বাংলার স্বদেশী আন্দোলন- শিল্পে বাঙালীদের অবদান

0
5535
বেঙ্গল কেমিক্যাল

আজকের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে , শিল্প ও শিল্পোদ্যোগে বাংলা ও বাঙালী হিন্দুদের দেখা মেলা ভার। সাধারণ একটি ধারণা হল যে হিন্দু বাঙালীরা বিশেষত শিক্ষিতরা চাকুরী সন্ধানী হয়, তাঁরা বৈতনিক চাকুরীর নিশ্চয়তা ও স্বাচ্ছন্দ্যকেই বেছে নিতে পছন্দ করেন। সরকারি চাকরি হতে হবে তেমন কোনো বিষয় নয় কিন্তু বেসরকারি বৈতনিক চাকরি, যেকোনো ছোটখাটো বা মাঝারি মাপের ব্যবসার চেয়ে তাঁদের কাছে অধিক প্রিয়। সামান্য কেরানি হওয়া যেকোনো দোকান চালানোর থেকে অনেক বেশি নিশ্চয়তার।

যদিও ১৯৬০-এর এর প্রজন্মের পর থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্যতায় পরিণত হয় [তার কারণ আজকে আলোচ্য বিষয় নয়), ২০ শতকের প্রথমার্ধ্বে স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকে বাংলায় প্রচুর আধুনিক উদ্যোগ ও শিল্প স্থাপিত হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে এই সময়ের অনেক আগে থেকেই বেশ কিছু শিল্প স্থাপিত হয়েছে। এমনকি আধুনিক শিল্পের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই শুধুমাত্র বাংলা নয় বাংলার বাইরে বাঙালিরা বাণিজ্যিক ইতিহাস রচনা করেছে।

একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

 

অধিকাংশ ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে প্রাচীনকাল থেকে ১৮ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ছিল ( যদিও মুঘল যুগে এই সমৃদ্ধির কারণ কায়িক পরিশ্রম ছিল না)। এই সমৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল বাংলার অত্যন্ত ও উৎপাদনক্ষম- সম্পন্ন সমতলভূমি, বৃষ্টিপাত (যার ফলে ধান বাংলার প্রধান শস্যে পরিণত হয়েছে) এবং বৃহৎ বৃহৎ নদী নালা যা হিমালয় থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরে শেষ হয়েছে, যা বাংলাকে ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে (প্রাথমিক পর্যায়ের অবশ্যই) এবং বহুজাতিক ব্যবসায় পরিণত করেছিল যা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ, শ্রীলঙ্কা থেকে বর্মা ও তিব্বতের সঙ্গে সপ্তগ্রাম বন্দর যা বর্তমানে হুগলিতে, চন্দ্রকেতুগড় আজকের উত্তর ২৪ পরগনায় এবং তাম্রলিপ্ত যা বর্তমানে মেদিনীপুরের মধ্যে-  প্রসার লাভ করেছিল। এমনকি মধ্যযুগের বাঙালি হিন্দু মহাকাব্যে চাঁদ সদাগর,  শ্রীমন্ত সাগর প্রমুখের মত ব্যবসায়ীদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এমনকি ১৬৮০ সালে যখন ইংরেজরা কলকাতায় প্রথম পদার্পণ করে, তখন ইতিমধ্যেই কলকাতা, শেঠ ও বসাক পরিবারগুলির সমৃদ্ধ কাপড় ব্যবসার উপর আধিপত্য বিস্তার করে রাখার ফলে সমৃদ্ধশালী অর্থনৈতিক  কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বসাকদের কারখানায় হাজার হাজার তাঁতি ও কর্মীরা কাপড় বুনত যা অন্যত্র রপ্তানি করা হত।

ভারতে ব্রিটিশ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হওয়ার পর বহু বাঙালি ব্যবসায়ী ও তাঁদের পরিবার প্রচুর সম্পত্তি সঞ্চিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘বেনিয়া’ হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে এঁদের আধিকারিকেরা যাঁরা এখানে নিজস্ব ব্যবসা চালাতেন এবং ব্রিটিশ কারখানাগুলি কলকাতায় ব্যবসা করার জন্য দোকান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

