বিদেশে বিভ্রাট – ২

0
509

(পূর্ব প্রকাশিতের পরে)

আমি বললাম, “ব্যাগ নেই মানে! আপনিই ঢোকালেন, আপনার মনে নেই?”
“ইয়েস, আই রিমেমবার। বাট নো ব্যাগ.. কেউ ভুল করে নিয়ে যেতে পারে।”
“কিন্তু সেটা তো আপনাদের দায়িত্ব। আপনি নিজেই তো বার করে দিয়েছেন সবাইকে।”
“স্যার, আই কানট রিমেমবার এভরিথিং। কেউ নিয়ে গেলে আমার কিছু করার নেই। আমাদের এবার যেতে হবে।”
পারমিতা বলল “এবার কি হবে তাহলে? আমার সবকিছুই তো ওর মধ্যে ছিলো..”
আমি একটু নিচু হয়ে দেখলাম। ভিতরে একটা ছোট্ট ব্যাগের মত কিছু একটা
“ওটা কি? দেখুন তো…”
কন্ডাকটর দেখে বলল “ওটা আমার ব্যাগ” হাত দিয়ে টেনে বার করে দেখাল। নাহ, এটা আমাদের নয়…
বাস এবার ছেড়ে দেবে। হঠাৎ পারমিতা নিচু হয়ে ঢুকে যেতে গেল পেটের মধ্যে।
“আমি একবার ভালো করে দেখব ভিতরটা, নিশ্চয় আছে এর মধ্যে। কোথায় যাবে?”
কন্ডাকটর হৈ হৈ করে উঠলো।
“ম্যাডাম ম্যাডাম, ঢোকার নিয়ম নেই। না না, বেরিয়ে আসুন…”
কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলো। ড্রাইভার চুপ করে সব শুনছে, একটা কথাও বলছে না।
আমি বললাম “আমি পুলিশে যাব, ছাড়ব না। এর শেষ দেখে ছাড়ব…”
“ইয়েস, ইউ মাস্ট গো। হ্যাভ ইউ পারচেসড ইন্সুরেন্স?”
“না…”
“তাহলে কিছু করার নেই।”
বলে কন্ডাকটর বাসে উঠে পড়ল।

ধীরে ধীরে আমরা দেখলাম বাস ঢুকে যাচ্ছে ভিতরের দিকে। কেউ কোথাও নেই এখন, একদম শুনশান। মাথায় জানি আকাশ ভেঙে পড়েছে দুজনের। আর দশদিন বাদেই আমাদের সুইজারল্যান্ড যাওয়া, কিন্তু সব নতুন জামা-কাপড়-জুতো-জিনস, দামী শাড়ি ওই ব্যাগের মধ্যেই ছিল। ভাগ্য ভালো বাড়িতে পরার একটা পোশাক হাত ব্যাগে রয়েছে, নাহলে আমার জামা-প্যান্টই পরতে হত পারমিতাকে। এইভাবেই মনে হয় স্ত্রীদের স্বামীদের উপর থেকে ভরসা চলে যায়।

এত সুন্দর ফ্ল্যাট, না খুশী হয়ে থাকা সম্ভব নয়। পারমিতা ঘুরে ঘুরে দেখল। সবচেয়ে খুশি হলো স্নানঘরের বড়সড় বাথটাবটা দেখে।

ওই রাতেই ইন্টারনেট খুলে বসলাম। প্রথমে একটা কড়া চিঠি লিখলাম ন্যাশনাল এক্সপ্রেসকে সবরকম তথ্য দিয়ে। তারপর খোঁজ নিলাম কাছাকাছি কোথায় থানা আছে। বাহ! আমাদের অফিসের পথেই রয়েছে থানা, হয়ত প্রতিদিন তার পাশ দিয়েই আমরা যাই-আসি। বেশ রাত করেই ঘুমাতে গেলাম, মাঝরাতে হঠাৎ করে কারো কাতরানি আওয়াজ। ধড়ফড় করে উঠে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি, তারপর খেয়াল হতে বুঝতে পারলাম পারমিতা কাঁদছে … ব্যাগের শোকে নাকি!
বললাম, “কি হয়েছে? কাল আমি পুলিশে যাচ্ছি তো, কিছু একটা হবে… এখানকার পুলিশ কি আর আমাদের ওখানকার মতো?”
খ্যাক্খ্যাক্ করে উঠলো, “পেটে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ… এদেশে না আসলেই ভালো ছিলো দেখছি …”
“এর আগে এরকম হয়েছে কখন?” পারমিতার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম ব্যথা নিত্যদিনের সঙ্গী… তার কারণ এবং নিরাময় দুই-ই রহস্যময়…
“হ্যাঁ …”
“কোনো ওষুধ আছে সাথে?”
“না…”
“অদ্ভুত! তোমাকে যে বললাম সবরকম ওষুধ নিয়ে এসো। এখানে দুম করে ওষুধ কেনা যায় না প্রেসক্রিপশন ছাড়া। এখন ডাক্তার দেখাতে হবে এবং সেটাও সোজা নয়। সেই এন এইচ এস-এ যোগাযোগ করতে হবে, ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।”

