রাম কে নাম ২

(২য় পর্ব)
অভীক মুখোপাধ্যায়

প্রথম পর্বের পর

স্লোগান — যারা বাংলায় বাম আমলে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন বা সোজা কথায় বাম আমলটাকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন স্লোগানের গুরুত্ব কতখানি। জ্বালাময়ী ডাক দিয়ে যখন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’ নারা উঠত, তখন সমাজের সবচেয়ে প্রতারিত লাঞ্ছিত কুণ্ঠিত মানুষটাও নিজের দাবীদাওয়া আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারত। গণ প্রতিরোধের প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ বিপ্লবের চাবিকাঠি এই স্লোগানগুলোই।
সম্প্রতি যখন দিল্লির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন থেকে নিয়মিত দেশবিরোধী স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ উঠছিল, তখন তার বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কেউ কেউ বলেন, সামান্য একজন ছাত্রের দেওয়া স্লোগানে কী এমন প্রভাব পড়তে পারে? কিছু একটা বলেই ফেলেছে নাহয়, ও এমন কিছু নয় — যাক গে। এমনটা যারা বলছেন, হয় তাঁরা ইতিহাসের খবর রাখেন না, নতুবা বিশুদ্ধ ধূর্ততার মোড়কে নিজেদের মুড়ে রাখেন।
মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে…। ১৯৮৬ সালে এক ছাত্রের দেওয়া এই স্লোগান যে ভারতকেই বদলে দিয়েছিল, তার প্রমাণ আজ মিলছে। ৫০০ বছর ধরে চলে আসা এক মহা সংঘর্ষের সমাপনে আজ সেই ছাত্র জনমানসে বিস্মৃত হলেও তার স্লোগান রয়ে গেছে আগের মতোই তেজস্বী, অটুট, অক্ষুণ্ণ।
পঁয়ত্রিশ বছর আগে এক এম কম –এর পড়ুয়ার দেওয়া এই স্লোগান সারা ভারতে অনুরণিত হয়েছিল। প্রথমে ভক্তদের মুখে – মুখে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরে এই নিয়ে অজস্র জোকস আর মীম বানায় রামমন্দিরের বিরোধীরা। মধ্যপ্রদেশের রাজগড়ে এম কম-এ পাঠরত এক ছাত্র যখন বজরং দলের শিবির থেকে এই স্লোগান তুলেছিলেন, তখন এই স্লোগানকে ঠিক স্লোগান নয় হুঙ্গকার বলে মনে হয়েছিল—
রামলল্লা হম আয়েঙ্গে
মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে।
প্রতিপক্ষ ব্যাপারটাকে খিল্লি করতে জুড়ে দিল ‘তারিখ নহিঁ বতায়েঙ্গে।’ অর্থাৎ, রাজনৈতিক স্বার্থে এই কেসটাকে চালিয়েই যাওয়া হবে। এর কোনো শেষ নেই। এবং তাই মন্দির নির্মাণের কোনো নির্দিষ্ট তারিখের কথা কোনো দিনই বলা হবে না।
ডান বলুন বা বাম, এই নীতির প্রয়োগ করে থাকেন অনেকেই। এটা গোয়েবেলস-এর টেকনিক। প্রতিপক্ষের তর্কের জবাব নিজের যুক্তি দিয়ে দেওয়া সম্ভব না-হলে তাকে মজার খোরাকে পরিণত করো। সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে খিল্লির নিঞ্জা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হল।
যে স্লোগানের ক্রেডিট শ্রী লালকৃষ্ণ আদবানিজির কপালে জোটে, সেই স্লোগানের মূল বক্তার নাম কী?
বাবা সত্যনারায়ণ মৌর্য।
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি ধ্বংসের দিনে অযোধ্যার বুকে মঞ্চের সঞ্চালনা করেছিলেন এই ছাত্র। রামমন্দির আন্দোলনের প্রচার প্রমুখের ভূমিকা পালন করছিলেন। অযোধ্যার অলিতে গলিতে দেওয়ালে – দেওয়ালে তখন শ্রীরাম আর হনুমানজির ছবি আঁকার কাজ চলত। এসব কাজে বাবা সত্যনারায়ণ মৌর্যর সক্রিয় ভূমিকা থাকত। এখনো তিনি ছবি আঁকেন, কবিতা লেখেন। রামমন্দির নির্মাণ আরম্ভ হলে কিছুদিনের মধ্যে বাবা সত্যনারায়ণ মৌর্যর ছবির প্রদর্শনীও দেখতে পাবে অযোধ্যা। যাই হোক, ছবি থাকবে ছবির জায়গায়, কিন্তু কথা হচ্ছিল স্লোগানের।
স্লোগান হল রাজনীতির যুদ্ধ উদঘোষ। ইংরাজির বিদ্বানে এটাকেই বলেন ‘ওয়ার ক্রাই’। যা বলে মনে যুদ্ধ জয়ের শক্তি আনা হয়। রাজপুতানা রাইফেলস-এর জন্ম ১৭৭৫ সালের ১০ই জানুয়ারি। ভারতীয় সেনার এই অঙ্গের শৌর্য বীর্যের কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে কি? অগুণতি পদকে সজ্জিত রাজপুতানা রাইফেলসের নামই যথেষ্ট। এহেন বাহিনীর যুদ্ধ উদঘোষ কী?
