে আসাটাই স্বাভাবিক। 

এই ব্রিগেড থেকে বিজেপির অপর প্রাপ্তি হল মিঠুন চক্রবর্তী। মিঠুনের উপর তৃণমূলের তীব্র আক্রমণ বা বামেদের হোয়াটস্যাপের মীম প্রমাণ করে যে তারা কতটা সমস্যায় পড়েছে মিঠুনের বিজেপিতে যোগদানে। বাংলার যুবসমাজের কাছে প্রকৃত হীরো হলেন “মহাগুরু” মিঠুন। তিনি বিজেপিতে যোগদান করায় বিজেপিকে বহিরাগত বলার তৃণমূলী বিপুল প্রচেষ্টাটি জলে গেল।  

 

নরেন্দ্র মোদীর বার্তা: এখন খেলা ভাঙ্গার খেলা

তৃণমূলের “খেলা হবে”র জবাবে নরেন্দ্র মোদী আঙ্গুল তুলেছেন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও তোষণের তৃণমূলী খেলার দিকে। সেই খেলা যে এবার সাঙ্গ হবার পালা তার তিনি বার্তা দিয়েছেন। তৃণমূল খেলা হবে বলতে কি খেলার কথা বলেছে, তা স্পষ্ট  করেনি। এই অস্পষ্টতাকে উন্মুক্ত করে দিলেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি  এই খেলা যে জনবিরোধী ষড়যন্ত্র তা বলে দিলেন। এতে সমস্যায় পড়ে গেল তৃণমূল। 

 

গুজরাটের মত শিল্পোন্নত হোক বাংলা 

কয়েকদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ইলেকট্রিক স্কুটারে চেপে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছিলেন। আজ সেই ঘটনাকেই হাতিয়ার করলেন মোদী। তিনি দেখিয়ে দিলেন যে বাংলা অর্থনীতিতে কত পিছিয়ে আছে। ঐ স্কুটারটি যে গুজরাটে তৈরী, তা তিনি তাঁর স্বভাবজাত রসসিক্ত ভঙ্গিমায় তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যঙ্গের কষাঘাত করলেন।

 

শেষ কথা

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ চেয়েছিলেন এক অর্থশক্তিতে বলবান বঙ্গ যারা আপন সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ। জয় বাংলা শ্লোগানের আড়ালে বর্তমান বাঙ্গালীর অভিভাবকেরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা আর নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি দিশাহীন। তাই চাই এক নবজাগরণ। তার সূচনা কি হবে ২রা মে?

 

লেখক বিজেপির নেতা। মতামত ব্যক্তিগত।