জেহাদি তিতুমীর: রূপ ও রূপান্তর

0
1774

দেবব্রত

বামৈস্লামিক আঁতাত সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা যে সবক্ষেত্রে সমান্তরাল ধারায় চলেছে তা নয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে বোঝায় একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধ। তার পূর্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর সংগ্রামের ইতিহাস সেখানে স্থান পায়নি। এর অন্যতম কারণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙ্গলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন ভূমিকা ছিল না। অগ্নিযুগের বাঙ্গালী বিপ্লবীদের অধিকাংশ ছিলেন পূর্ববঙ্গের, অথচ পূর্ববঙ্গ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কোন মুসলিম বিপ্লবী সংগঠন ছিল না, কোন বাঙ্গলাভাষী মুসলমানের দ্বীপান্তর বা মৃত্যুদণ্ড হয়নি।

বাঙ্গালীর ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের বিপ্রতীপে ১৯০৫ বর্ষে কার্জন বঙ্গ বিভাজনের ঘোষণা করলে নবাবী শাসনের অবসানের পর অবসাদে ভোগা বাঙ্গলার মুসলিম নেতৃত্ব পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করার দিকে মনোনিবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে খিলাফত আন্দোলনে। খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তারা নিরাশ হয়নি, বরং বঙ্গে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকতর অংশীদার হওয়ার দাবি জানাতে থাকে। ১৯২৩ বর্ষে বিভিন্ন মুসলিম দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করে চিত্তরঞ্জন দাশ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে পরিচিত একটা সমঝোতায় পৌঁছান বিশিষ্ট মুসলিমদের সাথে, যারা ভবিষ্যতে মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতা হবেন। কিন্তু দেশবন্ধুর মৃত্যুর ফলে চুক্তিটি কার্যকর হয় না, এবং ১৯২৬ বর্ষে কলকাতা সহ বঙ্গের বেশ কিছু স্থানে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। তিরিশের দশক থেকে বঙ্গের মুসলিম সমাজের সাম্প্রদায়িকতার সুর ক্রমশঃ চড়তে থাকে, ১৯৩৭ বর্ষে বঙ্গের ক্ষমতায় আসে মুসলিম লীগ, এবং চল্লিশের দশকে পুরোদমে শুরু হয় পাকিস্তান আন্দোলন।

এমতাবস্থায় স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম অবদানকে কিভাবে উপস্থাপন করা যায় তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সবাদীরা রীতিমত বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন। বিশ শতকে বিশেষ কিছু না পেয়ে ক্রমশঃ পিছোতে থেকে ঊনিশ শতকে শান্তিময় রায়, সুপ্রকাশ রায়, বিনয় ঘোষ সহ বামপন্থী ইতিহাসবিদ গোষ্ঠী আবিষ্কার করে তিতুমীরকে। হোক না সে জেহাদি, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই তো করেছিল, সুতরাং দাও তাকে ‘কৃষক বিদ্রোহী’ বা ‘শ্রেণী সংগ্রামী’ বানিয়ে—

ধর্মের দিকে তিনি একটু বেশি ঝুঁকেছিলেন—ফকিরদের প্রতি তাঁর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা তারই প্রমাণ। […] এসবই সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য, উনিশ শতকের এই মানুষটিই প্রথম নিপীড়িত মানুষকে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিক্ষা দিয়েছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নিজের রক্ত দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।[1]

কিন্তু শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে এই সব বাঘা বাঘা বিশেষণ বেমানান, তাই জেহাদি তিতুমীর পরিণত হলেন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’-তে। এইভাবে তিতুমীরের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ স্থান করে নিল রাজ্যের প্রাথমিক শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে; ‘বাঁশের কেল্লা’ বললেই বাঙ্গালী যুবা ও কিশোরদের মনে আজ ভেসে আসে তিতুমীরের নাম। তরিকা-ই-মহম্মদিয়া নামক উগ্র ইসলামাবাদী আন্দোলনের শরিক তিতুমীরের প্রকৃত বৃত্তান্ত শোনাতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক শতক।