সকালে তাড়াতাড়ি ভাতে-সেদ্ধ আর ডাল রান্না করে রেখে গেলাম, তখন ব্যথা একটু কমেছে কিন্তু তবু মাথা থেকে চিন্তা গেলো না। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে,  আবাহাওয়াটাও মেঘলা মেঘলা। যে ছেলে কোনদিন দেশেই থানা-পুলিশ করেনি সে বিদেশে এসে কিভাবে থানার বড়বাবুর সাথে কথা বলবে? থানার কাছে এসে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম, ঠিক করে বোঝাতে পারব কি আদৌ? তখনও আমার ইংরেজি বলা মনে মনে বাংলা থেকে অনুবাদ করে। সে যেমন কষ্টকর, তেমনি বেসুরো। থানার সামনে একটা লম্বা মতো খোলা জায়গা যার সামনে বুক-সমান উঁচু একটা লম্বা কাঠের টেবিল। কেউ নেই… কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কি করবো ভাবছি, পাশের একটা দরজা খুলে যে মেয়েটা এলো সে আমাদের দেশে যে কোনদিন নায়িকা হয়ে যেতে পারবে। নিশ্চয় ক্যামেরা লাগানো আছে কোথাও। পাঁচফুট তিন ইঞ্চি মত লম্বা হবে, নির্মেদ, সুঠাম। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে সাদা নয়, অনেকটা পাঞ্জাবি মেয়েদের মত… মুখের মধ্যেও এদেশী মেয়েদের কর্কশতা নেই। বিনুনি করে চুল পিছনে বাঁধা।

মেয়েটা সুন্দর করে জিজ্ঞাসা করলো কি এমন জিনিস যা আমাকে থানায় টেনে আনলো। আমি একটু হেসে সব যতদূর পারি গুছিয়ে বললাম। কিন্তু হতাশ হতে হলো। মেয়েটা বলল এ ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারবে না। কোম্পানির সাথে সমস্যা, কোম্পানির সাথেই মেটাতে হবে। আমি  মোবাইল-এ ইমেইল দেখালাম যেটা আগেই আমি পাঠিয়েছি। দেখে মেয়েটা একটু কি জানি ভাবলো, কিন্তু কোনো নালিশ নিতে যে সে তৈরি নয় বুঝতে পারছি। বাঙালি ছেলে, এত সহজে কি ছাড়া যায়, একটু হৈ-চৈ না করলে হবে কেন। আমি বললাম এটা কোম্পানির ব্যাপার নয়, এটা প্রতারণা। আমি লিখিত না জানিয়ে যাচ্ছি না.. বিশেষ করে আমাদের একান্ত বিশ্বাস যে কন্ডাকটরই কিছু করেছে। তার বিরুদ্ধেই আমি অভিযোগ জানাতে চাই। বিদেশী পেয়ে আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া হয়েছে। শেষ কথাটা কাজে দিল মনে হয়। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে একটা লোক বেরিয়ে এলো। খুব লম্বা নয়, কিন্তু বলিষ্ঠ চেহারা। একটা ব্যক্তিত্ব আছে মুখে, চলাফেরায়। তাকে দেখে মেয়েটা ভিতরে ঢুকে গেলো। লোকটা আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “নো শাওটিং। হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

