হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল? প্রাথমিক সমীক্ষা – ২

রাম জন্মভূমি নিয়ে ১৯৮০র দশকের বিতর্কের মধ্য়ে সীতারাম গোয়েল দেখেছিলেন হিন্দু মন্দিরগুলির উপর প্রভূত মধ্যযুগীয় বর্বরতা নিয়ে আছে ততোধিক অজ্ঞতা। তাই তিনি এই বিষয়টিকে নিয়ে লেখেন Hindu Temples: What Happened to Them. এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে  প্রাথমিক সমীক্ষা। লিখেছন অরুণ শৌরী, হর্ষ নারায়ণ, জয় দুবাসী, রাম স্বরূপ এবং সীতারাম গোয়েল।

এই বইয়ের সূচীপত্রটি নিম্নরূপ।

মুখবন্ধ
১। চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
২। হিমশৈলের চূড়া
৩। কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন
৪. ধর্ম যখন উপলক্ষ্য
৫। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
৬। ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস
৭। নভেম্বর-৯ ইতিহাস পরিবর্তন করবে
৮। শিল্যান্যাস থেকে “বার্লিনের পাঁচিল” পর্যন্ত
৯। রাম-জন্মভূমি মন্দির সংক্রান্ত মুসলিম বিবৃতি
১০। বোবা সাক্ষী কথা বলুক
উপসংহার

১৯৯০ সালে ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া এই বইটি প্রকাশ করে। হিন্দুত্ববুক্সের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বইটি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসল বঙ্গদেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা সরকার।

আগের পর্ব  []

দ্বিতীয় অধ্যায় : হিমশৈলের চূড়া

– সীতারাম গোয়েল

মৌলানা আবদুল হাইয়ের দ্বারা উল্লেখিত (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৮৯, “চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা” শীর্ষক নিবন্ধ) হিন্দু মন্দিরের মসজিদে পরিণত হওয়া শুধু মাত্র হিমশৈলের চূড়া মাত্র। প্রধান হিমশৈলটির আরেকটু বিস্তারিত বিবরণ মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচনা, বিদেশী ভ্রমণকারীদের রচনা এবং ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার প্রতিবেদনে নিমগ্ন। দমিয়ে রাখার ব্যস্ত প্রচেষ্টার পরেও যখনই হিমশৈলটি পৃষ্ঠের দিকে এগিয়ে গিয়েছে, তখনই ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয় সংহতিকরণের নামে একটি আওয়াজ উঠেছে।

নীরবতার এই ষড়যন্ত্রে প্রধান অবদান রেখেছেন “ঐতিহাসিক হিসাবে পরিচিত মার্ক্সবাদী রাজনীতিবিদরা”।
বর্তমান ভারতের মুসলিম রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতরা মধ্যযুগীয় সময়ে হিন্দু মন্দির ধ্বংস সম্পর্কে যে কোনও উল্লেখের বিরোধিতা করে থাকেন। বরং তাঁরা এমন প্রতিক্রিয়া দেখান যেন হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা এই মতবাদটি ছড়িয়ে তাঁদের কলঙ্কিত করছে। তবে, অতীতে, তাঁদের পূর্বসূরীরা একই কর্ম সম্পাদনকে ধার্মিকতার কাজ হিসাবে দেখেছিল এবং সেই কারণেই শিলালিপি ও সাহিত্যে কাজটিকে যথেষ্ট গর্বের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছিল। মধ্যযুগীয় ভারতের হিন্দুরা তাদের উপাসনালয়গুলিতে ইসলামিক মূর্তি ধ্বংসকারীদের হাতে কী ঘটেছিল, তার ইতিহাস খুব কমই লিখে গেছে। “হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা” এই প্রসঙ্গে যে প্রমাণই প্রস্তুত করে সেগুলি পুরোপুরি ইসলামিক উৎস, লিপি এবং সাহিত্য থেকেই আসে।

 

