ব্লাসফেমি – বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের এক নতুন অস্ত্র, সাইবার জিহাদে দিশেহারা হিন্দুরা!

0
5224

সায়ন দে

 

ইসলামিক বাংলাদেশে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদেরকে টার্গেট করে তাদের ক্যারিয়ার চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ব্লাসফেমি মডিউলকে নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ইসলামিক বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিমরা ব্লাসফেমি অ্যাক্টকে সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে ইমপ্লিমেন্টেশনের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে, বাংলাদেশ পুলিশ প্রায়ই হিন্দু ছাত্রছাত্রীদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ ও এর অ্যামেন্ডমেন্ট ভার্সন ২০২০ অনুযায়ী গ্রেফতার করছে। ব্লাসফেমির জন্য সরাসরি কোন সেকশন নেই। এরপরও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ছাত্রছাত্রীদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ তুলে নির্যাতন করা হচ্ছে।

এই প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই কমন প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে। প্রথমে হ্যাকাররা হিন্দু নাম সংবলিত ফেসবুক আইডিগুলো টার্গেট করে, আইডি হ্যাক করে নেয় এবং হ্যাক হওয়া আইডিগুলো থেকে ইসলাম বিরোধী ও অবমাননাকর কমেন্ট ও পোস্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এরপরে সেই কমেন্ট ও পোস্টের স্ক্রীনশট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হয়। ফলে উগ্রবাদী মুসলিম জনতার সাথে সাধারণ ধর্মভীরু জনতাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপর ইউনিভার্সিটি অথরিটি সেই হিন্দু ছাত্রছাত্রীদেরকে বহিষ্কার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (DSA) অনুযায়ী মামলা করা হয়। সাইবার জিহাদের অংশ হিসেবে ইসলামিস্টরা এই ব্লাসফেমিকে হিন্দু নির্যাতনের নতুন অস্ত্র রূপে ব্যবহার করছে।

এমনই কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনা নিম্নে তুলে ধরা হলো :

ঘটনা-১, মিথুন মণ্ডল

১২ অক্টোবর ২০২০ তারিখে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, সোশ্যাল মিডিয়ায় নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে সাতক্ষীরা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ যশোর ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (JUST) এর ছাত্র মিথুন মন্ডলকে গ্রেফতার করে। বহিষ্কৃত ছাত্র মিথুন মন্ডল JUST এর ফাইন্যান্স ও ব্যাঙ্কিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাকে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলায় তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর ইয়াসিন আলম জানায়, “মিথুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তবেই তাকে গ্রেফতার দেখানো হবে। বিক্ষুব্ধ স্থানীয়দের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই আমরা তাকে কাস্টোডিতে নিয়েছি।”

JUST অথরিটি এক জরুরী সভায় সোমবার মিথুন মন্ডলকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানান ইউনিভার্সিটির পাবলিক রিলেশন অফিসার আবদুর রশিদ। মিটিংটি ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনে নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। মিথুনকে কেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা উচিত নয় তার কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও ইউনিভার্সিটি অথরিটি তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘটনার তদন্তে একটি চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই রিপোর্টের পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেসবুকে নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে এর সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে কারণ অতীতেও মিথ্যা অভিযোগ তুলে হিন্দু ছাত্রদেরকে ফাঁদে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।

 

ঘটনা-২, তিথি সরকার

২৭ অক্টোবর ২০২০ তারিখে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে এক ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃত ছাত্রী তিথি সরকার জুওলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। রেজিস্টার মোঃ অহিদুজ্জামান এই বহিষ্কারাদেশ জারি করেন। তিথি সরকারকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা উচিত নয় তার কারণ দর্শানোর নোটিশ ও জারি করা হয়েছে। শনিবার ” সাধারণ ছাত্রছাত্রী” ব্যানারে এক বিক্ষোভ মিছিলে তিথি সরকারকে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে বহিষ্কারের দাবী জানানো হয়।

তিথি সরকারের এই বহিষ্কারাদেশ এমন সময়ে এসেছে যখন ফ্রান্সে নবী মুহাম্মদের কার্টুন দেখানোর জন্য এক ইতিহাস শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করা হয় এবং ফ্রান্স সরকার এই র‍্যাডিক্যাল ইসলামিজমের বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। উগ্র মুসলমানদের কর্তৃক মুহুর্মুহু প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ায় বর্তমানে তিথি সরকার ও তার পরিবার অজানা স্থানে আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের সাথে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যোগাযোগের চেষ্টা করলেও যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি।

 

ঘটনা-৩, প্রতীক মজুমদার ও দীপ্ত পাল

২৮ অক্টোবর ২০২০ তারিখে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে ২ রা নভেম্বরের মধ্যে, কেন তাদেরকে স্থায়ী বহিষ্কার করা উচিত নয় তার কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এই দুই ছাত্রকে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃত দুজন হলেন এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র প্রতীক মজুমদার ও ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র দীপ্ত পাল। দুজনেরই হোস্টেলের সিট বাতিল করা হয়েছে।