‘রাজা রামচন্দ্র কি জয়!’
একথা উচ্চারণ করেই তাঁরা যুদ্ধে নামেন। তাঁদের সঙ্গে রামমন্দিরের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের বন্ধন নেই। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। তাঁদের কাছে শ্রীরাম একজন রাজা। একজন ইতিহাসপুরুষ।
রামমন্দির আন্দোলনে শ্রীরামের নামে বিভিন্ন উদঘোষ জন্ম নেওয়ার পরে অনেকেই বলেছিলেন, ১৯৯০-এর আগে রামের নামে এধরণের ফ্যানাটিক স্লোগানের অস্তিত্বই ছিল না। এসবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত…ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাঁরা ভুলে গেছেন রামমন্দির আন্দোলনের আগেই দূরদর্শনের ‘রামায়ণ’ সিরিয়ালের মাধ্যমে ঘরে – ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল এই উদঘোষ। ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বলতে লঙ্কা দহনে ব্যস্ত হনুমানজির ছবি কিংবা লঙ্কায় আক্রমণ করার সময়ে বানরসেনার ‘জয় শ্রীরাম’ যুদ্ধ উদঘোষ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। শ্রীরামচন্দ্র গোবলয়ের রাজা। পশুকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থার মেরুদণ্ডে ভর করা রাজত্বের ছেলে বিয়ে করলেন জনকপুরীর কন্যাকে। জনকের রাজত্বে আবার কৃষিই অর্থনীতির শিরদাঁড়া। মিলন ঘটল দুধরণের অর্থনীতির। আবার সেই রামচন্দ্রই মধ্যভারত পার করে দাক্ষিণাত্য চিরে লঙ্কা বিজয়ে চললেন। দক্ষিণের খনিজ সম্পদের অর্থনীতি উত্তর ভারতের অর্থনীতিতে প্রবেশ করল এর পরেই। রামচন্দ্রের প্রভাব তাই এইসব ক্ষেত্রে সার্বজনীন। নেপালের মতো দেশ চিনের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলতে গিয়েও রামচন্দ্রকে ভুলতে না-পেরে নিজেদের ছেলে বলে দাবী করে বসে। দুর্ভাগা এই বঙ্গাল প্রদেশে কখনো রামচন্দ্রের চরণ না-পড়ায় ‘রাম আমাদের দেবতা নন’ বলা অতিশিক্ষিতদের তাই কিছুটা সুবিধা হয়। অতিবাস্তববাদী এই শ্রেণীর কাছে কেউই দেবতা নন। দরকার মতো দেবতার জন্ম দেন বা বিসর্জন করেন এঁরা। শ্রীরামকে দেবতা ভাবার দরকারও নেই। রামচন্দ্র ইতিহাসের ব্যক্তি। রাজনৈতিক চরিত্র। ‘দেবতা বলে মানি না’ বলে মানুষটার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরে যদি প্রশ্ন করা হয় ‘যার জন্মই মানেন না, তাঁর দ্বারা শুদ্র শম্বুকের বধ কীভাবে মেনে নেন, তা জানালে ধন্য বোধ করি,’ তাহলেই আর উত্তর মেলে না। তখনই সেই প্রশ্নটা রাজনৈতিক বলে চিহ্নিত হয়।
নিজেকে মহা বুদ্ধাঙ্কের অধিকারী ভাবা বিপ্লবের পোস্টার-বয় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানটিকে নারীবিরোধী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগে বলেন — ‘দেখিয়ে, এক তো আপ নে জয় শ্রীরাম কাঁহা হ্যায়, লেকিন হমারে ইঁহা লোগ সীতারাম বোলতে হ্যায়।’ এখানে একটা বিষয় একটু ভেবে দেখা যাক — আমরা যতটা সহজে শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ বলতে পারি, ততটাই সহজে কি শিব, মহাদেব, ব্রহ্মাদি নামের আগে শ্রী বসাতে পারি?
পারি না।
এর কারণ কী?
