রবীন্দ্রনাথ জনগণমন গানে কিভাবে হিন্দু ধ্যানধারণা প্রয়োগ করেছেন

0
3678

সিএএ বিরোধীরা জাতীয় সঙ্গীতকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, এবার দেখে নেওয়া যাক।

অনেকেই জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনের সাথে প্রবল ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি সাংস্কৃতিক নবজাগরণের পেছনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ একটা নয়, তিন তিনটে দেশের জাতীয় সঙ্গীতের উৎস। তিনি রচনা করেছেন ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের প্রেরণার উৎস তিনিই। তিনটি জাতীয় সঙ্গীতই নীচে সংক্ষেপে দেওয়া হল।

ভারত

জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

 

বাংলাদেশ

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥

 

শ্রীলঙ্কা

আমার শ্রীলঙ্কা নমো নমো নমো নমো মাতা.

সুন্দর শ্রীবরণী

সুন্দরী শ্রেষ্ঠ লঙ্কা

ধন ধান্যে ভরা জননী,

তুমি সকলের সেরা বিশ্ব জয়া

সেরা ভূমি যথা,

আমাদের রেখেছ সযতনে

ওহে প্রিয় দেশ মাতা!

তোমারই প্রতি মোদের ভক্তি পূজা

নমো নমো নমো নমো মাতা।

 

 

বন্দে মাতরম নিয়ে বিতর্ক

১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের বিজয়নগরম অধিবেশনের সময়ে সম্পূর্ণ বন্দে মাতরম সঙ্গীতকে প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কেননা কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ মনে করেছেন এর ফলে ভারতের মানুষ আরও বেশী করে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হতে পারবে। এ বিষয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একটি কমিটি গড়েছিল, যেখানে সদস্য হিসাবে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহেরু, সুভাস চন্দ্র বসু, আচার্য নরেন্দ্র দেব এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

মুসলিমদের ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে প্রথ দুটি পঙক্তি বাদে পুরো বন্দে মাতরম ছাঁটাই করা হল। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল – পরের পঙক্তিতে দেবী দুর্গা ও লক্ষ্মীর উল্লেখ আছে।

সাম্প্রতিক কালে বন্দে মাতরম নিয়ে বিতর্ক ওঠার সময়ে বহু বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ১৯৩৭ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথেরই লেখার একটি চিঠির সারাংশ উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজেই নেতাজিকে লিখেছেন –

তিনি আশা করেন না মূর্তিপূজার বিরোধী মুসলিমরা বন্দে মাতরম গাইবেন।

কথাটা  অর্ধসত্য। রবীন্দ্রনাথ উক্ত চিঠিতে আনন্দমঠ থেকে পুরো গানটাই রেফারেন্স হিসাবে দিয়েছেন; শুধুমাত্র প্রথম দুটি পঙক্তি নয়, যেমনটা বামপন্থীরা দাবি করেন। কেন করেন সেটা আন্দাজ করা কঠিন নয়।

এখানে স্মরণ করা দরকার মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলী জিন্নাহও প্রথম দুটি পঙক্তি নিয়ে কোনও আপত্তি জানান নি, এবং তাঁর দাবি মেনেই মুসলিমরা বন্দে মাতরমের প্রথম দুটি পঙক্তি গাইতে আপত্তি করেন নি।

অতঃপর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ১৯৩৭ সালে নেহেরু ও গান্ধী মিলে স্থির করলেন – বন্দে মাতরমের প্রথম দুটি পঙক্তিই জাতীয় সঙ্গীত হবে।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন সুভাষচন্দ্রকে, বলেন যে,

‘বাঙালি হিন্দুরা এই আলোচনা নিয়ে চঞ্চল হয়েছেন, কিন্তু ব্যাপারটি একলা হিন্দুর মধ্যে আবদ্ধ নয়। উভয় পক্ষেই ক্ষোভ যেখানে প্রবল, সেখানে অপক্ষপাত বিচারের প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্রীয় সাধনায় আমাদের শান্তি চাই, ঐক্য চাই, শুভবুদ্ধি চাই। কোনও এক পক্ষের জিদকে দুর্দম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাইনে।’