আবার সব বললাম। কোনো কথা না বলে একটা কাগজ আর পেন বার করে দিলো। সব লিখলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম, ফোন করে জানালাম পারমিতা-কে। কিন্তু দুজনেই আশা ছেড়ে দিলাম। বিকেলে গিয়ে  কিছু জামা-কাপড় কিনে নিতে হবে মার্কস-এন্ড-স্পেন্সের্স থেকে। মনের মেঘ কাটাতে বললাম, “ধুর! পুরনো জামা-কাপড় পরে সুইজারল্যান্ড বেড়াতে যাবে কেন? নতুন কিনে দেব তোমায়…”
একটু হাসির আওয়াজ শুনলাম জানি।
“আমার ব্যথা কিন্তু কমেনি, আরো বাড়লে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যাবে না।”
“হুমম, তাহলে এবার থানা ছেড়ে এন এইচ এসে যোগাযোগ করা দরকার…”
অফিস এসে সবাই-কে বললাম ঘটনাটা, সবারই একই বাক্য – “এদেশেও এমনি হয়!”
হঠাৎ মনে হলো সব সমস্যার কাণ্ডারী সেই নালাকে একবার বললে কেমন হয়। এমন ব্যক্তিগত সমস্যা বলতে একটু সংকোচ হলো বটে কিন্তু বুঝিয়ে বললাম। নালা মন দিয়ে শুনে বলল “চিন্তার কিছু নেই, আমি দেখছি কি করা যায়। ব্যাগটা তো আর হাওয়া হয়ে যাবে না…”
আমি একটু জোর দেবার জন্যেই বললাম, “পুলিশের লোকজন হয়ত ভাবছে আমরা বানিয়ে বলছি, কিন্তু ঘটনাটা সত্যি।”
নালা একবার আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো, তারপর বলল “তুমি ইণ্ডিয়া থেকে, ইণ্ডিয়ানরা মিথ্যে বলে না। “
কথাটা শুনে ভালো লাগার চাইতে খারাপ লাগলো বেশি। মানুষের কত বিশ্বাস, কিছু মহান মানুষের জন্যেই না সেই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। আর আমরা সেই বিশ্বাস থেকে কত দূরেই না বাস করি আসলে। আমাদেরই এক সহকর্মী দিনের পর দিন ট্যাক্সি বিল জোগাড় করে টাকা দাবি করে যাচ্ছে অফিস থেকে।
নালা বেশ কয়েকটা ফোন করলো। উত্তেজিতভাবে হাত-টাত নেড়ে কথা বলল বেশ কিছুক্ষণ, ভারতীয় দূতাবাসের কথাও জানি শুনলাম। তারপর বলল,
“আর এখন কিছু করার নেই, অপেক্ষা করা ছাড়া। সুতারং এনজয় ইওর স্টে নাউ, ডোন্ট স্পয়েল দা ফান…”
একদম ঠিক কথা। ব্যাগ পাওয়ার আশা না করাই ভালো। কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে, ইন্সুরেন্স নেই। ন্যাশনাল এক্সপ্রেস অস্বীকার করলে কোনো কিছু বলবার নেই। নালাও বিশেষ আশ্বাস দিল না। একটাই সান্ত্বনা যে বিদেশে এসেও প্রতিবাদ না করে ছাড়িনি। অভিযোগ তো জানিয়েছি, কোথাও না কোথাও সেটা রয়ে যাবে ওদের বিরুদ্ধে।

মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে বেশ কয়েকটা কেতাদুরস্ত জামা-কাপড়, জুতো, সাজগোজের জিনিস  কিনে ফেললাম দু-তিনটে শপিং মল ঘুরে। শপিং মলের সংস্পর্শে পারমিতার মনের বিষাদ কিছুটা কেটেছে মনে হল। উইক-এন্ড-এ গেলাম এন. এইচ. এসে পারমিতাকে নিয়ে। কৌশিকদা এখানে পরিবার নিয়ে এসেছে। ওদের একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে আছে, আদরের নাম পোজো। একদিন হই হই করে কাটল ওদের বাড়িতে; একদিন এখানকারই একটা সি-বিচ থেকে ঘুরে এলাম সবাই মিলে। যেখানেই যাই না কেন শুধু একটা কথাই মনে হয়, আমাদের দেশটা কেন এমন হয় না! আর দুদিন বাদে আমাদের সুইজারল্যান্ড যাওয়া। এরই মধ্যে আমাদের সহকর্মী সুমিত যে আমাদের হোটেল বুক করেছিল সে একটা ই-মেইল পেল “মিসিং ইউ” বলে। যার মর্মার্থ হলো হোটেলের মালিক আমাদের আসার জন্যে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো কিন্তু আমরা গিয়ে পৌছায়নি বলে তিনি সত্যিই  দুঃখিত। দেখা গেল হোটেল বুকিং-এর সময় সুমিত দিনটা ঠিক দিয়েছিলো কিন্তু মাসটা আগের মাস হয়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি আবার বুকিং করা হলো আর সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার সুমিতকে আর দেওয়া হবে না।

