বিসর্জনের দিনে আগমনীর সুর বাজে উত্তরবঙ্গের প্রান্তদেশে ডুয়ার্স জুড়ে

0
792

বঙ্গদেশ ডেস্ক :- গত কয়েক মাসের লকডাউনে স্তব্ধ পৃথিবীতে ঋতুপরিবর্তন যেমন থেমে নেই, তেমনই বাৎসরিক উৎসব আনন্দের হাত ধরে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার তাগিদও থেমে নেই। বাংলার আকাশে বাতাসে সেই নিয়মেই বেজে উঠেছে আগমনীর সুর। কখনও মাতৃরূপে, কখনও কন্যারূপে, কখনও শক্তিরূপে মাতৃমূর্তির বন্দনায় শোক দুঃখ বিলাপ অভাব অসুখ ভুলে থাকার আয়োজন। প্রার্থনামন্ত্রে উচ্চারণ করা সৃষ্টি স্থিতি রক্ষার সুর। এই শারদীয়ায় সমস্ত বঙ্গভূমি যখন দুর্গা, লক্ষ্মী বা কালী পূজায় মাতোয়ারা, সেসময় তিস্তাবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যা ভৌগোলিক মানচিত্রে ডুয়ার্স নামে পরিচিত, মেতে ওঠে কৃষিশক্তির আরাধনায় যা ক্রমে মাতৃশক্তির আরাধনায় মিশে দেবী ভান্ডানীর রূপ নিয়েছে। তাই প্রচলিত বিসর্জনের দিনেও আগমনী বাজে উত্তরের প্রান্তদেশের ডুয়ার্স জুড়ে, যেখানে একাদশীতে ভান্ডানী দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন কয়েকশত বছর ধরে।

উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল তিস্তা তোর্সা কালজানি রায়ডাক বিধৌত জলপাইগুড়ি আলিপুরদুয়ার ও কুচবিহারের একাংশে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক বলয়ে অর্চনা করা হয় লৌকিক দেবী ভান্ডানীকে, যিনি আসলে কৃষিদেবী। অরণ্যচারী সভ্যতা থেকে কৃষিসভ্যতার বিবর্তনের প্রত্নচিহ্ন নিহিত আছে এই দেবী কল্পনায় যা দুর্গাপূজার মিথ কথার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। তাই সম্পূর্ণভাবে লৌকিক এক দেবী সংস্কৃতির মিশ্রিত স্রোতে আর্যকৃত হয়ে প্রচলিত লোককথায় দেবী দুর্গারই ভিন্নরূপে পূজিতা হচ্ছেন ডুয়ার্সের গাঁ গঞ্জের মাটিতে।
হেমন্তের শুরুতে কৃষিকাজের প্রস্তুতিপর্বের হাত ধরেই তিস্তাপাড়ের মাটিতে ভান্ডানী পূজাকে কেন্দ্র করে মহোৎসবে মাতে সংলগ্ন এলাকার সকল মানুষ। প্রচলিত বিশ্বাস, বারোয়ারি মণ্ডপের জাঁকজমক থেকে বিদায় নিয়ে কৃষকের মাটির ঘরে শান্তিতে দুদিন কাটিয়ে তবেই কৈলাসে ফিরবেন দেবী। সেই বিশ্রামকালেই তিনি দেবী ভান্ডানী। এ পূজা এখন আর সীমাবদ্ধ নেই রাজবংশী সমাজের একান্ত নিজস্ব আরাধনায়। বরং উত্তরের মানুষের জীবনের অন্যতম উৎসব হয়ে উঠেছে কবেই।

দেবী ভান্ডানীর টকটকে রক্তবর্ণ, মুখের আদলে মঙ্গোলীয়ান ধাঁচ। তিনি ব্যাঘ্রবাহিনী। আদি ভান্ডানী দেবীর মূর্তি দ্বি-ভুজা। এক হাতে বরাভয়, অন্য হাতে কৃষিপাত্র। তিনি একাকিনী, পশ্চিমমুখে অধিষ্ঠিতা। দুর্গাপূজার দশমীর পর একাদশী থেকে তিনদিন তিনি পূজা পেয়ে থাকেন। মুখে মুখে ফেরা লোককথার একটি ধারা বলে, বিসর্জনের পর বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসে ফেরার সময় উত্তরাঞ্চলের গহীন অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন উমা। তাঁর কান্নার শব্দ শুনে সেই বনের রাখাল বালকেরা, ভিন্নমতে গ্রামবাসীরা নিজেদের গ্রামে তাঁকে আশ্রয় দেন। একাদশীর দিন সেই বাড়িতে কাটিয়ে কৈলাসে ফিরে যাবার সময় দেবী সমস্ত অঞ্চল শস্যপূর্ণ থাকার বর দিয়ে যান।