যদিও এই বেনিয়ারা  ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ব্যবসায়িক স্বার্থের অপরিহার্য সহযোগী ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ব্যবসা ও বাণিজ্য করার জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণির সাহায্যের দরকার ছিল। আর এখানেই বেনিয়ারা তাঁদের ভারতে বাণিজ্য করার ব্যাপক বুদ্ধি নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বাঙালিরা লবণের ব্যবসায় আধিপত্য  বিস্তার করেছিল।

বেনিয়ারা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় বাণিজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল; ব্রিটিশদের ভারতে শোষণমূলক ব্যবসা-বাণিজ্যে তাঁদের দরকার ছিল এবং বেনিয়ারাও ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে টিকে ছিলেন। ব্রিটিশ সংস্থা এবং তাঁদের ব্যবসায়িক সংযোগের উপর নির্ভর করে এই সম্প্রদায় উন্নয়নে নতুন ব্যবসায়ে (কয়লা খনি, জাহাজ, ব্যাঙ্ক, তুঁতে, রেশম) বিনিয়োগ করেছিলেন। ব্রিটিশ নীতির এই ধরনের ব্যবসা-মধ্যস্থতাকারীদের জন্য লাভদায়ক হলেও এটি মূলত ভারতের কুটির ও হস্তশিল্পের বিনাশ করেছিল ও শিল্পবিপ্লবের নামে ভারতীয় বাজার রপ্তানিকৃত দ্রব্যে ভরিয়ে দেয়।

এই ঘটনা বাংলায় নতুন ছিল না। সারাদেশের বিশেষত পশ্চিম ভারতের ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের সাথে সক্রিয় অংশীদারিত্বে কাজ করত ও ব্রিটিশদের উপনিবেশগুলি সহ সারা বিশ্বের বহুজাতিক ব্যবসার একটি অংশ হয়ে উঠেছিল (আফিম ব্যবসাও ছিল)। পশ্চিম ভারতের বেশকিছু ব্যবসায়ী পরিবার, যাঁরা পূর্বে ব্রিটিশের আফিম ব্যবসার অংশীদার ও দালাল ছিলেন তাঁরা বর্তমানে ভারতের অভিজাত সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে ব্রিটেনের সাথে ভারতের ব্যবসায়িক সংযোগ ও স্বার্থের দিকটা দেখাশোনা করে।

ঔপনিবেশিক বাংলার কাশিমবাজারের নন্দীরা (কৃষ্ণ কান্ত নন্দী ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের বেনিয়া), রানাঘাটের পাল চৌধুরী, আঠারো শতকের শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব এবং উনিশ শতকের উত্তর কলকাতার ঠাকুর পরিবার,  ঘোষাল, মিত্র , মল্লিক এইধরনের ব্যবসায় জড়িত কয়েকটি বিখ্যাত পরিবার। রামদুলাল দে( রামদুলাল দে আমেরিকার সংস্থাগুলির বেনিয়া ছিলেন যারা ব্রিটিশ কলকাতায় ব্যবসা করত), মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, রামগোপাল ঘোষ এনারা ছিলেন উনিশ শতকের প্রথমার্ধ্বে বাংলার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন। অধিকাংশ এই পরিবারগুলি বিভিন্ন জাত ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে এসেছিলেন- কেউ কেউ আবার শিল্পী ও কারিগর সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন( যাদের ‘নবশখ’ বলা হত), কেউ কেউ ছিলেন সুবর্ণ বণিক এবং গন্ধবণিক (যাঁরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট ধনশালী এবং উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন) এবং অবশ্যই ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থ ছিলেন।