সুইজারল্যান্ড ছবির মত দেশ ! এইভাবে যে একটা দেশকে সাজিয়ে রাখা যায় না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমদের বাড়িটাকেও বুঝি এভাবে সাজিয়ে রাখতে পারি না আমরা! আমাদের পাঁচদিনের ট্যুর নিমেষের মধ্যে কেটে গেলো। ফিরে আসার পরেও আমাদের প্ল্যান ঠিক হয়ে আছে কোথায় কোথায় যাবো। একদিন সবাই মিলে সকালে গেলাম আইল অফ ওয়াইট। নীল সমুদ্রের মধ্যে জাহাজে  করে যেতে হয় ছোট্ট সেই অপরূপ দ্বীপে। ঝকঝকে উজ্জ্বল একটি দিন, তারপর সন্ধ্যা নামতেই ভীষণ ঠাণ্ডা। যখন জাহাজঘাটে এলাম তখন রাত্রি নেমে এসেছে।

এক শনি-রবিবার গেলাম লণ্ডন আর তার আশপাশটা ঘুরে আসতে। প্রথমে ট্রেন ধরে চলে গেলাম লীডস ক্যাসেল দেখতে। এত সুন্দর ক্যাসেল সেই প্রথম দেখলাম আমরা। ঠাণ্ডায় দুজন একদম জড়সড় হয়ে আছি, তার উপর আবার হাওয়া বইছে ভীষণ। আমাদের দেশের দুর্গগুলি এর চেয়ে কম ঐতিহ্যশালী নয়, এর চাইতে কোনো অংশে কম আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু অযত্নে, অবহেলায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে থাকে। এখানেই প্রথম দেখলাম ধবধবে সাদা ময়ূর। আমরা সামনে যেতেই পেখম তুলে ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো তার অতুলনীয় সৌন্দর্য। ফিরে এসে পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম লন্ডন ঘুরতে। একদিনের একটা টিকিট কেটে নিলেই হলো – তারপর তুমি যত পারো ঘোরো কেউ ধরবে না। লন্ডনের বিখ্যাত দোতলা বাসে চড়া হল, খোলা ছাদের উপর নরম রোদের উত্তাপ নিতে নিতে লণ্ডন শহরটা দেখা হল, দেখা হলো ছবির সেই বিগবেন, হাউস অফ পার্লামেন্ট, টাওয়ার ব্রিজ। যেখানেই যাই দুটি অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েকে দেখে বয়স্ক লোকেরা হাত নাড়েন, প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন, সাগ্রহে ছবি তুলে দেন। মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল। আমাদের কলকাতার অনেক কিচ্ছুর সাথে এখানকার মিল আছে। রাস্তাগুলোও সরু সরু। তফাৎ এই যে আমদের শহরটি অনেক বেশি নোংরা, রাস্তার পাশে পাশে অপরিচ্ছন্ন বস্তি, গরিব মানুষের ভিড়।

দুজনেই লণ্ডনের ম্যাপ হাতে নিয়ে ঘুরছি। লণ্ডন মেট্রো অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছে। সময় সময় হঠাৎ করেই রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে বন্ধ করে রাখে। প্রথম প্রথম মেট্রোর নেটওয়ার্কটা বুঝতে পারাই মুশকিল। আমরা কখন যে মেট্রো করে টেমস নদীর নীচ দিয়ে অন্য পাশে চলে আসছি সে আমার খেয়াল থাকছে না। ম্যাপ দেখে সব গুলিয়ে যাচ্ছে আর পারমিতা শুধরে দিচ্ছে আমায়। ওর যেমন স্মৃতিশক্তি তেমনি রাস্তাঘাটের বোধ। টাওয়ার অফ লণ্ডনে গিয়ে দেখে এলাম কোহিনুর আর তাল তাল সোনা। টেমস নদীর উপর দিয়ে লঞ্চে করে ঘুরে এলাম অনেকটা। তারপর সেই বিখ্যাত মাদাম তুসো আর বিকেলের দিকে গেলাম রয়াল ওবজারভাটরি অফ গ্রীনিচ। সেখানে মেরিডিয়ান লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হল। ফিরে আসছি এমন সময় একটা ভারতীয় ছেলের সাথে দেখা.. একাই… আমাকে প্রথমে একটা ছবি তুলে দিতে বললো, তারপর জিজ্ঞাসা করল আমাদের সঙ্গে এক সাথে ঘুরতে পারবে কিনা। কি মনে হতে রাজি হয়ে গেলাম। আর তো মাত্র দুই-তিন ঘন্টা তারপর ভিক্টোরিয়া বাস ট্যার্মিনাস থেকে সোজা সাউদ্যামপটন।