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ

ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে দ্বারা এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে সমগ্র ভারতবর্ষে অনেকগুলি মসজিদ রয়েছে যেগুলি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরী হয়েছিল। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দ্বারাও এটি একটি যাচাই করা সত্য। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মসজিদে আল্লাহ ও নবীর আবাহন, কোরানের বাণী এবং কখন, কীভাবে, কার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। শিলালিপিগুলি বিশিষ্ট মুসলিম প্রত্নতত্ত্ববিদ দ্বারা পাঠোদ্ধার করা হয়েছে ও তাদের ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেগুলি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দ্বারা ‘এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা-আরবিক’ এবং ‘ফারসি সাপ্লিমেন্টস’তে প্রকাশিত হয় ; (১৯০৭-০৮ সালে এটির প্ৰথম বার্ষিক ক্রোড়পত্র ‘এপিগ্রাফিয়া ইন্দো-মোসলেমিকা’নামে প্রকাশিত হয়েছিল)।

নিম্নলিখিত কয়েকটি শিলালিপি নির্বাচন করা হয়েছে এটি দেখানোর জন্য যে

(১) মুসলিম আধিপত্যের সময়কালে হিন্দু মন্দির ধ্বংস অব্যাহত ছিল;

(২) ভারতের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণের সমস্ত অঞ্চল জুড়েই এই ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছিল এবং

(৩) সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী, প্রাদেশিক ও মুসলিম রাজবংশ এই ‘ধর্মীয় কাজে’ অংশগ্রহণ করেছিল।

১) কউয়াত আল-ইসলাম মসজিদ, কুতুব মিনার, দিল্লি: এই দুর্গটি জয় করা হয়েছিল এবং সুলতানের দাস আমির দ্বারা ৫৮৭ হিজরী সালে জামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। অভ্যন্তরের ২৭টি প্রতিমা, যার প্রত্যেকটির নির্মাণে ২,০০,০০০ দিল্লিওয়াল ব্যয় করা হয়েছিল, মসজিদটির নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় (প্রকাশ :১৯০৯-১০, পৃষ্ঠা ৩-৪)। আমির কুতুবুদ্দীন আইবক ছিলেন মাইজুদউদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরির দাস। ৫৮৭ হিজরী সালে অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিওয়াল ছিল সেই সময়ে দিল্লিতে প্রচলিত একটি উচ্চমূল্যের মুদ্রা।

২) কর্ণাটকের রায়চুর জেলার মানভিতে অবস্থিত মসজিদ: পারভারদিগার ফরমান ছিলো আল্লাহর প্রশংসা হোক। ধর্মের চিহ্ন হিসেবে একটি মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছিল, সুলতান ফিরোজ শাহ বাহামনির রাজত্বকালে। ফিরোজ শাহ বাহমানি মুসলমান ধর্মের প্রসারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন (প্রকাশ: ১৯৬২, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭)। শিলালিপিতে নির্মাণের সময় হিসাবে ১৪০৬-০৭ খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।

৩) গুজরাটের বনসকাঁথা জেলায়, মালানের পলানপুর তালুকে জামে মসজিদ: জামে মসজিদটি খান-ই-আজম উলুগ খান নির্মাণ করেছিলেন…হতভাগ্য কাফেরদের দমন করে। তিনি প্রতিমা-উপাসনাকারীদের ঘরবাড়ি এবং তাদের বসতি উচ্ছেদ করেন, তাদের পূজ্য প্রতিমাগুলি দিয়ে তিনি তাঁর প্রাসাদটি প্রস্তুত করেছিলেন। এই প্রাসাদের দরজা ও দেওয়ালগুলি এক একটি মূর্তি থেকে তৈরী করা হয়েছিল; প্রতিটি পাথর প্রতিমা-বিশ্বাসীর কাছে নিরাশার জায়গা হয়ে উঠেছিল (প্রকাশ: ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ২৬-২৯)। গুজরাটের প্রথম মামুদ শাহের (বেগদা) রাজত্বকালে নির্মাণের তারিখটি ১৪৬২ খ্রিস্টাব্দ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪) উত্তর প্রদেশের জৌনপুরে হাম্মাম দরওয়াজা মসজিদ: আল্লাহের অপার করুণায় একজন “অবিশ্বাসী কাফেরের বাসস্থানটি” প্রার্থনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল! এর পুরষ্কার হিসাবে, উদার আল্লা স্বর্গে নির্মাতাদের জন্য একটি আবাস তৈরি করেছিলেন (হয়তো!) (প্রকাশ ১৯৬৯, পৃষ্ঠা ৩৭৫)। এটি মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরী হয়। স্থানীয় ইতিহাসবিদ ফসিহুদ-দিন লিখেছেন যে মন্দিরটি এর আগে মোগল সরকারের আধিকারিক দিওয়ান লছমন দাস তৈরি করেছিলেন।

