বিধাতার হাতে লেখা গান – ৯

অভীক মুখোপাধ্যায়

(অষ্টম পর্বের পর)

পর্ব – ৯

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মোটামুটি তিনটে গুণ থাকা দরকার। এক, ধনী ব্যক্তি হতে হয়, এবং অর্থবিত্তের ধ্যানধারণা রাখতে হয়। দুই, ফ্যামিলি ম্যান হতে হবে। কথায়-কথায় নিজের পরিবারকে মঞ্চে তুলে এনে আমেরিকাবাসীকে বোঝাতে হবে—আমি তোমাদের-ই (মতোই) লোক। (খেয়াল করলেই দেখবেন, ভারতের নেতারা আবার অবিবাহিত হয়ে থাকাটাকে অনেকটা হাই এস্টিমের বিষয় ভাবেন। যত বড় নেতা, ততই অবিবাহিত থাকার প্রবণতা বেশি। এমনকি বিয়ে হয়ে থাকলেও সেটাকে অস্বীকার করার একটা টেণ্ডেন্সি দেখা গেছে) এবং তিন, তাঁকে যুদ্ধ করতে হবে। সেটা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে হলে খুব ভালো হয়, নাহলে অন্তত পক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দেশের হয়ে কোনো যুদ্ধে অংশ নিয়ে সেই যুদ্ধের নায়ক হয়ে থাকতে হবে—‘ওয়ার হিরো’।

যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হল, তখন কেনেডি পরিবার হিটলারের সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে ফেলেছিল। পাপা জো কেনেডি হিটলারকে নিয়ে বেশ কিছু ভালো ভালো মন্তব্য করে বসেছিলেন। বড় ছেলে জো জুনিয়রও হিটলারের জাতিবাদী চিন্তাধারা নিয়ে বেশ আনন্দ প্রকাশ করেন। শুধু একজনই কিছু বলেননি—জন এফ কেনেডি। তিনি তখন এক ড্যানিশ যুবতীর প্রেমে মগ্ন। সেই কন্যের নাম ছিল ইনগা। এফ বি আই (ফেডেরাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) থেকে অবশ্য বলেছিল, জন এফ কেনেডির এই প্রেমিকা নাকি হিটলারের স্পাই ছিল। এই কাহিনিটা লিখতে বসলেই হয়তো একটা গোটা বই লেগে যাবে।

যাই হোক, হিটলারকে কেন্দ্র করে কেনেডি পরিবারের গায়ে দাগ লেগে গিয়েছিল। এবার ছিল সেই দাগ ধুয়ে ফেলার পালা।

বড় ছেলে জোসেফ বা জো জুনিয়র তড়িঘড়ি করে নৌ-বাহিনীর পাইলট উইং-এ যোগ দিলেন। আগেই লিখেছি যে, জো জুনিয়র কিন্তু সব দিক দিয়েই নাম্বার ওয়ান ছিলেন। একেবারে এক্সপার্ট! ছোট ভাই জন এফ কেনেডি তো প্রায়ই ভুগতেন। সেনায় যোগ দেওয়ার জন্য তাঁর মেডিকেল রেকর্ড গায়েব করিয়ে দেওয়া হল। ক্রেডিট গোজ টু হিজ ফাদার পাপা জো। জন এফ কেনেডি-ও চান্স পেয়ে গেলেন। বড়দা জোসেফকে ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করার জন্য ইউরোপে পাঠানো হল। জন এফ কেনেডি আমেরিকাতে বসেই জাপানিদের আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

স্কুল – কলেজের জীবনের পরে দুই ভাইয়ের মধ্যে আবার একটা ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেল যে, কে কাকে টেক্কা দিতে পারে।

আমেরিকা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে সলোমন দ্বীপ। সেখানে জন এফ কেনেডিকে পাঠানো হল। সঙ্গে একটা গুরুদায়িত্ব—জাপানের যুদ্ধজাহাজগুলোকে টরপেডো দিয়ে আক্রমণ করে ডুবিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আজকের জমানায় পড়তে যতটা সহজ লাগছে, ব্যাপারটা কিন্তু ততটা সহজ তখনকার দিনে ছিল না। আমেরিকা থেকে যে ক’টা যুদ্ধজাহাজ রওনা দিল, তাদের নিজেদের মধ্যেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কেনেডি নিজে যে জাহাজটাতে ছিলেন, সেটাও পথ হারিয়ে বসল। এবং দুর্ভাগ্যবশত জাপানি পক্ষের বোমার আঘাতে কেনেডিদের জাহাজটা ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ডুবতে বসল। সেদিন কেনেডির মৃত্যু নিশ্চিত ছিল।