১৯ শতকের মাঝামাঝি (কিছু ক্ষেত্রে ১৮ শতকের শেষ দিকে) বাংলার  অধিকাংশ ব্যবসায়িক পরিবারগুলি ব্রিটিশদের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিবর্তে জমিদারি ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে থাকে। প্রতিটি বাঙালি ব্যবসায়িক ধনী পরিবারের গল্প একই- পরিবারগুলির সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি ব্রিটিশদের সাথে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পত্তি তৈরী করে নেয় কিন্তু ১৮৪০ সালে এঁদের পরের প্রজন্মরা এই সম্পত্তি জমি কেনায় বিনিয়োগ করতে থাকে (এবং এই জমিগুলি থেকেই তাঁদের আয় আসত) এবং তাঁরা ব্যবসা ও বাণিজ্যে উৎসাহ   হারিয়ে ফেলেন, যদিও ক্ষণিক সময়ের জন্য। এই সময় রাজস্থান ও হরিয়ানার মারাওয়াড়ী বণিকরা ১৭০০ সালে তাঁদের ব্যবসা সারা ভারতে ছড়িয়ে ফেলে (বাংলাসহ) এবং এই শূন্যস্থান পূরণ করে। তাঁরা কলকাতায় ব্রিটিশদের শিল্প সংস্থাগুলির অংশীদার ও দালালের পরিণত হন। যে মুষ্টিমেয় বাঙালি ব্যবসায়ীরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরাও ১৯ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে ফেলে।

১৯০০ শতকের পরবর্তী সময়স্বদেশী আন্দোলন

স্বদেশী আন্দোলনের শুরু হয় ১৯০৫ সালে  ব্রিটিশ সরকারের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে । স্বদেশী আন্দোলন শুধুমাত্র ব্রিটিশ পণ্যের যথাসম্ভব বর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না,  কিন্তু স্বদেশী শিল্পের  উৎপাদন করাও ছিল যা মূলত ব্রিটিশ অনুদান ছাড়া  দ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রয়ে মনোনিবেশ করেছিল। ব্রিটিশদের সহযোগিতা যথাসাধ্য কম নেওয়া হত, মূলত এটি যন্ত্রপাতি কেনা অবধিই সীমাবদ্ধ ছিল।

যদিও ১৯০৫  সালের স্বদেশী  আন্দোলনের বহু আগে থেকেই বেশ কিছু শিল্প স্থাপন হয়েছিল যেমন ১৮৮৩ সালে পি.এম.বাগচি ও কোং , ১৮৭৮ সি. কে. সেন ও কোং, বেঙ্গল কেমিক্যালস (১৮৯২), ১৯০১ সালে শক্তি ঔষধালয়; ১৯০০ সাল থেকে এটি ব্যাপকভাবে বিস্তার করে এবং সামাজিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন পরিণত হয়।

বাঙালি হিন্দুদের দ্বারা স্থাপিত কয়েকটি উদ্যোগ  যা শুধুমাত্র  ব্রিটিশদের সাথে পাল্লা দিয়ে  টিকে ছিল তা নয় এমনকি ভীষণ উন্নতি  এবং প্রসারও ঘটেছিল, হল (অন্ততপক্ষে ১৯৪০ এর বিধ্বংসী শতক পর্যন্ত )- বেঙ্গল কেমিক্যালস, ক্যালকাটা কেমিকেলস, আলেম্বিক ক্যামিকেলস, পূর্ব ভারতীয় ফার্মাকিউটিক্যালস, মোহিনী মোহন সুতির মিল, অন্নপূর্ণা সুতির মিল, বঙ্গলক্ষী মিল, ঢাকেশ্বরী টেক্সটাইল মিল, ক্যালকাটা ফ্যানওয়ার্কস, বৈজ্ঞানিক ও শৈল্পিক কাচের কাজ, ভারত ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারিং, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ, ভারত জুট মিল ইন্ডিয়া, মেশিনারি কোম্পানি লিমিটেড, (বাংলার সংগঠক পাল ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাটলাস ওয়েটব্রিজ কোম্পানি দ্বারা স্থাপিত ও মাপক যন্ত্র নির্মাতা) বেঙ্গল ইমিউনিটি, কৃষ্ণা সিলিকেট এন্ড গ্লাস ওয়ার্ক, কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন, বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, হুগলি ব্যাংক, বাংলার মাটির শিল্প, হাউস অফ লেবারারস এবং এর স্টিল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড, হিন্দুস্থান কো-অপারেটিভ ইনসিওরেন্স, জিডি ফার্মাকিউটিক্যালস, সুলেখা ইনক, শ্রীনাথ মিল, বাংলার প্রদীপ, নদীয়া ট্যানারি।