পরে সংবাদমাধ্যমেও বিবৃতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

বন্দে মাতরম্-এর প্রথম অংশটি সুন্দর, একটি কোমল মধুর ভাবের উদ্রেক হয় বঙ্গমাতা বা ভারতমাতার জন্য, সেটি জাতীয় সমাবেশে গাওয়ার উপযোগী, তাতে কারও আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু দ্বিতীয়াংশে যে ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী কমলা কমলদলবিহারিণী’ ইত্যাদি, তাতে আপত্তি ওঠারই কথা। কোনও গানের আসরে সম্পূর্ণ গানটি গাওয়া চলতেই পারে। কিন্তু কোনও জাতীয় সমাবেশে তা উচিত নয়। যখন জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গানটি গাওয়া হচ্ছে, যখন সব ধর্মের মানুষ একত্র হচ্ছেন— প্রথমাংশটিই গাওয়া উচিত।

যে কেউ বলতেই পারেন যে, প্রথম দুটি পঙক্তিতে যেহেতু বিতর্কের কিছুই নেই, তাই বর্তমান নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা যতই লাফাক, বিনা দ্বিধায় বন্দে মাতরমকে দ্বিতীয় জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া উচিত। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক না থাকাই ভাল। বাস্তবে তা মোটেই নয়।

জনৈক ফৈজ-উর-রহমান হিন্দুস্তান টাইমসে লিখেছেন –

“১৯৩৭ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে তোলা প্রস্তাব অনুসারে বলা হয়েছিল মুসলিমরা যেন অন্তত প্রথম দুটি পঙক্তি উচ্চারণ করে, কেননা নিজের মাতৃভূমির প্রতি মা নত করাটা কোনও অপরাধ নয়।কিন্তু প্রথম দুটি পঙক্তিও উচ্চারণ করা সম্ভব নয়, কেননা মূল সঙ্গীতে যেখানে মাতৃভূমি কথাটা উচ্চারিত হয়েছে তার সূত্র ধরে চতুর্থ  পঙক্তিতে দেবী দুর্গা ও লক্ষ্মীকে মাতৃভূমির সাথে একাত্ম করা হয়েছে।”

রহমান এও বলেছেন,

“একজন মুসলিম হিসাবে বলছি একজন একেশ্বরবাদীর পক্ষে কোনও অবস্থাতেই আল্লাহ ছাড়া কোনও মূর্তি, জীবন্ত প্রাণী বা ভূখণ্ডের সামনে মাথা নত করা সম্ভব নয়।”

মজার কথা হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা সঙ্গীতে কিন্তু একাধিকবার স্পষ্ট করে “আমার মাতৃভূমি” কথাটা উচ্চারিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ কিন্তু পুরোপুরি ইসলামিক দেশ।

“দেশকে বন্দনা করা ধর্মীয় কর্তব্য নয়।” এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ.জে. নুরানির বর্ণিত বক্তব্য যেভাবে আমার সোনার বাংলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেভাবে বন্দে মাতরমও প্রযোজ্য কি?

“বন্দে মাতরমে, বাংলার ভূমিকে তো বটেই, সমগ্র ভারতকে একটি দেবী হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে, এবং এর ফলেই একটি স্বর্গীয় মাতৃভূমির ধারণার উদ্ভব হয়েছে। ইহা কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সঙ্গীত হতে পারে?” প্রশ্ন করেছেন নুরানি।

তাঁর মতে, “এমন একটি গানকে কিছুটা অদলবদল করা দরকার যাতে সব ধর্মের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হতে পারে।”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে জনগণমন কি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ বলে গণ্য হতে পারে?

