বিধাতার হাতে লেখা গান-৪১

অভীক মুখোপাধ্যায় 

(চত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪১

‘যখন ভারত আর চিনের সাক্ষাৎ হয়, তখন সারা বিশ্ব সেদিকেই তাকিয়ে থাকে।’ — জি জিনপিং

ভারত এবং আমেরিকা হল বিশ্বের দুটি সবথেকে বড় গণতন্ত্র। ভারত এবং চিন হল এই পৃথিবীর এমন দুটি রাষ্ট্র, যাদের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রথম জুটিতেও ভারত আছে, দ্বিতীয় জোড়াতেও ভারত আছে। কমন ফ্যাক্টর। আমেরিকা আর চিনের মধ্যে আমেরিকা হল পুঁজিবাদী দেশ, চিন হল তথা সাম্যবাদী রাষ্ট্র। দুটি পৃথক নীতি নিয়ে চলা দেশের মধ্যিখানে দাঁড়ানো ভারতকে কিন্তু বন্ধু – রাষ্ট্র হিসেবে যে কোনও একটিকেই বেছে নিতে হতো। ভারত কাকে বেছে নিয়েছিল? প্রেম – ত্রিকোণের মতো তিনটি বিন্দুতে অবস্থিত এই তিনটি দেশের যে কোনও একটির অবস্থানে সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটলেই যুদ্ধের সম্ভাবনা ছিল। ১৯৬২ সালে তেমন বিচ্যুতিই অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

১৯৬২ সালের যুদ্ধ। সবাই বলে ভারত – চিন যুদ্ধ। যে যুদ্ধ হয়তো হয়নি, তাকেই যুদ্ধ – যুদ্ধ বলা হয়। আবার এটাও বলা চলে যে সেদিনের সেই যুদ্ধ শুরু হলেও আজ অবধি শেষই হয়নি, তবুও বলা হয় যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ইতিহাসবেত্তারা অনেক কিছু বলেন, কিন্তু একথা বলতে যান না যে, ১৯৬২ সালে আমেরিকা না – থাকলে না এই যুদ্ধ শুরু হতো, না এই যুদ্ধ শেষ হতো। এই যে বিস্তীর্ণ শৃঙ্খলাটিকে লিখতে শুরু করেছিলেম, তখন কিন্তু আমার মাথায় কেনেডি সাহেব আসেননি। একজন ভারতীয় হিসেবে কেনেডি সাহেবের ব্যাপারে আগ্রহ না – আসাটাই স্বাভাবিক। মাথায় ছিল ভারত চিনের যুদ্ধ। তারই সরেজমিন তদন্ত করতে গিয়ে দেখি কেনেডির হাত। বিধাতা তখন আমাকে দিয়ে কেনেডির কথা বোলাতে আরম্ভ করলেন। সবই তো তাঁর হাতে। বিধাতাই আমাদের কেনেডি, বিধাতাই আমাদের আমেরিকা। যাক গে, বাজে কথা ছেড়ে আমেরিকাতে ফিরি, ভারত – চিনে ফিরি, ১৯৬২ সালটাকে ঘুরে ফিরে দেখি, কারণ ১৯৬২ সালের পরই ভারত নামক এই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মন থেকে সাম্যবাদের প্রতি স্পৃহা কমতে থাকে। মোহভঙ্গ প্রেমিকের মতো ভারত পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকতে আরম্ভ করে দেয়। হাত ধরে আমেরিকার।

