রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার অর্ণব গোস্বামী: এখন গণতন্ত্র বিপন্ন নয়?

0
1288

 

প্রজ্ঞা পারমিতা 

 

রায়গড় পুলিশ মুম্বইয়ের বাসভবন থেকে বুধবার ৪ নভেম্বর, ২০২০ রিপাবলিক টিভির মালিক ও মুখ্য সম্পাদক অর্ণব গোস্বামীকে একটি দু’বছর পুরনো আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মামলায় গ্রেফতার করেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোস্বামীকে রায়গড় তুলে নিয়ে গিয়েছে।

গোস্বামীর সাথে আরও দু’জন ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছে, তাদের নাম ফিরোজ শেখ এবং নিতেশ সারদা। এই দু’জনের নাম আত্মঘাতী ইন্টেরিওর ডিজাইনার এবং আর্কিটেক্ট অন্বয় নায়েক ও তাঁর মায়ের সুইসাইড নোটে উল্লেখ রয়েছে। নায়েক এবং তাঁর মা—গোস্বামী, শেখ ও সারদার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে তাঁদের সংস্থার জন্য করা কাজের পাওনা বকেয়া টাকা মিটিয়ে না দেওয়ায় বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আত্মহত্যার ঘটনার পর নায়েকের স্ত্রী অক্ষতা, অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে মামলা রজু করে এবং সোশাল মিডিয়ায় রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে একাধিক ভিডিও পোস্ট করেন বলে অভিযোগ করেছেন।

অন্বয় নায়েক কে এবং ঠিক কী ঘটেছিল?

২০১৮ সালের মে মাসে অন্বয় নায়েক এবং তাঁর মা কুমুদ নায়েককে আলিবাগে তাঁদের বাসভবনে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। অন্বয় ছিল কনকর্ড ডিজাইন প্রাইভেট লিমটেড কোম্পানীর ম্যানাজিং ডিরেক্টর। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, অন্বয়ের পরিবারে বর্তমানে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা রয়েছে।

এই ঘটনায় তদন্তকারী রায়গড় পুলিশের অনুমান অন্বয় প্রথমে তাঁর মাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে এবং পরে নিজে আত্মহত্যা করেছে। তদন্তে নেমে পুলিশ একটি ইংরেজিতে লেখা সুইসাইড নোট খুঁজে পায়, যেখানে অন্বয় তিনটি কোম্পানীর নাম উল্লেখ করে। এই নোট অনুযায়ী রিপাবলিক কর্তৃপক্ষের থেকে তাঁর ৮৩ লক্ষ টাকা এবং অন্য দুটি ফার্ম থেকে মোট ৪ কোটি ও ৫৫ লক্ষ টাকা বকেয়া ছিল।

২০১৯ সালের এপ্রিলে, তদন্তকারী দল স্থানীয় রায়গড় পুলিশ একটি রিপোর্ট জমা করে এবং উল্লেখ করে যে সুইসাইড নোটে উল্লেখ করা অর্ণব গোস্বামী ও অপর দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপর অন্বয়ের স্ত্রী অক্ষতা ও মেয়ে আদন্যা সোশাল মিডিয়ায় একাধিক ভিডিও পোস্ট করে যেখানে তারা মহারাষ্ট্রের ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত তৎকালীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযোগ করেন যে, প্রশাসন গোস্বামীর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

২০২০ সালের মে মাসে, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও কংগ্রেস-এনসিপি জোট রাজ্যে ক্ষমতায় এলে, কংগ্রেস দল টুইটারে অক্ষতার সেই ভিডিও শেয়ার করে এবং রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করে।
২৬ মে মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখ এই টুইটকে রিটুইট করেন এবং ঘটানটি নিয়ে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আশ্বাস দেন।

 

”বিকৃত ঘটনা, ৯০ শতাংশ বকেয়া টাকার মীমাংসা হয়েছে: রিপাবলিক টিভি”

