বিধাতার হাতে লেখা গান – ১৬

অভীক মুখোপাধ্যায়

(পঞ্চদশ পর্বের পর)

পর্ব – ১৬

রুজভেল্ট ক্রমশঃ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তখন বিশ্বের মহাশক্তি আমেরিকার নায়ক ঠিকভাবে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। হুইল চেয়ারটাই জেগে-থাকার মুহূর্তের বিশ্বস্ত সঙ্গী। তাই তাঁর পক্ষে তেহরানে গিয়ে উপস্থিত হওয়াটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। অন্যদিকে, স্তালিন আবার বিমান যাত্রা করতে ভয় পেতেন। তাঁর এরোফোবিয়া ছিল। চার্চিলকে নিয়ে কোনো সমস্যাই ছিল না, ভবঘুরের মতো ঘুরতে পারতেন। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া তাঁর কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। তবে তিনজনের মধ্যে একটা মিল ছিল—তিনজনেই ছিলেন চেইন স্মোকার। সবসময়েই মুখে জ্বলন্ত সিগারেট কিংবা চুরুট দেখা যেত।

স্তালিন রুজভেল্টকে খুব ভালো ভাবে বোঝালেন—‘আপনি তেহরানে গিয়ে রাশিয়ার অতিথি হয়ে থাকবেন। কোনো সমস্যা হবে না’

রুজভেল্ট স্তালিনের কথায় তেহরানে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। এত বড় রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের চালে একটা ভুল হয়ে গেল। স্তালিনকে বিশ্বাস করেছিলেন রুজভেল্ট। আঁচ করতে পারেননি যে, তেহরানে তাঁর থাকার নিবাসে স্তালিন গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য নানারকম যন্ত্রপাতি লাগিয়ে রেখেছেন। আসলে তখনও আমেরিকার গুপ্তচরবৃত্তি তেমন দরের হয়ে ওথেনি। তাই ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। আর এটাই ছিল স্তালিন ও রুজভেল্টের প্রথম সাক্ষাৎ। স্তালিন অসম্ভব ধূর্ত ছিলেন। তাঁর চোখ দেখেও তাঁকে বোঝা অসম্ভব হয়ে পড়ত। মুখে চুরুট গুঁজে, একটা সুন্দর হাসি নিয়ে তিনি নিজের শর্তগুলোকে এমন ভাবে পেশ করে দিতেন, যে সেগুলোই হয়ে দাঁড়াত খেলার শেষ দান। স্তালিন হিটলারের মতোই একনায়ক হলেও তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী, বুদ্ধিমান এবং অসম্ভব ধূর্ত নেগোশিয়েটর ছিলেন।

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। মিত্রশক্তির সেনাদল নাৎসিদের ঠেলতে – ঠেলতে বার্লিন ঢুকব – ঢুকব করছে। তখন স্তালিন আবার চার্চিল এবং রুজভেল্টকে আমন্ত্রণ করলেন। তদ্দিনে রুজভেল্ট ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি স্তালিনের আহ্বানে রাশিয়াতে গিয়ে পৌঁছালেন। ইয়াল্টাতে তাঁকে মহাসমারোহে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হল। ওখানেই শেষবারের মতো বসলেন ত্রিমূর্তি — স্তালিন, রুজভেল্ট আর চার্চিল। তিন ইয়ার মিলে কাগজে – কলমে গোটা ইউরোপটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন। ইয়াল্টা থেকে ফিরেই রুজভেল্ট গত হলেন।

এপ্রিল, ১৯৪৫। জার্মানিতে একদিক দিয়ে ঢুকল আমেরিকান সেনাদল, অন্যদিক দিয়ে রাশিয়ান সৈন্যরা। এই দুই দেশের সেনাদল একটা সময়ে, এক জায়গায় মিলিত হল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! সেই ছবি ধরেও রাখা হল ক্যামেরায়। ফৌজিরা নিজেদের ন্যাশনালিটি উপেক্ষা করে একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরল। জার্মানি জয়ের আনন্দে। এবারেই প্রথম এবং এবারেই শেষবারের জন্য এই দৃশ্য ধরা দিল পৃথিবীর বুকে। আর হয়নি। আর হয়তো হবেও না।

এই যে একটু আগে ইয়াল্টার কথা লিখেছিলাম, ওই শহরে বসেই সেদিন ইউরোপকে দুভাগে ভাগ করে নেওয়ার কথা হয়ে গিয়েছিল। মানচিত্রের বুকে স্তালিন একটা রেখে টেনে দিলেন — সেই রেখার পূর্ব দিকে সোভিয়েত রাশিয়ার অংশ, আর পশ্চিমে আমেরিকা / ইংল্যান্ডের এলাকা।