আকবরকে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেখে বিভিন্ন সুফী ও ইসলামী মৌলবীদের মধ্যে ইসলামের বিপন্ন হবার যে আশঙ্কা গ্রাস করেছিল তা ঔরংজেবের ইসলামিকরণের সাময়িক সাফল্যের পর মারাঠা আধিপত্যের বিস্তারে আবার বৃদ্ধি পায়। এই সুদীর্ঘকালে যে সকল উগ্র হিন্দুদ্বেষী মুসলিম ধর্মনেতাদের উত্থান ঘটে তাদের মধ্যে কয়েকজন মুখ্য চরিত্র ছিলেন আকবরের সময়ে বাকি বিল্লা, জাহাঙ্গীরের আমলে বিল্লার মুরিদ (চেলা) শাইখ আহমেদ সিরহিন্দি, এবং ঔরঙ্গজেব পরবর্তী যুগে নকশবন্দি সুফী শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী। মারাঠা রাজশক্তির উত্থানে বিচলিত মক্কা ও মদিনায় সুশিক্ষিত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইরানের নাদের শাহর সেনাপতি আহমদ শাহ দুররানিকে (আবদালি নামেও পরিচিত) আমন্ত্রণ পাঠান ভারতে জেহাদি অভিযান করে পুনরায় ইসলামী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার। অবদালির কাছে তাঁর কুখ্যাত আবেদনে ওয়ালিউল্লাহ লেখেন,

We beseech you (Durrani) in the name of the Prophet to fight a jihad against the infidels of this region. This would entitle you to great rewards before God the Most High and your name would be included in the list of those who fought for jihad for His sake. As far as worldly gains are concerned, incalculable booty would fall into the hands of the Islamic ghazis and the Muslims would be liberated from their bonds. The invasion of Nadir Shah who destroyed the Muslims left the Marathas and Jats secure and prospersous. This resulted in the infidels regaining their strength and in the reduction of the Muslim leaders of Delhi to mere puppets.

(বঙ্গানুবাদ: আমরা নবীর নামে আপনাকে (অর্থাৎ দুররানিকে) অনুরোধ করছি যে আপনি এই অঞ্চলের কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন। এটি আপনাকে আল্লাহর কাছে মহাপুরস্কারের অধিকারী করবে এবং আপনার নাম তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে যারা তাঁর জন্য জিহাদ করেছে। [আর] জাগতিক লাভের কথা যতদূর বলা যায়, ইসলামী গাজীদের হাতে বিপুল লুঠের মাল আসবে এবং মুসলমানরা তাদের বন্ধন থেকে মুক্তি পাবে। মুসলমানদের উপর নাদির শাহের আক্রমণ মারাঠা ও জাটদের নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করে। এর ফলে কাফেররা তাদের শক্তি ফিরে পেয়েছে এবং দিল্লির মুসলিম নেতৃত্ব তাদের ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে।) [2]

আবদালি অবশ্য পানিপথের যুদ্ধের পর আর ভারতমুখী হননি। পরে ১৭৭১-এর দিল্লীর যুদ্ধে মাহাদজি সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে মারাঠারা আফগানদের পরাস্ত করে দ্বিতীয় শাহ আলমকে মুঘল রাজা ঘোষণা করলে মুঘল সাম্রাজ্য পুনরায় মারাঠাদের সামন্তে পরিণত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল রাজত্ব থাকায় মুসলিম মৌলবীদের কাছে ভারত তখনও ছিল দার-উল-ইসলাম বা ইসলামী দেশ। অবশেষে ১৮০৩-এর দিল্লীর যুদ্ধে ইংরেজরা মারাঠাদের পরাজিত করে দিল্লী দখল করলে ওয়ালিউল্লাহর ছেলে শাহ আব্দুল আজিজ ভারতকে দার-উল-হারব বা ‘কুফরী দেশ’ হিসেবে ফাতোয়া জারি করেন।
‘কুফরী’ ভারতবর্ষকে পুনরায় ইসলামীকরণের ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসেন আজিজের সাগরেদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী।