এই সুপরিচিত উদ্যোগ গুলি ছাড়াও , অনেক ছোট ছোট উদ্যোগ এবং শিল্প ছিল, যারা অনেক ভাল মানের দ্রব্য-সামগ্রী তৈরি করত। বাঙালি উদ্যোক্তারা  সবচেয়ে বেশি  ঢালাই ও যন্ত্রপাতি শিল্পে উন্নতি করেছিল। ২৪ পরগণা, হাওড়া, কলকাতা এবং কুমিল্লা  ছোটখাটো ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল যেগুলি মূলত  ছুরি, কাঁচি, তালা-চাবি, লোহার বাক্স, ট্রাঙ্ক, জলের ট্যাঙ্ক, বালতি,  বাসনপত্র, জলের পাইপ, শল্য চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, দরজা, কৃষির যন্ত্রপাতি, ছোটখাটো শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যা চিনি ভাঙতে ব্যবহার হত, মৃৎ শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ড্রিলিং মেশিন, ওজন মাপক যন্ত্র, বেকারি ও খাদ্য শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, সাবান প্রভৃতি উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলেন।

এই ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলি ছাড়াও, বাংলার পশ্চাৎভূমির বহু শিল্পী বংশানুক্রমে কারখানা চালাতেন।

স্বাধীনতার সময়  শুধুমাত্র হাওড়ায়  হাজারের কাছাকাছি ছোট ও মাঝারি মাপের  বাঙালি অধিকৃত একক ব্যবসা গড়ে উঠেছিল ( বিশেষত মাহিষ্য বর্ণীয় যারা প্রথমে কৃষিকাজ করলেও পরবর্তীতে শিল্পোদ্যোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে চলে আসে)।

এছাড়াও বাঙালিরা  ছোট মাপের  কাগজ তৈরি, ছোট মাপের দেশলাই  তৈরির কারখানা, খাদ্য শিল্প (১৯৮০ সাল পর্যন্ত সম্ভবত সবচেয়ে বৃহৎ বেকারি দ্রব্যের উৎপাদক), সোনার গহনা, মুদ্রণ ও প্রকাশনা, জুতোর কারখানা, বাড়ির দৈনিক ব্যবহৃত জিনিস ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে বিখ্যাত ছিল। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে সি.কে. সেন ও কোম্পানি, সাধনা ঔষধালয়, ঢাকা আয়ুর্বিদ্যা ফার্মেসি, ডাবর (একটি পাঞ্জাবি পরিবার শুরু করেছিলেন) কয়েকটি বিখ্যাত নাম ছিল।

স্বদেশী মিলগুলি পাইকার ব্যবসার পথ সুগম করে দেয়; বাঙালী দোকানদারদের স্বদেশী দ্রব্যই বিক্রি করতে হত। স্বদেশী আন্দোলনের প্রজ্ঞাপনের জন্য খবরের কাগজ ও মুদ্রণ ব্যবসার প্রসার ঘটে এবং বিজ্ঞাপন উদ্যোগের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ব্রিটিশ শাসনের জন্য নয় কিন্তু ব্রিটিশ শাসন সত্ত্বেও

একটি সাধারণ ভ্রান্ত ধারণা হল বাঙালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ হয়েছে।

এটি সত্যি যে যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করা শুরু করল, অন্যান্য প্রদেশের মত বাংলাতেও অনেক অংশীদাররা প্রভূত সম্পত্তি তৈরী করে নেয়। যদিও ১৮৪০ এবং ১৮৫০ সাল নাগাদ বাঙালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ব্রিটিশদের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিবর্তে জমি কেনায় পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকে।

