বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৪

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ত্রয়োবিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৪

রাজনীতির একটাই নীতি হওয়া উচিত — মোবাইলের অ্যাপের আপডেটেশনের মতোই নীতিতে ক্রমাগত বদল আনতে থাকা। স্তালিন একদা রাজা ছিলেন, আবার একসময়ে তাঁরই মূর্তি জনতার পদতলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। আমেরিকাও বদলাচ্ছিল। যে ম্যাকার্থি সাম্যবাদীদের শিকার করছিলেন, তিনি নিজেই শিকারে পরিণত হলেন। আইজেনহাওয়ার দুধ থেকে মাছি তুলে ফেলার মতোই তাঁকে তুলে ফেলে দিলেন। বললেন —‘Mccarthism এখন থেকে Mccarthwasm…। এই দেশে এত ঘৃণা ছড়ানো চলবে না।’

এরই মধ্যে কেনেডি পরিবারও কিন্তু ওঁর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেছিল। একদা কট্টর দেশভক্ত রূপে পরিচিত জোসেফ ম্যাকার্থির দিন আর রাত কাটছিল মদের নেশায় চুর হয়ে। লিভারে সমস্যা দেখা দিল। তিনি ইহলোক ছেড়ে চলেও গেলেন।

জন এফ কেনেডি একটু উদারপন্থার সাহায্য নিলেন। সংখ্যালঘু, ইহুদি, আইরিশ এবং ইতালিয়ান – আমেরিকান মহিলা তথা শ্রমিকদের কাছে গেলেন। তাদের ইস্যুগুলোকে নিয়ে কাজ করতে লাগলেন। পাপা জো কেনেডির টাকার জোরটা তো ছিলই। সেনেটরের ভোটে জয় আর কে আটকাবে?

এবার আসা যাক সোভিয়েত আর আমেরিকার সম্পর্কের কথায়। প্রথমবারের জন্য কোনো কমিউনিস্ট সোভিয়েত লিডার আমেরিকার মাটিতে পা-রাখলেন। ১৯৫৯ সালে নিকিতা ক্রুশ্চেভ নিজের শাহী বিমানে চড়ে আমেরিকা গেলেন। গানবাজনা সহযোগে ভদ্রলোকের রিসেপশন করা হল।

আইজেনহাওয়ার আর ক্রুশ্চেভ একযোগে বললেন — ‘আমরা বিশ্বের সবথেকে বড় দুটি শক্তি। এবার আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। আর যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।’

সবাই ভাবল, শীতযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। পরের বছরই আইজেনহাওয়ার আর নিকিতা ক্রুশ্চেভের প্যারিসে সাক্ষাতের কথা ছিল। ক্রুশ্চেভ ঠিক যে সময়ে সোভিয়েত থেকে বিমানে উড়লেন, ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তান থেকে একটি বিমান টেক অফ করল। এই বিমানটি কিন্তু পাকিস্তানি বিমান ছিল না, ছিল একটি মার্কিন বিমান।
আমেরিকা একটি গুপ্তচর-বিমান তৈরি করে ফেলেছিল। বিমানটিকে কোনো রাডারে ধরা সম্ভব ছিল না। এই প্লেন উড়ে – উড়ে সোভিয়েত দেশের ছবি গোপনে তুলে নেওয়ার জন্যে গেল। কিন্তু সোভিয়েত ব্যাপারটা ধরে ফেলল এবং গুলি করে নামাল ওই বিমানটাকে। প্লেনখানা মাটিতে পড়ে ধ্বংস তো হলই, পাইলট বেচারাও বন্দি হয়ে গেল।

ক্রুশ্চেভ প্যারিসে নেমেই খবরটা পেলেন। সম্মেলনে খোলাখুলি বললেন — ‘এই ধরণের ঘৃণ্য কাজের তীব্র নিন্দা করছি। অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। আর আমি কোনো ফাঁকা আওয়াজ করি না। এটা একটা ওয়ার্নিং। আপনি আপনার ইচ্ছে গেলেই বিনা অনুমতিতে সোভিয়েত বা কোনো সমাজবাদী দেশের সীমা লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়তে পারেন না। আর যদি বলেন, আমাদের দেশের সীমানা সম্পর্কে আপনার সম্যক ধারণা নেই, তাহলে আমরা সেটা বুঝিয়ে ছাড়ব। আমাদের দেশের সীমারেখার প্রত্যেক বিন্দু থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাবেন।’