দিল্লীতে অবস্থানকালে তিনি অনেককে বা’আত বা সুফী মতে দীক্ষা দেন যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আজিজের ভাগ্নে[3] শাহ ইসমাইল ও জামাতা আব্দুল হাই। এই দীক্ষা প্রসঙ্গে রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,
বা’আত হলো সুফী মতবাদে দীক্ষা। বেরিলবীর সুফী মতের নাম ছিল সুলুক-ই-রহ-ই-নুবুওয়াত বা নবীর আচরিত মরমীবাদ। এই মতে মরমীয়া হতে গেলে শরিয়ৎ মেনে বিশুদ্ধ হতে হবে। এই মতের দ্বারা বিভিন্ন সুফী তরিকাকে শরিয়তের কোলে টেনে আনাতেই ছিল বেরিলবীর বিশেষত্ব। তাঁর বা’আত ছিল বা’আত-ই-ইমামত—জেহাদের জন্য একজন ইমামকে মেনে চলা। তিনি যে মতবাদ প্রচার করলেন বস্তুতঃ তারই নাম ‘তরিকা-ই-মহাম্মদীয়া’।[4]

বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অবশ্য তাঁর মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য বইয়ে বেরলভীর সংস্কার আন্দোলনকে অত্যন্ত নিরীহভাবে উপস্থাপন করে লিখেছেন,
তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারতীয় মুসলমানদের সকলপ্রকার কুসংস্কার ও অনৈসলামিক ভাবধারা থেকে মুক্তি দিয়ে ইসলামের আদি বিশুদ্ধতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।[5]

‘বিশুদ্ধতা’, অর্থাৎ অনেকটা আইসিস বা তালিবান জাতীয় ব্যাপার আর কি! স্বপন বসু ধর্মান্তরিত হিন্দুদের উত্তরসূরি মুসলমানদের এই তালিবানিকরণের প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করতে যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা চমকপ্রদ:
তারিখ-ই-মহম্মদী আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ এবং শা ওয়ালিউল্লার মতবাদ প্রচার করে গ্রামীণ মুসলমানসমাজকে তিনি [অর্থাৎ তিতুমীর] আত্মস্থ করে তুলতে চাইলেন। [শব্দের উপর জোর লেখকের][6]
তিতুমীরের বিপক্ষ মুসলিমদের ‘রক্ষণশীল’ আখ্যা দিয়ে প্রকারান্তরে স্বপন বসু তিতুমীরের সঙ্গীদের ‘প্রগতিশীল’ সাজাতে চেয়েছিলেন।[7]

বিনয় ঘোষ অবশ্য কোন রাখঢাক না রেখেই তিতুমীরকে রামমোহনের সমগোত্রীয় ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি কারণ সপ্তম শতকের ইসলামী গোঁড়ামিকে তাঁর মনে হয়েছে অধিক প্রগতিশীল:
হিন্দুধর্মের ইতিহাসে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের অথবা উনিশ শতকে রামমোহনের অদ্বৈতবাদী ব্রাহ্মধর্মের যদি কোনপ্রকার প্রগতিশীল ভূমিকা থাকে তাহলে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তিতুমীর (রামমোহনের সমসাময়িক) অনুসৃত ওয়াহাবীবাদেরও অনুরূপ ভূমিকা আছে ইসলামের ইতিহাসে। […]

যখন দেখা গেল যে রাষ্ট্রীয় শক্তি হাতছাড়া হবার ফলে মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে অবহেলিত অপমানিত [..] তখন ভারতীয় ওয়ালিউল্লাহ অথবা আরবের মৌল ইসলামধর্মে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান এবং বিধর্মীয় কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের আওয়াজ, ভারতের ঐতিহাসিক পরিবেশে অবশ্যই প্রগতিশীল ছিল […]।[8]

