দ্বিতীয় অধ্যায়: চার্মণ্যবতী

0
701

অনুবাদক: বৈষ্ণবাচারী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অস্তি তন্দ্রা কাটাতে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন। তিনি প্রাপ্তি আর প্রবলের কথাবার্তা কিছুই শোনেন নি। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি? কেন রথ এতো জোরে যাচ্ছে? আর একটু আস্তে যাওয়া যায় না? আমি তো ঝাঁকুনির ঠেলায় মরেই গেলাম।”

প্রাপ্তিই যেন জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ভূমিকা নিলেন। “দিদি, চিন্তা কোরো না। আমরা কাশীতে যাচ্ছি। ঠাকুমার শরীর খারাপ। তাই তিনি নিজের বাপের বাড়িতে এসেছেন। ধবলপুরী (বর্তমানের ঢোলপুর) ঘাট থেকে শীঘ্রই নৌকা ছাড়বে। প্রবল কাকা এইজন্য এতো হুটোপাটি করছেন। ওনার ব্যবহার একটু বেশিই রূঢ়। আমরা কাশী গিয়েই এ নিয়ে কথা পাড়ব।”

রথ আবার যাত্রা শুরু করল। প্রাপ্তি বিষণ্ণ। কংসের পরিবারে নারীদের ভূমিকা মগধের মত নয়। মগধে নারী পুরুষের সমান বলেই গণ্য হয়। রাজপুত্র আর রাজকন্যার শিক্ষায় কোন ভেদ থাকে না। রাজকন্যাদের নিজের পছন্দসই বিষয় নিয়ে চর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, এমনকি যুদ্ধে সেনানায়কের পদেও তারা বহাল হয়। প্রাপ্তি নিজেও এক ছোট সৈন্যদলের নেত্রী ছিলেন যখন অস্তি সঙ্গীত আর নৃত্যচর্চা করতেন। মথুরায় তাদের বিগত দশ বৎসর কেটেছিল ঠিক এর বিপরীতভাবেই। প্রথম প্রথম তাঁরা মগধদেশের মতই স্বাধীনতা ভোগ করতেন। প্রাপ্তিও মথুরা সেনাবাহিনীর সাথে অস্ত্রচর্চা করতেন। তারপর কংস বদলে গেলেন। এক কিম্ভূত মুনির প্রভাব কংসের উপর বাড়তে লাগল।

অন্তঃপুরে তখন গুজব এই যে রাজা সনাতন ধর্ম পরিত্যাগ করেছেন এবং কিম্ভূত এক সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছেন। তিনি একবার ভগ্নীদ্বয়কেও বলেছিলেন এই কিম্ভূত সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। তাঁরা রাজী হননি। কংস মথুরার এক শিবমন্দির ধ্বংসের সাথেও যুক্ত ছিলেন। শিবভক্তকন্যা হিসাবে রাজকন্যারা গর্বিত ছিলেন। তাঁদের একাজ ভালো লাগেনি এবং পিতাকে জানিয়েও ছিলেন। জরাসন্ধ তাঁর বিরক্তি জানাতে কংসের কাছে দূতও পাঠিয়েছিলেন। কংস অন্য কোন শিবমন্দির স্পর্শ করার স্পর্ধা করেন নি, কিন্তু এর পরেও অন্যান্য মন্দির ভাঙার ষড়যন্ত্রে সামিল ছিলেন। মথুরার মানুষ কংসকে রাক্ষস বলে ডাকা শুরু করল।

কংস যাদব সৈন্যবাহিনীকে ভরসা করতেন না। এই বাহিনীতে ছিল বহু গোষ্ঠীর সৈন্য। বেশির ভাগ যোদ্ধা ছিল বৃষ্ণিগোষ্ঠীর। তাঁর সম্পর্কিত ভগ্নী দেবকীর স্বামী বসুদেবও ছিলেন বৃষ্ণি, কাজেই কংস তীব্র আশংকায় ভুগতেন। নিজের দেহরক্ষী হিসেবে তিনি কেবল মগধের রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করতেন। মগধ মল্লযোদ্ধাদের তিনি পোষণ করতেন এবং তাদের বলেই বলীয়ান হয়ে জনসাধারণকে ভয়ভীত করে রাখতেন।

