বিধাতার হাতে লেখা গান – ৭

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ষষ্ঠ পর্বের পর)

পর্ব – ৭

পাপা জো এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। আজও। এখনও। তাঁর নামের ফাইল কেনেডির লাইব্রেরিতে গচ্ছিত রাখা আছে। এবং সেই ফাইলকে ততদিন অবধি খোলা হবে না, যতদিন অবধি না আবার কোনো কেনেডি রাষ্ট্রপতি হবেন।

আমেরিকাতে পরিবারগুলো ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছিল। তবে জোসেফ কেনেডি বা পাপা জো-এর ব্যাপারটা ব্যতিক্রম ছিল। তাঁর ছিল নয় সন্তান। হাডসন নদীর তীরে বারো কামরার সুবিশাল বাংলো বাড়িতে একেবারে ভরা সংসার। মদ বন্ধ হওয়ার আগে তিনি বিলিতি মদের ব্যবসা করতেন, সরকার মদবন্দি তুলে নেওয়ার পর আবার লাইসেন্স মিলল। ইউরোপ আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছিল। রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট দিনে-দিনে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। হুইলচেয়ার ব্যবহার করার শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর পাপা জো হয়ে উঠছিলেন রুজভেল্টের ডান হাত। রাষ্ট্রপতির সিংহাসনের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে ছিলেন পাপা জো।

কেনেডি হলিউড সিনেমা প্রোডিউস করছিলেন। পড়তে খারাপ লাগলেও একটা সত্যি কথা লিখতে বাধ্যই হব বন্ধুরা—সেই সময়কার হাইয়েস্ট পেইড নায়িকা গ্লোরিয়া স্যামসন তাঁর শয্যাসঙ্গিনী ছিলেন। এবং পাপা জো’র বিছানায় না-থাকলেও তাঁরা নাকি রাতের পর রাত টেলিফোনে গল্প করতেন। একটা রেকর্ড আছে যে, এঁদের দুজনের এক রাত্তিরের ফোনালাপের ফলেই তৎকালীন আমেরিকাতে সবথেকে বেশি বিলের টেলিফোন কলটা হয়েছিল। চূড়ান্ত সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার একটি পরিবার, যেখানে যুবতী নারীদের আনাগোণা লেগেই থাকত এবং পিতা-পুত্র প্রত্যেকেই তাদের ভোগ করত। ছবিটা কল্পনা করতে পারছেন, আশা করি। পাপা জো’র বড় ছেলে ‘জো জুনিয়র’ রাষ্ট্রপতি হবে, জো জুনিয়রের থেকে বয়েসে দু’বছরের ছোট জন এফ কেনেডি হবে রাষ্ট্রপতির ডান হাত, রাষ্ট্রপতির বাঁ হাত হয়ে উঠবে ছোট ভাই রবার্ট। বিশ্বের ইতিহাসে অনেক পরিবারই অনেক রাষ্ট্রে এভাবে শাসন করার স্বপ্ন দেখেছে বা করেওছে। কেনেডিরা ঠিক মাফিয়াদের মতোই আমেরিকাতে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল।

আমেরিকাতে যখন মদ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তখনই মাফিয়ারাও জেঁকে বসে। ‘মাফিয়া’ শব্দটা এসেছে ইতালি থেকে। পিন পয়েন্ট করে বলতে হলে এর জন্ম ইতালির একটি দ্বীপ সিসিলি থেকে হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সিসিলি থেকে বেশ কয়েকটি পরিবার আমেরিকাতে চলে যায়। ওই পরিবারগুলোর মধ্যে থেকেই একটি বাচ্চা বড় হয়ে মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলে। নামটা আগেও লিখেছি, আবার লিখছি—আল কাপোন।

