পঞ্চদশ অধ্যায় – জন্ম

0
624

অনুবাদক: সূর্যদেব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

দুই দিন বিরতির পরে আচার্য চণ্ডকৌশিক গিরিব্রজে তাঁর পূর্বপক্ষ পুনরারম্ভ করলেন। রাজ্ঞী সৌদামিনী দেবীকে তথায় না দেখে তিনি কর্মসূচি স্থগিত রেখেছিলেন। অনন্তর মহারাজ জরাসন্ধের সনির্বন্ধ অনুরোধে রানিমা পূর্বপক্ষে উপস্থিত হন। শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তিবর্গের নগ্নরূপ তাঁর নিকট বড়ো অসহ্য ঠেকছিল। কিন্তু গৃহকর্ত্রীর অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে পূর্বপক্ষের অনুষ্ঠান অবিধেয়। সুতরাং বিস্তর উপরোধে তিনি প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলে তবেই আচার্য তাঁর বিবরণ শুরু করলেন, পঞ্চ প্রহর বিলম্বের পর।

‘দেবকী ও বসুদেবকে একটিই কক্ষে রাখা হল। কংস চেয়েছিল দুজনকে দুটি পৃথক কক্ষে আটক করতে, কিন্তু বৃষ্ণিদের পূরণমাত্রার বিদ্রোহের আশঙ্কায় এমন চরম সিদ্ধান্ত শেষমেশ সে নেয় নি। ফলে জনতাকে অজুহাত দিতে পারল, যে আসন্ন এক প্রাণঘাতী বিপদ থেকে দম্পতিকে রক্ষা করতেই তাঁদেরকে নিরাপদ প্রহরায় রাখা হয়েছে। এমন দুর্বিষহ জীবনেও দেবকীর স্থৈর্য এবং বসুদেবের ধৈর্য ছিল অটল। অষ্টম সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সিদ্ধান্ত ইতোপূর্বেই তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন। অশুভ শক্তির অবসান তাঁরা মনেপ্রাণে চাইতেন। স্পষ্টই তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, যেনতেন প্রকারেণ অষ্টম সন্তানটিকে রক্ষা করতে পারলে কংস দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্কেই মারা পড়বে, কারণ জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, গুনিন দল তাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করেছে।

‘প্রথম ছয় সন্তানকে কংস জন্মের অব্যবহিত পরেই হত্যা করল। হতভাগ্যা দেবকী, দুঃখিনী দেবকী প্রতিজ্ঞাচ্যুত হওয়ার ভয়ে সদ্যোজাতদের মুখদর্শন করাও বন্ধ করলেন। এই দম্পতির তিতিক্ষায় এমনকী কারাধ্যক্ষ ও রক্ষীদের হৃদয়ও দ্রাবিত হল। বৃষ্ণি শূরসেন বংশীয় বসুদেবই ছিলেন মথুরার সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী। তথাপি কুকুর বংশীয় পিতৃব্য উগ্রসেনকে সানন্দে, নির্দ্বিধায় রাজপদে বরণ করে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ, তথা অধিক অভিজ্ঞ। তাঁর এই ত্যাগরূপ কীর্তি মথুরা মননে অক্ষয় স্থান লাভ করেছিল। আর সেজন্যই তিনি মথুরাবাসীর বড়োই প্রিয়।