এই কাহিনিটি অঞ্চলভেদে একটু আলাদা মাত্রা পেয়েছে যেখানে দেবী কৈলাসে প্রত্যাবর্তনকালে রাজবংশী বধূ ও কন্যাদের নাচগানে মুগ্ধ হলে তাঁকে ‘সেবা ও আদর’ দেবার জন্য গ্রামবাসীরা থেকে যেতে বলেন। হেমন্তে ভরে ওঠা শস্যভাণ্ডারের বর পেয়ে সেই থেকে গ্রামবাসীরা ভান্ডানী দেবীর আরাধনা শুরু করে।

অন্য একটি জনশ্রুতি বলে, কয়েকশত বছর পূর্বে রাজা নহুষ রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করে শিকারে বের হন এবং পূজার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যান। রাজবাড়িতে পুজো শেষে বিসর্জনের পর দেবী বাঘের পিঠে চেপে গভীর অরণ্যে রাজার কাছে গিয়ে বলেন তিনি তাঁর হাতের পুষ্পাঞ্জলি না নিয়ে মর্ত্য ত্যাগ করবেন না। অনুতপ্ত রাজা সেই একাদশীর দিন জঙ্গলের মধ্যে বনফুল ও কৃষিজ জিনিসপত্র সংগ্রহ করে দেবীর পূজা করেন। পরবর্তীতে তা ভান্ডানী দেবীর পূজা নামে খ্যাত হয়।

এই কাহিনিগুলো বাদ দিয়েও আরও নানা প্রচলিত লোককথা উত্তরের হাওয়া বাতাসে মিশে আছে। সবগুলিই দেবী দুর্গা ও দেবী ভান্ডানীর মধ্যে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। অথচ উত্তরের বিস্তীর্ণ জনজাতির বসতি অঞ্চলের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিতে উমা বা পার্বতী বা দেবী দুর্গা আদতে পূজিত হতেন না কখনোই। পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের সূচনা নয়, বরং বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিভাগের উপর গড়ে ওঠা “যাত্রা” ও “মাত্রা” নামে দুটি পক্ষ প্রচলিত ছিল আদি রাজবংশী সমাজে। অপেক্ষাকৃত ধনী জোতদার নবমীতে করতেন মাত্রা পক্ষে দেবী আরাধনা ও দশমীতে যাত্রা পক্ষে ছিল সাধারণ মানুষের কৃষিবন্দনার মধ্যে দিয়ে দেবী ঠাকুরানির পুজো। এই কৃষিপুজোর হাত ধরেই লোকশ্রুতির বন্যায় ভেসে একাকার হয়ে গেছেন দেবী দুর্গা ও ভান্ডানী।

ময়নাগুড়ির বার্নিশ গ্রামে ডুয়ার্সের সবচেয়ে বড়ো ভান্ডানী দেবীর পুজো এবং তাকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি নেপাল, ভুটান বাংলাদেশ থেকেও ভক্ত সমাগমে জমজমাট হয়ে ওঠে পূজাপ্রাঙ্গন ও মেলা। একদিনের এই মেলাকে কেন্দ্র করে ডুয়ার্সের এই অঞ্চল মহামিলনের ও সম্প্রীতির এক আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এই মেলার বিশেষ দিক হল মানত বা মানসিক। গ্রামবাসীরা সারাবছর ধরে নানা মনস্কামনা দেবীর কাছে পূরণের প্রার্থনা রেখে তার বিনিময়ে পুজোদানের জন্য মেলায় আসেন। একসময় এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল লোকগানের আসর। লোকসংস্কৃতিরও অন্যতম পীঠস্থান হয়ে আছে ভান্ডানী পুজোর মেলা।

বিভিন্ন গবেষণায় দেবী ভান্ডানীকে দুর্গা বা বনদুর্গা বলে অভিহিত করা হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে এক স্বতন্ত্র দেবীকল্পনা, যিনি হেমন্তের শস্য উৎপাদন ও সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফার্টিলিটি কাল্টের দেবী ভান্ডানী ও দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা তিথিসূত্রে এক ধারাবাহিকতার সুরে বাঁধা পড়ে অভিন্ন হয়ে উঠেছেন কীভাবে, তা আশ্চর্যের হলেও অসম্ভব নয়। দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের পর একাদশীতে ভান্ডানী দেবীপ্রতিমার আগমন ও আরাধনায় উত্তরের মাটিতে যে দেবীবন্দনা তা এক ভিন্ন মাত্রা পায়, তা বলাই বাহুল্য।