মথুরার রাজার যাদব সৈন্যবাহিনীর উপর কোনই কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ছিল না। আঠারোটি যাদব গোষ্ঠী যে সৈন্য পাঠাত, তারাই সম্মিলিত ভাবে যাদব সৈন্যবাহিনী হিসাবে পরিগণিত হত। মহারাজ কংস যে তাঁর শ্বশুরের সাহায্য ব্যতীত রাজমুকুট রক্ষা করতে পারবেন, এমনটি ছিল অসম্ভব। মগধের শক্তিশালী রক্ষীবাহিনীর সুরক্ষাকে ভেদ করে কিভাবে এক গোয়ালার পক্ষে তাঁকে হত্যা করা সম্ভব? কংস নিজেও ছিলেন মহারথী। মথুরায় জরাসন্ধের আক্রমণের সময় তাঁর বীরত্বে জরাসন্ধ হয়েছিলেন মুগ্ধ। এই বীর যুবকটির হাতে নিজের দুই কন্যারত্নকে সমর্পণ করতে জরাসন্ধ মনস্থির করেন। জরাসন্ধ কংসবধের সংবাদে যে গভীরভাবে চিন্তিত হবেন তা নিঃসন্দেহ।

প্রাপ্তির মনে পড়ে গেল যে সব অশুভসংকেত তিনি দিনকয়েক আগে দেখেছিলেন। কুলগুরু গর্গাচার্যের কাছে নিজের ভয় ব্যক্ত করতে তিনি দেখা করেন। গর্গাচার্যের সীমাহীন ক্রোধ ছিল কংসের উপর। কারণ কংস সনাতন ধর্মকে উপেক্ষা করতেন এবং প্রকাশ্যে এক কিম্ভূত সম্প্রদায়কে মদত দিতেন যারা আপন সম্প্রদায়ে ধর্মান্তরিত হতে নারাজ ব্যক্তিদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়। তিনি তাঁর ক্রোধের কারণে মথুরা ছেড়ে পাঞ্চাল চলে যান এবং কিয়দ্দিন পূর্বে মথুরায় ফিরে এসেছেন। এই সম্প্রদায়টি তাঁর আশ্রম আক্রমণও করে।

কারাগারে আপন ননদ দেবকীর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ গর্গাচার্যই প্রাপ্তিকে দেন। দেবকী তখন প্রাপ্তিকে নিজের উপরে হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন। দেবকী প্রাপ্তিকে জানান কিভাবে তাঁর ভ্রাতা এবং প্রাপ্তির স্বামী দেবকীর ছয় পুত্রকে বধ করেছেন। তাঁরা সনাতন সংস্কৃতিতে নারীর ভূমিকা নিয়েও কথাবার্তা বলেন। “প্রাপ্তি,” দেবকী বলেন, “নারী এবং পুরুষ হল একই সমগ্রের দুই অংশ। নিজের কর্মচক্রের অঙ্গ হিসাবে নারী না হয়ে জন্মে কখনও কারুর মোক্ষপ্রাপ্তি অসম্ভব।”

“ঠিক বলেছ, দিদি। কিন্তু তোমার ভাই এখন কোন এক দুষ্ট মায়ার বশীভূত। কুটিল মুনি তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন যে সৃষ্টিকর্তা পুরুষকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছেন। সেই শিক্ষার জন্যই তিনি ভাবেন যে যদি তিনি কুটিল মুনির সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন তবে তাঁকে সৃষ্টিকর্তা পুরষ্কৃত করবেন। দাদা বসুদেব এবং তোমার উপর তিনি যেরকম পাশবিক অত্যাচার দিনের পর দিন করেছেন, তা জেনে আমি তাঁর গতি নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন।”

“আমার কথা মিলিয়ে নিও প্রাপ্তি,” দেবকী বললেন, “এই নির্যাতনও বিশ্বপ্রপঞ্চের দশা-প্রতিদশার অঙ্গ। কংস, তার আচার্য বা তার সম্প্রদায় আপন কর্মের দ্বারা যে কর্মফল সৃজন করছে, সেই কর্মফল তাদের ভোগ করতেই হবে, কোন নিস্তার নেই। কুটিল মুনির এই জ্যোতিষ শিষ্যটি তার হাতের পুতুল মাত্র। সে ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে আমার গর্ভের অষ্টম পুত্র কংসকে বধ করবে। কংস এখন আবিষ্কার করেছে যে আমার ছেলে নন্দ-যশোদার ঘরে মানুষ হচ্ছে। জানি না, সেই সময় এসেছে কিনা।”