‘ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম ও নিধনের পর বসুদেব রোহিণীর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলেন। মাসে মাত্র একটিবার তাঁরা পরিবারের সদস্যদের সহিত মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতেন। বসুদেবের অন্যান্য পত্নী, অর্থাৎ দেবকীর অপরাপর ভগিনীরা নিয়মিত দেখা করলেও জ্যেষ্ঠা রোহিণী কদাচিৎ আসতেন। পতির অবর্তমানে তিনি বৃষ্ণিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের জমিজমা, গোশালা সমস্তই যমুনার বিপরীত তটে গোকুলের নন্দ উপবনে অবস্থিত। মথুরাকে দুগ্ধ – নবনী সরবরাহকারী বৃহত্তম গোশালাটি সেখানেই, আর সেসব পরিবহনের জন্য কয়েকটি নৌকাও তাদের ছিল। যমুনার এই পাড়ে বসুদেবের প্রাসাদ উচ্চতর ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত। মথুরার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুগ্ধ নন্দ উপবনেই মন্থন করে তক্র (ঘোল) ও নবনী প্রস্তুত করা হত, অতঃপর বসুদেবের প্রাসাদে এনে রাখা হত। এই প্রাসাদ থেকে কারাগারের ফটক মাত্র এক শত কদম দূরত্বে। কারাগারটি বিবিধ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। রাজনৈতিক বন্দীরা একেবারে সামনের চত্বরে বাস করত, তাদের কোনো শৃঙ্খল কিংবা হাতকড়া পরানো হত না। দিবাভাগে তারা স্বাধীনভাবেই চলাফেরা করতে পারত, এবং রাত্রে প্রত্যেককে তার জন্য সুনির্দিষ্ট বিলাসবহুল কক্ষে বন্ধ করা হত। বহুবিধ সুযোগ সুবিধা তারা উপভোগ করত। ইতোমধ্যে বসুদেবের ছয় সন্তানকে অনায়াসে হত্যা করতে পেরে কংস বড়োই প্রীত হয়েছিল। বসুদেবও এই বন্দীদশা শান্তভাবেই স্বীকার করেছিলেন। রাজকীয় এক কারাগারে অন্তরীণ বই তো নয়? কারাগারে তাঁর পৃথক কক্ষ ছিল, এবং যখন ইচ্ছা তিনি স্বগৃহে গমন করতে পারতেন। কারারক্ষীরা সকলেই তাঁর অনুগত।

‘রোহিণী তিন দণ্ডের মধ্যেই উপস্থিত হলেন। প্রাসাদ থেকে কারাগার পদব্রজে সামান্যই।

“রোহিণী, আমি চাই তুমি নন্দ উপবনে গিয়ে বসবাস কর”, বললেন বসুদেব।

“কী হেতু, আর্য? মথুরায় আমরা সুবিধামতো সাক্ষাৎ করতে পারি। যমুনার ওই পাড়ে নন্দ উপবনে চলে গেলে তো আমি মাসের পর মাস তোমার দেখা পাব না। এখানে রয়েছি বলেই দ্রুত তোমার নিকট চলে আসতে পারি”, রোহিণী আপত্তি ব্যক্ত করলেন।

‘বসুদেব চিন্তামগ্ন হলেন। “দেখ রোহিণী, ধর্মরক্ষার্থে আমাদের সকলকেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভিন্ন কর্তব্য পালন করতেই হয়। যুগে যুগে বার বার অশুভ শক্তির কবলে আমরা পড়ি, এদেরকে একক প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা অসম্ভব। উপদেশ – অভিভাবন হয়তো আমরা পাই, কিন্তু কর্মানুষ্ঠানের দায়িত্ব নিজেদেরই। তোমাকে আমি অনুরোধ করছি, ধর্মযজ্ঞে নিজভাগের আহুতিটুকু দাও।”

“হেঁয়ালি কোরো না, হে আর্যপুত্র। যদি তুমি মনে করো ধর্মের কোনো উপকারে আমি আসতে পারব, অবশ্যই আমি সেথা যাব। কিন্তু অর্ধাঙ্গিনীকে সমস্ত পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা তোমার কর্তব্য। কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছ তুমি?”, প্রতিপ্রশ্ন করলেন রোহিণী।

“কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ঠ হত চলেছে। আমি চাই তুমি নন্দ উপবনে তাকে নিজের সন্তানরূপে বড়ো করে তোল। মথুরা থেকে তুমি দূরে থাকলে তোমার গর্ভধারণের সংবাদ অধিক বিশ্বাসযোগ্য হবে। এমনিতে আমরা যে একসঙ্গেই দিন যাপন করছি তা তো কারোর অজানা নয়। দয়া করে সম্মত হও, রোহিণী।”

