করোনার পাশবালিশ: রাজ্যের মানুষের জীবনকে রাজনীতির ঘুঁটি করতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী?

0
436

২৯শে মে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যে লকডাউন বাস্তবতঃ তুলে দিতে চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ১লা জুন থেকে খুলে দিতে চেয়েছিলেন মন্দির, মসজিদ, গীর্জা ইত্যাদি উপাসনালয়গুলি, আর ৮ই জুন থেকে সব অফিস কাছারি। ৮ই জুন থেকে সরকারি অফিসগুলি ১০০% কর্মী নিয়ে কাজ করবে বলে ২৯শে মে’র সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমত ঘোষণার পূর্বে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ বৈঠক করেছেন বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এবং তারপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও। কিন্তু এই সকল বৈঠকের পর ৩১শে মে-পরবর্তী সময়ে লকডাউন সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা কি হতে চলেছে তা জানার পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এমত ঘোষণা জনমানসে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। প্রশ্ন ওঠে, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও ৮ই জুন থেকে স্বাভাবিক হয়ে যাবে কি না সে সম্বন্ধে কোনো ঘোষণা কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে হওয়ার আগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এমন ঘোষণা করলেন কিসের ভিত্তিতে? এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে পূর্ববর্তী ঘোষণা অনুযায়ী নিয়মিত লোক্যাল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কথা অন্ততপক্ষে ৩০ শে জুন পর্যন্ত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার প্রেক্ষিতে ভারতীয় রেলও যদি ৮ই জুন থেকে লোক্যাল ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না করে, তবে ১০০% সরকারি কর্মচারী কর্মক্ষেত্রে পৌঁছবেন কেমন করে? সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে তাঁদের পৌঁছনোর ব্যবস্থা সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারই করবে কি না, ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সরকারি কর্মচারীরা। তাঁরা সরাসরি অভিযোগ তোলেন যে সরকারি কর্মচারীদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।

অতঃপর অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘোষণা পরিবর্তন করেন। সরকারি নোটিফিকেশন বেরোয় যে, সরকারি কোনো কাজ যেন আটকে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ৭০% উপস্থিতির মাধ্যমেই কাজ চালাতে পারবে সরকারি অফিসগুলো। বেসরকারি অফিসের সিদ্ধান্তের ভার মুখ্যমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ছেড়েছেন কম্পানিগুলোর ওপরেই এবং বলেছেন ওয়ার্ক ফ্রম হোম যথাসম্ভব চালু রাখতে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ২৯শে মে মুখ্যমন্ত্রীর এমত সাংবাদিক বৈঠকের পর ৩০শে মে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রদপ্তরের নোটিফিকেশনেও জুন মাসে লোক্যাল ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কোনো ঘোষণা নেই।

পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকেরা শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে রাজ্যে এসে পৌঁছচ্ছেন। খবরে সম্প্রতি প্রকাশিত হয় যে ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর আগেই শ্রমিকরা ট্রেন থেকে নেমে পড়ে যে যার বাড়ির পথে পালিয়ে যেতে শুরু করেছেন। পৌঁছনোর পর ১৪ দিন সরকারি কোয়ারান্টাইন ব্যবস্থায় থাকতে না চাওয়ার কারণেই হয়ত ওঁরা এমন ঘুরপথ অবলম্বন করছিলেন বলে অনুমান করা হয়। অথচ নিজেদের এলাকায় পৌঁছনোর পর এইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের সেখানে ঢুকতে দিতে চায় না এলাকার স্থানীয় মানুষ। অপরপক্ষে, এমন সন্দেহও প্রকাশিত হয় যে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের কোভিড টেস্ট ও কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করার পরিকাঠামো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেই বলেই তা করার সদিচ্ছাও হয়তবা রাজ্য সরকারের নেই। তাই ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে মধ্যপথ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ হয়ত শ্রমিকদেরকে দেওয়া হয়েছে শাসক দলের তরফ থেকেই। কারণ গন্তব্যে পৌঁছনোর পর নিয়মমাফিক স্ক্রীনিং, টেস্ট, কোয়ারান্টাইন ইত্যাদির ব্যবস্থা করা রাজ্যসরকারের তরফ থেকে স্ট্যাণ্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওরের (SoP) মধ্যে পড়বে এবং তার অধিকাংশ ব্যয়ভারও বহন করতে হবে সরকারকেই। সেটি এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই কি গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ শ্রমিকদেরকে দেওয়া হয়েছে? উঠেছে প্রশ্ন। গোটা ঘটনার মধ্যে জনমানসে রাজ্য সরকারের প্রতি অনাস্থার ভাবটিই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে নানা ভাবে, নানা স্তরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে নানা ভিডিও যাতে দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এর তোয়াক্কা না করে একটি বাসে গাদাগাদি করে উঠে পড়ছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা কারণ শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে তাঁদের পৌঁছনোর খবর থাকলেও তাঁদেরকে যথাযথ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়মমাফিক পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত রাজ্য প্রশাসনের দিক থেকে তৈরি নেই।