৫) মহারাষ্ট্রের পুনা জেলার ঘোড়া জামি মসজিদ : ও আল্লাহ! ও মুহাম্মদ! হে আলী! মীর মুহাম্মদ জামান নিজের হাতে তিরিশটি মূর্তি মন্দির ভেঙে দিয়েছিলেন এবং এই ধ্বংসস্তূপে মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন (প্রকাশ ১৯৩৩-৩৪, পৃষ্ঠা ২৪)। শিলালিপিটিতে ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দ লেখা রয়েছে। সেই সময় পুণা অঞ্চলটি আহমদনগরের নিজাম শাহী সুলতানদের শাসনাধীন ছিল।

৬) অন্ধ্র প্রদেশের কুর্নুল জেলার কুম্বমে গছিনালা মসজিদ: তিনি আল্লাহ, তিনি মহিমান্বিত হন। মুহাম্মদ শাহের ‘অগস্ট শাসনকালে’ কুহুমায় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মন্দির ছিল। মুহাম্মাদ সালেহ, যিনি মন্দির ভাঙার বিষয়গুলিতে সুনির্দিষ্টভাবে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তিনি মন্দিরটিকে ভেঙে ফেলেছিলেন এবং মূর্তিগুলিকে ও অত্যন্ত নৃশংসতার সঙ্গে নষ্ট করেন। তার স্থানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, যা সবার ভবনের উপরে ছিল (প্রকাশ: ১৯৫৯-৬০, পৃষ্ঠা ৬৪-৬৬)। নির্মাণের তারিখটি মোগল সম্রাট মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে ১৭২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভেঙে দেওয়া হিন্দু মন্দিরগুলির জায়গাগুলি মসজিদ এবং ঈদগা তৈরি করতে ব্যবহৃত হত; অন্যান্য মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভগুলিতেও মন্দিরের উপকরণগুলি প্রায়শই ব্যবহৃত হত। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বেশ কয়েকটি দুর্গ, প্রাসাদ, মকবরা, সূফী মিলনস্থান বা খানকাহ, মাদ্রাসা ইত্যাদিতে এ জাতীয় উপকরণ, স্থাপত্যের পাশাপাশি ভাস্কর্যও আবিষ্কার করেছেন। কাশ্মীরের শ্রীনগরে, ঝিলাম নদীর দুপাশে পাথরের বাঁধগুলিতে মন্দিরের উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছিল। গোপী তালাবের দেওয়ালে দুটি শিলালিপি, সুরাটের একটি “ধাপযুক্ত কূপ”, আমাদের জানায় যে কূপটি ফররুখ সিয়ারের রাজত্বকালে ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের মুঘল সম্রাট হায়দার কুলি নির্মাণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে এর ইটগুলি একটি প্রতিমা মন্দির থেকে নেওয়া হয়েছিল। অন্যরা বলেন যে হায়দার কুলি খান, যাঁর আমলে অত্যাচারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন বেশ কয়েকটি মন্দির ও প্রতিমার উপকরণ দিয়ে তিনি এই শক্তিশালী ভবনটি নির্মাণ করেন (প্রকাশ: ১৯৩৩-৩৪, পৃষ্ঠা ৩৭-৪৪)।

