কালী পূজায় পশুপ্রেম এবং ঝটকা-হালাল

কালীপূজা যতই এগিয়ে আসে, একশ্রেণীর পশুপ্রেমীদের মধ্যে চঞ্চলতা ততই বাড়তে থাকে। ফেসবুক, টুইটার, whatsapp-এ কান পাতলেই শোনা যায় এইসব পশুপ্রেমীদের হাহাকার। বলিপ্রথা যে কতটা বর্বর, কতটা অমানবিক- একথা বোঝাতে বৈজ্ঞানিক যুক্তি, মানবিক যুক্তি তো বটেই, এমনকি ধর্মীয় যুক্তি অব্দি খুঁজে বার করে ফেলেন তাঁরা। ধর্মীয় ব্যাখ্যার প্রতি এমন নিষ্ঠা আর পাঠার জীবনের প্রতি এমন অচলা প্রেমের দেখা মেলে বছরের মাত্র দুটি দিনে। নবমী এবং কালী পূজা। কালী পূজা যাওয়ামাত্রই এই “দুদিনের পশুপ্রেম”-এ ভাটার টান আসে। সেজন্য এই পশুপ্রেমীদের “শারদীয়া পাঠা-প্রেমিক” বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না।

এই “শারদীয়া পাঠাপ্রেমিক”-রা যে সকলেই নিরামিষাশী এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। বরং বাঙালি “পাঠা-প্রেমিক”রা সকলেই পুরোদস্তুর আমিষ-ভোজী এবং রোববারের দুপুরে কষিয়ে পাঠার ঝোল দিয়ে ভাত খান। তাহলে এদের বলি-বিরোধের অর্থ কি? রবিবারের পাঠার ঝোলের মাংস তো আর জ্যান্ত পাঠার থেকে আসে না। কিংবা পাঠাবলি দিলে সেই পাঠা যে রবিবারের কাটা পাঠার থেকে বেশি কষ্ট পায়, এমন কোন প্রমাণ-ও নেই। বরং প্রথম বিশ্ব জুড়ে যে বৈজ্ঞানিক এবং মানবিক উপায়ে মাংস কাটা হয়, তাকে পশুবলির হিন্দু উপায় “ঝটকা”র সমকক্ষ-ই বলা যায়।

আশ্চর্যের বিষয় এই, পশুবলির বিরুদ্ধে যতগুলি কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়; কোরবানির বিরুদ্ধে কিন্তু তাদের বেশিরভাগকেই নীরব থাকতে দেখা যায়। কোরবানি অর্থাৎ উৎসর্গ। বলির মাংস যেমন দেবীমাতৃকা-র উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত; ঠিক তেমনই আল্লার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে আড়াই প্যাঁচে প্রাণী কাটা-কেই “কোরবানি” বলা হয়। পাড়ায় পাড়ায় যত হালাল দোকান আছে কাঁচামাংসের, তার সবগুলোতেই আল্লাকে উৎসর্গ করে প্রতিটি প্রাণী কেটে বিক্রি করা হয়। “মা কালীকে উৎসর্গ করা বলি অমানবিক” বলা পশুপ্রেমিকরা কিন্তু হালাল হওয়া প্রাণীদের হয়ে ওকালতি করতে নামেন না। এক্ষেত্রে কারুরই মনে হয় না যে অন্যধর্মের ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা মাংস আমরা খাব কেন? তার মানে আপত্তিটা কি কেবল নিজের ধর্মের ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা মাংস খেতে? কি অদ্ভুত এই “শারদীয়া পাঠাপ্রেম”!

এবং সত্যিই যদি এরা পাঠা প্রেমিক হতেন, তাহলে  পাঠার “খাসিকরণ”-এর বিরুদ্ধেও আন্দোলনে নামতেন। পুরুষ ছাগল হল পাঠা, কিন্তু সেই পাঠাকে জন্মের কিছুদিন পরই খোজা করে খাসি বানানো হয়। খাসির মাংসে চর্বি হয়, পাঠার মাংস মেদহীন। অতএব স্বাস্থ্যকর। এই স্বঘোষিত পশুপ্রেমিকদের কিন্তু  অমানবিক ভাবে পাঠার পুরুষত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে খাসি করার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। সেক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি হল- “পাঠার মাংসে গন্ধ বেশি। খাসির মাংস বেশি সুস্বাদু”! অর্থাৎ স্বাদের জন্য “পাঠাপ্রেম” জলাঞ্জলি দেওয়া বৈধ। হিন্দুধর্মে কিন্তু এইভাবে কুথে কুথে হত্যা করা প্রাণী খাওয়া সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।