আল কাপোন। পুরো নাম—আলফ্রান্সো কাপোন। নিউইয়র্ক শহরে পথেঘাটে ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই দিয়ে হাত পাকানোটা শুরু হয়। ছোটবেলায় কাপোন নিজের এক স্কুলটিচারকে ধরে পিটিয়েছিল। এই ঘটনার পর স্বাভাবিক ভাবেই সে স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়। তখন সে গিয়ে যোগ দেয় দুষ্কৃতিদের একটা গ্যাং-এ। সেই গ্যাংটা আবার বরফের ব্যবসা করত। গ্যাং মানেই পাল্টা দলও থাকবে। ছিলও। এমনই বিপক্ষের এক গ্যাংস্টারের বোনের শ্লীলতাহানি করার ফলে আল কাপোনের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়। তার মুখে এই হামলার ফলে একটা স্থায়ী দাগও থেকে যায়। কাপোনের নাম হয়ে যায় ‘স্কার–ফেস’। আমাদের এখানে যেমন হাতকাটা কমল, ফালা ফটকে এরকম নামগুলো হয়, তেমনই ব্যাপার আর কি। এই আক্রমণ কাপোন ভোলেনি। সে বদলা নিতে উদ্যত হয়। বিপক্ষও শক্তিশালী, তারা এবার কাপোনকে প্রাণে মেরে ফেলার সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালাতে থাকে। কাপোন তখন প্রাণের ভয়ে শিকাগোতে পালিয়ে আসে। সেইসময়ে শিকাগোর সবথেকে বড় ডন ছিল জন দুরিয়ো। জন দুরিয়োর বডিগার্ডের কাজ পায় কাপোন। দুরিয়োর ভয়ানক প্রতিদ্বন্দী ছিল আরেক ডন, মোরিনো। সে একবার দুরিয়োর ওপরে হামলা করে। দুরিয়ো যা হোক করে প্রাণে বাঁচে। তারপর সে ঠিক করে এসব ব্যবসা ছেড়ে দেবে। এবং নিজের ভাবনা মতোই ব্যবসার সবটাই আল কাপোনের হাতে তুলে দিয়ে সে ইতালিতে ফিরে যায়।

আল কাপোনই হয়ে উঠল রাজার রাজা। শিকাগোর শের। মদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মদের ব্যবসা কিন্তু ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। পাপা জো কেনেডি তখন শিকাগোতেই ব্যবসা করতেন। মদের বিরাট স্টক। আশা করি, কেনেডি আর কাপোনের মধ্যে কী ধরণের ডিল চলত, তা আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। পাপা জো কেনেডি ছিলেন স্টক মার্কেটের বিগ বুল। মদের খানদানি ব্যবসায় লাল হয়ে ওঠা ধনী মানুষ। আর আল কাপোন? দ্য বিগ বস! স্যুট – বুট, সাদা ফেঁদোরা টুপি আর মুখে কিউবান চুরুট নিয়ে হলিউড আইকন। ব্যাডবয় ইমেজ নিয়ে ‘ম্যায় বাদশাহো কা বাদশা’। আমেরিকার এই আইকনকে মাথায় রেখে গ্যাংস্টার মুভির যুগ শুরু হল হলিউডে।

শিকাগোতে একটা সাংস্কৃতিক রদবদল আসছিল। আল কাপোন একটা নতুন কসেপ্ট আনল—স্পিকইজি বার। গ্যাংস্টারদের বার। মদ বন্ধ থাকলেও মদ মিলবে। ঝাকানাকা নাচ হবে। মেয়েমানুষের শরীর নিয়ে ব্যবসা চলবে। কে রুখবে আল কাপোনকে? মেয়র থেকে পুলিশ সবাই তার পকেটে ছিল। ঠিক ওই সময়েই আমেরিকার জ্যাজ ঘরানার সঙ্গীত জন্ম নিচ্ছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের গান। সেইসময়কার তাবড় তাবড় সব জ্যাজ মিউজিসিয়ানরা আল কাপোনের বার-এ বাজাতেন। যেমন লুই আর্মস্ট্রং। বলা হয় যে, মাফিয়া আল কাপোন না-থাকলে জ্যাজ ঘরানাকে আমরা পেতামই না।

এলোমেলো হাওয়া যেভাবে জলপথে এগোতে থাকলে শক্তি বৃদ্ধি করে মহাঝড়ে পরিণত হয়, সেভাবেই ক্ষমতা বাড়ছিল আল কাপোনের। প্রতিবছর কত আয় ছিল একটু লিখি—একশো মিলিয়ন ডলার। তবে পাবলিক ইমেজ কিন্তু দারুণ ছিল। রবিনহুড মার্কা। গরিবদের জন্য কমিউনিটি কিচেন করে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করত। কিন্তু রাজনীতিতে পালা বদল হলে এই ধরণের চরিত্রের জীবনের বদল আসে। হার্বার্ট হুবার রাষ্ট্রপতি হতেই ঠিক করলেন যে, আল কাপোনকে শায়েস্তা করতে হবে। আল কাপোন জননায়ক হয়ে উঠছিল। এবার তাকে খলনায়ক বানানোর সময়ে এসে গিয়েছিল।