‘পরের দিনই রোহিণী নন্দ উপবনের অভিমুখে যাত্রা করলেন। প্রথমেই গেলেন গোকুল – প্রধান নন্দরাজের সকাশে। বসুদেবের তালুকে স্বচ্ছন্দে বসবাস করার সমস্ত ব্যবস্থা রোহিণীকে করে দিলেন নন্দ। নন্দজায়া যশোদার সঙ্গেও তাঁর বেশ সখ্য স্থাপিত হল। প্রায়শই তাঁরা একত্রে কালাতিপাত করতেন। এদিকে রোহিণী গর্ভধারণের অভিনয় করায় যশোদা তাঁর প্রতি সমধিক মনোযোগী হয়ে পড়লেন। তিনি রোহিণীর অনুজা, এক দশক পূর্বে বিবাহ হলেও অদ্যপি তিনি সন্তান সুধারসে বঞ্চিত।

দেবকীর সপ্তম সন্তানের জন্মকাল যখন নিকটে, বসুদেব ততদিনে সমস্ত প্রস্তুতি সমাধা করেছেন। স্বধর্ম অগ্রাহ্য করে এমন কপটতা অবলম্বন করা তাঁর পক্ষে বেশ কষ্টকর ছিল, এমনকী দেবকীও তাঁর শঠতাকে প্রশ্ন করতে পিছপা হন নি। বসুদেব ভাবলেন, কংসকে নিজের অষ্টম সন্তান অর্পণ করবেন এমন বচন দেওয়া সত্ত্বেও সে তাঁকে ধর্মাধিকারী পদচ্যুত করেছে। অতএব, স্বধর্ম অপেক্ষা শ্রেয় হল রাষ্ট্রধর্মের বৃহত্তর, মহত্তর আদর্শ। কংসের বিনাশ প্রয়োজন ভারতবর্ষের স্বার্থেই। তাঁর অষ্টম সন্তান রক্ষা পেয়েছে এমন সংবাদই কংসকে মৃতবৎ করতে যথেষ্ট, জানতেন বসুদেব। ক্ষমতার মোহডোরে কংস এতদূর জড়িয়ে পড়েছে যে সমস্ত হারানোর আশঙ্কা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এদিকে বৃষ্ণি, কুকুর সহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্রোহের আভাস স্পষ্ট। মগধের সেনা আর বাণকণ্টকের অনুগামীদের অকথ্য নির্যাতনে ক্রুদ্ধ মথুরা টগবগিয়ে ফুটছে। ধর্মযুদ্ধের প্রান্তরে স্বধর্ম বলি দেওয়া বসুদেবের অবশ্য কর্তব্য।

‘সপ্তম সন্তানটিকে সঙ্গোপনে রোহিণীর নিকট প্রেরণ করে একটি মৃত সদ্যোজাতকে তার স্থলে রাখা হল। বৃষ্ণিরা একাজে সর্বতোভাবে সহায়তা করল। কিন্তু মৃত সন্তান প্রসবের কাহিনীতে কংসের সন্দেহপ্রবণ মন স্বভাবতই উচাটন হল।

‘সত্বর সে কারাগারে বসুদেবের কক্ষে পদার্পণ করল। সত্য উদ্ঘাটনের নিমিত্ত বসুদেবকে সে বারংবার সদ্ধর্মের প্রতি দায়বদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দিল। ক্রূরসেন আবার জানাল যে তার গণনা অনুযায়ী মৃত শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা নয়। কংস আরও উৎকণ্ঠিত হল।

‘তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল। বসুদেবকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেবকীর সঙ্গেই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক কক্ষে আটক করল কংস।