গল্প করতে করতে অনেকদূর ঘোরা হল। সবাই ঠিক করলাম রাতের খাবার খেয়ে বেরিয়ে যাবো। একটা রেস্টুরেণ্টে বসে খেতে খেতে কখন যে রাত আটটা বেজে গেছে বুঝিনি। খেয়াল হয়নি এখান থেকে মেট্রো করে অনেকদূর যেতে হবে, তারপর হেঁটে অনেকটা। ছেলেটা-কে বিদায় দিয়ে মাঝপথেই বেরিয়ে এলাম। সেই এক পাউণ্ডে কেনা দুটি টিকেট আছে। বাস ধরতে না পারলে চোদ্দো পাউণ্ড দিয়ে কিনতে হবে নতুন করে। কিন্তু বাস পাব কিনা সেটাই এখন সব চেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। এখন মেট্রো ধরতে গেলে হবে না বুঝে, একটা কালো ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ ড্রাইভার, তাকে অনেক কষ্টে বোঝালাম পরিস্থিতিটা। আমরা যতই তাকে তাড়াই সে শুধু বলে “ডোন্ট ওয়ারি..”। বোঝো ঠেলা ! ট্যাক্সি থেকে নেমে ব্যাগদুটো কাঁধে নিয়ে রুদ্ধশ্বাস ছুট…প্লাটফর্মে যখন পৌঁছলাম তখন তিন মিনিট দেরী হয়ে গিয়েছে। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে বলল “বাস তো বেরিয়ে গেছে।” এমনভাবে তাকালো যেন আমার আশা করাটা একটা অপরাধের বিশেষ। সে তো বটেই, তবুও মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা ভুল প্লাটফর্মে আসিনি তো? লোকটা ঠিক বলছে তো? আরো কয়েকজন-কে জিজ্ঞাসা করাতে একইরকম প্রতিক্রিয়া পেয়ে নিশ্চিত হলাম যে টিকিট কাটা ছাড়া উপায় নেই। টিকিট না পেলে হোটেল খুঁজতে হবে।