গতকালের সাংবাদিক বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী করোনাকে পাশবালিশের মত জড়িয়ে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন রাজ্যের মানুষকে, যার অর্থ সম্ভবতঃ এই যে রাজ্যে কোভিড সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা মুখ্যমন্ত্রী করতে চাইছেন না। একটি প্রবল সংক্রামক রোগের মহামারী নিয়ন্ত্রণের রণে হয়ত ভঙ্গ দিতে চাইছেন তিনি। ওয়াকিবহাল মহলে প্রশ্ন উঠছে যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন ধীরে ধীরে রাজ্যে ঢুকছেন, এবং তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড সংক্রমণ যখন অতি দ্রুত গতিতে বাড়বে বলে প্রত্যাশিত, ঠিক সেই মুহূর্তেই করোনাকে ‘পাশবালিশ’ করতে বলে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাইলেন কেন মুখ্যমন্ত্রী?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্ববর্তী সমস্ত আচরণের প্রেক্ষিতে ওঁর এমত বক্তব্যের তুলনা করলে যে ব্যাখ্যা সর্বাধিক সম্ভাব্য তা হল, কেন্দ্রের সঙ্গে সম্ভবতঃ আর একটি সংঘাতে যেতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং সেই সংঘাতে বাজি ধরতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের জীবনকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থান বিরোধী রাজনীতির মাধ্যমে। গত ৯ বছর যাবৎ একটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ওঁর রাজনৈতিক আচরণ প্রায় সর্বদাই বিরোধিতামূলক। সেই বিরোধিতার রাজনীতিকে পুনরায় উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ তাঁর সামনে সহসা এসে পড়েছে যে সুযোগের সদ্ব্যবহারই হয়ত করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। কি সেই সুযোগ? রাজ্যের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যে এসে পৌঁছলে তাঁদের কোভিড টেস্ট, কোয়ারান্টাইন, চিকিৎসা ও খাদ্যদ্রব্যাদির ব্যবস্থা করার দায় মুখ্যমন্ত্রী নিতে (হয়ত) অনিচ্ছুক কারণ পশ্চিমবঙ্গে এই সবকিছুর পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। এই খাতে সরকারি অর্থব্যয়ের সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে বলে সন্দেহ করার ক্ষেত্রও প্রস্তুত। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ দপ্তর রাজ্যের জনকল্যান প্রকল্পগুলির CAG প্রসেস অডিটে সহযোগিতা করে নি। সন্দেহ করার এটিই প্রধান ও ন্যায্য কারণ। সরকারি তহবিল তছরূপ না হয়ে থাকলে অর্থদপ্তর প্রসেস অডিটে অসহযোগিতা করে অডিট বানচাল করল কেন? মুখ্য প্রশ্ন এটিই। পশ্চিমবঙ্গে পরিকাঠামোর অভাবের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে যখন সংবাদমাধ্যম তুলে ধরেছে যে শ্রমিকদের কোয়ারান্টাইনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে এমনকি টয়লেটের মধ্যেও। এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে অন্যান্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ ভারতীয় রেলমন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে নেওয়ার বিষয়টি পছন্দ হয় নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মত করোনা হটস্পটগুলি থেকে আসা শ্রমিক ট্রেনগুলিকে বলে বসেছেন ‘করোনা এক্সপ্রেস।‘ সেই জন্যই হয়ত বা কিঞ্চিৎ ক্ষোভের বশেই রাজ্যে লকডাউন সহসা তুলে দিয়ে মানুষকে আরও দ্রুত করোনা সংক্রমণের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ত বলতে চাইছেন যে উনি রাজ্যে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বাইরে থেকে শ্রমিক পাঠিয়ে ভারত সরকারই যখন রাজ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী আর কি করতে পারেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে সন্দেহ হয় যে ভারত সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে আম্পান-বিধ্বস্ত কোনঠাসা মমতা হয়ত রাজ্যের মানুষের জীবনকেও বাজি ধরতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ত চাইছেন যে বহু মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন যার দায় তিনি চাপিয়ে দিতে পারবেন ভারত সরকারের ওপর। মুখ্যমন্ত্রী প্রমাণ করতে চাইছেন যে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে করোনা সংক্রমণের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্যই এবং এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের ষড়যন্ত্র।

কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকরা এ রাজ্যের বাসিন্দা ও এ রাজ্যের ভোটার। তাঁরা বাড়িতে ফিরতে চাইলে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সুবিধের জন্য অন্য রাজ্যে তাঁদেরকে জোর করে আটকে রাখা কোন্ মানবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে, সে প্রশ্নের উত্তর মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন বলে জানা নেই। যে রাজ্যের জনঘনত্ব বিপুল, যে রাজ্যে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল, সে রাজ্যে প্রতিটি মানুষ ও প্রতি ভোটারের জন্য যথাযথ পরিকাঠামোর ব্যবস্থা রাখা (এমনকি তাঁরা রাজ্যে নিয়মিত বসবাস না করলেও) এবং মহামারীর দুঃসময়ে তাঁদের প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের যত্ন সুনিশ্চিত করার দায়িত্বও যে তাঁরই গণতান্ত্রিক দায়িত্ব, ভারত সরকার, মহারাষ্ট্র সরকার বা গুজরাট সরকারের নয়, সে বিষয়টিও সম্ভবতঃ মুখ্যমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেন নি পশ্চিমবঙ্গের কোনো আমলা। তাছাড়া মহারাষ্ট্রে বসবাস ও কর্মরত এ রাজ্যের শ্রমিকদের দায় মহারাষ্ট্র সরকার এতদিন বহন করার পর মহারাষ্ট্রের ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির নিরিখে আর যদি বহন করতে না চায়, তবে মহারাষ্ট্র সরকারকে তার জন্য দোষ দেওয়ার বা জোর করে তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের দায়ভার বহন করতে বাধ্য করানো আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি না সে বিষয়েও অবশ্য মুখ খোলেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পূর্ণ ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে ভারত সরকারের ওপর। তাই হয়ত মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন গোটা রাজ্যে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ুক কোভিড সংক্রমণ যার দায় ভারত সরকারের ওপর চাপিয়ে নিজের প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় মুক্ত হওয়ার রাজনৈতিক প্রয়াস করতে পারবেন তিনি।

মানুষের জীবনকে রাজনীতির ঘুঁটি বানানোর এই বিপজ্জনক পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতে এ রাজ্যের মানুষকেই সচেতন হতে হবে।

লেখিকা দেবযানী ভট্টাচার্য্য।