১৯০৫ সালের পর থেকে যখন বাঙালী অধিকৃত শিল্প  বাণিজ্যের প্রস্তার ঘটতে থাকে তখন তাদের শুধুমাত্র ব্রিটিশ ব্যবসাগুলির সাথে নয়, এমনকি ভারতের একটি বৃহৎ পুঞ্জীভূত অংশীদার যারা ব্রিটিশদের সাথে ব্যবসা করত, তাদের সঙ্গেও ভীষণ বিরোধ হয়েছিল। সেই সময় বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী সংস্থা ভারতে কাজ করছিল- ব্রিটিশ কারখানাগুলি ব্রিটিশ কারখানাগুলি ব্রিটেনে দ্রব্য উৎপাদন করত এবং  সেগুলি ভারতে রপ্তানি করত, সংস্থাগুলি ভারতে উৎপাদিত দ্রব্য বাইরে আমদানি করত, ভারতীয় দালালরা এই ব্রিটিশ আমদানিকারকদের অধীনে কাজ করত (পাইকারি বিক্রেতা, আমদানিকৃত দ্রব্যের পরিবেশক হিসেবে কাজ করত), ব্রিটিশ সংস্থাগুলি ভারতে ব্যবসা পরিচালনা করত ও দ্রব্যবস্তু তৈরী করত এবং এর দালালদেরকেও পরিচালনা করত, ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা যাঁরা বোম্বাইয়ের জনতার সঙ্গে একজোট হয়েছিলেন এবং অবশেষে স্বদেশী শিল্পগুলি যেগুলি উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়দের উপর নির্ভর করে ছিল (কখনো তাঁরা বিদেশে শিক্ষিত বা পূর্বে জাপান, জার্মানী, আমেরিকায় কর্মরত ছিলেন), বিদেশীদের পরামর্শদাতা ও ব্যবস্থাপক হিসাবে নিয়োগ না করে তাঁদের ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ করা হত এবং তাঁরা মাঝেমধ্যে আমদানির পরিবর্তে নিজেদের যন্ত্রপাতি বানিয়ে নিতে বা অন্য ভারতীয় যন্ত্রশালা থেকে আনিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করতেন।

শেষের ধরণের স্বদেশী ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির বাংলায় সবচেয়ে আধিক্য ছিল এবং সাথে  (যেগুলি মূলত বাঙালি সহ মারোয়াড়ি ও উত্তর ভারতের হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হত)। এছাড়াও মাদ্রাজ, মহীশূর (যেখানে স্বত্ব থেকে অনুদান পাওয়া যেত) এবং ধীরে পাঞ্জাব (পাঞ্জাবি হিন্দুদের দ্বারা অধিকৃত শিল্প) ও উত্তরপ্রদেশের ছোট ছোট অঞ্চলে এর আধিক্য ছিল। বোম্বেতেও স্বদেশী শিল্প গড়ে উঠেছিল কিন্তু যাদের সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ছিল, তাদের তুলনায় সংখ্যায় কম। এই অংশীদারিত্ব যতটা না ব্যবসায়িক স্বার্থে, তার চেয়েও অনেক বেশি রাজনৈতিক কারণে।