এত রাতের বাস বলেই হয়ত টিকিট পেলাম। কিন্তু মনের ভিতর আপশোষ আর ধিক্কারের শেষ নেই। দোষ তো আমাদেরই। কোথায় দুই পাউণ্ড আর কোথায় ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে চুয়াল্লিশ পাউণ্ড। তখনও পাউণ্ডকে টাকায় পরিবর্তন করে দেখার বদভ্যাস যায়নি। টিকিট কেটে ফিরছি, একটা ভদ্র সভ্য শ্বেতাঙ্গ যুবক কাছে এসে দাঁড়ালো, বলল
“এক পাউণ্ড হবে?”
“মানে?”
“এক পাউণ্ডের জন্যে টিকিট কাটতে পারছি না.. প্লিজ …”
আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে, আবার যোগ করল, “আমি আমার পার্সটা হারিয়ে ফেলেছি…” প্যান্টের দুই পকেট এমনভাবে হাতড়াতে লাগলো যে দেখে খারাপ লাগল। আমার অত ভাববার সময়, মন কোনটাই নেই। হাতের মধ্যেই কিছু খুচরো ছিল, তার মধ্যে থেকে একটা পাউন্ড নিয়ে ছেলেটাকে দিলাম। ফিরে এসে পারমিতার পাশে বসে অপেক্ষা করছি। এখনও কুড়ি মিনিট আছে.পারমিতাকে ছেলেটার কথা বললাম। লোক দেখছি আশেপাশের… আর বেশিক্ষণ নেই। পারমিতার কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে ফিরে তাকালাম…
“কি হলো?”
“দেখো তো ওই ছেলেটাই তোমার কাছে টাকা চেয়েছিল কিনা?”
পারমিতার আঙ্গুল সোজা তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ, সেই ছেলেটাই এখনও টিকিট কাউন্টারের সামনে ঘুরঘুর করছে। একটা লোকের কাছে কি জানি বলছে, পকেট হাতড়াচ্ছে। মনে হলো একবার গিয়ে ধরি, কিন্তু সময় নেই, শক্তিও নেই, ঘরে ফিরতে পারলে বাঁচি।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হল। মনটা আরোই খারাপ যে পরের সপ্তাহেই পারমিতা ফিরে যাবে। আবার অত বড় সাজানো ফ্ল্যাটে একা…
পরেরদিন অফিসে ভীষণ ব্যস্ত। হঠাৎ মিটিং-এর মধ্যেই একটা ফোন। এদেশেরই অজানা একটা ফোন নম্বর। একটু অবাক হলাম, কিন্তু কেটে দিলাম। আবার একই নম্বর থেকে ফোন এলো। না, ধরে দেখি, চাপাস্বরে বললাম, “কে?”
চোস্ত ব্রিটিশ উচ্চারণে একজন বলল
“মজুমদার দেবাশিস?”
“হ্যাঁ..”
“আমি লণ্ডন থেকে বলছি… আপনি একটা অভিযোগ জানিয়েছিলেন আপনাদের একটা ব্যাগ হারিয়ে যাবার..”
“হ্যাঁ” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম…
সবাইকে বলে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম…
“আপনাদের ব্যাগ আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি।”
“সত্যি!”
এমন অভূতপূর্ব ঘটনা হতে পারে!. আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি শুনছি?
“আমাদের একজন অফিসার লণ্ডন থেকে সাউদ্যাম্পটনে যাচ্ছে। আপনার ঠিকানায় দুপুর দুটো থেকে তিনটের মধ্যে পৌঁছে দেবে… আশাকরি বাড়িতে ব্যাগটা নেবার মতো লোক থাকবে।”
“অবশ্যই, আমার স্ত্রী আছেন।”
“বেশ…”
বলেই কেটে দিল ফোনটা…

তাড়াতাড়ি পারমিতাকে ফোন করলাম। ফ্ল্যাটের ল্যাণ্ডলাইনেই কথা হয় আমাদের আজকাল। পারমিতার ফোন কাজ করছে না বেশ কিছুদিন, সারানোও হয়নি যেহেতু আর কয়েকদিনের মধ্যেই ও ফিরে যাবে দেশে। আমরা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাগের কথা। শুনে পারমিতা বাকরুদ্ধ, বললাম,
“লোকটা আমাদের ঠিকানায় এসে আমাকে ফোন করবে। আমি তোমাকে জানিয়ে দেব, তুমি নিচে নেমে এসো তখন।”
ঠিক দুটোর সময় ফোন। লোকটা ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছে আমাদের হাউসিং-এর প্রধান দরজার সামনে। পারমিতা বলল
“আমি নেমে যাচ্ছি, তুমি ওকে ফোন করে অপেক্ষা করতে বল… চলে না যায়..”
আমি আবার ফোন করলাম লোকটা-কে। প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পরেও পারমিতার কোনো দেখা নেই। ঘরে ফোন করলে বেজে যাচ্ছে, তার মানে পারমিতা নেমে গেছে অনেকক্ষন। লোকটাকে আবার ফোন করলাম। নাহ, কেউ নেই… “নো লেডিস”। রাগে আমার গা রি রি করছে। পারমিতার সাথে যোগাযোগও করতে পারছি না। লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম
“আপনি ঠিক কোথায় আছেন?”
“মেইন গেটে, ফিফটিন মিনিটস নাউ। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমি আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবো, তারপর ফিরে যাব লণ্ডন। আপনাদের ওখান থেকেই ব্যাগটা নিতে হবে তখন…”
আমি আবার ফোন করলাম ঘরের ফোনে। পারমিতা ধরল,
“কি হলো, তুমি যাওনি নিচে?”
“আমি গেলাম তো, কেউ নেই…”
“আশ্চর্য ! তুমি তাই চলে এলে ! একটু আসে পাশে দেখো। লোকটা অপেক্ষা করছে তো। এবার চলে যাবে বলল…”
“আচ্ছা এই বিল্ডিং-এর আরো কোনো গেট নেই তো…”
আমার মনে হলো ঠিক, আমরা যে গেট ব্যবহার করি সেটা পিছনের গেট। সামনে আর একটা থাকতে পারে।
আমি বললাম “তুমি নেমে যাও, আমি বলছি লোকটাকে”
লোকটাকে ফোন করে বললাম, “আপনি একটু বিল্ডিং-এর পিছনের দিকে দেখুন তো গিয়ে…”
“ওকে…লেট মি সি..”
একটু পরেই বলল, “ইয়েস, আই ক্যান সি এ লেডি..”
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