আমেরিকার মিসৌরিতে ১৯৪৬ সালে দেওয়া একটি ভাষণে চার্চিল এই রেখাটাকেই ‘আয়রন কার্টেন’ বলেছিলেন। কিন্তু ঠিক কী বলেছিলেন সেটাও জানা দরকার। তিনি বলেছিলেন — ‘ইউরোপে টানা এই লৌহ পর্দার একদিকে আছে সাম্যবাদ, অন্যদিকে পুঁজিবাদ। ক্রমশঃ বাড়তে থাকা সাম্যবাদ কিন্তু আমাদের পাশ্চাত্য খ্রিস্টান সভ্যতার জন্য সবথেকে বড় বিপদ।’

আজকাল টিভি চ্যানেলে আমরা রাজনৈতিক তরজা দেখে মজা নিই। একজন নেতা এই কথা বলা মাত্রই আরেকজন নেতা ওই কথা বলেছেন ইত্যাদি পাশাপাশি দেখানো হয়। তখনকার দিনেও নেতারা এমন বাইট দিতেন, শুধু সেগুলোকে চটজলদি এভাবে তারিয়ে তারিয়ে দেখার বা পড়ার উপায়টা ছিল না এই যা। চার্চিলের এই ভাষণের জবাবে মস্কো থেকে স্তালিন বললেন — ‘আমার প্রিয় বন্ধু চার্চিল আজকাল হিটলারি সুরে কথা বলছেন। আমি শুধু একটাই কথা বলতে চাই — আমরা কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যেও প্রস্তুত। আর এবারে লড়াইটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে হবে।’

ওয়ারটাইম প্রাইম মিনিস্টার চার্চিল থাকলে হয়তো আরেকটা যুদ্ধ হয়েও যেত, কিন্তু বিধাতার অঙ্গুলি হেলনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়ক চার্চিল ভোটে হেরে গেলেন। ইংল্যান্ডের জনগণ এবারে বেছে নিল বামপন্থী লেবার পার্টির ক্লিমেন্ট অ্যাটলিকে। স্তালিনের জন্য এটা ছিল সুখবর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর পারমাণবিক বোমার প্রয়োগের পরে আমেরিকার পুঁজিবাদে যেন জোয়ার এল — সে এক স্বর্ণযুগ। আহা কী আনন্দ আকাশে – বাতাসে! বেকারত্ব প্রায় নেই। লোকে গাড়ি কিনছে, গাড়ি চাপছে। কে বলবে যে এই আমেরিকাই একদা দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন দেখেছিল?

ওদিকে নাৎসি বাহিনী সোভিয়েতদের ক্ষতি করে দিল। বহু ইমারত, রাস্তা, রেললাইন ধ্বংস করে দিল তারা। সব মিলিয়ে প্রায় তিন কোটি লোকের মৃত্যু হয়। সরকারি জমিতে কাজ করতে থাকা চাষি অভুক্ত অবস্থায় মরছিল, কিন্তু এইসব খবর চেপে দিচ্ছিল সোভিয়েত গভর্নমেন্ট।

আর এদিকে ইউরোপে নারকীয় দৃশ্য চলছিল। যুদ্ধের পরে সোভিয়েত সেনা জার্মানিতে লুটতরাজ, গণধর্ষণ করছিল। যেসব সম্পত্তিকে স্থানান্তরিত করা সম্ভব, তা তুলে আনা হচ্ছিল সোভিয়েত দেশে। সঙ্গে ট্রেনের পর ট্রেনে বোঝাই করে আনা হচ্ছিল বৈজ্ঞানিক, শিক্ষকদের। কিন্তু কারণ কী? সোভিয়েত পক্ষের উত্তর ছিল — যুদ্ধের খরচা তোলা হচ্ছে। পোল্যান্ডের লোকেরা জার্মানিতে ঢুকে পড়ে ঘরবাড়ি জবরদখল করছিল, আর জার্মানরা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পলায়ন করছিল পশ্চিমে…আরো পশ্চিমে। চারিদিকে দারিদ্রের থাবা, ক্ষুধার করাল গ্রাস। ইংল্যান্ড সাহায্য পাঠালো। কিন্তু তারাই বা কী সাহায্য করবে, নিজেদেরই তখন ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা। জার্মানিকে সাহায্য পাঠাতে গিয়ে নিজেদের তহবিল শেষ হয়ে যাচ্ছিল, আর ইংল্যান্ডের লোকজনেই জরুরি পরিষেবা পাচ্ছিল না।