শুরু থেকেই বহু স্বদেশী মিলগুলি সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। শুরুতে তাদের ‘মুক্ত বাজার’ ও ‘মুক্ত বাণিজ্য’- এর পরিবেশে কাজ করতে হত কোনোরকম সরকারি সাহায্য ছাড়া এবং ব্রিটিশ সরকারের নীতি বিভিন্ন মাপের ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়ক হলেও (বিশেষত ব্রিটিশ সংস্থাগুলি অধিক লাভ পেত) স্বদেশী যাঁরা করতেন তাঁদের মূলত ক্ষতি হত। এই স্বদেশী সংস্থাগুলি পুঁজির প্রয়োজন সত্ত্বেও ব্রিটিশ ব্যাঙ্কগুলির থেকে কোনো সাহায্য নিত না; অতঃপর  পুঁজির ঘাটতি, বৃহৎ আকারে ব্যাপক ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে জাত, গোষ্ঠী   ও আত্মীয়তার অভাব, প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে তাদের পূর্বে সংঘাত ছিল (পূর্বে উল্লিখিত) প্রভৃতির সম্মুখীন হয়। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশ সংস্থাগুলির কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কিনত, তারা দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বে যেত না। যখন বিদেশী অংশীদারি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তারা তখন জার্মানি ও জাপানিদের (তারা যন্ত্রপাতি বিক্রি করত ও পরামর্শকারীদের পাঠাত)। ব্রিটিশ পরিচালিত রেল সংস্থাগুলির থেকে সহযোগিতা পাওয়া একটু মুশকিল ছিল। হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ ইনসিওরেন্স সোসাইটি ( যেটি আর্থিকভাবে সবল ও যথেষ্ট ভালোভাবে চলছিল) প্রায়শই ভুয়ো খবর ও বিদেশী বিমা কোম্পানীগুলির দ্বারা পরিচালিত মুদ্রণের থেকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হত।

ব্যাপক সংখ্যায় ছোট ছোট শিল্পোদ্যোগ তাদের প্রতিষ্ঠার কিছু বছরের মধ্যেই পুঁজির ঘাটতি, অভিজ্ঞতা ও বিদেশী প্রতিদ্বন্দ্বীদের গণহত্যার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। মালিকেরা কিছু বছর পর আরো কিছু পুঁজি ও আরো বেশি লোকবল নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা শিল্পোদ্যোগ সামান্য বিস্তার সত্ত্বেও পরিমিত উৎপাদন সত্ত্বেও বহু বছর ধরে টিকে ছিল। তারা প্রথম দিকে টিকেছিল মানুষের আবেগের জন্য, পারস্পরিক নির্ভরতার জন্য। পরে এই শিল্পোদ্যোগগুলি নিজেদের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে উন্নতি করেছিল এবং বিদেশী প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে মোকাবিলা করেও টিকেছিল। কিছু অল্প সংখ্যক শিল্পোদ্যোগ ছিল যারা প্রথম থেকেই খুব ভাল কাজ করছিল কারণ তাঁরা জমিদার, বিত্তবান উকিল, পেশাদারি লোক, উচ্চশিক্ষিত ও ব্যবস্থাপক বাঙালির পক্ষ থেকে অবিরাম পুঁজির জোগান পাওয়ার ফলে। প্রায় সমস্ত ফার্মাসিউটিক্যাল ও ড্রাগ প্রস্তুতকারকেরা প্রযুক্তির জন্য ব্রিটিশদের সাহায্য নেওয়ার বদলে তাঁরা নিজেরাই প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উন্নতিকল্পে (যা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ) চেষ্টা করতেন।

কিছু স্বদেশী শিল্পোদ্যোগীরা বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলিকে পুঁজি সরবরাহ করার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন ( গান্ধী থাকা সত্ত্বেও!)। ক্যালকাটা কেমিক্যালস এর খগেন্দ্র চন্দ্র দাসগুপ্ত, ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালসের হীরেন্দ্র নাথ দত্তগুপ্ত, কৃষ্ণ সিলিকেট ও গ্লাস ওয়ার্কসের বিভূতিভূষণ সরকার, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ এর সুরেন্দ্র মোহন বসু প্রমুখই কারাগারে কিছু বছরের জন্য ছিলেন।

পাশ্চাত্যের ভারতীয় পরিপূরকের থেকে একটি জায়গায় স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাঙালিদের সুবিধা ছিল, তা হল মালিকানা এবং বাঙালি কারখানার ব্যবস্থাপনা কিছু ‘জাতি’র হাতে ছিল না। বিনিয়োগকারীরা, বোর্ড সদস্য ও একটি কোম্পানির শীর্ষ ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন জাত, সামাজিক ও পেশাগত ক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল, যাতে তাদের প্রত্যেকের দক্ষতা, শিক্ষা, ক্ষমতা ও জ্ঞান প্রকাশ পায়। ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য ও কারিগর সম্প্রদায়; জমিদার কৃষকেরা ছোট ব্যবসায়ী হয়েছেন, বিভিন্ন জাতের বড় জমিদার ব্রাহ্মণ বৈদ্য ও কায়স্থ পেশাদার উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ (প্রায়শই বিদেশে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) সহযোগী এবং স্বদেশী উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন।

