প্রণম্য গুরুজী

বহুকাল আগের কথা।  জনৈক মহামহোপাধ্যায় সন্ন্যাসী তাঁর এক জ্ঞানবান, বলিষ্ঠ শিষ্যের সাথে দেশভ্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করেছেন। বহু স্থান অতিক্রম করে তাঁরা এক অজানা দেশে উপনীত হয়েছেন। পথপাশে এক বটবৃক্ষের তলায় শ্রান্ত গুরুদেবের বিশ্রাম করার আয়োজন করে শিষ্য অজানা দেশটিকে জানার জন্য পুনরায় যাত্রা করেন। বহুক্ষণ পরে, গোধূলি বেলায়/সূর্যাস্তকালে তিনি ফিরে এসে আপন অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন স্বীয় গুরুদেবের কাছে। গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন দেখলে এই দেশটিকে?” শিষ্য বললেন, “গুরুদেব এই দেশটি অন্যান্য অঞ্চলগুলির মতো নয় কোনোমতেই।” এহেন কথায় উৎসুক গুরুদেব কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। শিষ্য বলেন, “গুরুদেব, দেশটি বেশ। কিন্তু মানুষজন যেন গৃহের পরিবর্তে পথের পাশে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল – এস্থানে মুড়ি ও মুড়কি একই মূল্যে বিক্রয় করা হয়।” সচকিত গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন স্থানে দেখলে?” শিষ্য – “গুরুদেব, কোন বিশেষ স্থানে নয়। সর্বত্র।” গুরুদেব বললেন, “সত্বর এ স্থান ত্যাগ করতে হবে।” শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন গুরুদেব? এস্থানে তো কোন গোলযোগ চোখে পড়ল না।”

স্মিত হেসে গুরুদেব বললেন, “তুমি বললে যে মানুষজন আপন গৃহের পরিবর্তে পথপাশে থাকতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।  আবার তুমি ও বললে যে মুড়ি ও মুড়কি একই মূল্যে বিক্রয় করা হয়।” শিষ্য – “হ্যাঁ। গুরুদেব।” গুরুদেব – “তাও বুঝলেনা!” শ্রদ্ধায় অবনত শিষ্য বললেন, “না।  গুরুদেব।” গুরুদেব বললেন – :মানুষের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়, নিরাপত্তা তাঁর আপন গৃহ।  মানুষ সেটিকে ত্যাগ করে পথে তখনই উপস্থিত হয় যখন তা আর নিরাপত্তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, মুড়ি ও মুড়কির একই দর। অর্থাৎ, এখানে গুণাবলীর কোন মূল্য নেই। যেস্থানে গৃহের নিরাপত্তা ও গুণাবলীর কোন মূল্য থাকে না সেখানে মাৎস্যন্যায় বিরাজ করে। ধর্ম সেখানে অন্তর্হিত হয়। এস্থানে বর্তমানে অধর্মের তান্ডব চলছে। তাই কোন ধার্মিক ব্যক্তি এস্থানে বসবাস করতে পারেননা এক মহুর্তের জন্যেও। ” স্বশিষ্য গুরুদেব পুনরায় যাত্রা প্রারম্ভ করলেন ধর্মের সন্ধানে।