‘এক বৎসর অতিক্রান্ত। দেবকীর গর্ভে অষ্টম সন্তান আবির্ভূত। এ যাত্রায় মাগধীয় কর্মকর্তাদের প্রহরাধীন বন্দীদশা ছিল বড়োই ক্লেশকর। কংস বিনিদ্র রজনী যাপন করছিল। কিন্তু, যাদব প্রহরীদের আনুকুল্যে বসুদেব পূর্ববৎ প্রায় সকল সুবিধাই ভোগ করতেন। অন্যদিকে, মহর্ষি গর্গাচার্যের শিষ্যগণ নন্দরাজের সঙ্গে বৈঠক করলেন। স্থির হল, বসুদেব তাঁর অষ্টম সন্তানটিকে রক্ষা করার শেষ একটা চেষ্টা করবেন। সজ্ঞান কর্ম ব্যতিরেকে উদ্দেশ্য সাধনের আশা বসুদেবের ছিল না। তিনি নিরুদ্দেশ্য ও নিষ্কাম কর্মের পার্থক্য অবগত ছিলেন। একবার অন্তত চেষ্টা করা তাঁর কর্তব্য, নিশ্চিত ছিলেন তিনি। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা মানুষের অনুগত নয়। কর্মের প্রচেষ্টা স্থিরনিশ্চিত, তথাপি ফলাফল সর্বদা অনিশ্চিতই হয়ে থাকে।

‘সদ্য রক্ষা বন্ধন পেরিয়ে গেছে। ভাদ্রপদের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে দিনের আলো ফুটল। কিন্তু ঊষার আগে থেকেই আকাশ ঘন ঘোর করে বর্ষণ অব্যাহত। জ্ঞানত মথুরাবাসী এহেন বৃষ্টি প্রত্যক্ষ করে নি।

‘বসুদেব দুশ্চিন্তাকুল হলেন। পরিকল্পনা প্রস্তুত, এমনকী মাগধীয় কারাকর্তাদের মাদক সেবন করানোর ভাবনাও তাঁর মাথায় ছিল। প্রাসাদ সংলগ্ন ঘাটে তাঁর তরীও তৈরি। কিন্তু কীভাবে তাঁর প্রতিনিধিরা শিশুটিকে হস্তান্তর করবে, তা নিয়েই যত চিন্তা। গতবারে রোহিণী সমস্তই অবহিত ছিলেন, ফলে সমস্যা হয় নি। কিন্তু এমত অঝোর বর্ষণ চললে কার্যসিদ্ধি সহজ হবে না মোটেও।

‘বৃষ্টি কিন্তু ক্ষান্ত হল না, ফলে বসুদেবের যাবতীপ্রচেষ্টার সাফল্য বড়োসড়ো প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। মথুরার পথে পথে উত্তাল জলপ্রবাহ। কারাঙ্গন বারিমগ্ন। মধ্যরাতের সামান্য পূর্বে দেবকীর প্রসব বেদনা শুরু হল। উচ্চ কোনো স্থানের সন্ধানে মগধের কর্তাব্যক্তিরা কারাগার ত্যাগ করেছেন ততক্ষণে। ফলে প্রহরার দায়িত্বে কেবল বসুদেবের অনুগত মথুরার রক্ষীগণ।

‘ঠিক মধ্যরাত্রে তাঁর অষ্টম সন্তানের জন্ম দিলেন দেবকী। প্রহরা শিথিল, কারণ প্রবল দুর্যোগের মধ্যে প্রহরীদের কাজকর্মে নজর রাখার কেউ নেই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধাত্রীও আসতে পারে নি, সুতরাং কংসও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। যমুনার জলস্রোত যাতে রাজপ্রাসাদকে গ্রাস না করে, সেই চিন্তায় সে তখন ব্যতিব্যস্ত।

‘বসুদেব যখন শিশুটিকে সুরক্ষিত এক পেটিকায় রাখলেন, দেবকী তখনও ব্যথাতুর। জলপ্রবেশ রুখতে পেটিকাটি ভালোভাবে বস্ত্রাচ্ছাদিত, কেবল প্রশ্বাসের অল্প বন্দোবস্ত রয়েছে। ওটি নিয়ে বসুদেব গমনোন্মুখ হলেন, হয়তো বা তখন ভাবছেন এভাবেই এক স্বৈরাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে মানবতা।

