বিশ্ব চরাচরে নারী প্রতিষ্ঠিত হোক বীরাঙ্গনা ও জ্ঞানদায়িনী রূপে

    0
    2747

    প্রজ্ঞা পারমিতা

    স্বামী বিবেকানন্দ নারী জাতি সম্পর্কিত আলোচনায় নারীকে বীরাঙ্গনা আখ্যা দিয়েছিলেন।আমরা বৈদিক যুগে, উপনিষদের যুগে ফিরে তাকালে দেখতে পাব- মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েরা ব্রহ্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়েছিলেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ক্যকে ব্রহ্মবিচারে আহ্বান করতেন। স্বামীজি বলেছিলেন, মেয়েদের পূজা করেই সব সব জাত বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতে মেয়েদের পূজা নেই, সে দেশ সে জাত কখনও বড় হতে পারেনি, কস্নিন কালে পারবেও না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এইসব শক্তির অবমাননা করা। ………যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসারে- সে দেশের কখন উন্নতির আশা নেই। এজন্য এদের আগে তুলতে হবে- এদের জন্য আদর্শ মঠ স্থাপন করতে হবে।”

    কবিগুরু সেই কবেই আক্ষেপ করে বলে গেছেন,”নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?” বর্তমানে দেশের কোথাও নারীরা নিরাপদ ও সুরক্ষিত নয়। সর্বত্রই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিনিয়ত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। নারী নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটে, তার সবগুলোতে আবার সোচ্চার প্রতিবাদ হয় না। অভিযোগ করা হয় যে ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমের দৌলতে আমাদের চোখের সামনে চলে আসে, সেখানেই কেবল প্রতিবাদ হয়। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় দায়সারা প্রতিবাদ তারপর আবার তা‌ থেমেও যায় দ্রুত। অন্যদিকে আবার অভিযোগ ওঠে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আসল ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। মার্কেটে নতুন ইস্যু নিয়ে এসে পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিও অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।

    তাছাড়া, এ অভিযোগ‌ও করা হয় নির্যাতনের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবার অবস্থা এমন হয় যে, নির্যাতনকারী নির্যাতিতার তুলনায় আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনেক শক্তিশালী থাকে। কখনও কখনও সে আবার রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া থাকে, ফলে অপরাধী অপরাধ ঘটিয়ে নির্যাতিতাকে বা তার পরিবারকে হুমকি দেয়, ভয়ভীতি দেখায়। যে সমাজে নারী নির্যাতনকারী, ধর্ষকরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, নির্যাতিতাকে প্রকাশ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, নারী নির্যাতনের ভাইরাস সে সমাজে কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে একবার ভাবুন। এই অভিযোগসমূহ থেকে কারোর পালাবার পথ নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা মিডিয়ার শিরোনামে উঠে আসে যা আমাদের ঘোর অমাবস্যার রাতে আশার আলো দেখায়‌। তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে ভোপালে।

     

    ভোপালের ঘটনা

    প্রবল আক্রোশ ও ঘৃণায় ছুরি দিয়ে অভিযুক্তের বুকে ২৫ বার আঘাত করে নিজেই আত্মসমর্পণ করেছেন এক যুবতী। এই সাংঘাতিক ঘটনায় প্রথমটায় সকলে চমকে উঠলেও পরবর্তীতে যুবতী নিজেই সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন ওই যুবতী।

    দীর্ঘ বছর ধরে নিজের উপর অত্যাচার, নির্যাতন আর সহ্য করতে পারছিলেন না ৩১ বছর বয়সী ভোপাল নিবাসী এক যুবতী। তাই নিজেকে বাঁচাতে এই উপায় বেছে নিয়েছে সে, এমনটা জানিয়েছেন। ওই যুবতী পুলিশকে জানিয়েছেন- সে যখন ১৬ বছরের কিশোরী তখন থেকেই তার প্রতিবেশী ব্রিজভূষণ শর্মা তাকে ধর্ষণ করে। সেই ২০০৫ সাল থেকে এখনও অবধি একানাগাড়ে একই কাজ করে চলেছিল ওই প্রতিবেশী।

    যুবতী আরও জানায়, সেইসব নোংরা কর্মকান্ডের ভিডিও করে রেখে তাকে ব্ল্যাকমেলও করত ব্রিজভূষণ শর্মা। সেই কারণে ভয় পেয়ে গিয়ে পরিবারকে কিছুই জানাতে পারেনি ওই যুবতী। বর্তমানে তিনি দুই সন্তানের মা হয়ে গেলেও, তার পিছু ছাড়ে কুচক্রী ব্রিজভূষণ। তার স্বামীর পোস্টিং ডিউটি হওয়ার সুবাদে ওই যুবতীর বাড়িতে গিয়েও হানা দিতো ব্রিজভূষণ।