গোস্বামীর বকেয়া টাকা না মেটানো ও নায়েকের আত্মহত্যা করা নিয়ে সব ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বিপাবলিক টিভি ৭ মে একটি বিবৃতি দেয়। অক্ষতার সব অভিযোগকে মিথ্যে ও অমূলক আখ্যা দিয়ে রিপাবলিক টিভি বলে কেসটি বন্ধ হয়েছে কারণ অক্ষতা “অভিযোগের স্বপক্ষে উপযুক্ত কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি,” এবং জানায় ৯০ শতাংশ বকেয়া মেটানো হয়ে গিয়েছে। চ্যানেল আরও অভিযোগ করে অক্ষতা নায়েক রিপাবলিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ মীমাংসা ও মিটমাটের জন্য দেখা করতে অস্বীকার করে। এবং নায়েকরা রিপাবলিককে বলে তৃতীয় সংস্থার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে টাকা মেটাতে যা চুক্তি বহির্ভূত ছিল।

চ্যানেলটি আরও অভিযোগ করে, কংগ্রেস নেতাদের শেয়ার করা ভিডিওটি রাজনৈতিক দলটির ”স্বাধীনভাবে সংবাদ সংস্থা চালানো” রিপাবলিকের বিরুদ্ধে একটি ‘প্রতিহিংসা পরায়ণ’ ব্যবহার।

গোস্বামীর বুধবারের গ্রেফতারির পর পর চ্যানেলটি তাদের অবস্থান থেকে না সরে বিবৃতিতে জানিয়েছে, “সাজানো আত্মহত্যার ঘটনায় বন্ধ হওয়া কেসে অর্ণব গোস্বামীর এই গ্রেফতারি স্পষ্টভাবেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎউদ্দেশ্যে এবং রিপাবলিক মিডিয়া নেটওয়ার্কের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সত্যি কথা বলার জন্য চক্রান্তমূলক শাস্তিস্বরূপ।”

 

এখন কেসটির বর্তমান অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে?

মহারাষ্ট্র পুলিশ ৪ নভেম্বর, ২০২০ সুইসাইড নোটে উল্লেখ থাকা তিন ব্যক্তি গোস্বামী, শেখ এবং সারদাকে গ্রেফতার করেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কঙ্কন এলাকার ইন্সপেক্টর জেনারেল সঞ্জয় মোহিতকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে লিখেছে, ”অর্ণব গোস্বামীকে এখন রায়গড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁকে তদন্তকারী অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করবে সেই অনুযায়ী বাদবাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

অন্বয়ের স্ত্রী অক্ষতা এবং কন্য আদন্যা একটি সংবাদ সম্মেলন করে রাজ্য সরকারকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং দাবি করেছে রিপাবলিকের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার দাবি একদ‌ম‌ই সঠিক নয়।

 

এর সঙ্গে কি সম্প্রতি রিপাবলিকের বিরুদ্ধে ওঠা টিআরপি জালিয়াতির যোগ আছে?

এই কেসেটি দাখিল হয়েছে রায়গড়ে আর এর তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে রায়গড় পুলিশের স্থানীয় অপরাধদমন বিভাগ। এই কেসের সঙ্গে মুম্বই পুলিশের দায়ের করা রিপাবলিকের বিরুদ্ধে ওঠা টিআরপি বাড়াতে টিভি রেটিং সংস্থার কর্মীদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগের কোনও যোগ নেই, এমনটাই জানানো হয়েছে।

যখন মুম্বই পুলিশের ক্রাইম শাখার একটি টিম গোস্বামীকে গ্রেফতার করতে হাজির হয়, অন্য পুলিশের দলও সহযোগিতা করে তাদের কারণ অভিযুক্তের বাড়ির এলাকা মুম্বই পুলিশের সীমানার বাইরে। তিনজন অভিযুক্ত গোস্বামী, শেখ এবং সারদাকে ওরলি, যোগেশ্বরী এবং কান্দিভালির পুলিশ এবং রায়গড় ও মুম্বই পুলিশের ক্রাইম শাখার দল যৌথভাবে গ্রেফতার করে বলে জানানো হয়েছে।

 

মুম্বই পুলিশের অর্ণব গোস্বামী ও রিপাবলিক টিভির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক কেস