 

স্বদেশী উদ্যোগ গুলি যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল

 

১৯৪০ শতকের সময় প্রায় একশত ফার্মের মধ্য থেকে এক ডজন বাদে বাকি সব বাঙালি মালিকানার ফার্মগুলি, আজকে আমরা যাকে ছোট ও মাঝারি মাপের ব্যবসা (এসএমই) বলে থাকি, সেই রূপেই ছিল। এই সংস্থাগুলি প্রায়শই আলাদা আলাদা বিভাগে প্রশিক্ষিত ছিল না। অনেক উদ্যোগ সংস্থা উন্নতি সাধন করতে পারত না। অপরদিকে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত সংস্থাগুলির অনেক বেশী মাত্রায় যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। দরকার ছিল হিতৈষীকারী স্বাধীন একটি  রাজ্য সরকারের । স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে মুক্ত বাণিজ্যে এই ছোট উদ্যোগগুলির পক্ষে বড়ো হাঙরের সামনে টিকে থাকা দায় ছিল। প্রতিটি উদ্যোগ সংস্থা  রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পায়। দেখবার বিষয় হল যে কোন ধরণের শিল্পগুলি সুরক্ষা ও যত্ন পাচ্ছে যাতে উদ্যোগপতিরা বাকি সমাজের মূল্যে কখনই মুনাফা না লুটতে পারে। একই সময়, উপভোক্তাদের স্বার্থ (অপেক্ষাকৃত সস্তা আমদানিকৃত দ্রব্যের লোভ) সবসময় দেশীয় শিল্পের উন্নতির বিনিময়ে দেখা উচিত নয়।

‘স্বাধীনতা’র প্রস্তাব দেওয়ার পর ভাবা হয়েছিল যে বাংলার রাজ্য সরকার  ও স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই স্বদেশী কোম্পানীগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করবে  ও এই কোম্পানির এই উদ্যোগ গুলিকে সাহায্য করবে ও স্থিতিশীলতা  প্রদান করবে, যার দ্বারা এই কোম্পানিগুলি  আরো উন্নতিসাধন করতে পারবে।।

স্বাধীনতার পরিবর্তে ( মূলত ক্ষমতার হস্তান্তর ও ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে গণতন্ত্রের আধা- ঔপনিবেশিক সত্তায় পরিণত হয়) যা এসেছিল তা হল বাংলা ভাগের কলঙ্কর সাথে গান্ধী ও নেহরুর বাংলার বিশাল অংশের উর্বর জমি, পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া এবং আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য পুনর্বাসনের অভাব। একটি বড় সংখ্যার মিল যেগুলির ভারতে থাকার কথা ছিল সেগুলি পাকিস্তানে চলে যায়, ভূমি সম্পদের ক্ষতির প্রসঙ্গ নয় বাদই থাকল। এর সাথে নেহরুর বাঙালি হিন্দুদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ ও সাধারণভাবে বাংলার পতন শুরু হয়।  যে যে কারণে বাংলার শিল্পীদের পতন ঘটেছিল সেগুলির আলোচনা বিস্তারিতভাবে অন্য একটি প্রবন্ধে করা যাবে।

সূত্রঃ

১। ইন্ডিয়া’স নিউ ক্যাপিটালিস্টসঃ হরিশ দামোদরান

২। স্বদেশী এন্টারপ্রাইজ ইন বেঙ্গল ১৯২১-১৯৪৭ঃ অমিত ভট্টাচার্য

৩। স্বদেশী এন্টারপ্রাইজ ইন বেঙ্গল ১৯০০-১৯২০ঃ অমিত ভট্টাচার্য

মূল লেখাটি স্বতন্ত্র পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন অবান। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।