বন্দে মাতরমকে যেভাবে মাত্র দুটি পঙক্তিকে গ্রহণ করার মাধ্যমে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে; সেভাবেই রবীন্দ্রনাথের ভারত ভাগ্য বিধাতা সঙ্গীতের প্রথম পঙক্তিই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নেওয়া হয়েছে।

বন্দে মাতরমের মধ্যে মাতরম শব্দ থেকেই বোঝা যায় সেটা একটি হিন্দু ধর্মীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে।

এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারত ভাগ্য বিধাতা গানের দিকে নজর দেওয়া যাক। এখান থেকে স্পষ্ট হবে ‘বিধাতা’ বলতে আসলে কি বলা হয়েছে।

“জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ

বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ

তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,

গাহে তব জয়গাথা।

জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।”

প্রথম দুই পঙক্তিতে রবীন্দ্রনাথ শুধু যে পুরো ভৌগলিক ভারতকে ধরেন নি, সাথে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিকেও উল্লেখ করেছেন।

“অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী

হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী

পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে

প্রেমহার হয় গাঁথা।

জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।”

এরপরের পঙক্তিতে ‘ভারত ভাগ্য বিধাতা’র উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান ও খৃস্টানদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন এক জাতিভুক্ত হবার জন্য। এই পঙক্তিতেই রবীন্দ্রনাথ ভারত ভাগ্য বিধাতাকে ‘জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক’ বাক্যবন্ধনীর মাধ্যমে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেন বলে বুঝিয়েছেন।

“পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।

হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।

দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে

সঙ্কটদুঃখত্রাতা।

জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।”

এই পঙক্তি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন যে, ব্রিটিশদের ভারতে আসার ঢের আগে থেকেই ভারতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। এবং সেটা যুগ যুগ ধরেই। ভারত যে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ভূখণ্ড নয়, সাথে অন্য কিছুও বটে। রবীন্দ্রনাথ এও উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে।

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।

এরপরের স্তবকে রবীন্দ্রনাথ বিধাতাকে ‘চিরসারথি’র সাথে তুলনা টেনেছেন। কোনও সন্দেহ নেই, এক্ষেত্রে তিনি শ্রীকৃষ্ণের রূপক ব্যবহার করেছেন। যিনি আবার মহাভারতের যুদ্ধের কৃষ্ণের সারথি ছিলেন।

হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।

এখানে তিনি রূপকার্থে কৃষ্ণের কথাই বলেছেন যিনি অর্জুনের কঠিন মানসিক দ্বন্দ্বের সময়ে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।

যদি এতেও যথেষ্ট না বুঝে থাকেন, পরের স্তবক দেখুন।

দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে

সঙ্কটদুঃখত্রাতা।

যখনই সংসারে মহা বিপর্যয় নেমে আসে, সর্বত্র বিপ্লবের নামে নৈরাজ্য সৃষ্ট হয়, তখন শঙ্খের শব্দ আরও জোরে জোরে বাজে, ফলে মনের সব শঙ্কা, ভয় দূর হয়।

একথা সবাই জানেন শ্রীকৃষ্ণ শঙ্খ বাজাতেন সাধারণ কারণে নয় – কেবল মাত্র অধর্মের ওপর ধর্মের বিজয় সম্পন্ন হলেই।

ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে

জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।

দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে

স্নেহময়ী তুমি মাতা।

জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে –

গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।

তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে

তব চরণে নত মাথা।

জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

ঠিক এর পরের স্তবকেই রবীন্দ্রনাথ ‘জনগণপথপরিচায়ক’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন।

এখানে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে হিন্দু ধর্মের ‘গুরু’ হিসাবে দেখিয়েছেন। কোনও সন্দেহ নেই শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সত্যিই জনগণপথপরিচায়ক বা সাধারণ মানুষের কাছে সার্বজনীন গুরুদেবই ছিলেন।

এর পরের স্তবকে রবীন্দ্রনাথ ‘স্নেহময়ী তুমি মাতা’ বাক্যবন্ধনীর মাধ্যমে একজন মার কথা তুলে ধরেছেন, যিনি সন্তানকে মহাবিপর্যয়ের সময়ে স্নেহ দিয়ে বাছিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এখানে মাতা ‘নতনয়নে অনিমেষে’ তার সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখেন। সংস্কৃত শব্দ ‘অনিমেষ’ এর অর্থ হল – যার চোখের পলক পরে না।