কালীপূজায় যে বলি হয়, তার কিছু নিয়ম আছে। কেবলমাত্র পুরুষ প্রাণীই বলি হয়। এবং সেই প্রাণী হতে হবে সম্পুর্ন নীরোগ এবং নিখুঁত। পুরুষত্বহীন পাঠা বা খাসি কিন্তু বলির উপযুক্ত নয়। বলির প্রাণীটিকে ব্যথা কমানোর জন্য অনেক সময় জাবনার সাথে সিদ্ধি পাতা মিশিয়ে খাওয়ানো হত। আধুনিক মাংসের ফার্মগুলিতে যে প্রাণীটিকে stunning করিয়ে কাটা হয়, এগুলি ছিল তারই প্রাচীন উপায়। এতসব শর্ত পালনের পর হত বলি। সেই বলি হতে হবে এক ঝটকায়। অর্থাৎ একটিমাত্র কোপে প্রাণীটির মুন্ড তার দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে হবে। যাতে তৎক্ষণাৎ প্রাণীটির মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ প্রাচীন যতগুলি উপায় ছিল প্রানীহত্যার, তাদের মধ্যে ঝটকা সর্বোত্তম এবং সব চাইতে মানবিক।

তা সত্ত্বেও ঝটকা-র বিরোধিতা ভারতে সর্বাধিক। অনেকেই বলতে পারেন, তাঁরা ঝটকা পদ্ধতির বিরোধী নন। কেবল বলিপ্রথার বিরোধী। সেক্ষেত্রে মনে করিয়ে দিই, এই বাংলাতেই মাংসের দোকানগুলি ক্রমেই হালাল-সিদ্ধ হয়ে উঠছে। ঝটকা মাংসের দোকান গুলি একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে। এয়ারপোর্টে, হোটেলে-রেস্তোরাঁয়, বার-এ, মল-এ সর্বত্রই ঝুলে যাচ্ছে বোর্ড, “হালাল সার্টিফাইড”। ঝটকার ক্ষেত্র যত সঙ্কুচিত হচ্ছে, তত ফুলেফেঁপে উঠছে হালাল-রাজ। কোণঠাসা হতে হতে ঝটকা কোনোমতে টিকে আছে নবমী আর কালীপূজার বলিতে। ঝটকা-র সেই দুদিনেও হাত দিয়েছেন স্বঘোষিত পশুপ্রেমিকরা। ঝটকার আর চিহ্নমাত্র তারা রাখতে দেবেন না কোথাও। ঝটকা পড়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

এই বিষম অবস্থা থেকে যদি পরিত্রাণ পেতে হয়, বাঙালি হিন্দুকে নিজের ধর্ম আঁকড়ে ধরতে হবে। তাকে বুঝতে হবে, নিখুঁত প্রাণীর মাংস খাওয়াই শাস্ত্রসম্মত। আড়াই প্যাঁচে গলার নলি কেটে ছেড়ে দিয়ে, তড়পে তড়পে প্রাণীকে হত্যা করা হিন্দু শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। অশাস্ত্রীয় ছাড়াও এমনভাবে প্রানীহত্যা মানবিক দিক দিয়েও সমর্থনযোগ্য নয়। অতএব, রবিবারের মাংস কিনুন ঝটকা-সম্মত দোকান থেকে। নিজের এলাকায় ঝটকা কাটার দোকান খুঁজুন। আত্মীয়-বন্ধুদেরও কিনতে উৎসাহ দিন। হোটেল-রেস্টুরেন্টে মাংস খেলে, ঝটকা মাংস কিনা প্রশ্ন করুন। ঝটকা না হলে সেই দাবি তুলুন। ঝটকার চাহিদা যত বাড়বে, আপনারই কোন বাঙালি হিন্দু ভাই কাজ পাবে বা তার মাংসের ব্যবসা বাড়াবে। ঝটকার জনপ্রিয়তা যত বাড়বে, নতুন নতুন প্রয়োগের ক্ষেত্র খুলে যাবে। এইভাবেই কিন্তু আজকে “হালাল সার্টিফিকেশন”-এর বর্তমান বাজারমূল্য 1.9 ট্রিলিওন ডলার। 1 ট্রিলিয়ন অর্থাৎ 1000 বিলিয়ন। বাংলা মতে হিসাব করলে প্রায় দুই লক্ষ কোটি ডলার! ঝটকার জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারলে এর থেকেও আকর্ষণীয় বাজার “ঝটকা সার্টিফিকেশন”-এর হতেই পারে। এই বিপুল অর্থে হিন্দু সম্প্রদায়ের কতখানি উন্নতি সম্ভব, ভাবুন। সিদ্ধান্ত আপনার। ভ্রান্ত পশুপ্রেমে মেতে হালাল-এর বাজার বাড়াতে সাহায্য করবেন নাকি ঝটকা বলির পক্ষে থাকবেন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-

শ্রী সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রী জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

তথ্যসূত্র-

১) http://www.beshto.com/questionid/4309

২) https://www.google.co.in/amp/s/www.anandabazar.com/amp/state/খরচ-আর-ঝ-ক-কম-ছ-গল-প-লন-1.237948

৩) http://endgenderapartheid.com/2017/06/02/sharia-stealth-halal-certification-2-1-trillion-dollar-islamic-industry-chipping/