আসলে মুসলিম শাসনকালে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের অধিকাংশ বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করায় তাঁরা পূর্বের হিন্দু রীতি মেনেই জীবনযাপন করতেন। হিন্দু নামধারণ, পীরের দরগায় ধূপ-দীপ সহ শিরণী (বাতাসা, ফুল ইত্যাদি) দেওয়া, মানত করা, মাদুলী কবচের ব্যবহার, হিন্দু উৎসবে যোগদান, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদির কারণে তাঁরা নামে মাত্র মুসলমান ছিলেন। সুতরাং ওয়ালিউল্লাহর সময় থেকেই মৌলবীরা ভারতের মুসলিম সমাজের ‘শুদ্ধিকরণ’-এর প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন যা বিংশ শতকেও পূর্ণ উদ্যমে চলেছিল তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে।
যাই হোক, বেরলভী পাঞ্জাব নৃপতি রঞ্জিত সিংহের বিরুদ্ধে জেহাদে বালাকোটে নিহত হন। পাকিস্তান দ্বারা বালাকোটকে জেহাদিদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পশ্চাতে বেরলভীর এই ‘শাহাদাত’ অন্যতম অনুপ্রেরণা। কিন্তু মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি বাঙ্গলায় প্রচারে এসেছিলেন ১৮২১-এ হজ যাত্রার প্রাক্কালে এবং কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন ১৮২৪-এ। আনিসুজ্জামান স্বীকার করেছেন, বেরলভীর আন্দোলন ও তাঁর জেহাদের বিপুল সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল বঙ্গের মুসলমানদের থেকে:
শিষ্যদের মধ্যে থেকে সৈয়দ আহমদ চার জনকে খলিফা মনোনীত করেন। […] ইনায়েত আলী, কেরামত আলী ও জয়নুল আবেদীন—এই তিনজন নেতার প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশে : বিলায়েত আলীও (চতুর্থ খলিফা) কর্মব্যপদেশে সারা বাংলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলায় এঁদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছিল।[9]

বেরলভীর বঙ্গে অবস্থানকালে তিতুমীর তাঁর কাছে বা’আত বা দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁর হজযাত্রায় সামিল হন।[10] তিতুমীরের আসল নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। আশরাফি, অর্থাৎ উচ্চ মুসলমান বংশের পরিবারের জন্ম তিতুমীর বৈবাহিক সূত্রে মুন্সী আমীর নামে এক ধনী জমিদারের আত্মীয় ছিলেন। হজ যাত্রার পরের কয়েক বছর তিনি কি করেছিলেন জানা যায় না, কিন্তু তাঁকে আমরা পুনরায় দেখি ১৮২৭-এ (মতান্তরে ১৮২৯) বারাসত জেলার হায়দারপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটাতে। গ্রামে ফিরে তিতুমীর শুরু করলেন তাঁর শুদ্ধিকরণ অভিযান। সাজন গাজীর গানে তাঁর কীর্তিকলাপের উল্লেখ পাই:
নামাজ রোজা শেখাইত রাখতে বলত দাড়ি।
দিনের তারিখ শেখায়ে ফেরে বাড়ি বাড়ি।।
পাপ গোনা বদকাম তাও করে মানা।
বাংলায় জারি করে আরবের কারখানা।।[11]