আশ্চর্য হলেন? তাহলে বলি, আশ্চর্যের কিছু নেই এতে। এটিকেই গুরু-শিষ্য সংবাদ বলা হয়। ভারতবর্ষের বৈদিক সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এই পরম্পরা প্রবাহিত হচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় শিষ্যকে সর্ববিষয়ে উপযুক্ত করেই গুরু তাঁর স্বীয় জ্ঞান ও সাধনার অবিমিশ্র প্রবাহকে সচল রাখেন। ধর্মময় ভারতে জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র – চারি বর্ণের বিধিসম্মত কর্মের মিলিত উদ্যোগেই আর্য হিন্দু ধর্ম প্রবাহমান। ধর্মের মূল অর্থ কর্তব্য। তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সাংখ্যযোগ নামা দ্বিতীয়ত অধ্যায়ের ৪৭ তম শ্লোকে বর্ণিত আছে ”  কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন| মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি||” অর্থাৎ কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই| কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়| – নিঃসন্দেহে মানবজীবনের ক্ষেত্রে এটি কঠিনতম ব্রত। কেবলমাত্র স্বীয় লক্ষ্যে অবিচল থেকে কর্ম সম্পাদন করা মুখের কথা নয়। তার প্রস্তুতি ও প্রয়োগে এক দীর্ঘকালের প্রয়োজন থাকে। 

ব্রত কঠিনতম কিন্তু তাও পালন করা হয় ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায়। কিন্তু কে সেই স্থিতপ্রজ্ঞ? অবশ্যই সেইরকম প্রতিভাশালী, অনন্য ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হন কালের প্রয়োজনে, ধর্মস্বার্থে সহস্র নিযুত লোকের মাঝে। তিনি অবশ্যই – শ্রী মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর অথবা শ্রদ্ধেয় গুরুজী। 

১৯০৬ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী তাঁর আবির্ভাব; প্রস্থান ১৯৭৩ সালের ৫ই জুন অর্থাৎ আজকেই। সামান্য ৬৭ বছরের নশ্বর জীবন তাঁর কিন্তু কর্ম!? সমগ্র ভারতের হিন্দু জাতি তাঁর সম্মুখে মাথা নত করে। প্রাচীনকালে মহামতি কৌটিল্য বলেছিলেন, একটি রাষ্ট্র ততক্ষণ পরাজিত হয়না যতক্ষণ তার মন না পরাজিত হচ্ছে। মন ততক্ষণ পরাজিত হয়না যতক্ষণ তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুন্ন থাকে।  গত সহস্রাব্দে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের ভয়াবহ আক্রমণে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিধ্বংসী অত্যাচারে হিন্দুজাতির ভয়ঙ্করতম ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয় হয়েছে।  অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু তার মন পরাজিত হয়নি। বিপর্যস্ত হয়নি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদেরও। তাই এই ক্ষতবিক্ষত জাতি চলমান ও এক নতুন দিগন্তের সন্ধানে রত বর্তমানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের অমোঘ বিচারাধারার মাধ্যমে।

এক কথায়, সেই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক হলেন গুরুজী। আপন বৈভব তাঁর অতি সামান্য কিন্তু সামর্থ্যবান, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিরা তাঁকে প্রণাম করেন আভূমি।

ধর্মের প্রগাঢ় প্রভাব তাঁর মধ্যে বাল্যকাল থেকেই। ১৯২২ সালে ছাত্র হয়ে তিনি ভর্তি হন খ্রীষ্টান মিশনারী দ্বারা পরিচালিত – হিসলপ কলেজে। কিন্তু কলেজে প্রতিনিয়ত খ্রীষ্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করা ও হিন্দুধর্মকে হেয় করার মাত্রাতিরিক্ত প্রচেষ্টা তাঁকে ব্যথিত করে। ধর্মস্বার্থে বারংবার এর প্রতিবাদে রত তাঁর সাথে কলেজ কর্তৃপক্ষের বাদানুবাদ ঘটে। পরিশেষে, তিনি কলেজ ত্যাগ করে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু (BHU) যোগ দেন ও ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানে স্নাতক ও ১৯২৭ সালে বায়োলজি বা জীববিদ্যায় স্নাতকোত্তর হন। এইসময়ই তিনি প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী মদনমোহন মালব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। তাঁর আদ্যন্ত ইচ্ছা ছিল সুদূর মাদ্রাজে গিয়ে মেরিন বায়োলজিতে গবেষণা করার কিন্তু অর্থের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে, তিনি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা (zoology) বিভাগে অধ্যাপক রূপে তিনবছর পড়ান।  তাঁর আড়ম্বরহীন জীবনযাত্রা, ধার্মিক চরিত্র, লম্বা দাড়ির জন্য তাঁর ছাত্ররা তাঁকে “গুরুজী” বলে আখ্যায়িত করেন যা তাঁর জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। অধ্যাপনার কাল শেষ হলে তিনি নাগপুরে ফিরে আসেন এবং ১৯৩৬ সালের মধ্যে তিনি আইনে স্নাতক হন।