একই সাথে হিন্দু ধর্মে শ্রীকৃষ্ণ ও কালীকে এক বলে ভাবানো হয়েছে। হিন্দু সাহিত্যেও বাস্তবে শ্রীকৃষ্ণ ও কালী একই, একজন পৌরুষ্যের প্রতীক ও একজন শক্তিশালী নারীত্বের প্রতীক।

এখানে বলা যেতে পারে দেবী ভাগবৎ গ্রন্থানুসারে মা কালীকে শ্রীকৃষ্ণের রূপ ধারণ করেছিলেন। অনুরূপ ভাবে শিব তার সান্নিধ্য দিতে রাধার রূপ ধারণ করেছিলেন। ১৮৮২ সালে তৈরি হওয়া একটি তৈলচিত্রে রাধাকে কালীকে পূজা দিতে দেখা যাচ্ছে। এখানে কৃষ্ণ কালীর রূপ ধারণ করছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। এখানে বলে রাখা দরকার – কালীঘাট কালী মন্দিরের ভেতরে কিন্তু রাধাকৃষ্ণ যুগলের মূর্তি আছে এবং নিয়মিত পূজাও হয়।

রাধা ও কৃষ্ণ দুইই বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং এক সাথে পূজা করে থাকেন। বিখ্যাত শাক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন কৃষ্ণ ও কালীকে এক করে দেখিয়ে বেশ কিছু সুন্দর গান লিখেছেন এবং তা যুগপৎ শাক্ত ও বৈষ্ণব গায়করা গেয়ে থাকেন।

ঠিক একইভাবে শ্রীকৃষ্ণ ও কালীকে রবীন্দ্রনাথ ভারত ভাগ্য বিধাতা রূপে দেখিয়েছেন।

শেষ পঙক্তিতে রবীন্দ্রনাথ ‘রাজেশ্বরো’ শব্দ দিয়ে রাজারও রাজা অর্থ বুঝিয়েছেন, যা আবার শিবের আরেক নামও বটে। তামিল নাড়ুতে এই নামে একটি চোল আমলে তৈরি মন্দিরও আছে।

এরপর পরের স্তবক ‘করুণারুণরাগে’ দিয়ে ভারতকে নতুন প্রভাতে জেগে ওঠার জন্য আবেদন জানিয়েছেন।

এই বর্ণনার সাথে অদ্ভুত ভাবে প্রলয়ের পর সৃষ্টির বর্ণনার অদ্ভুত মিল দেখা যায়। শিব যেভাবে প্রলয়ের সাথে সবকিছু ধ্বংস করে পড়ে আবার নতুন করে সৃষ্টি করেন তাই যেন উপরোক্ত স্তবকে রূপকার্থে লেখা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত

পাঠক, এতক্ষণ পড়ার পর মনে হচ্ছে কি যে; বন্দে মাতরমের মতই জনগণমন ধর্মনিরপেক্ষ সঙ্গীত? নাকি উলটোটা?

এখানে মনে রাখতে হবে পুরো জনগণমন সঙ্গীত পাঠ করলে পাঠকরা বুঝতে পারবেন যে, রূপকার্থে ঠিকই হিন্দু সাহিত্য ব্যবহার করা হয়েছে। এবং জনগণমনও এক ভাবে বন্দে মাতরমের মতই ‘সাম্প্রদায়িক’ গান।

সত্যি কথাটা হচ্ছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত নেতারাও তা জানতেন বলেই জনগণমন গানকে বন্দে মাতরমের মতই পুরোটা গাওয়াবার সাহস দেখাতে পারেন নি; কেননা তারা বুঝতে পেরেছিলেন পুরো গানটাই গাইবার ব্যাপারে মুসলিমরা ঠিকই আপত্তি করবে; যেটা তারা বন্দে মাতরমের বেলায় করেছেন। তাই শুধু মাত্র প্রথম পঙক্তি ব্যবহার করে দায় সেরেছেন।