সালটা ১৯২৯। ভ্যালেন্টাইন ডে। মানে ১৪ই ফেব্রুয়ারি। শিকাগোর কুখ্যাত গ্যাংস্টার মোরান-এর সাতজন লোককে কয়েকজন পুলিশ আটক করে। অবশ্য তারা পুলিশ ছিল কিনা সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন। দিনেদুপুরে মেশিনগান ফায়ার করে ওই সাতজনকে উড়িয়ে দেয় সন্দেহভাজন পুলিশবাহিনী। সন্দেহভাজন কেন লিখলাম? কারণ শোনা গিয়েছিল যে, আল কাপোন নাকি পুলিশ সাজিয়ে নিজের লোক পাঠিয়ে নিয়ে বসের ওপরে হওয়া হামলার প্রতিশোধ নিয়েছিল। যাই হোক, পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেল। আল কাপোনের পিছনে উঠেপড়ে লাগল প্রশাসন। তাকে আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল বলে ঘোষণা করে দিল মার্কিন গভর্নমেন্ট। আর ঠিক এর কয়েক মাস পরেই স্টক মার্কেট মুখ থুবড়ে পড়ল। আমেরিকার সামনে এল ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’।

সরকার আল কাপোনকে গাঁথতে চাইছিল। কিছু-না-কিছু দোষ ধরে তাকে গারদে ভরাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। মদ বন্ধ হওয়ার পরেই আমেরিকায় ইনকাম ট্যাক্স ব্যবস্থা চালু হয়। এর আগে কিন্তু আয়কর নামক কিছুই জানা ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই আয়কর আসার পরেও তাই কেউ ব্যাপারটাকে তেমন আমল দেয়নি। লোকে সেভাবে ট্যাক্স ফাইল করতো না। আল কাপোনও ট্যাক্স দেয়নি। ব্যাস! বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা টাইপের একটা আইনে ফেলে কাপোনকে কোণঠাসা করে দেওয়া হল। হত্যার আরোপ নয়, তস্কর হিসেবে নয়, অবৈধ মদ ব্যবসার জন্য নয়, আল কাপোনকে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার আইনে ফেলে মোকদ্দমায় বেঁধে ফেলল সরকার। সাগর টাগর পার করে এসে গোষ্পদে ডুবে গেল আল কাপোন।

বিচারে কাপোনের জেল হল। আটল্যান্টার জেলে প্রথম ক’টা বছর অবশ্য একেবারে ফাইভস্টার হোটেলের মতো লাইফস্টাইলেই কাটিয়েছে কাপোন। সমস্ত ভোগবিলাসের ব্যবস্থা ছিল। জেল থেকেই নিজের ব্যবসাও চালানো যেত। কিন্তু ওই যে নিয়তি, সে চাইলে রাজাকে ফকির আর ফকিরকে রাজা বানায়। রাষ্ট্রপতি বদল হল। রুজভেল্ট এলেন। পরে এলেন জন এফ কেনেডি। আর তখন কাপোনকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলা হল আমেরিকার সবথেকে কুখ্যাত জেল-এ। আল্কাট্রাজ আইল্যান্ডের জেল। জেলের জীবন সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা জানেন যে অনেক ক্ষেত্রেই বন্দিরা যৌন হেনস্থার শিকার হন। কাপোনের ওপর যৌন নির্যাতনের মাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে সে সিফিলিস গোত্রের গুপ্তরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। জেলেই তার মৃত্যু হয়।

‘গদফাদার’ কিংবা ‘স্কারফেস’-এর মতো ইংরাজি সিনেমা বা মাইকেল জ্যাকসনের ফেঁদোরা টুপির স্টাইল সবেতেই কিন্তু মাফিয়াসম্রাট আল কাপোনের ছাপ রয়ে গেছে। সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটা প্রশ্ন জাগেই—কাপোন কি মদবন্দি থাকাকালীন আমেরিকাতে রাজত্ব চালানোর জন্য কারো হাতের পুতুল ছিল? বন্ধুরা হয়তো ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছেন। আমি বাপু কিছু বলিনি। পাপা জো কেনেডির সঙ্গে মাফিয়াদের সম্পর্ক নিয়ে পরেও কথা উঠবে। জন এফ কেনেডিকে রাষ্ট্রপতি করার সময়ের অনেক হিসেব বাকি রইল।

এবার পাপা জো কেনেডি’কে লন্ডনে আমেরিকান অ্যাম্বাস্যাডর করে পাঠানো হল। এরপর হিটলার সেখানে বোমা ফেলবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

(ক্রমশঃ)