‘শ্রী’ হল লক্ষ্মী দেবীর অপর নাম। শ্রীদেবী। ভগবান বিষ্ণুর অবতারের নামের আগে তাই ‘শ্রী’ যুক্ত হলে তা সহজেই গ্রহণযোগ্য। অন্যান্য নামের ক্ষেত্রে যতক্ষণ না কোনো বিশেষ গুণ পরিলক্ষিত হচ্ছে, ততক্ষণ তা ‘শ্রী’যুক্ত হতে পারে না। তাই জয় সীতারাম বলুন বা জয় শ্রীরাম, মানেটা একই। ভারতীয় শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করতে হলে তাতে নিষ্ণাত হতে হয়। পপুলার পলিটিক্স, হাততালি দেওয়া অডিয়েন্স নিয়ে হলঘর জয় করা যায়, ভারতবাসীর মন নয়।
স্লোগান, নাম কিংবা প্রতীকের গুরুত্ব বুঝতে হলে বুঝতে হবে ‘রাম সে বড়া রাম কা নাম’ কথাটাকে। স্বস্তিক চিহ্নের দিকে তাকাতে হবে। হিটলার এরই কাছাকাছি একটি চিহ্নকে বেছে নিয়েছিলেন। তা ছিল খ্রিষ্টান ক্রসের একটি বিবর্তিত রূপ — হ্যাকেন ক্রুস। ধূর্ত প্রোপাগাণ্ডাকারীর দল সেটাকেই বলে দিল, স্বস্তিক — ইহা হিন্দুদিগের প্রতীক।
ফিরে আসি হিন্দুত্বের কথায়। সনাতন ধর্মের একটা জেনেরালাইজড নাম আপাতত হিন্দুত্ব। যার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল রামমন্দিরের রাজনীতি। ধর্ম আর রাজনীতির লোকেদের বাঁধা জোট থেকে ইতিহাস স্বাভাবিক নিয়মে বেছে নিয়েছে শুধু রাজনীতিকদের নাম। ধর্মের ধ্বজা বহনকারীদের কে-ই বা কবে মনে রেখেছে?
রামমন্দির আন্দোলনের পুরোধাদের নাম খুঁজতে গেলে শ্রী লালকৃষ্ণ আদবানি, শ্রী মুরলী মনোহর জোশি কিংবা শ্রী নরেন্দ্র মোদির নামটাই সামনে আসে। কানহাইয়া লাল মুন্সির সোমনাথ সম্পর্কিত উপন্যাস পড়ে আদবানি যখন রথযাত্রা সোমনাথ থেকেই আরম্ভ করলেন, তখন তাঁকে পতাকা দেখিয়েছিলেন বিশ্বহিন্দু পরিষদের চম্পত রাই। ইতিহাস তাঁকে ক’বার স্মরণ করেছে? নেতামন্ত্রীদের ভিড়ে হারিয়ে গেছে কোঠারি ভাইদের নাম। শ্রী অশোক সিংঘল তো স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন পদের গুণে, কিন্তু ক’জন মনে রেখেছে নিশা নামের মেয়েটিকে, যে নিজের যৌবনকালটাকেই শ্রীরামের পায়ে অর্পণ করেছিল?
মা-বাপ নিশা নাম রেখেছিল। কিন্তু সকলে তাঁকে চেনে ঋতাম্ভরা নামে। সাধ্বী ঋতাম্ভরা। ভক্তদের কাছে ‘দিদি’ বলে পরিচিত মা সাধ্বী ঋতাম্ভরা ছিলেন রামও মন্দির আন্দোলনের পুরোধা।
সাধ্বীর উগ্র বক্তব্য নিয়ে প্রবল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সনাতনী ধারা এবং হিন্দুত্বকে মিশিয়ে ফেলে তিনি বলেছিলেন — ‘ হাঁ হম হিন্দু হ্যায়, হিন্দোস্তান হমারা হ্যায়।’ আবেগে ভরা ভাষণে মসজিদের পক্ষধারীদের শত্রু ভেবে নিয়েছিলেন তিনি। বক্তব্য ছিল — ‘মহাকাল বনকর দুশমন সে টকরায়েঙ্গে, জহাঁ বনি হ্যায় মসজিদ, মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে।’
কয়েক বছর আগে দিগ্বিজয় সিংহ স্যাফরন টেররজিম নিয়ে হইচই করেছিলেন। এই দিগ্বিজয় সিংহ সাধ্বীকে সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করতে এবং নাস্তানাবুদ করতে কোনো পদক্ষেপই বাকী রাখেননি। একবার সাধ্বীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় মাঝপথেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। অচেনা পথে অন্ধকারে চলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছিলেন সাধ্বী। এক পুলিশকর্মী সাধ্বীকে বলেছিল — ‘লাও সাধ্বী, তুমহারা হাথ পকড় লুঁ।’ সাধ্বীর জবাব ছিল — ‘চণ্ডী কা হাথ পকড়নে কি তুম মে সামর্থ্য হ্যায়?’
পক্ষ প্রতিপক্ষের ঠিক বা ভুল আসলে রাজনীতির রূপ নিয়েছিল। আর রাজনীতি অবশ্যম্ভাবী ভাবে এনে দিয়েছিল হিন্দু – মুসলিম সমস্যা। কিন্তু এর জন্ম হিন্দু – মুসলিম বিবাদ হিসেবে হয়নি, হয়েছিল আক্রমণকারী এবং আক্রান্তদের যুদ্ধ রূপে। এর সূত্রপাত হয়েছিল প্রায় পাঁচশো বছর আগে — যখন মধ্য এশিয়ার এক দুর্ধর্ষ যুবক ভারতবর্ষ জয় করার স্বপ্নে মশগুল হয়ে যুদ্ধের আগে দরকারি খবর সংগ্রহ করার জন্য ভারতে এসেছিল। আর এসে উঠেছিল কোথায়?
অযোধ্যায়…
(ক্রমশঃ)