বাস্তবে দেখা যায় দীপ্ত পাল মূলত ফেসবুকে একটি কৌতুকপূর্ণ পোস্ট করেছিল। তাতে সে লিখেছিল, ” আমি আজকে ফ্রান্সের ভিসা পেলাম। এখন আমি কি ফ্রান্সকে বয়কট করবো নাকি করবো নাহ..?? #কৌতূহলীমনজানতে_চায়। ” শুধুমাত্র এই পোস্টের জন্যে দীপ্ত পালের বিরুদ্ধে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কটূক্তি অভিযোগ তুলে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রতীক মজুমদারের সাথে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি।

 

ঘটনা- ৪, দীপ্তি রাণী পাল

২৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখে যায় যায় দিনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৮ শে অক্টোবর বুধবারে পার্বতীপুর রেলওয়ে পুলিশ, ছদ্মবেশে পালানোর চেষ্টার সময় দীপ্তি রাণী পালকে গ্রেফতার করেছে। তার বিরুদ্ধে কোরাণ অবমাননার অভিযোগ রয়েছে। এর জেরে পার্বতীপুরে মুসলিম জনতা ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল করে। দীপ্তি রাণি ” কোরাণের অনুযায়ী অমুসলিমদের ওপর আক্রমণের নির্দেশনা ” এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল। প্রাণনাশের আশঙ্কায় দীপ্তি ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। গোপন সূত্রের খবর পেয়ে পুলিশ তাকে ৭৬৬ নীলসাগর ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ২৫, ২৮ ও ৭১ ধারা অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে।

 

ঘটনা- ৫, মিথুন দে

অক্টোবর ৩০ ২০২০, সমকালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেনী পুলিশ নবী মুহাম্মদ ও তার স্ত্রী আয়েশার বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে মিথুন দে নামের এক যুবককে গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও মিথুনের বিরুদ্ধে বোরকা নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের অভিযোগও রয়েছে। পুলিশ মিথুনকে ফেনী টাউনের নাজির রোডের বাড়ি থেকে ২৯ শে অক্টোবর গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায় যে মিথুন তার ফেসবুক আইডি “পিকলু নীল” থেকে নবী মুহাম্মদ ও তার স্ত্রী আয়েশার বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছে। এর জেরে ফেনী টাউনে উগ্র মুসলিম জনতা তার মৃত্যুদণ্ডের দাবীতে মিছিল করেছে।

গ্রেফতারের মিথুনকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ধ্রুবজ্যোতি পালের আদালতে তাকে সোপর্দ করে পুলিশ এবং ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায়। উল্লেখ্য, মিথুন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট রিসার্চার হিসেবে কর্মরত।

যখন উল্টোটা হয়

ইসলামিক বাংলাদেশে ব্লাসফেমির অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন নতুন কিছু নয়। কিন্তু ব্লাসফেমির অভিযোগে এক মাসের মধ্যে ছয়জন হিন্দু ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে তাও আবার যখন ফ্রান্স ইসলামিক আগ্রাসনের ফলে ভুগছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রতিনিয়ত প্রাণসংশয়ে ভুগছে ও সাইবার বুলিইং এর শিকার হচ্ছে। ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে মিথ্যা ব্লাসফেমির অভিযোগ তুলে অসংখ্য হিন্দু নির্যাতন করা হয়েছে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি- মন্দির- ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে চলেছে বাংলাদেশের কট্টরপন্থী মুসলিমরা। বিশিষ্ট, সমৃদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত হিন্দুরাও প্রতিনিয়ত এই নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে ভিক্টিম হয়ে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটার লিটন দাস ফেসবুকে দুর্গা পূজা উপলক্ষে মা দুর্গার একটি ছবি পোস্ট করেন যাতে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন অকথ্য ও নোংরা ভাষায় আক্রমণ করে। পরবর্তীতে বোর্ডের চাপে লিটন দাস মা দুর্গার ছবিটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পাবলিক হেলথ অ্যাকটিভিস্ট ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হিন্দু এবং ভারতকে নিয়ে প্রচন্ডরকম অপমান ও অবমাননাকার মন্তব্যে করে। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে জাফরুল্লাহ বলেছিলেন, “রামায়ণ ও মহাভারত মিথ্যা ও নোংরামিতে ভরা মনগড়া গালগল্প, যা মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত। মসজিদ ভেঙ্গে দিয়ে রাম মন্দির তৈরি করা হচ্ছে। ” কিন্তু এরকম ঘৃণ্য বক্তব্য রাখার পরেও জাফরুল্লাহ বিরুদ্ধে কোন আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু একইরকভাবে কোন হিন্দু ইসলামের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করলেই তাকে সরাসরি নির্যাতনের শিকার হতে হবে। এই জিহাদী এক্সারসাইজে, কাফেরদের সাথে ব্যবহারের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দুদেরকে অভিযুক্ত, অত্যাচার, বুলিইং, হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়। ব্লাসফেমি নিয়ে যদি আইন ইমপ্লিমেন্ট করা হয় তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় তা হবে বাংলাদেশের হিন্দুদের কফিনের শেষ পেরেক! বাংলাদেশের হিন্দু এক্সিসটেন্স ফোরাম এই ছয় হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও তাদেরকে সসম্মানে তাদের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী করেছে।