এ. জে. নুরানি বলেছেন,

গান্ধী পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন যে বন্দে মাতরম গানটাকে শ্রদ্ধা জানানো যেতে পারে কিন্তু বাধ্যতামূলক ভাবে চাপানো হবে না। কিন্তু সত্যি কথাটা হল কংগ্রেসের কিছু নেতা অত্যন্ত উগ্র ভাবে বন্দে মাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, যার ফলস্বরুপ কংগ্রেস ও মুসলিমদের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয় এবং অন্তিম পরিণতি দেশভাগে এসে দাঁড়ায়। ঠিক এই কারণে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গঠনের সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করব যাতে ঐ ঘটনার (দেশভাগ) পুনরাবৃত্তি না হয়।

আমরা যদি সমস্যাটা তলিয়ে দেখি সেক্ষেত্রে বুঝতে পারব যে, কাউকে পুরষ্কার দিয়ে তার বদ স্বভাবকে পালটান যায় না। তাকে তিরস্কার, দরকারে শাসন করেই বদ স্বভাব পাল্টাতে হবে।

নেহেরু ও গান্ধীর মত নেতারা যতটা সম্ভব ধর্মনিরপেক্ষ হয়েও দেশভাগ আটকাতে পারেন নি। আসলে পুরো সমস্যাটাই অপর পক্ষের নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িকতার পরিণাম হিসাবে ঘটেছে।

আমাদের সর্বাগ্রে অপর পক্ষের কাল্পনিক কারণের জন্য নিজেকে দোষারোপ করার ধর্মনিরপেক্ষ অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। এতে তাদের সামরিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বাড়িয়ে দেওয়া হয় মাত্র। এতে বিভিন্ন অজুহাতে তাদের ক্ষমতার লোভকে বাড়িয়ে চলছে, সেটা বোঝা উচিত।

পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল হিন্দু আধিপত্য থেকে মুসলিমদের মুক্ত করার জন্য, কোনও কংগ্রেস ও মুসলিমদের মধ্যে অবিশ্বাসের কারণে হয়নি। এবং দশভাগের জন্য সম্পূর্ণ ও একক ভাবে দায়ী মুসলিম লিগ। কংগ্রেস নয়।

হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও কেনই বা পাকিস্তানে ইসলামিকরণের মাত্রা দিনকেদিন বেড়েই চলছে, তার উত্তর নুরানি দিতে পারবেন? যেখানে পাকিস্তানে অমুসলিমদের আধিপত্যের বিন্দুমাত্রও সম্ভাবনা নেই?

এটাও মনে রাখা দরকার যদি গাধী ও নেহেরু জিন্নাহের সব দাবি মেনে নিতেন সেক্ষেত্রে আমরা একটা অখণ্ড পাকিস্তান পেতাম, অখণ্ড ভারত নয়।

আমরা বলতেই পারি যে, কেউ জনগণমন বা বন্দে মাতরম গাইবে কিনা সেটা তার পছন্দ হতে পারে; তাকে বাধ্য করাটা মোটেও গণতান্ত্রিক বা সংবিধানসম্মত নয়।

কিন্তু আমাদের দেখতে হবে যে, বন্দে মাতরম গাওয়া প্রত্যাখ্যানের পেছনে কি ধরণের উদ্দেশ্য কাজ করছে। শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নাকি অন্য কোনও ব্যাপার আছে? আমাদের দেখতে হবে তাদের যুক্তি কি একপেশে নাকি সার্বজনীন? নাকি তাদের কাছেও গান্ধী, নেহেরু এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যথেষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ নয়? তাদের জন্য আমাদের কতবার সমঝোতা করে চলতে হবে? তারা কি সমঝোতা করতে শিখবে না?

স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত যাজ্ঞসেনীর লেখা মূল প্রবন্ধ থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন সদানন্দ গৌড়াপ্পা।