হিটলারের একটি মন্তব্য মনে পড়ছে — ‘It is not truth that matters, but victory.’ স্বাধীন ভারতের ভেতরে এবং বাইরে বহু যুদ্ধ ভারত লড়েছে, তার মধ্যে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল ভারত – চিনের যুদ্ধ। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ। বীরত্ব, শৌর্যের কোনও কমতি ছিল না। এসবকিছু থাকা সত্ত্বেও ভারত – চিনের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলাই হয় না, কারণ ভারত তথাকথিত ভাবে সেই যুদ্ধে জিততে পারেনি। জয়ীই সত্য, বাকী সবকিছু কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই যুদ্ধের যাবতীয় নথি, দলিল দস্তাবেজকে দাবিয়ে রাখা হয়। লজ্জার তদন্ত কে-ই বা কবে চেয়েছে বলুন দেখিনি? সেইসময়ে এমন বেশ কিছু সিনেমাকে রিলিজ হতে দেওয়াই হয়নি, যেগুলি ভারত – চিন যুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়েছিল। স্বর্ণালি ইতিহাসের বুকে কালো আখর কে-ই বা দেখতে চায়? ভুলে যাও, বন্ধু। ভুলে যাওয়াই ভালো। পরে সরকারের পরিবর্তনে অবস্থানে কিছু বদল এসেছে। সাম্প্রতিক বইপত্র লেখাও শুরু করেছেন অনেকে। কেউ ভারতের হার নিয়ে লিখেছেন, কেউ লিখেছেন চিনের জিত নিয়ে। কেউ বলতে চেয়েছেন এই এই জিনিসগুলো পেলে ভারত অবশ্যই জিতে যেত। আমরা একটু অন্য কোণ থেকে দেখব — ত্রিভুজের তৃতীয় বিন্দুটায় উঠে বসা যাক, যেটার নাম আমেরিকা। আমরা আমেরিকা চোখ দিয়ে দেখব। থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার হয়ে।  

সেনেটর হিসেবে কেনেডি ১৯৫১ সালে ভারতে এসেছিলেন। তখন নেহরুজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু তার পরে ভারত – আমেরিকার সম্পর্কে বিশেষ কোনও আঠা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং ওই সময়ে ভারত – সোভিয়েত সম্পর্কে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়েছে। অথচ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান আমেরিকার পক্ষ চয়ন করে নিয়েছিল। আমেরিকার পোষ্যপুত্র হয়ে উঠেছিল। তখন পেশোয়ারে আমেরিকান সেনাছাউনি, ঢাকা-তে (তখন কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পড়ত) আমেরিকান সৈন্য। মার্কিন জাহাজ আর উড়োজাহাজ তখন সবদিকে নজর রাখত। খবরদারি চালাত। গোড়ায় লিখেওছি যে সোভিয়েতরা এরকম নজরদারি চালাতে থাকা মার্কিন প্লেন গুলি মেরে নামিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে সোভিয়েতের ওপরে নজরদারি চালানো বন্ধ হয়ে গেলে আমেরিকা চিনের ওপরে নজর রাখছিল। পূর্ব পাকিস্তানের দিক দিয়ে মার্কিনরা চিনের ওপরে নজর রাখছিল। গোপনে ছবি আর ভিডিও তুলে আনা হচ্ছিল চিনাদের। নিজেদের দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়ার বদলে পাকিস্তান পেত লাখ – লাখ ডলার। সেই অর্থ পাকিস্তানের ঘুষখোর নেতা – মন্ত্রীরা খেয়ে ফেলত, সেনা – আধিকারিকদের স্তম্ভ সেই অর্থেই শক্ত হচ্ছিল; সেই অর্থ দিয়ে পাকিস্তান ভারত – বিরোধী কার্যকলাপ ক্রমশ বাড়িয়েই চলেছিল।  

১৯৫০ – ১৯৬০। খুব গুরুত্বপূর্ণ দশক। ওই দশকের শেষভাগে দুটি ভিন্ন সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুজির সঙ্গে দুজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ হয়। একজন ছিলেন তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা জেতসুন জাম্ফেল নোয়াং লবসাং ইয়েশে তেনজিং গিয়াৎসো। আরেকজন ছিলেন এই গিয়াৎসোর কাস্টডির দাবীতে আসা চৈনিক রাষ্ট্রপ্রধান চাউ এন লাই। প্রথমজনকে চিনে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। আজ্ঞে হ্যাঁ, ইনি এখনকার দলাই লামা। চাউ এন লাই দলাই লামাকে ফেরত চাইতে এসেছিলেন। নেহরু কাউকেই চটাতে চাইছিলেন না। শরণ দেওয়ার ইচ্ছেটাও ছল, বন্ধুত্বও হারাতে চাননি পণ্ডিতজি।  