(দিনের তারিখ = ইসলামের (দ্বীনের) ইতিহাস, গোনা বদকাম = (ইসলামী দৃষ্টিতে) গুনাহ বা দোষ)।
পূর্বেই বলেছি সে সময় ধর্মান্তরিতরা গ্রামবাসীরা ছিল নামমাত্র মুসলমান, দাড়িবিহীন মুখ ও ধুতি পরিধানের ফলে তাদের চেহারা বা বেশভূষায় মুসলমানত্ব কিছু ছিল না। কিন্তু এবার তিতুমীর শুদ্ধিকরণের নামে বারাসতের সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল ক্রমশঃ বিষাক্ত করতে শুরু করলেন:
পীর-মানা, মাজার তৈরী করা, মৃতের উদ্দেশ্যে কিছু নিবেদন করা এবং মুহর্রম উৎসবে যোগদান করা মুসলমানদের পক্ষে নিষিদ্ধ বলে তিতুমীর ঘোষণা করেন। “দাড়ি, কাছা-খোলা (অর্থাৎ কাছা দিয়ে কাপড় পরা নিষিদ্ধ—সে যুগে মুসলমানদের পরিধেয় ছিল ধুতি) এবং মাথার মধ্যভাগ কামান, তিতুর মতের বিশিষ্ট বাহ্য স্বাতন্ত্র।” তিতুমীরের অনুসারীদের স্বাতন্ত্র্যবোধ কেবল এই বাহ্যরূপই গ্রহণ করে নি, নিজেদের মতামত সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে এমন গোঁড়ামি প্রবেশ করেছিল যে, অন্য মতাবলম্বী মুসলমানদের সঙ্গেও তাঁদের বিরোধ উপস্থিত হয়।[12]

অন্যান্য মুসলিমদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে তিতুমীরের অনুগামীদের উৎসাহের কারণ হয়ত ছিল বেরলভীর পেশওয়ার বিজয়। বর্তমান প্রজন্মের মত বাঙ্গালী তখন আত্মবিস্মৃত ছিল না, মধ্যযুগের ইসলামী অপশাসনের স্মৃতি তখনও সতেজ। তাই গ্রামের লোকেদের কাছে ‘মৌলভী’ হিসেবে অভিহিত এই নব্য মুসলিম সম্প্রদায়ের গোঁড়ামি, উগ্রতা দেখে স্থানীয় জমিদাররা চিন্তিত হলেন। পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এই নব্য মুসলমানদের দাড়ির উপর আড়াই টাকা কর বসালেন। বাধা এল কর আদায়ে, শুরু হল সংঘর্ষ। ১৮৩১-এর জুনের শেষে এরকম এক সংঘর্ষে নব্য মুসলিমদের এক মসজিদে আগুন লাগলে মৌলভীরা বারাসত আদালতের দ্বারস্থ হন। সবদিক শুনে দু’পক্ষের দোষ আছে বুঝে বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার উভয় পক্ষকে পঞ্চাশ টাকার বণ্ড সম্পাদন করতে বলেন। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে মৌলভীরা কলকাতার বড় আদালতে আপীল করতে যান কিন্তু দুর্গাপুজোর কারণে আদালতের ছুটি ও জেলা পরিদর্শনের কাজে ডিভিশনাল কমিশনার অনুপস্থিত থাকায় ফিরে আসেন সেপ্টেম্বরের শেষে। এরপরেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী জেহাদ।

ইতিহাসবিদরা এই কলকাতার সাময়িক ব্যর্থতাকে বিদ্রোহের কারণ হিসেবে দাবি করেছেন। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায় দ্বিমত পোষণ করে কিছু প্রশ্ন রেখেছেন:
দুর্গাপূজার ছুটি তো চিরতরে ছুটি নয়, কমিশনারের পরিভ্রমণ তো অগ[স্ত্য] যাত্রা নয়। ছুটি[র] পরেই তো আবার আপীল করার সুযোগ মিলতো। তবে তিতু এত মরিয়া হয়ে উঠলেন কেন? কেন তাঁর তর সইলো না? কেন তিনি সামিল হলেন আত্মঘাতী সংগ্রামে?
তর যে তাঁর সয়নি এ কথাও বলা যাবে না। কলকাতা থেকে ফেরার দিন থেকে ‘অ্যাকশন’ নেওয়ার দিনের ব্যবধান পাঁচ সপ্তাহেরও বেশী। ততোদিনে কি বড় আদালত খোলেনি? নরহরি কবিরাজ বলেছেন, তাঁদের বিশ্বাস হয়েছিল যে সরকার থেকে গরীব মানুষরা সুবিচার পাবে না। কিন্তু এ বিশ্বাস থাকলে তাঁরা কলকাতায় গেলেন কেন?[13]