আইজেনহাওয়ার কিন্তু কোনো ক্ষমা চাইলেন না। আর এতেই ক্ষেপে গিয়ে নিকিতা ক্রুশ্চেভ সম্মেলন ছেড়ে বেরিয়ে নিজের গাড়ি ধরে চলে গেলেন।

আমেরিকার এই গুপ্তচরবৃত্তি কিন্তু একেবারে নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। সোভিয়েত রাষ্ট্রও কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আমেরিকাতে চরবৃত্তি চালিয়ে গেছে। সমস্যা একটাই, ধরা পড়ে যাওয়া। এর আগেও একটা বড়সড় কাণ্ড হয়েছিল। স্তালিনের খুব কাছের লোক এবং গুপ্তচর সংস্থার চীফ লাভরেন্তি বেরিয়ার ওপরে দোষারোপ হয়েছিল। ইয়াল্টা সম্মেলনে তিনি স্তালিনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। স্তালিনের পরে এই লাভরেন্তিই রাষ্ট্রপতি হতেন, কিন্তু নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাঁকে আমেরিকান গুপ্তচর এবং দেশদ্রোহী বলে ট্রায়ালের মুখে ফেলেন। তিনি নতজানু হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে গুলি মেরে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

মজার ব্যাপার নাকি কাকতালীয় তা জানা নেই, তবে ইয়াল্টা সম্মেলনে রুজভেল্টের দক্ষিণ হস্ত এল্গর হিসস-এর ওপরেও কিন্তু দেশদ্রোহীতার আরোপ আনা হয়েছিল। ঠিক বেরিয়ার মতোই। যদি সত্যিই এই দুজন ব্যক্তিই নিজ নিজ মনিবের প্রতি প্রভুভক্তিতে ছেদ ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে কিন্তু বলতেই হয় যে উভয়পক্ষের গুপ্তচরবৃত্তিই ছিল অসাধারণ।

ওদিকে জন এফ কেনেডি আমেরিকায় ভাষণ দিলেন — ‘জেনারেল আইজেনহাওয়ার এবার আমাদের দেশের মানসম্মান নিয়ে খেলা করাটা বন্ধ করুন। সোভিয়েতের কাছে পদে পদে ঠোক্কর খেয়েও লজ্জা হচ্ছে না? আমরা ওদের থেকে মাটিতে পিছিয়ে, আকাশে পিছিয়ে, মহাকাশেও পিছিয়ে। এবার একজন সশক্ত নেতার প্রয়োজন।’
যখন কেনেডি এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন সোভিয়েত ইউরি গ্যাগারিনকে মহাকাশে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রথম কোনো মানুষ মহাকাশে চলেছিল। পৃথিবী পরিক্রমা করবে বলে গিয়েছিল। অদ্বিতীয় এক ঘটনা। শুধু সোভিয়েতের নয়, এ ছিল সারা বিশ্ববাসীর গর্ব। কখনো কখনো মাধ্যমের থেকেও লক্ষ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে বিজ্ঞান-সমুদ্র এমন ভাবে মন্থন হচ্ছিল যে, নিত্য নতুন হলাহল, কামধেনু, মোহিনী কিংবা অমৃত উঠে আসছিল। রোজ নতুন গবেষণা। রোজ নতুন আবিষ্কার। নতুন উচ্চতা স্পর্শকারী রেকর্ড। কোল্ড ওয়ার কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আশীর্বাদই ছিল।

দুনিয়া হ্যায় গোল, রক অ্যান্ড রোল!

সত্যিই দুনিয়াটা এবার রক-ও করছিল, রোল-ও করছিল।

(ক্রমশঃ)