মুম্বই পুলিশ, মহারাষ্ট্র সরকার এবং অর্ণব গোস্বামী পরিচালিত রিপালিক টিভির মধ্যে বাকযুদ্ধ, এফআইআর ও আইনি মামলা চলছিল গত কয়েকমাস ধরে। মুম্বই পুলিশ প্রথমে আরও ৫ জন সহ চ্যানেলটির বিরুদ্ধে কেস শুরু করে টাকার বিনিময়ে টিআরপি বৃদ্ধির অভিযোগ এনে। চ্যানেলটি সব অভিযোগ অস্বীকার করে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে দাবি করে একাধিক মুম্বই পুলিশের আধিকারিকের বিশেষতঃ পুলিশ কমিশনার পরমবীর সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তার ফলে অর্ণব গোস্বামী ও রিপাবলিকের সম্পাদকীয় বিভাগের একাধিক কর্মীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। দেখা গেছে অর্ণব নয় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইণ্ডিয়া টুডেই জালিয়াতিতে যুক্ত

এফআইআরে উল্লেখ করা হয় চ্যানেলটি বান্দ্রা স্টেশনের বাইরে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং পালঘরে দুই সাধুর গণপিটুনি সহ শহরের বিভিন্ন ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোয় অভিযুক্ত। সম্প্রতি, শিব সেনা নেতারা বিধানসভা ও বিধানপরিষদে অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের দুটি প্রস্তাব আনে।

 

এই কেসে শিবসেনার মদতের অভিযোগ

মিডিয়া নেটওয়ার্ক ভয়াবহ তথ্য উদঘাটন করেছে। বলা হয়েছে, যে রায়গড় থানার এসপি উদ্ধব ঠাকরের কার্যালয় থেকে অর্ণবকে গ্রেফতারের প্রত্যক্ষ আদেশ পেয়েছিলেন।

রিপাবলিক টিভির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে মুম্বই পুলিশ ডিজি একটি পুরানো মামলায় রিপাবলিকের প্রধানকে গ্রেফতারের বিষয়ে সিআইডি প্রধানের সঙ্গে একমত হননি, সিআইডি তখন অর্ণবের বিরুদ্ধে কোনও উপযুক্ত প্রমাণ পায়নি। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মুম্বই সিপি পরমবীর সিংয়ের সাথে দেখা করেছেন এবং গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছেন।

শীর্ষস্থানীয় সূত্র অনুসারে জানা গিয়েছে, মুম্বই পুলিশ ডিজি গ্রেফতারের বিষয়ে সিআইডি প্রধানের সঙ্গে একমত হননি এবং তাই মহারাষ্ট্রের সিএম উদ্ধব ঠাকরে এবং মুম্বইয়ের সিপি পরম বীর সিং এই বিষয়ে ক্লোজডোর বৈঠক করেছেন। সূত্র অনুযায়ী আরও খবর যে, এসএন রায়গড়কে অর্ণবের গ্রেফতারের জন্য সরাসরি সিএম অফিস থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।”

মুম্বই পুলিশ জানিয়েছে যে তারা ২০১৮ সালের মামলা নতুন করে তদন্ত করতে চায় কারণ তারা মনে করে তদন্তে গলদ রয়ে গিয়েছে।

চ্যানেলের দাবি রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিশেষ কেসটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেছিলেন, কিন্তু প্রমাণের অভাবে মামলাটি আর এগোনো হয়নি। বর্তমানে, উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার, চ্যানেলের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার অভিযোগে স্থানীয় রায়গড় পুলিশকে বিষয়টি পুনরায় তদন্ত করতে বাধ্য করেছে।

মুম্বাই পুলিশের কমপক্ষে ৩০ জন সদস্যের একটি দল, এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞ শচীন বাজেয়ের নেতৃত্বে, একে -৪৭ এর মতো রাইফেল নিয়ে কোনোরকম সমন, নথিপত্র বা আদালতের কাগজপত্র ছাড়াই তাকে লাঞ্ছিত করে টেনে হিঁচড়ে পুলিশ ভ্যানে টেনে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয় অর্ণব গোস্বামীর নাবালক পুত্র, তার শ্বশুর-শাশুড়িকেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

রিপাবলিক টিভি পালঘর সাধু হত্যা মামলা এবং সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর মামলায় ব্যাপকভাবে রিপোর্ট দিতে থাকে। বেশ কিছুদিন ধরেই অর্ণব বলেছিলেন যে মহারাষ্ট্র সরকার ভয় পেয়েছিল যে সত্য প্রকাশিত হবে তাই তারা তার কন্ঠ রোধ করার চেষ্টা চলছে। পালঘরে সাধু হত্যা মামলায় সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগের জন্য অর্ণবকে পুলিশ যথেষ্ট হেনস্তা করেছিল।

