[তা ছিল এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। যারা ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করেনি, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল ইসলামিক রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ গঠনের সংকল্প নিয়ে এবং তা পূর্ণ নাকি করতে হবে হিন্দুর রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বঙ্গে আসীন কৃষক প্রজা পার্টি-মুসলিম লীগ সরকার যেন স্বাধীন ইসলামিক শাসনতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করে ফেলল আর তার বিয়োগান্তক পরিণতি হিসেবে হিন্দুরা হলেন বলি। অবস্থা সীমা লঙ্ঘন করলে হিন্দুদের মধ্যে জন্ম নিল মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ র কলকাতায় মহাসমর যা শুরু হয়েছিল মুসলমানের নৃশংসতম আক্রমণ দিয়ে, তা শেষ হল হিন্দুর ভয়াল, ভয়ঙ্কর প্রত্যুত্তরে।
বাঙ্গালার হিন্দুরা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশভাগ করার, হিন্দু মহাসভা ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের যৌথ নেতৃত্বে। এপ্রিল, ১৯৪৭ এ তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার সম্মেলন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের গঠন ও তার ভারতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে। তৎকালীন বিখ্যাত দৈনিক “যুগান্তর” এ সেই সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। কালের ধুলা পরিষ্কার করে “বঙ্গদেশ” পুনঃপ্রকাশ করল সেই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনটি।]
মহাসমারোহে প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত
বঙ্গভঙ্গের দাবী এবং লীগ মন্ত্রীত্বর সাম্প্রদায়িক নীতির তীব্র নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত
তারকেশ্বর, ৫ই এপ্রিল – বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার দ্বাদশ অধিবেশন উপলক্ষে নেতৃবৃন্দের সমাগমে হিন্দুগণের মহাতীর্থস্থান তারকেশ্বর মুখরিত হইয়া উঠে। সকাল হইতে মোটর ও ট্রেনযোগে দলে দলে লোক তারকেশ্বরে সমবেত হয়। রেল কর্তৃপক্ষ স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।
সভাপতি শ্রীযুক্ত নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ট্রেনযোগে তারকেশ্বরে পৌঁছিলে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁহাকে ও বাংলা বিভিন্ন জেলা হইতে আগত প্রতিনিধিকে সম্বর্ধনা জানান। প্রায় ছয়শত স্বেচ্ছাসেবকের বাহিনী সামরিক কায়দায় তাঁহাদিগকে স্বাগত জানান।
মেয়েরা হুলুধ্বনি দিয়া ও ধান্যদুর্ব্বা সহকারে সভাপতির মঙ্গলাচরণ করেন।
অতঃপর তাঁহাদিগকে একটি হাতীর উপর বসাইয়া মহাসভা অধিবেশনের মণ্ডপ রাজেন্দ্রলাল নগরে লইয়া যাওয়া হয়।
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও মেজর জেনারেল এসি চ্যাটার্জি উপস্থিত হইলে ১০ হাজার নরনারীর বিরাট এক জনতা ‘বন্দেমাতরূম ও জয়ধ্বনি করিয়া তাঁহাদিগকে সম্বর্ধনা জানায়। স্টেশন হইতে মহান্তের প্রাসাদ পর্যন্ত ডাঃ মুখার্জি ও মেজর জেনারেল চ্যাটার্জিকে শোভাযাত্ৰা সহকারে লইয়া যাওয়া হয়। শোভাযাত্রার পুরোভাগে হিন্দু মহাসভার পতাকা পৃষ্ঠে করিয়া একটি হস্তী ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। তাহার পশ্চাতে সামরিক বাদ্যভান্ড সহ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সুদীর্ঘ শ্রেণীর প্রায় ৫ হাজার লোক এই শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। জলপাইগুড়ির শ্রীযুক্ত নলিনীনাথ ঘোষ বলেন -বিপন্ন হিন্দুকে রক্ষা করার দায়িত্ব ও আদর্শ হিন্দুর আত্মত্যাগ ও সংঘশক্তির গুণে মহীয়ান হইয়া উঠিবে।
দাক্ষিণাত্যের প্রখ্যাতনামা সাধু মহারাজ পাঁচলেগোঁয়েকে প্রথমদিনের অধিবেশন উদ্বোধন করেন। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংস্কৃত ভাষায় স্বস্তিবাচন পাঠ করেন। শ্রীযুক্ত মনুজ সর্বাধিকারীর “শেষ সংগ্রাম” চারণগাথা সমবেত দর্শকবৃন্দের মধ্যে বিপুল উল্লাসের সঞ্চার করে। অতঃপর রাজেন্দ্রলাল রায়ের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে সকলে দন্ডায়মান হইয়া শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।
দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন –
অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে অধিকতর আশা ও উল্লাসের লক্ষণ পরিলিক্ষিত হয়। কাতারে কাতারে নরনারী-বৃদ্ধ-যুবাকে অধিবেশনে যোগদান করিতে দেখা যায়। অধিবেশনে প্রায় ৩০ হাজার জনসমাগম হয়।
কলিকাতা কর্পোরেশনের ভূতপূর্ব মেয়র শ্রীযুক্ত সনৎকুমার রায়চৌধুরী বাঙ্গলার হিন্দুর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের একান্ত প্রয়োজনীয়তার দাবী জানাইয়া প্রস্তাব উত্থাপন প্রসঙ্গে বলেন – জনসংখ্যা, আয়তন ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিচার করিলেও এই নবরাষ্ট্র রাষ্ট্রনামের উপযুক্ত।
ঢাকার শ্রীযুক্ত সূর্য্যকুমার বসু প্রস্তাবটি সমর্থন করিতে উঠিয়া বলেন, “মিঃ জিন্নার পাকিস্থান মানিয়া লইলে বাংলায় হিন্দুদের অবস্থা দাসত্বের নামান্তর হইবে। অমুসলমানদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি নাগরিকদের প্রাথমিক দাবী পর্যন্ত ইসলামের নিকট জলাঞ্জলি দিতে হইবে। পাকিস্থান প্রতিষ্ঠিত হইলে অমুসলমানদিগকে দেশছাড়া হইয়া জিপসিদের মতো ঘৃণ্য জীবনযাপন করিতে বাধ্য করা হইবে। তাই বাঙ্গালী হিন্দুর বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকাইয়া ও নবনির্মিত রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের নাগরিক দাবী স্বীকৃত হইবে – এই সকল বিবেচনা করিয়া পূর্ববঙ্গবাসী হইয়াও আমি এই দাবী সমর্থন করিতেছি।
উপরিউক্ত প্রস্তাবটিতে লীগ অনুসৃত সাম্প্রদায়িক নীতির নিন্দা করিয়া ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আসন্ন মৃত্যুর মুখ হইতে রক্ষা করিতে স্বতন্ত্র হিন্দু রাষ্ট্রের দাবী জানান হয়।
স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিম্নলিখিত কার্যপন্থার কথা প্রস্তাবটিতে বলা হয় –
১) ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে অবিলম্বে একটি কর্মপরিষদ গঠন ও কার্য্যকরী করিতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়;
২) এই নবনির্মিত রাষ্ট্রের সীমা নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হইবে।
৩) গণপরিষদকে সীমান্ত নির্ধারণের জন্য ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অধিকার অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করা হইবে।
৪) গ্রামে গ্রামে নগর নগরে এই সম্পর্কে জনমত গঠনের জন্য প্রায় এক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবককে কার্য্যে নিয়োজিত করা হইবে।
৫) অবিলম্বে নব রাষ্ট্রের সীমা নির্ধারণ কার্য্য শেষ হইলে ভোটদাতাগণের দাবী অনুযায়ী পরিষদে উক্ত অঞ্চলের সদস্যরা নুতন প্রদেশের দাবী জানাইবেন। প্রয়োজন হইলে তাঁহারা নূতন পরিষদ গঠন করিবেন।
৬) ইংরাজের নিকট হইতে ক্ষমতা লইবার জন্য অবিলম্বে নূতন প্রাদেশিক সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হইবে।
এই প্রসঙ্গে বীর সাভারকার অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রীযুক্ত বিমল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিম্নোক্ত তার প্রেরণ করেন –
উপরিউক্ত প্রস্তাবটি সর্ব্বসম্মতিক্রমে বিরাট উদ্দীপনা ও হর্ষধ্বনির মধ্যে গৃহীত হয়।
মেজর জেনারেল চ্যাটার্জির বক্তৃতা –
সুসজ্জিত মণ্ডপমধ্যে সুদৃশ্য বেদীর উপর দণ্ডায়মান হইয়া মেজর জেনারেল এসি চ্যাটার্জি বাঙ্গলার স্বতন্ত্র হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেন, ” যে মন্ত্রে আমি দীক্ষিত হইয়াছিলাম, সেই মন্ত্রে ভিন্ন ধর্মের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নাই। আমার কাছে হিন্দু ও মুসলিমনের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।”
“ইংরেজ আমাদের উপর অত্যাচার করিয়াছিল সেইজন্য ইংরাজের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ধরিয়াছিলাম। আর আজ মুসলিম লীগ আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করিয়াছে তাই তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজন হইয়াছে। আজ অনেকেই নেতাজীর নাম করিয়া অনেক কিছু বলিয়া থাকেন অথচ হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে দ্বিধা বোধ করেনা। নেতাজী মহাপ্রাণ ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে উনি ধর্ম মানিতেন না। কিন্তু দিনের পর দিন ভোরবেলায় তাঁহার কণ্ঠ হইতে মন্ত্র, স্তোত্র, আবৃত্তি শুনিয়াছি।”