মিটিং-এ আর মন নেই, বাড়ি ফেরার জন্যে মনটা আঁকুপাঁকু করছে। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলাম।
পারমিতা আমাকে দেখেই হেসে ফেলল …
“ভাবা যায়! এ নিশ্চয় নালার কেরামতি। কিছু কি খোয়া গেছে?”
“নাহ! সব আছে, এমনকি তোমার বন্ধুদের জন্যে আনা সিগারেটের প্যাকেটগুলো-ও। শুধু ট্রলির হাতলটা ভেঙে গেছে…”
“আমি নিশ্চিত কন্ডাকটর-ই নিয়েছিল এবং এটা সবাই জানত। পুলিশের গুঁতো খেয়ে দিয়ে দিয়েছে।”
সেদিন রাতে দুজনে বাইরে খেতে গেলাম। পরের দুদিন পারমিতা প্রচুর কেনাকাটা করল নিজের জন্যে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব-সহকর্মীদের জন্যেও তো কিছু নিয়ে যেতে হয়। প্রচুর বিদেশী বিশেষ করে সুইস চকলেট কেনা হলো, জামা কাপড় কেনা হল আর পাউণ্ড-ল্যাণ্ড থেকে ছোটো-খাটো অনেক কিছু। পাউণ্ড-ল্যাণ্ডে সব জিনিসের দাম-ই এক পাউণ্ড। ঘোরাঘুরি আর দোকানপাটের মধ্যে সময় সময়ই পারমিতা বলে যাচ্ছে পুলিশ অফিসারটা কত্ত লম্বা ছিল, কি ভীষণ সুপুরুষ ছিলো আর কি দারুণ মার্জিত, সুন্দর ব্যবহার!

পারমিতাকে হিথরো বিমানবন্দরে ছেড়ে ফিরে আসছি। আবার ভিক্টোরিয়া বাস স্টেশন, ন্যাশনাল এক্সপ্রেস, এক পাউন্ডের টিকিট। বাসে উঠতে যাব, দেখি মূর্তিমান দাঁড়িয়ে আছে। এক চেহারা। টেকো মাথায় একটা বাহারি টুপি সংযোজন হয়েছে মাত্র। আমাকে দেখেও ব্যাটা চিনতে পারল। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। বরং আমার উপর যেন রেগে আছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় বলল, “ইউ ওয়েন্ট টু পুলিশ!”
“ইয়েস, এন্ড ইউ স্টোল দা ব্যাগ।”
আমি কিছুতেই হাতের ব্যাগটা বাসের পেটে আর ঢোকাব না। লোকটাও ছাড়বে না। আমি সোজা ব্যাগ নিয়ে ঢুকে গেলাম। পায়ের কাছে রেখে বসে পড়লাম সিটে। কণ্ডাকটর নিচে নেমে একটা পুলিশের সাথে কি কথা বলল। দেখলাম পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আসছে এবার। বাসে পুলিশ ঢুকতেই সবাই একটু ঘাবড়ে গেল। আমি পুলিশ-টাকে সব খুলে বললাম এবং এও বললাম যে এই লোকটাই নিয়েছিল ব্যাগটা। সুতরাং এর কাছে আমি আবার ব্যাগ দিতে পারি না।

পুলিশটা শান্তভাবে অনেক বোঝালো আমাকে। বলল এবার হারালে তার দায়িত্ব। এমনকি নিজের ফোন নম্বরও দিল। অগত্যা ব্যাগটা নিয়ে আবার বার হলাম। পুলিশটা নিজেই রেখে দিলো ভিতরে। সারা পথে যখনই বাস থামছে আমার পারমিতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। জানালার পাশেই আমার সিট। লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে লাগেজ বের করে দিচ্ছে আর আমি তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টিতে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই সে মাথা থেকে টুপি খুলে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। রাতের অন্ধকারে বাস হু হু করে ছুটছে। এত সুন্দর দেশ, এত সুন্দর শহর কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে কবে কলকাতায় ফিরবো! এবার সাউদ্যাম্পটনে ফিরলে ঘর-গুলো একটু বেশি-ই খাঁ খাঁ করবে…

(সমাপ্ত)