 

আমাদমি পার্টি ও কংগ্রেসের ভূমিকা

আম আদমি পার্টি এবং কংগ্রেস নেতারা এবং তাদের চাটুকার সমর্থকরা যারা কথায় কথায় “ফ্যাসিবাদ” বলে কান্নাকাটি জুড়ে দেন, তারা মুম্বই পুলিশ কর্তৃক অর্ণব গোস্বামীর গ্রেফতার নিয়ে রীতিমতো ভার্চুয়াল সেলিব্রেশনে মেতে উঠেছেন। অথচ মুম্বই পুলিশ আধিকারিকরা একে-৪৭ নিয়ে একজনের বাড়িতে প্রবেশ করেছিল সেই ঘটনা তাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে।

শিবসেনা সরকারের সমালোচক সাংবাদিকের গ্রেফতারের ঘটনায় নিন্দার পরিবর্তে কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টির সমর্থক ও নেতারা এটি নিয়ে হর্ষোল্লাসে মেতে উঠেছে।

আম আদমি পার্টির মুখপাত্র টুইট করেছেন যে অর্ণব ‘সহানুভূতির অধিকারী’ নন, মুম্বই পুলিশ যা করেছে বেশ করেছে। কংগ্রেস নেতারাও অর্ণবের গ্রেফতারের জন্য স্যালুট জানিয়েছেন মুম্বই পুলিশকে।গৌরব পান্ধী, সংযুক্তা বসু, সাকেত গোখলে, প্রতীক সিনহা সহ অনেকেই প্রাউডলি এই ব্যাপারটা সাপোর্ট করেছেন।

কংগ্রেস নেতারা অর্ণবকে গ্রেপ্তারের জন্য এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার কৃতিত্ব নিতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তারা এগিয়ে গিয়েছিল এমনকি আত্মহত্যার মামলায় ২০১৮ সালের ছাড়পত্র সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ারও অবলম্বন করেছিল।

তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র উল্লসিত

সাত সকালে গ্রেফতার করা হয়েছে রিপাবলিক টিভির সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীকে। যা নিয়ে মহারাষ্ট্রের শাসক শিবসেনার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সুর চড়িয়েছে গেরুয়া শিবির। সাংবাদিককে গ্রেফতার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। যা নিয়েই পালটা মাঠে নেমেছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র।

সাংবাদিক নিগ্রহ এবং গ্রেফতার করার পুরনো ইতিহাস টেনে বিজেপিকে ঘৃণ্যভাবে আক্রমণ করেছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ। সেই সঙ্গে সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর পুরনো সংলাপ ‘নেশন ওয়ানটস টি নো’-কেও কটাক্ষ করেছেন তিনি। তবে সরাসরি একই শব্দ ব্যবহার না করে তিনি বলেছেন, ‘নেশন নিডস টু নো’।

বুধবার বিকেলের দিকে টুইট করে মহুয়া মৈত্র লিখেছেন, “নেশন নিডস টু নো বা দেশের জানা প্রয়োজন কেন এবং কীভাবে বিজেপি নেতারা সাম্প্রতিক অতীতে সাংবাদিকদের হেনস্থা করেছে ও আটক করে রেখেছে। আর আইন যখন অন্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে তখন তারা (বিজেপি নেতারা) হাহাকার রব তুলেছেন।”

 

ইন্ডিয়ান ডিজিটাল মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিক্রিয়া

ভারতের বৃহত্তম ডিজিটাল নিউজ অ্যাসোসিয়েশন – ইন্ডিয়ান ডিজিটাল মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএমএ) রিপাবলিক টিভির এডিটর ইন চিফ অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া ঘটনায় মহারাষ্ট্র সরকারের আচরণের তীব্র নিন্দা করেছে।

বুধবার, আইডিএমএ ২০১৮ সালের একটি আত্মঘাতী মামলায় রিপাবলিক টিভি প্রধান অর্ণব গোস্বামীর হামলা এবং গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে একটি কট্টর বক্তব্য জারি করেছে এবং রিপাবলিক টিভি প্রধানের তাৎক্ষণিক মুক্তির দাবি করেছে।