তাঁর স্বামীর ভাগ্যবিপর্যয় শুরু হল কি না এই ভাবতে ভাবতেই প্রাপ্তি কারাগার থেকে ফিরে এলেন। জ্যেষ্ঠা ভগিনী এবং প্রধানা মহিষী অস্তি তাঁর এই ভাবনাকে কোন গুরুত্বই দিলেন না। স্বামীর বীরত্বের প্রতি অস্তি সম্পূর্ণভাবে আস্থাশীল। একবার তো অস্তি প্রাপ্তিকে বলেই বসেছিলেন যে কুটিল ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার জন্য। প্রাপ্তি পুরোপুরি বেঁকে বসেছিলেন আর বলেছিলেন যে তাঁদের পিতা বর্তমান কালের শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত জরাসন্ধের কাছে এক দূত প্রেরণ করে ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারে মত জিজ্ঞাসা করবেন। অস্তি প্রাপ্তির সঙ্গে বুদ্ধির ধারেভারে পেরে উঠতেন না। কাজেই আপন প্রস্তাব থেকে পিছু হঠলেন। তাঁরা তাঁদের মগধের কুলগুরু আচার্য চন্দ্রকৌশিকের যা কিছু সনাতন ধর্মাঙ্গীভূত আচার শিখেছিলেন, সে সবই পালন করে যেতে লাগলেন।

আজ প্রাপ্তির নিজ জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে আপন ছত্রছায়ায় রক্ষা করার পালা। জ্যেষ্ঠ ভগিনীকে নিজের কনিষ্ঠা ভগিনী ভেবে তাঁকে যতনভ’রে আগলে রাখতে হলেন তৎপর। “প্রবল কাকাকে নিয়ে কোন সন্দেহ না করাই ভালো। আমাদের ভালোমন্দ নিয়ে ওনার চেয়ে কেই আর বেশি ভাবে? কাকাবাবু, চলুন আমরা এগুতে থাকি।”

অশ্বগুলিকে জলঘাস খাওয়ানো শেষ। রথ আবার চলতে শুরু করল। রথ যখনই চলতে শুরু করল বামদিকের জঙ্গল থেকে শোনা গেল খস্ খস্ ধ্বনি। প্রবল এবং তাঁর সঙ্গী চার অশ্বারোহী যোদ্ধা নিমেষে সতর্ক দৃষ্টিতে পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। রথও থামল।

কয়েকটি দীর্ঘ মুহূর্তের বিরতি। এই অল্প সময় দুই মহারানীর কাছে দীর্ঘ উৎকণ্ঠায় প্রহরপ্রতিম লাগছিল। তাঁরা পরিশেষে অবলোকন করলেন, এক ভল্লুক পরিবারকে। পরিবারটি তাঁদের থেকে দূরে পালাচ্ছিল। হয়তো এই সদ্যই শীতঘুম থেকে তারা উঠেছে। দু’পাশের জঙ্গল মাঝারি আর ছোট্ট বৃক্ষে পরিপূর্ণ। জনপদের পল্লীগুলি জঙ্গল পরিষ্কার করে স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছে। পল্লীর চারিপার্শ্বে বিস্তৃত কৃষিজমি। এই সতর্ক ক্ষুদ্র দলটি জঙ্গল পথেই পরিভ্রমণ করছিল। বিপদ কখন আসে কেই বা জানে। রথ চলতে শুরু করা মাত্র অস্তি আবার নিদ্রামগ্ন হলেন।

প্রায় ছয় ঘটিকার সময় তাঁরা নদীটিকে দেখতে পেলেন। দুই তীর এবং নদীর মধ্যস্থল প্রস্তর সমাকীর্ণ। চার্মণ্যবতী।

ধবলপুরী ঘাট মৎস্যরাজ্যের বাণিজ্য স্থল। এখান থেকে দুই রানী এবং তাঁদের সুরক্ষাবাহিনী কাশীগামী এক নৌকায় আরোহণ করলেন।

রাজমহিষীরা যেমন প্রমোদতরণীতে ভ্রমণ করে অভ্যস্ত, এই নৌকাটি সেরকমটি একেবারেই নয়। নিতান্তই সাধারণ এক নৌকা। পণ্যবহনের জন্য শ্রেষ্ঠীরা ব্যবহার করেন এ রকম নৌকা। নৌকার ডানদিকে এককোণে অভিজ্ঞ নাবিকদের জন্য একটি বিশ্রামাগার বানানো ছিল। চার কাঞ্চনমুদ্রার বিনিময়ে স্থানটি রানীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে নাবিকরা।