রুদ্রপ্রতাপ শুধু যুক্তির ফাঁক দেখাননি, প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে একটা ভিন্ন কারণ দেখিয়েছেন যা অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য।[14] সশস্ত্র জেহাদের কয়েক মাস পূর্বে, ১৮৩১-এর মে মাসে বালাকোটে পাঞ্জাব বাহিনীর হাতে তিতুমীরের মুর্শিদ বেরলভীর মৃত্যু হয় যা ইন্ডিয়া গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল। ওদিকে অক্টোবরে তিতুরের দলে যোগ দেয় পাঞ্জাব থেকে আগত ফকিররা যারা বেরলভীর ছাউনি থেকে এসেছিল। অর্থাৎ যে সূত্র থেকেই হোক না কেন তিতুমীর বেরলভীর মৃত্যু সংবাদ জানতেন, এবং বেরলভীর শাহাদাতের প্রেরণা অথবা ফকিরদের উস্কানি তিতুমীরকে সম্মুখ সংঘাতে যেতে প্ররোচিত করে।[15]

প্রস্তুতি পর্বে নারকেলবেড়িয়ার মৈজুদ্দিন বিশ্বাসের পঞ্চাশ বিঘার জমিতে শুরু হয় বাঁশের কেল্লা বানানোর কাজ। মৈজুদ্দিন বিশ্বাসের দৃষ্টান্ত থেকে পরিষ্কার তিতুমীরের গোষ্ঠীতে ধনীদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। জেহাদিদের প্রথম আক্রমণ ঘটে ৬ নভেম্বর। পুঁড়ার বাজারে মহেন্দ্র ঘোষের একটা গরু কেটে গোরক্ত ছিটিয়ে দেওয়া হয় মন্দিরে ও বিগ্রহে, তারপর গরুটিকে কেটে চার ভাগ করে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয় বাজারের চার কোণে। লুঠপাট হয় দোকান ও বাড়ি। পরের দিন লাউঘট্টি বাজার আক্রান্ত হলে হিন্দুরা প্রতিরোধ করে, নিহত হন জমিদার পুত্র দেবনাথ রায়। দুটি সফল আক্রমণের পর জেহাদিদের দলে অনেক মুসলমান নাম লেখাতে শুরু করে, শুরু হয় টাকায় ও ফসলে তোলা আদায় করা। সাথে শুরু হয় ধর্মীয় নির্যাতন—গোহত্যা, গোমাংস খাইয়ে চলে হিন্দুদের ইসলামীকরণ, নারী ধর্ষণ ও বলপূর্বক হিন্দু মেয়েদের বিবাহ।
সাজন গাজীর গানে আছে:
বামনের মেয়ে এনে নেকা দেয় কতো জনে
সাঁকা ভাঙ্গি হাতে দিল চুড়ি।
বামনের গোনেরে ধোরে কলমা পড়ায় জোরে
চুল ফেলে মুখে রাখে দাড়ি।
গাও গোস্ত তারা খাইয়া কাপড় পড়ে ওন্দারা দিয়া
কাছা খুলে সবে গেল বাড়ী।।[16]