    ঘটনার দিন নিজের নোংরা কামনা চরিতার্থ করতে ওই যুবতীর বাড়িতে যায় ব্রিজভূষণ। সেই সময় যুবতীর দুই সন্তানই ঘুমাচ্ছিল। নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত হার মানে ওই যুবতী। শেষে রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে ব্রিজভূষণের বুক লক্ষ্য করে বসিয়ে দেয় ওই যুবতী। নিজের দীর্ঘ ১৫ বছরের রাগ, কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে এক নাগাড়ে ২৫ বার আঘাত করে তার বুকে। খুন করে নিজের জ্বালা মিটিয়ে নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তিনি।

     

    পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি

    এ তো গেল ভোপালের ঘটনা কিন্তু আমাদের বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গেও নারী সুরক্ষার অবস্থা তথৈবচ। নারী-বিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ প্রায় শীর্ষ স্থান অধিকার করেই রয়েছে। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আলোচনা, মিছিল সত্ত্বেও রাজ্যে নারী নির্যাতন কমার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না।

    বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতন। হিন্দু নারীরা মাঝে মধ্যেই জিহাদিদের ট্রাপে পড়ে দিকভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে যায় সমাজের মূল স্রোত থেকে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের ফিরিয়ে আনার গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ফিরিয়ে আনা যায় না কিছুদিন পর খবর পাওয়া যায় তারা বিক্রি হয়ে গেছে না হলে তারা মৃত।

    অস্ত্র রূপেণ সংস্থিতা

    বাংলা জুড়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এক অভিনব প্রতিবাদের আয়োজন করে শিরোনামে উঠে এসেছে নারী ‘সংহতি’। আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে, ‘অস্ত্র রূপেণ সংস্থিতা’ নামে এক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল নারী সংহতির পক্ষ থেকে। এর মূল লক্ষ্য ছিল, মেয়েদের হাতে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র তুলে দেওয়া এবং এই বিষয়ে সচেতনতার প্রসার ঘটানো।

    প্রথম পর্যায়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বাসন্তী অঞ্চলে বেশ কিছু মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ‘পেপার স্প্রে’। আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেয়েদের মধ্যে নিজেদের আত্মসুরক্ষার জন্য ‘পেপার স্প্রে’ কেনার চল বেড়েছে। এটি মূলত অত্যন্ত ঝাল লঙ্কা গুঁড়োর একটি শক্তিশালী মিশ্রণ। একবার পেপার স্প্রে প্রয়োগ করে পাঁচ-ছয়জন আক্রমণকারীকে চোখের নিমেষে ধরাশায়ী করা সম্ভব।

    তবে স্মরণে রাখতে হবে মানসিক দাসত্ব সবচেয়ে বড় কঠিন। এই দাসত্বের শৃঙ্খল নারীকেই ভাঙতে হবে। নারীদের নিজস্ব গুণাবলী ও মূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সঙ্গে প্রয়োজন জ্ঞান অর্জন, আত্মসংযম, শ্রমনিষ্ঠা, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, সেবা, ক্ষমতায়ন তার সঙ্গে থাকবে দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। প্রতিবাদ করতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

    একুশ শতকের পৃথিবী মেয়েদের আজও সুস্থ সমাজ দিতে পারেনি। মুক্ত দুনিয়া মুক্ত বাণিজ্যের জগতে মেয়েরা আজ‌ও পণ্য। এর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো বড় জরুরি। এ মুক্তির জন্য প্রয়োজন আমাদের মানসিক পরিবর্তন। রাষ্ট্রীয় সামাজিক পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন আর বহুযুগ লালিত সংস্কার আর অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি। তবেই হয়তো লাভ হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।

     

    দেবী চৌধুরানী

    বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রতিটি হিন্দু নারীকে হয়ে উঠতে হবে আধুনিক যুগের ‘লক্ষ্মীবাঈ’। স্বামীহারা রাজ্যহারা যে নারী স্বদেশ রক্ষার্থে শেষ রক্তবিন্দু অবধি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। আজকের নারীদের শরৎচন্দ্রের ‘রমা’ নয় হয়ে উঠতে হবে দেবী চৌধুরানীর ‘প্রফুল্ল’। আজকের প্রতিটি হিন্দু নারীর আদর্শ হয়ে উঠুক ভুরশুট রাজ্যের রানী রায়বাঘিনী। যিনি অসিখেলা থেকে শুরু করে ঘোড়ায় চড়া ও তীরন্দাজিতে পারদর্শিনী ছিলেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে।আজ থেকে একশো বছর আগে যা মানুষ ভাবতে পারত না তা এখন অনায়াসেই সম্ভব। তাই নারী চাইলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। প্রত্যেক নারী আদ্যা শক্তি মহামায়ার অংশ। একজন নারী চাইলেই অনায়াসে অসুর নিধন করতে পারে। শুধু চাই সেই ইচ্ছাশক্তি।