বন্ধুত্ব হারাতে না – চাওয়াটাই স্বাভাবিক। দুটি বৃহৎ দেশ। দুদেশের মধ্যে মাইলের পর মাইল ধরে তানা সীমান্তরেখা। মাও ৎসে তুং থেকে শুরু করে চাউ এন লাই পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে নেহরুজির কথা হতো। ১৯৫১ সালে যখন ইউনাইটেড নেশনস পণ্ডিতজিকে সান ফ্রান্সিস্কোতে আমন্ত্রণ জানাল, তখন পণ্ডিতজি সেই আমন্ত্রণকে অস্বীকার করলেন। কারণ কী ছিল? কারণ চিনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

তাই যখন চাউ এন লাই নেহরুজিকে বললেন যে, দলাই লামাকে ফেরত পাঠাতে হবে এবং চিনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলালে চলবে না, তখন নেহরুজি পড়লেন উভয় সঙ্কটে। শাঁখের করাত একেই বলে। তৃতীয় কোনও পক্ষের প্রয়োজন অনুভব করলেন। চলে গেলেন আমেরিকাতে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। পথ চাই যে।

আইজেনহাওয়ার নেহরুজিকে নিয়ে নিজের বিশাল ফার্মে চলে গেলেন। আরাম করে কথা হবে। সামনের টেবলে সাজানো মাছ আর ওয়াইন।

নেহরুজি প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনি চিনকে ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিলে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিন। জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম রাষ্ট্র। আমাদের প্রতিবেশী। ভারত আর চিন দীর্ঘ সীমান্তরেখা ভাগাভাগি করে আছে। আমাদের দেশ সোভিয়েত বা আমেরিকা নয়, চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে এগোতে চায়। যতই হোক পড়শি বলে কথা।’

আইজেনহাওয়ার তার কিছুদিন আগেই কোরিয়াতে চিনের কাছে হেরেছিলেন। ক্ষত টাটকা। ক্ষেপে গেলেন। সোজা বলে দিলেন, ‘এসব হবে না।’

‘আচ্ছা, তাহলে একটা অন্য কথা বলি। ন্যাটোতে পর্তুগাল আপনাদের সহযোগী রাষ্ট্র। এবার ওদের বলুন ভারত থেকে তল্পিতল্পা গোটাতে হবে। ইংরেজদের আসারও অনেক আগে আমাদের দেশে এসেছে।’

আইজেনহাওয়ার পর চোদ্দ পাতার একটি নোটে নেহরুজির কথা লিখেছিলেন। লাইনটার ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায় — ‘নেহরু এমনিতে বেশ ভালো মানুষ, কিন্তু আমি ওঁর কথাবার্তা কিছুতেই বুঝতে পারি না।’

অন্যদিকে আরেকটা টানাপোড়েন চলছিল। তিব্বতে ব্রিটিশদের অধিকার ছিল। হলে কী হবে? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তিব্বত ছিল অন্য একটি রাষ্ট্রের অধিকার – ক্ষেত্র। চিনের। ইংরেজ সাহেব ম্যাকমোহন ব্রিটিশ রাজত্বের হিসেবে আঁক কষে একটি সীমানা বানিয়ে দিলেও চিন কখনোই তা মেনে নেয়নি। যখন ভারত স্বাধীন হল এবং চিনে মাউ ৎসে তুং এলেন, তখন চিন তিব্বত অধিকার করে নেয়। আর এরপর থেকেই শুরু হয় একটি নতুন খেলা, চিন তিব্বতের পশ্চিমে থাকা ভারতের ভূমিটিকেও নিজেদের বলে দাবী করতে আরম্ভ করে দেয়। ওটাই আকসাই চিন।  