নৌকা বেগে চলছিল। নৌকার কর্ণধার ছিলেন দিকনির্দেশে পটু। তাঁর লক্ষ্য ছিল দ্রুত এগিয়ে রাত্রির আগেই তিন যোজন দূরত্ব অতিক্রম করা। নদীটি ছিল কুমীরে পরিপূর্ণ। এরা নৌকার ক্ষতিসাধনও সময় সময় করে থাকে।

নৌকায় পাল ছিল ছয়টি। মৃদুমন্দ পশ্চিমী বায়ু বইছিল। বাতাসের ধাক্কায় নদীর স্রোতের অনুকূলে নৌকা তর তর করে এগুতে লাগল।

নৌকার কর্ণধারের বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ বৎসর। তিনি সময় সময় রানীদের কাছে এসে তাঁদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের খবর নিতে লাগলেন। প্রায় আড়াইঘটি (একঘণ্টা) নৌকাযাত্রার পরে অস্তি আবার সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। সূর্য নৌকার পিছনে আস্তাচলে যাওয়ার পথে। স্পষ্টতঃই নৌকা যাচ্ছে পূর্বদিশায়।

নৌকার কর্ণধার এরপর যেই রানীদের কাছে এলেন, অস্তি জিজ্ঞাসা তাঁকে করলেন, “মহাশয়, কাশী পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে?”

ভারতবর্ষের নদী

“মহারাজ্ঞি, কাল রাত নামার আগেই আমাদের কাশী পৌঁছে যাওয়া উচিৎ। আজ রাতে আমরা একচক্রপুরের কাছে (বর্তমান এটাওয়া) যমুনায় পড়ব। তার আগে আমরা সিন্ধুবতী (বর্তমান সিন্ধু) আর তার পরে বেত্রবতী (বেতয়া) এবং কেন্দ্রবতীর (কেন) মোহনা পার হয়ে যাব। সকালে রাজপুরীতে (বর্তমান রাজাপুর) আমরা থামব। দুপুরে কৌশল রাজ্যের প্রয়াগে আমরা অনেকক্ষণ থামব। আর কাশীতে পৌঁছব রাত্রির আগেই। তবে হ্যাঁ, বুঝতেই পারছেন, বায়ুর বেগের উপরই সবকিছু নির্ভর করছে।”

প্রাপ্তি গুম হয়ে ছিলেন। পুরো দিনের ঘটনাগুলিকে তিনি স্মরণ করছিলেন। অস্তি তাঁর মুখ থেকে কোন কথা শোনার জন্য ব্যগ্র। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে মৌনব্রতী। কাশী আগমনের পূর্বে তিনি দিদিকে কিছু জানাবেন না, এই তাঁর সংকল্প। রাত ঘনিয়ে এল। অস্তি তাঁর জন্য প্রস্তুত বিছানায় নিদ্রামগ্ন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রাপ্তিও নিদ্রার কোলেই আশ্রয় নিলেন।

প্রভাতসন্ধ্যার সময়ই প্রাপ্তির ঘুম ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার কমে আসছে। নদীর দুইপার্শ্বে বৃক্ষের সারিগুলি নদীর আঁচলের মতো শোভা পাচ্ছে।

নৌকা রাজপুরীতে থেমেছে। রাজকীয় তরণীতে নৌকাতেই সমস্ত কৃত্য করা যায়। এইখানে নদীর ঘাটে যাত্রীদের ভোজনের ব্যবস্থা আদি আছে। রানীরা সাধারণ প্রজাদের মত নদীর ঘাটে প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করলেন। কি বিচিত্র পৃথিবী! চিরদিন যাঁরা রাজবিলাসে দিনপাত করেছেন, তাঁদের আজ বিলাসী জীবনকে স্বপ্নসম মনে হচ্ছে।