বিবৃতিতে আইডিএমএ রিপাবলিক টিভি সম্পাদক-প্রধান-অর্ণব গোস্বামীর আকস্মিক গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং মুম্বাই পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারি এবং তাদের আচরণ দেখে হতবাক সেকথাও বলেছেন। আইডিএমএ আরও উল্লেখ করেছে যে, কীভাবে গোস্বামী ও তার পরিবারের উপর হামলা করা হয়েছে এবং তাকে জোর করে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকটি ভ্যান পরিবর্তন করা হয়েছিল।

এছাড়াও, আইডিএমএ বলেছে যে তারা মহারাষ্ট্র সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছে, মনে করছে, এই ঘটনা সাংবাদিক এবং তার চ্যানেলকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য‌ই করা হয়েছে।

আর‌ও বলা হয়েছে “এই ঘটনাটি কেবল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দমন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি দেশের প্রতিটি নাগরিককে দেওয়া ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার লঙ্ঘন। নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য তৈরি করা আইন যখন নাগরিকদের সুরক্ষার প্রয়োজনে কাজে লাগে না তখন গণতন্ত্রের সম্মিলিত শক্তিকে ন্যায্যতার দাবিতে নিজেকে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।” একথাও বলা হয়েছে, “আমরা, ডিজিটাল নিউজ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসাবে বিশেষত হতাশ হয়ে পড়েছি যে যদি এই জাতীয় হস্তক্ষেপ করা হয় তাহলে তো বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে দেওয়া হবে।” এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া বিবৃতি জারি করে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে।

 

বিজেপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য

অনেকের‌ই ধারণা এই গ্রেফতারি প্রত্যাশিতই ছিল। সেইমতো রিপাবলিক টিভির এডিটর-ইন-চিফের গ্রেফতারির পর তর্জা শুরু হল রাজনৈতিক মহলে। বিজেপি নেতারা সেই গ্রেফতারির মধ্যে “জরুরি অবস্থার ছায়া” দেখতে পাচ্ছেন। আবার শিবসেনার সাফাই, আইন মোতাবেক যাবতীয় কাজ হয়েছে। কে কী বলেছেন, দেখে নিন একনজরে –

অমিত শাহ : কংগ্রেস ও তার সহযোগী দলগুলি আবারও গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জাজনক কাজ করেছে। রিপাবলিক টিভি এবং অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে রাজ্যের ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের উপর সজোড়ে আঘাত করা হয়েছে। এটা আমাদের জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের উপর এই আক্রমণের বিরোধিতা অবশ্যই করতে হবে।

বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের হাতে অর্ণব গোস্বামীর হেনস্থার ঘটনায় ক্ষুব্ধ। যাঁরা একমত হবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে সোনিয়া-রাহুল গান্ধীর নির্দেশিত পদক্ষেপের আরও একটি নিদর্শন এটি।’

এস জয়শংকর : জরুরি অবস্থার ছায়া। অর্ণব গোস্বামীর গ্রেফতারি হল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। যাঁরা এই স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের অবশ্যই মুখ খোলা উচিত।

কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর : মহারাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর আক্রমণের নিন্দা করছি আমরা। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ব্যবহারের এটা উপায় নয়। এটায় আমাদের জরুরি অবস্থার কথা মনে পড়ছে, যখন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এভাবে ব্যবহার করা হত।

এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন অপর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী। সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে অর্ণব গোস্বামীর সমর্থনে এক হতে অনুরোধ করেছেন তিনি। ট‍্যুইটারে তিনি লিখেছেন, “ফ্রি প্রেসে যারা আজকে অর্ণব গোস্বামীর সমর্থনে দাঁড়াচ্ছে না, তারা আসলেই ফ‍্যাসিবাদকে সমর্থন করে। আপনি তাঁকে পছন্দ নাই করতে পারেন, আপনি তাঁকে সমর্থন নাই করতে পারেন, আপনি তাঁর অস্তিত্বকে তুচ্ছ মনে করতে পারেন, কিন্তু আপনি যদি এখন চুপ থাকেন তার মানে আপনি এই দমননীতিকে সমর্থন করছেন। এর পর যদি আপনার সাথে এমনটা হয় তখন কে কথা বলবে আপনার হয়ে?”