পরের সফল অভিযানটি ঘটে ১৪ই নভেম্বর শেরপুর গ্রামে। সেখানে জমিদারের সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে স্থানীয় মুসলমান ইয়ার মহম্মদকে সপুত্র বাঁশের কেল্লায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আর দুই মেয়ের ‘নিকাহ’ দেওয়া হয় দুই জেহাদির সাথে। পরদিন কিছু সৈনিক সহ ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার নারকেলবেড়িয়ায় তিতু দমনে উপস্থিত হলে জেহাদিদের প্রতি আক্রমণে সিপাহীরা পিছু হটে। আলেকজান্ডার অল্পের জন্য পালিয়ে বাঁচেন, কিন্তু বসিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী ধরা পড়েন। মুসলমান হতে অস্বীকার করায় তিতুমীরের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করে জেহাদি বাহিনীর সেনাপতি গোলাম মাসুম। এরপর কয়েকদিন ধরে আক্রান্ত হল কয়েকটি নীলকুঠি। বারঘরিয়ার পিঁরো সপরিবারে পালালেও, হুগলি কুঠি ও জঙ্গলপুর কুঠির দুই ইংরেজ, ব্লন্ড ও শিলিংফোর্ড তিতুমীরের অধীনতা স্বীকার করে ও মোটা অঙ্কের অর্থদণ্ড দিয়ে নিজেদের রক্ষা করেন। এই ঘটনা থেকেও পরিষ্কার বোঝা যায়, নীলকুঠির মালিকদের স্বত্ত্ব কেড়ে নিতে তিতুমীরের কোন আগ্রহ ছিল না, বশ্যতা স্বীকার করানোই ছিল উদ্দেশ্য।

এরপর তিতুমীরকে বাধা দিতে গিয়ে পরাজিত হলেন নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ। তিতুমীরের এহেন সাফল্যে টনক নড়ল ইংরেজদের। এগারো রেজিমেন্ট পদাতিক, কিছু অশ্বারোহী ও দুটি কামান সহ ইংরেজ বাহিনী ১৮ই নভেম্বর উপস্থিত হল নারকেলবেড়িয়ায়। পরদিন শুরু হল লড়াই। কেল্লার সম্মুখ মাঠে গুলিবর্ষণে অনেক জেহাদি নিহত হলে বাকিরা আশ্রয় নিল বাঁশের কেল্লায়। ঘন্টাখানেক তুমুল লড়াইয়ের পর সেটিও ধ্বংস হলো, তিতুমীর সহ বহু জেহাদি শহীদ[17] হলো।
ঊনিশ শতকে বঙ্গের তালিবানিকরণের প্রচেষ্টার এভাবেই ঘটেছিল যবনিকাপাত। তিতুমীরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও কার্ল মার্ক্সের Notes on Indian History (664-1858) গ্রন্থে তিনি স্থান করে নিয়েছেন, যদিও মার্ক্সের মন্তব্য তাঁর বঙ্গীয় ভক্তদের কাছে শ্রুতিমধুর লাগবে না:
Also, formidable disturbance at Barasat, near Calcutta, where bloody fight broke out between Moslem fanatics under Titu Mir and Hindus. British regiment put the rioters down.
(বঙ্গানুবাদ: এছাড়াও, কলকাতার অদূরে বারাসাতে মারাত্মক গোলযোগ, যেখানে তিতুমীর ও তাঁর অধীনে থাকা ধর্মান্ধ মুসলিমদের সাথে হিন্দুদের রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ রেজিমেন্ট দাঙ্গাকারীদের দমন করে।)[18]

গত কয়েক দশক ধরে অবশ্য জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে বাংলাদেশের তালিবানিকরণের কাজ যথেষ্ট সাফল্যের সাথেই এগোচ্ছে—“আমরা হব তালিবান, বাংলা হবে আফগান” ধ্বনি[19] আজ সেখানে শোনা যায়। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গের জনচরিত্রের ক্রমাগত বাংলাদেশায়ণের ফলে তার আঁচ এখানেও পড়তে শুরু করেছে।