এই সময়ই সাথে কিছু ঘনিষ্ঠ সূত্রের মাধ্যমে তাঁর আলাপ হয় ডাক্তারজী অথবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারজীর সাথে। কথিত আছে, ডাক্তারজীই তাঁকে উৎসাহিত করেন ওকালতি করার জন্য। কিন্তু তাঁর অন্তরে ধর্মজিজ্ঞাসা যে প্রবল!! যিনি তাঁর স্বীয় ধর্মজীবনে গুরুর সন্ধানে চিরকাল রত ছিলেন তিনি অবশেষে ঠাঁই পেলেন বঙ্গের সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে, স্বামী অখণ্ডানন্দের (স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা) চরণে। রইল পড়ে পিছনে তাঁর ওকালতি ও আরএসএসের কর্মজীবন। স্বামী অখণ্ডানন্দের কাছেই তিনি পেলেন তাঁর জীবনের লক্ষ্য; গুরুদেব তাঁকে দীক্ষা দিলেন ১৯৩৭ সালের ১৩ই জানুয়ারীতে। কিন্তু স্বামীজীর প্রয়াণ তাঁর জীবনে এক শূন্যতার সৃষ্টি করল। কার্যত বিপর্যস্ত, শোকাচ্ছন্ন তিনি নাগপুরে ফিরে গেলেন। এইক্ষণে,. ডাক্তারজী তাঁকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর জীবনের ব্রত, ধর্মাচরণ পূর্ণ করার অনুরোধ জানান। আর ফিরে তাকাননি তিনি। সংঘের কর্মপ্রবাহে নিজেকে সমর্পণ করে মুক্তির সন্ধানে রত হলেন গোলওয়ালকরজী বা গুরুজী।

পরবর্তী কর্মপ্রবাহ অথবা তাঁর উত্তরোত্তর সাফল্য সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। বহু গ্রন্থে তা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যা বলার – ১৯৪৮ সালে গান্ধী হত্যা হেতু যে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের সম্মুখীন হয় সংঘ এবং হিন্দুত্ববাদী সংগ্রামকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার যে পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিল নেহেরু সরকার তা প্রতিহত করা গিয়েছিল একমাত্র তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বেই। নিঃসন্দেহে, তাঁর অনুপস্থিতিতে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতো।

১৯৬৪ সালে গুরুজীর সুযোগ্য নেতৃত্বে গঠিত হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভি এইচ পি)। এই সংগঠনের মাধ্যমে আরএসএস র সাথে সমগ্র ভারতবর্ষের সন্ন্যাসী সমাজের সাথে এক সান্নিধ্য সৃষ্ট হয় যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগ্রামে দেখা গেছে বারংবার। ১৯৬৭ সালে গোহত্যা বন্ধের দাবীতে তীব্র আন্দোলন থেকে ‘৮০ র দশকে ভারত-কাঁপানো রাম জন্মভূমি আন্দোলন তারই প্রমান। এক কথায়, গুরুজী হলেন এক সকর্মক ক্রিয়া যা ধর্ম ও তার স্বার্থ রক্ষা, প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মধ্যেই নিহিত আছে।

আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে একটি কথাই বলার –

ওঁম ধ্যানমূলং গুরুমূর্তিঃ পূজামূলং গুরু পদম।

মন্ত্রমূলং গুরুবাক্যং মোক্ষমূলং গুরুকৃপা।।