সাহিত্যগত প্রমাণ

হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে পাওয়া প্রমাণ থেকেও ইসলামিক সাহিত্য থেকে পাওয়া মূর্তিপূজার বিরোধিতার প্রমাণ অনেক বেশি বিস্তৃত। এটি সপ্তম শতাব্দীর পঞ্চম দশক থেকে আঠারো দশকের সমাপ্তি বছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় জুড়ে বিস্তৃত। এটি উত্তরের ট্রান্স-অক্সিয়ানা থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত একটি সুবিশাল জায়গাকে যুক্ত করে। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক এবং মুসলিম সমর্থনকারীরা আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে মধ্যযুগীয় মুসলিম লেখকরা তাদের ধর্মপ্রাণ পৃষ্ঠপোষকদের খুশী করার জন্য কাব্য রচনাতেও বিধর্মীয় ধর্মস্থান ধ্বংসের কথা অতিরঞ্জিত করে লিখেছিলেন। আধুনিক সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানগুলি অবশ্য সাহিত্যিক বর্ণনার বাস্তবিক প্রমাণ দেয়, যা থেকে সাহিত্যগুলিকে শুধুমাত্র কল্পনা বলে অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রসঙ্গতঃ হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি সমস্ত ধর্মের, বৌদ্ধ, জৈন, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদির মন্দির, মঠের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, যেগুলি সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অংশ।

প্রায় সকল মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিক হিন্দু মূর্তি অবমাননা এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার জন্য তাঁদের বীরদের কৃতিত্ব দেন। যে প্রশ্নটি উঠে আসছে তা হলো এইরকম : মূর্তি ভঙ্গের কাজটি হিন্দুদের বাঁধার সম্মুখীন হয়ে তড়িঘড়ি করে করা না কি বিজয় লাভ করার পরে ধীরে সুস্থে করা।

১) মূর্তিগুলি বিকৃত করা হয়েছিল, ভেঙে ফেলা হয়েছিল বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অথবা মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি হলে তা গলিয়ে ফেলা হয়েছিল।

২) দেওয়াল এবং স্তম্ভের ভাস্কর্যগুলি ছিন্নভিন্ন ও নষ্ট করা হয়েছিল।

৩)(ক) ক্ষমতাসীন মুসলিম সুলতানদের মহানগরীতে এবং (খ) ইসলামের পবিত্র শহরগুলি, বিশেষত মক্কা, মদিনা ও বাগদাদে মূল মসজিদের সামনে পাথর ও ধাতুর তৈরী মূর্তিগুলিকে টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

৪) এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে মূর্তির অংশগুলিকে শৌচাগার তৈরির সময় ব্যবহার করা হয়েছে অথবা মাংসের দোকানে ওজন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

৫) মন্দিরের আশেপাশের ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল ও তাদের হত্যা করা হয়েছিল।

৬) পূজাতে ব্যবহৃত পবিত্র পাত্র এবং ধর্মগ্রন্থকে অশুচি করা হয়েছিল ও সেগুলি ছিঁড়ে নষ্ট করে পোড়ানো হয়েছিল।

৭) মন্দিরগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছিল, উচ্ছেদ করা হয়েছিল, ভেঙে ফেলা হয়েছিল বা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল বা কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করে সেগুলি মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছিল বা পুরো মসজিদগুলি বেশিরভাগ মন্দিরের উপকরণ সহ একই জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল।

৮) মন্দিরের জায়গাগুলিতে গোহত্যা করা হয়েছিল যাতে হিন্দুরা আবার সেই স্থান ব্যবহার না করতে পারে।
সাহিত্যের উৎসগুলি প্রমাণ দেয়, কীভাবে শিলালিপিগুলি, এই ধর্মীয় কাজগুলি প্রত্যক্ষ বা বিবৃত করার সময় মুসলমানরা উল্লাস অনুভব করত। আমির খুসরু থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি এই বিষয়টির চিত্র তুলে ধরবে। উদ্ধৃত দৃষ্টান্তগুলি জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি, আলাউদ-দীন খলজি এবং পরবর্তীকালের সুলতানের সেনাপতিদের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। খুসরু দিল্লিতে সুলতানদের সভা-কবি হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং প্রত্যেকের প্রশংসায় একটি মশনবী লিখেছিলেন। তিনি শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার প্রিয় শিষ্য ছিলেন এবং নিজেই একরকম সূফী হিসাবে সম্মানিত হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে, তিনি একটি সংহত হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির জনক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পথিকৃৎ হিসেবে প্ৰশংসিত হন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, যাকে মার্ক্সবাদীরা সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক হিসাবে অপবাদ দিয়েছিল, খুসরুকে উদারপন্থী মুসলিম হিসাবে পরিচয় দেন।