[1] স্বপন বসু, ‘তিতুমীর প্রসঙ্গে’, বিহারিলাল সরকার প্রণীত তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার লড়াই, পুস্তক বিপণি, ১৯৮১, পৃ. ১১৭।
[2] উদ্ধৃত: Andrew G. Bostom, ‘Shah Wali-Allah’, Andrew G. Bostom (Ed.), The Legacy of Jihad: Islamic Holy War and the Fate of Non-Muslims, Prometheus Books, 2008, pp. 202-203।
[3] মতান্তরে ভ্রাতুষ্পুত্র।
[4] রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, নবরূপে তিতুমীর, অমৃত শরণ প্রকাশন, ১৯৯৬, পৃ. ২৪।
[5] আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৭৫৭-১৯১৮), চারুলিপি, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ৫৯।
[6] স্বপন বসু, ‘তিতুমীর প্রসঙ্গে’, বিহারিলাল সরকার প্রণীত তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার লড়াই, পুস্তক বিপণি, ১৯৮১, পৃ. ১০৮।
[7] স্বপন বসু, ‘তিতুমীর প্রসঙ্গে’, বিহারিলাল সরকার প্রণীত তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার লড়াই, পুস্তক বিপণি, ১৯৮১, পৃ. ১১২।
[8] বিনয় ঘোষ, ‘তিতুমীর’, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৩০ মার্চ ১৯৭৯, https://songramernotebook.com/archives/385258 (বাণান ও যতিচিহ্নের ব্যবহার সংশোধিত)।
[9] আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৭৫৭-১৯১৮), চারুলিপি, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ৫৯
[10] রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায় তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে বেরলভীর হজযাত্রার সময় ভারত থেকে দ্বিতীয় কোন হজযাত্রী দলের উল্লেখ নেই। বস্তুতঃ বেরলভীর সময় ভারতে হজযাত্রা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তিনিই তার পুনঃ প্রচলন করেন। তাছাড়া ইসলামী বর্ষপঞ্জির জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের পালনীয় আচার অনুষ্ঠান হল হজ। সুতরাং তিতুমীরের পক্ষে মক্কায় গিয়ে বেরলভীর সাথে প্রথম সাক্ষাতের কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নয়।
(রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, নবরূপে তিতুমীর, অমৃত শরণ প্রকাশন, ১৯৯৬, পৃ. ৫৪।)
[11] উদ্ধৃত: রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, নবরূপে তিতুমীর, অমৃত শরণ প্রকাশন, ১৯৯৬, পৃ. ৫৬।
[12] আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৭৫৭-১৯১৮), চারুলিপি, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ৬৪।
[13] রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, নবরূপে তিতুমীর, অমৃত শরণ প্রকাশন, ১৯৯৬, পৃ. ৬০।
[14] তিতুমীর সম্পর্কে ইসলাম ধর্ম ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাধর্মী নবরূপে তিতুমীর একটা আকরগ্রন্থ।
[15] রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, নবরূপে তিতুমীর, অমৃত শরণ প্রকাশন, ১৯৯৬, পৃ. ৬১।
[16] উদ্ধৃত: রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, নবরূপে তিতুমীর, অমৃত শরণ প্রকাশন, ১৯৯৬, পৃ. ৬৩।
[17] জেহাদের পথে যারা মারা যায়, অর্থাৎ ‘শাহাদাত’ প্রাপ্ত হয় তারাই প্রকৃত ‘শহীদ’; ক্ষুধিরাম, বাঘাযতীন বা ভগৎ সিংয়ের মত মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের ‘শহীদ’ বললে তাঁদের অবমাননা করা হয়।
[18] Karl Marx, Notes on Indian History (664-1858), Second Impression, Foreign Languages Publishing House (Moscow), 1900, p. 129
[19] রাজিব নুর, ‘‘আমরা হব তালিবান, বাংলা হবে আফগান’ এ স্লোগান কম শুনিনি’, News 24 Online, ১৫ আগস্ট ২০২১, https://www.news24bd.tv/details/73789/আমরা-হব-তালিবান-বাংলা-হবে-আফগান-এ-স্লোগান-কম-শুনিনি।