‘সেই মুহূর্তেই সর্বশক্তি দিয়ে দেবকী তাঁকে আহ্বান করলেন। শিশুটির মুখ তিনি একটিবার দর্শন করতে অত্যাগ্রহী। পূর্বের সাত সন্তানের মুখদর্শন না করার চরম বেদনাভারে তিনি ন্যুব্জ। প্রায়ান্ধকার সেই অবস্থাতেই বসুদেব পেটিকা তাঁর নিকটে আনলেন।

‘অলৌকিক ভাবেই যেন ঠিক তখনই গগনভেদী এক বিদ্যুচ্চমকে চতুর্পার্শ আলোকিত হল। ঈষৎ শ্যামলা শিশুটির দুষ্টু মিষ্টি দৈব হাসিতে যেন দেবকীর হৃদয় জুড়িয়ে গেল। ওই এক পলেই যেন শাশ্বতকে দর্শন করলেন তিনি, আর তৎক্ষণাৎ পরমানন্দ সাগরে নিমজ্জিত হলেন।

‘পেটিকা মস্তকে ধারণ করে বসুদেব জলরাশি অতিক্রম করে পূর্বোল্লিখিত ঘাটে উপস্থিত হলেন। অথচ, নৌকাটি তত্র দেখা গেল না। ততক্ষণে যমুনা দশ হস্ত উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিকষ অন্ধকার, দুর্বার বর্ষণ, ওদিকে গৃহে সকলে শায়িত। ধর্ম রক্ষার এ অভিযানের গোপনীয়তা ভঙ্গ করতে চাইলেন না বসুদেব।

‘এক অজানা আশঙ্কায় তাঁর হৃদয় কম্পিত।

‘কী আর করা? তিনি নিজগৃহে স্বকক্ষে ফিরলেন। সে কক্ষেও তখন জলের প্রবেশ আরম্ভ হয়েছে। বসুদেব পার্শ্ববর্তী কক্ষে প্রবেশ করতেই – কিমাশ্চর্যম্! তরীটি ওইখানেই রয়েছে! বন্যার কারণে তিনি সেটিকে কক্ষ থেকেই সোজা ভাসিয়ে নদীবক্ষে নিতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না ভাটিতে যমুনা তাঁকে কতদূর নিয়ে যাবে, এদিকে গোকুল সামান্য উজানে।

‘নৌকাটি মধ্যম আকারের, সুঠাম ও নিরাপদ। দাঁড় বাইতে লাগলেন বসুদেব। একাজে তাঁর জুড়ি মেলা শক্ত, তথাপি নদীর প্রস্থ বরাবর সরলরেখায় অগ্রসর হওয়া যে কারোর পক্ষেই দুঃসাধ্য। বসুদেবকে সর্বশক্তি ও সর্বপ্রকার কৌশল প্রয়োগ করতে হল। কিয়ৎক্ষণ পরে বৃষ্টি থামল। ঝঞ্ঝাবাত শান্ত হল। এরপরেও স্রোতের সঙ্গে বসুদেবের যুদ্ধ অব্যাহত রইল। অর্ধপ্রহর ব্যাপী প্রচণ্ড সংগ্রাম শেষে বসুদেব বিপরীত তীরে উপনীত হলেন। স্রোতে যাতে ভেসে না যায় সেজন্য নৌকাটিকে নদীবক্ষ থেকে উত্থাপিত করলেন। অনন্তর সন্তানকে নিয়ে নন্দ উপবনের লক্ষ্যে অগ্রসর হলেন।

‘দ্রুত পদচালনায় এক দণ্ডের কিছু বেশি ব্যয় হল নন্দর গৃহে পৌঁছাতে। নন্দ যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত। ফলে তাঁর গৃহটি খড়ে ছাওয়া, সাধারণ ধাঁচের। তবে গ্রমের অপরাপর গৃহের তুলনায় বৃহত্তর।

‘শিশুটির জন্মের ঠিক এক প্রহর বাদে নন্দর দ্বারে করাঘাত করলেন বসুদেব।

(ক্রমশ)

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রী জয়জিৎ কর

সৌজন্য: Bloomsbury India