খুসরুর উদ্ধৃতিগুলি নিম্নলিখিত:

১। ঝাইন: পরের দিন সকালে তিনি (জালালউদ্দিন) আবার মন্দিরে গিয়ে তাদের ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সৈন্যরা যখন লুণ্ঠনের প্রতিটি সুযোগ চাইছিল, শাহ মন্দিরগুলি পুড়িয়ে ফেলতে এবং প্রতিমা ধ্বংস করতে ব্যস্ত ছিলেন। ব্রহ্মার দুটি ব্রোঞ্জের মূর্তি ছিল যার প্রত্যেকটির ওজন এক হাজার মণেরও বেশি ছিল। এগুলি টুকরো টুকরো করা হয়েছিল এবং টুকরোগুলি আধিকারিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল, তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে দিল্লিতে ফিরে মসজিদের (মিফতাহ-উল-ফুতুহ) প্রবেশদ্বারে তা ছড়িয়ে দেবার জন্য।

২। দেবগিরি: তিনি (আলাউদ্দিন) মূর্তিপূজারীদের মন্দিরগুলি ধ্বংস করেছিলেন এবং সেই জায়গায় মসজিদের জন্য মিনার এবং খিলান স্থাপন করেছিলেন।

৩। সোমনাথ: তারা মন্দিরটিকে কাবার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। নতুন অবস্থায় : মন্দিরটিতে প্রথমে পূজা হবে এবং তারপরে সেখানে স্নানের ব্যবস্থা থাকবে (অর্থাৎ মন্দিরটি যেন উল্টে সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিল)। তিনি (উলুগ খান) সমস্ত মূর্তি এবং মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তবে সমস্ত মূর্তির মধ্যে একটি বৃহত্তম মূর্তি প্রেরণ করেছিলেন তাঁর ঈশ্বরস্বরূপ রাজার দরবারে। সেই কারণে মূর্তিপূজার দুর্গের এই স্থানে, নামাজের আহ্বান এত জোরে ঘোষণা করা হত, যেন তা তারা মিশর এবং মাদেইনে (ইরাক) (তারিক-ই-আলাই) থেকেও তা শুনতে পান।

৪। দিল্লি: তিনি (আলাউদ্দিন) এক নতুন মিনার তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন যার পরিধি পুরানো মিনারের (কুতুব মিনার) দ্বিগুণ। এর জন্য প্রয়োজনীয় পাথরগুলি পাহাড় থেকে খনন করা হয়েছিল এবং কাফেরদের মন্দিরগুলি ভেঙে তা থেকে সরবরাহ হয়েছিল।

৫। রণথম্ভোর: দুর্গন্ধযুক্ত রাইকে বধ করে এই দুর্ভেদ্য দুর্গটি দখল করা হয়েছিল। ঝাইনকেও অধিকার করা হয়েছিল, সেখানে একটি লোহার দুর্গ, ও মূর্তিপূজার একটি প্রাচীন আবাসে, ধর্মবিশ্বাসী লোকদের একটি নতুন নগর গড়ে ওঠে। বাহির (ভৈরব) দেওর মন্দির এবং অন্যান্য দেবতার মন্দিরগুলি সমস্ত ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