স্বল্পবিশ্রামের পর নৌকা যাত্রা পুনরারম্ভ করল। প্রায় বারো ঘটিকা (পাঁচ ঘণ্টা) যাত্রার পরে, তাঁরা প্রয়াগে পৌঁছালেন। প্রয়াগ কৌশল রাজ্যে অবস্থিত। কাশীরাজ্যের সীমানা শুরু প্রয়াগের পর থেকেই। রাজকীয় ঘাটে নৌকা বাঁধা হল। ঘাটটি ছিল গঙ্গার বামতীরে, গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর পবিত্র সঙ্গমের পরই। অস্তি কিন্তু প্রজ্ঞা, সঙ্গীত এবং কলার দেবী সরস্বতীর একনিষ্ঠ ভক্ত। বহু লোককে তিনি প্রশ্ন করেছেন তাঁর প্রিয় দেবীর নামাঙ্কিত এই নদী কিভাবে প্রয়াগে এসেছে। তাঁর পিতা তাঁকে একদা বলেছিলেন যে প্রবলা প্রবাহিনী সরস্বতীর উৎস হিমালয়ের শ্যামল বনের কাছে  শতদ্রু নদীর নিকটে। একদা কংস তাঁর দুই মহিষীকেই মদ্রদেশের রাজধানী জলন্ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পথে তাঁরা সরস্বতী অতিক্রম করেন। সরস্বতী শীতকালে তখন এক ক্ষীণস্রোতা নদী। এই নদীর উৎস শিবালিক। অস্তির মনে পড়ে গেল, সে সময় তিনি তাঁর বিশেষ প্রার্থনাটি দীর্ঘ অনুষ্ঠান সহ বলেছিলেন। কংস আর প্রাপ্তি দু’জনেই এই দীর্ঘ অনুষ্ঠানে প্রতীক্ষার সময় বিরক্ত হয়েছিলেন। কোনরকমে অস্তিকে তাড়া দিয়ে তাঁরা মা সরস্বতীর প্রার্থনা শেষ করান। আজ আবার সুযোগ এসেছে অস্তির সামনে তিনি তাঁর প্রিয় দেবীর অন্তসলিলা রূপকে স্মরণ করার জন্য।

অস্তি প্রাপ্তিকে বললেন তাঁর অন্তরের ইচ্ছা। মোহনায় যেখানে শুভ্র গঙ্গা নীল যমুনায় মিশেছে সেখানে নেমে প্রার্থনা করতে যেতে চান অস্তি। তীব্র বাস্তববাদী প্রাপ্তি বুঝতে পারলেন যে যদি অস্তি তাঁর সেই দীর্ঘ প্রার্থনা শুরু করেন, তবে তাঁদের কাশী পৌঁছানোয় বিলক্ষণ বিলম্ব তো হবেই, কাশী পৌঁছানো হয়ত আর হয়ে উঠবে না। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর।

“দিদি এটা যে মলমাস। আজ তো দেবীকে আমরা প্রণাম করতে পারি না কারণ তাঁরা তো রজস্বলা। এই সময় তাঁর জন্য ধ্যানের সময়। তাঁকে তো আমরা বিব্রত করতে পারি না,” প্রাপ্তি বললেন।

প্রবল প্রাপ্তির উপস্থিত বুদ্ধিতে বিস্ময়ান্বিত হলেন। তিনি কয়েক বিঘটিকার (৬০ বিঘটিকায় এক ঘটিকা। এক বিঘটিকা = ২৪ সেকেণ্ড) মধ্যেই নৌকার যাত্রা শুরু করলেন। নদী আরো প্রশস্ত হচ্ছে, স্রোতস্রিনীর স্রোত ক্রমশঃ খরতর এবং বাতাস তীব্রতর। নৌকা বেগে কাশীর দিকে চলতে লাগল।

ছয় ঘটিকার মধ্যেই, মথুরার দুই মহারানী অসি নদীর মুখে কাশীর সাইমবেদ ঘাটে নামলেন। ঘাটের এক অংশ রাজপরিবারের জন্য সংরক্ষিত আছে। তাঁদের প্রপিতামহ আর জীবিত নেই। কিন্তু পারিবারিক সম্বন্ধ আজও তেমনটাই গাঢ় আছে।

যখন তাঁরা নৌকা থেকে নামছিলেন, এক অবধূত রাজমহিষীদের সামনে দিয়ে পার হচ্ছিলেন। তিনি মন্দিরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে বললেন, “কৃষ্ণম্ বন্দে জগদ্গুরুম্।”

প্রাপ্তির দমবন্ধ লাগতে লাগল। তাঁর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে এল।

(ক্রমশ )

 

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রীমতী পৌলমী গঙ্গোপাধ্যায়

সৌজন্য: Bloomsbury India