কেনেডি ছোট থেকেই দুর্বল থাকতেন—এই প্রসঙ্গ একাধিক বার তুলেছি। কিন্তু যে কথা হয়নি বলা, তা হল তিনি একজন ভালো সাঁতারু ছিলেন। তাঁদের জাহাজ যখন ডুবতে বসেছিল, তখন তিনি নিজের এক সহকর্মীকে জাপটে ধরে নিয়ে সাঁতার কেটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গিয়ে একটা দ্বীপে ওঠেন। সেই দ্বীপে থাকাকালীন অবস্থায় নারকেল গাছ থেকে ডাব পেড়ে তৃষ্ণা মেটান। মাছ ধরে ঝলসে খান। এভাবে একসপ্তাহ অতিবাহিত হলে পরে উদ্ধারকারী টিম গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে। ব্যস! জন এফ কেনেডির ‘ওয়ার মেডেল’-এর ব্যবস্থা পাকা হয়ে যায় তখনই।

সবটাই নিয়তি। যে সবকিছুতে এগিয়ে ছিল, তাঁর কপালে মেডেল জুটল না, আর যে কিছুই করতে পারত না, সে হয়ে গেল নায়ক। দাদা জো জুনিয়র এই খবর পেয়েই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর কপালে তখনও কিছুই জোটেনি, মেডেল তো অনেক দূরের কথা। ওদিকে জো জুনিয়রের সব সঙ্গীরা দেশে ফিরে আসছিলেন। জো জুনিয়র তাঁদের বললেন—‘হিটলার আত্মসমর্পণ না-করা পর্যন্ত আমি দেশে ফিরছি না। ওকে হারানোর জন্যে আমি সব করতে পারি।’

তখনও ড্রোন ব্যাপারটা সায়েন্স ফিকশনের জিনিস (ড্রোন নিয়ে ‘হ্যারেৎজ’ বইতে বিস্তারে আলোচনা করেছি)। এরোপ্লেন গিয়ে বম্বিং করে আসত। তারও অনেক হ্যাপা ছিল। ডিরেক্ট বম্বিং করা যেত না। প্লেনে বম্ব লোড করে উড়ে যাও, তারপর অটো পাইলট মোডে রেখে প্যারাশুট নিয়ে লাফ মারো, পেছনে আরেকটা প্লেনে থাকা লোকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে বম্ব ইজেক্ট করে দেবে। জো জুনিয়র এরকমই একটা মিশনের জন্য সম্মত হয়ে গেলেন। গুপ্ত মিশন।

সবই ঠিক ছিল, কেনেডি জো জুনিয়র যখন প্যারাশুট নিয়ে লাফ মারতে যান, বোমাটা তখনই ফেটে যায়। কেনেডি আকাশেই হারিয়ে যান। দেহটাও মেলেনি। গুপ্ত মিশন ছিল, তাই আগামী তিরিশ বছরেও এই অপারেশনের কোনো খবর সামনে আনা হয়নি। আমেরিকান জনতা জানতই না যে কেনেডি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন। অনেক বছর পরে একজন জার্মান সৈন্য জানিয়েছিল, কেনেডি যখন প্যারাশুটে করে নীচে নামছিলেন, তখন আমরা ওঁকে গুলি করে মেরেছিলাম।

আমেরিকান পক্ষের একজন অফিসার এই সবটাই খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। আসলে তাঁর প্লেনটাই কেনেডির প্লেনের পেছনে ছিল। এবং বাস্তবে এই সাংঘাতিক ধরণের মিশনটার পরিকল্পনা তিনিই করেছিলেন। জো জুনিয়র আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট হতে পারে এই কথা জেনেও সেই অফিসার এই মিশনে সম্মতি দিয়েছিলেন। তিনি আবার ছিলেন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের ছেলে—কর্নেল ইলিয়ট রুজভেল্ট। তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন, কেনেডির প্লেনটা শূন্যেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

দাদার মৃত্যুর পরে জন এফ কেনেডি বলেছিলেন—‘ছোট থেকেই আমাদের মধ্যে একটা রেষারেষি চলত। ও সবসময়েই জিতে যেত। এবারেও জিতে গেল।’

ছেলের মৃত্যুর পরেও কিন্তু পাপা জো ভেঙে পড়েননি। জন এফ কেনেডি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে বলেছিলেন—‘পাপা আমাকে বলেছিলেন, যদি তোমার দাদার মৃত্যু হয়, তাহলে তোমাকে রাষ্ট্রপতি হতে হবে। যদি তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তোমার ছোট ভাই ববিকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কেনেডিরা হারতে শেখেনি, কেনেডিরা হারবে না!’

(ক্রমশঃ)