সত্যি কথা হল নেহরুজির কাছে তিব্বতকে ছাড়িয়ে আনার মতো সাধ্য ছিল না। ভারতের সেনাবাহিনী তখন পশ্চিম আর পূর্ব দিকে পাকিস্তানের সেনার সঙ্গে যুঝছে। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই নীতিতে ভর করেই নেহরুজি চাউ এন লাই-এর সঙ্গে বারংবার দেখাসাক্ষাৎ করে তিব্বত নিয়ে চর্চা করে চলেছিলেন। কিন্তু নীট ফল জিরো।

আমেরিকা সবকিছুতে প্রফিট দেখতে পায়। যাতে কিচ্ছু নেই তাতেও। তাই তারা তিব্বতেও লাভ খুঁজে পেল। শুধু – শুধুই পেল। এবং সম্ভবত আমেরিকার লাভ খোঁজার এই তাগিদই একটি যুদ্ধের জন্ম দিল। নইলে ভারতকে চিনের সঙ্গে লড়তে হতো না। সুখী দম্পতি না হোক, ঘর ভাঙার মতো অবস্থায় তখন আসেনি ভারত আর চিনের দাম্পত্য, আমেরিকা অবৈধ প্রেমিকের মতো তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ঢুকে পড়ে সংসারে আগুন লাগিয়ে দিল। ইতিহা সাক্ষী আছে, আমেরিকা এভাবেই কালে- কালে দিকে –দিকে আগুন লাগিয়েছে।

এইসময়ে আমেরিকা যে টেকনিক ব্যবহার করেছিল, তা পরে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান বলবে ভারত সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেইনড করে তুলেছে, ভারত বলবে পাকিস্তান একই পদ্ধতিতে কাশ্মীরে জেহাদিদের জন্ম দিয়েছে, ভারত শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের দিকেও একই আঙুল তুলবে।

তা কী করছিল আমেরিকা?

তারা তিব্বত থেকে টুক – টুক করে তিব্বতীয়দের তুলে নিয়ে আসছিল অধুনা বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। সেখান থেকে প্লেনে করে নিয়ে যাচ্ছিল কলোরাডোতে। কলোরাডোতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। ফেরত আনছিল ঢাকায়। ঢাকা থেকে ব্যাক টু টিবেট। গুটিকয় তিব্বিতীয় গেরিলা যোদ্ধা লাল – চিনের সুবিশাল বাহিনীর সঙ্গে লড়তে চলেছিল। আমেরিকা নিজে কিন্তু আসেনি। তিব্বতীয় গেরিলাদের শহিদ হওয়ার সব পথ খোলা রেখে তাদের ছেড়ে দিয়েছিল। এই একই টেকনিক তারা পরের রাষ্ট্রপতি কেনেডির সময়েও ব্যবহার করবে। কিউবায়। বলেছি সেই গল্পটাও।  

ভারতের কিন্তু এসবে কোনও ভূমিকা ছিলই না। পুরো ব্যাপারটায় পাকিস্তান আমেরিকাকে মদত দিচ্ছিল। কিন্তু চিন ভারতের ওপরে ক্ষেপে উঠছিল অন্য কারণে। দলাই লামার প্রসঙ্গে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডল লিখছেন —

‘সি আই এ – এর বিভিন্ন গতিবিধির কারণেই ১৯৬২ সালে চিন ভারতকে আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণ চিনকে আমেরিকার শত্রুতে প্রিণত করে দেয়। ভারত আর চিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তান চিনের নেকনজরে চলে আসে। আর ভারত আমেরিকার কাছাকাছি হয়ে যায়।’

দুই মহাযুদ্ধের পরের বিশ্বে নতুন সব মহাশক্তির জন্ম হচ্ছিল। পালটে যাচ্ছিল সকল সমীকরণ।

(ক্রমশ)