এমতাবস্থায় ইংল্যান্ড আর নিজের উপনিবেশগুলোকে সামলাতে পারছিল না। ভারতের মতো বড় একটা দেশকে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় তাদের কাছে ছিল বলে মনে হয় না। যদি তুলনা করে দেখা হয়, তাহলে বিধ্বস্ত, ধরাশায়ী, গৃহহীন, দারিদ্রের আক্রমণে লাঞ্ছিত, ক্ষুধার্ত ইউরোপের থেকে তখনও ভারতের অবস্থা অনেক – অনেক ভালো ছিল। এখনকার ইংল্যান্ড, জার্মানির সমৃদ্ধি দেখে সেইসব দিনগুলোর কথা বুঝতে পারাটা অসম্ভব।

ইরানের জন্য একটা সিদ্ধান্ত আগে থেকেই গৃহীত হয়েছিল—যুদ্ধ মিটে গেলে ইরানকে স্বাধীন করে দেওয়া হবে। ব্রিটেনের বাহিনী ফিরে গেল, কিন্তু স্তালিনের তো আর ইরান ছাড়তেই মন করছিল না। সদ্য গঠিত ইউনাইটেড নেশনস তাদের প্রথম ইস্যু পেয়ে গেল। ইরানকে তারা সোভিয়েত থেকে মুক্তি দিল। এবার আইনমাফিক কিছু করতে গেলে আইনকে আবার সবার জন্য সমান ভাবেই প্রয়োগ করে দেখাতে হবে। গ্রীস তখন ব্রিটেনের দখলে ছিল, ব্রিটেনকে সেখান থেকে বিদায় নিতে হল। এবার স্তালিনের নজর গিয়ে পড়ল গ্রীস এবং তুরস্কের ওপরে, কারণ এই দুটো দেশকে আয়ত্তে আনতে পারার মানে ছিল ভূমধ্যসাগর দখল করা।

স্তালিন এই যে আয়ত্তে আনার খেলা আরম্ভ করেছিলেন, এর মানে কিন্তু ফিজিক্যাল ক্যাপচার ছিল না। তিনি চাইছিলেন ওই দেশগুলোকে চালানো সরকারগুলো কমিউনিস্ট হোক এবং তাঁর আদেশে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করুক। একটার পর একটা দেশে কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হতে লাগল — পোল্যান্ড, রোমানিয়া, যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ইস্ট জার্মানি। স্তালিনের ইশারায় ওঠবোস করতে লাগলেন এইসব রাষ্ট্রের প্রধানরা। আর ইউরোপের অন্যান্য অংশের চূড়ান্ত দারিদ্রের কথা তো লিখলামই, তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে মানুষ সাম্যবাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। গরিব মানুষের মন বামপন্থীদের জন্য উর্বর জমির কাজ করে।

তবে এই সবকিছু থেকে অনেক দূরে, বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যা সম্পন্ন দেশটা আস্তে আস্তে একটা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছিল। ভারতের প্রতিবেশী দেশ চিনে মাও -ৎসে – তুং বিদ্রোহ আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। স্তালিনে বরাভয় তখন তাঁর মহাস্ত্র।

সেই মুহূর্তে সমগ্র ইউরেশিয়াতে নিজের অঙ্গুলিহেলনে অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারা স্তালিন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। পারমাণবিক বোমা তৈরি করার জন্য রাশিয়ার নিজের বৈজ্ঞানিকেরা তো ছিলই, পাশাপাশি কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল জার্মানি থেকে নিয়ে যাওয়া সায়েন্টিস্টদের। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সব রহস্যই রাশিয়ান গুপ্তচরদের মাধ্যমে জলের মতো সহজ হয়ে গিয়েছিল। এবার সত্যি সত্যিই আমেরিকা সোভিয়েতের ক্ষমতা বৃদ্ধি দেখে ভয় পেতে শুরু করেছিল।

১৯৪৭ সালে ট্রুম্যান একটা মারাত্মক বাক্য বলে বসলেন — ‘বিশ্বের যে কোনো দেশেই হোক না কেন, সাম্যবাদের বিস্তারকে আটকাতে আমেরিকা সম্ভাব্য সবকিছু করবে। দরকার হলে এই লড়াই একলাই লড়বে!’

এটাই ট্রুম্যান ডক্টরাইন।

এরই ফলে পরবর্তী কালে জন্ম নিল — মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও টাইপের স্লোগান।

এবং এই কারণেই শীতযুদ্ধের বাদ্যি বেজে উঠল।

(ক্রমশঃ)