নেটিজেনদের বক্তব্য

অধিকাংশ নেট নাগরিক বলেছেন,২০১৬ সালে কানহাইয়া কুমার সহ জেএনইউর ‘ভারত তেড়ে টুকড়ে হোঙ্গে’ গ্যাং-রে ভিডিওসহ,  ‘ভারত কে বরবাদি তক জঙ্গ চলেগি/ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে ইনশাআল্লাহ ইনশাআল্লাহ’ গ্যাংগের কীর্তিকলাপ মিডিয়ার সামনে প্রথম তুলে ধরেছিল গোস্বামী। এবং তখন থেকেই তিনি অনেকের কোপে পড়েন। আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগ সেক্যুলার এবং প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম কানহাইয়ার পাশে দাঁড়াচ্ছিল তখন হিন্দুদের, ভারতীয়দের প্রশ্নগুলো নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল একা অর্ণব গোস্বামী৷

বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার, কালিয়াচক, দেগঙ্গা, ধুলাগড়, কাংলাপাহাড়িতে দুর্গাপুজো বন্ধ, কলকাতায় মহরমের জন্য দুর্গাপ্রতিমা ভাষাণ বন্ধ বাঙালি হিন্দুদের এই ইস্যুগুলো ন্যাশনাল মিডিয়াতে তুলে এনেছিল একমাত্র অর্ণব গোস্বামী।অর্ণব গোস্বামী না থাকলে এই ইস্যুগুলো কখনও মানুষ জানতে পারতো না।

অর্ণব গোস্বামীকে গ্রেফতার করানোর পেছনে শিবসেনা ও কংগ্রেসের পাশাপাশি দার-উল-ইসলামের আগ্রাসনের বিশাল ভূমিকা রয়েছে৷ অর্ণবকে গ্রেফতার করিয়ে বোঝানো হয়েছে, হিন্দুস্বার্থে কথা বললে এই পরিণতি ভুগতে হবে৷ তোমার সামনে রাস্তা খোলা আছে। সিদ্ধান্ত একান্ত তোমার ব্যক্তিগত।

বাকস্বাধীনতা হরণ

সংবাদ মাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। অভিযোগ উঠেছে, মহারাষ্ট্রে এখন এই গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকেই গলা টিপে হ’ত্যার কাজ শুরু করেছে সোনিয়া ও শিব সেনার মিলিত সরকার। দেশের সংবাদ মাধমের সবথেকে বড়ো মুখ হিসেবে পরিচিত অর্ণব গোস্বামীকে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, অর্ণব গোস্বামী একমাত্র সাংবাদিক যিনি পালঘর সাধু হ’ত্যা মামলায় এবং সুশান্ত সিং রাজপুত মামলায় প্ৰশ্ন তুলেছিলেন।

বেশকিছু সংবাদ মাধ্যম যখন তথাকথিত সেকুলারিজম বজায় রেখে, মহারাষ্ট্র সরকারের হিত বজায় রেখে সাংবাদিকতা করতে ব্যস্ত ছিল তখন অর্ণব গোস্বামী মাথা উঁচু করে মহারাষ্ট্র সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেছিলেন। এই কারণে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে যে মহারাষ্ট্র সরকারকে কি ভয়ে অর্ণবের মতো সাহসী সাংবাদিককে দমনের চেষ্টা করছে!?

সুশান্ত সিং রাজপুত মামলা সামনে আসার পর বলিউডের ড্রা’গস কান্ড প্রকাশ্যে চলে আসে। সেই সময়েও সাহসী কণ্ঠে প্রশ্ন তুলেছিলেন অর্ণব গোস্বামী। ড্রা’গস কান্ড নিয়ে বলিউড অভিনেতা সালমান খান কেন চুপ সে প্রশ্ন‌ও করেছিলেন অর্ণব গোস্বামী।

সোনিয়া গান্ধীকে প্রশ্ন করার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করার দাবী করেছিলেন কংগ্রেস নেতারা। মহারাষ্ট্র সরকারও চলে সোনিয়া গান্ধীর কথায়। তাহলে অর্ণব কি কংগ্রেসের করাল থাবার শিকার? মহারাষ্ট্রে কি আবার এল জরুরী অবস্থা?