৬। ব্রহ্মস্তপুরী (চিদাম্বরম): তিনি (মালিক কাফুর) শুনেছিলেন যে ব্রহ্মস্তপুরীতে একটি সোনার প্রতিমা রয়েছে। এরপরে তিনি মন্দিরটিকে মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন। এটি ছিল হিন্দুদের পবিত্র স্থান যা মালিক কাফুর তার ভিত্তি থেকে সর্বাধিক যত্ন সহকারে খনন করেছিলেন এবং সেখানে ব্রাহ্মণ ও মূর্তিপূজারীদের হত্যা করা হয়েছিল ও রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল।

লিঙ্গ মহাদেব নামক পাথরের মূর্তিগুলি এই স্থানে দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠিত ছিল; কাফের মহিলারা (যৌন) সন্তুষ্টির জন্য সেটিতে যোনিগুলিকে ঘষত, যতদিন অবধি এগুলি ইসলামের ঘোড়ার লাথি থেকে বেঁচে ছিল। তারপর মুসলমানরা লিঙ্গগুলি ধ্বংস করে এবং দেব নারায়ণ মূর্তি নীচে ফেলে দেয়। অন্যান্য দেবতারা যাঁরা সেখানে তাঁদের আসন স্থির করেছিলেন, তাঁরা পা উঁচু করে এতো উঁচুতে লাফিয়েছিলেন যে এক লাফ দিয়ে তাঁরা লঙ্কার দুর্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন। লিঙ্গগুলি এতটাই ভয় পেয়েছিলো যে তাদের পা থাকলে তারাও পালাত।

৭। মাদুরা: তারা শহরটি খালি পেয়েছিল, কারণ রাজা রানীদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তবে জাগনার মন্দিরে (জগন্নাথ) দু’শ বা তিনশো হাতি ছিল। হাতিদের বন্দী করা হয়েছিল এবং মন্দিরটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

৮। ফাতান (পট্টান): এই অংশগুলিতে আরও একটি রাজা ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ। তাঁর নাম ছিল পণ্ড্য গুরু। তাঁর রাজধানী ছিল ফাতান, সেখানে একটি মন্দির ছিল সেখানে মণিমুক্তো খচিত মূর্তি ছিল। সুলতানের সেনাবাহিনী ফাতান এলে রাই পালিয়ে যান। তারপরে সুলতানের সৈন্যরা লোহার কুঠার দিয়ে প্রতিমাটিকে আঘাত করে এবং এর মাথাটি ভেঙে ফেলে। যদিও এটি অভিশপ্ত কাফেরদের জায়গা ছিল, তবে এটির থেকে প্রাপ্ত সম্পদ সুলতানের কোষাগারকে পূর্ণ করেছিল (আশিকা)।

৯। মাবার (দক্ষিণ ভারতের অংশ): ডান দিকে, বাম দিকে সেনাবাহিনী সমুদ্র থেকে সমুদ্র পর্যন্ত এবং হিন্দুদের দেবতাদের বেশ কয়েকটি রাজধানী জয় করেছে, যেখানে জিনের সময় থেকেই শয়তানবাদ বিরাজ করছিল। সেইগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছে। দেবগিরির প্রথম পবিত্র অভিযানের সূচনা করে সুলতানরা মূর্তি-মন্দির ধ্বংস করে কাফেরদের এই সমস্ত অশুচিতা শুদ্ধ করে দিয়েছে, যাতে শরীয়তের আলোয় (ইসলামের আলো) এই সমস্ত অপরিষ্কার দেশগুলিকে আলোকিত করে এবং তার জন্য নামাজের আওয়াজকারীদের উচ্চতর স্থান দেওয়া হয় এবং মসজিদে নামাজ পড়া হয়। আল্লাহ প্রশংসিত হোক! (তারিখ-ই-আলাই)।

ইসলামী হানাদাররা কীভাবে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির ভিত্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল তার গল্প দীর্ঘ এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক। অতীতকে ভুলে যাওয়াটা সবার জন্যই ভালো সন্দেহ নেই। তবে ইসলামের ধর্মতত্ত্বে মূর্তিধ্বংসের নীতিটি এখনও অপরিবর্তিত, প্রশ্নাতীত এবং তার অনুসরণকারীদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক কাজ।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৯ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯

(ক্রমশঃ)