“ভারতবর্ষের বাণী হইতেছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ – সমগ্র পৃথিবীর লোককে ভারতবাসী আত্মীয় বলিয়া মনে করিয়া আসিতেছে। সমগ্র এশিয়াখন্ডে এই এই জাতীয় মাহাত্ম্য তাই গরিমাময়। ইংরেজ আমাদের এই ঐতিহ্য লোপ করিয়া আত্মবিস্মৃত করে, ইহাই ইংরেজের সর্ব্বাপরক্ষা বড় জয়।”
মেজর জেনারেল চ্যাটার্জি আরও বলেন যে, মুসলিম লীগ নিজেদের ভিন্ন জাতি ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সংস্কৃতির ধ্যার্ক বলিয়া পরিচিতি দেয়। স্যার সুরেন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন যে আমরা এক জাতি, এক সংস্কৃতি ও একই ভাষার ধারক ও বাহক। নেতাজী কখনও বিশ্বাস করিতেন না এবং আমিও নিজে করিনা যে আমরা “দুই জাতি” এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া পাকিস্থান কায়েম করিলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোন সমাধান হইবে।
তৃতীয় দিনের অধিবেশন –
তারকেশ্বর, ৬ই এপ্রিল – অদ্য বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার তৃতীয় দিনের অধিবেশনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয় : –
১) হিন্দুদের স্বার্থ এবং শান্তিরক্ষার জন্য সত্বর প্রদেশের প্রত্যেক ইউনিয়নে হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গার্ড গঠন করিতে হইবে।
২) কলিকাতা শহরের পুলিশ বিভাগে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করাইবার জন্য এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীতে অবাঙ্গালী মুসলমান লোয়াড় জন্য এই সম্মেলন লীগ মন্ত্রিসভার নীতির তীব্র নিন্দা করে। সাম্প্রতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা যাহাতে বৃদ্ধি না পায় তাহার জন্য
ক) সমস্ত গুন্ডাদের গ্রেপ্তার করিতে হইবে;
খ) বস্তীগুলি তল্লাশি করিতে হইবে;
গ) কলিকাতা শহরের সাম্প্রদায়িক হার রক্ষা করিয়া পুলিশ বিভাগে অফিসার, কনষ্টেবল ও সশস্ত্র প্রহরী রাখিতে হইবে;
ঘ) অবাঙ্গালী মুসলমান নিয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করিতে হইবে;
ঙ) অত্যাচারী পুলিশ অফিসার ও কর্ম্মচারীদের বিরুদ্ধে কড়া সাজার ব্যবস্থা করিতে হইবে;
চ) মুসলমান ন্যাশনাল গার্ডকে টহল দিয়া বেড়াইতে দেওয়া এবং তল্লাশিতে অংশগ্রহণ করিতে দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করিতে হইবে।
৩) মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা দল ও সম্প্রদায়ের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই ব্যবসা সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণে কতকগুলি বিধি ব্যবস্থা করিয়াছে। সুতরাং এই সম্মেলন ইহা প্রত্যাহারের দাবী জানায়।
৪) শান্তি স্থাপন না হওয়া পর্য্যন্ত সরকারী রিলিফকেন্দ্রগুলি হইতে যাহাতে প্রদেশের দাঙ্গাপীড়িতদের ছাড়িয়া যাইতে বলা না হয় এই সম্মেলন তাহার দাবী জানায়।
৫) পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিভিন্ন জিলায় হিন্দুদের যেরূপ নৃশংসভাবে হত্যা করা হইয়াছে, গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হইয়াছে, বলপূর্ব্বক নারী অপহরণ করা হইয়াছে তাহা অত্যন্তই মর্মান্তিক এবং এই সম্মেলন দাঙ্গাপীড়িতদের প্রতি সর্ব্বান্তঃকরণে সমবেদনা জানাইতেছে।
ডাঃ মুখার্জির পাঞ্জাব রিলিফ ফান্ডে দান করার জন্যও জনসাধারণের নিকট আবেদন জানানো হয়।
৬) প্রদেশের ভিতর ও বাহির হইতে আসামে অভিযান চালাইবার যে ভয় প্রদর্শন করা হইয়াছে তাহার বিরুদ্ধে আসাম সরকারকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য এই সম্মেলন অনুরোধ জানাইতেছে।
দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে সকাল দশটায় শ্রীযুক্ত মনুজচন্দ্র সর্ব্বাধিকারীর সভাপতিত্বে অখিল বঙ্গ হিন্দু যুবক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।