দ্য চেঞ্জিং টাইড

অভীক মুখোপাধ্যায়

 

বুধবার ছিল। আকাশে এক টুকরো চাঁদও ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল আরব সাগরের ওপরে চন্দ্রকলাটাকে কে যেন গেঁথে রেখে গেছে। আর সেই চাঁদের রোশনাইতে কুইনস্ নেকলেস গলায় জড়িয়ে নিত্যদিনের মতোই জাগছিল মুম্বাই। সে জানত না কী বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

— কী মনে হয়, এভাবে ভাবের ভায়াগ্রার ডোজ দিয়ে অশ্রুর স্খলন ঘটিয়ে আবেগ্র লাইক চাইছি? না, একদম নয়! এভাবে মুম্বাই হামলার বিবরণ লিখে সাহিত্য করতে চাই না। ইটস্ বুলশিট, টোটালি বুলশিট!

ভাবপূর্ণ, আলঙ্কারিক ভাষার নিজস্ব গরিমা থাকে। সুন্দর ভাষা দিয়ে ঘৃণ্য কোনো ঘটনার বিবরণ দেওয়া উচিত নয়। বরং আসুন, ২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বরের হামলার আগের গল্পটা শুনি।

আচ্ছা, আশ্চর্য লাগে কিনা বলুন, পাকিস্তান কীভাবে ভেবে নিল যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শহরকে নতজানু করে দেওয়ার জন্য দশটা এ কে ফরটি সেভেন, দশটা পিস্টল, হ্যান্ডগ্রেনেড, ম্যাপ, জি পি এস ডিভাইস, স্যাটফোন, জল, বাদাম আর কিসমিস যথেষ্ট?

আসলে মুম্বাইকে হারানোর জন্য ওরা আসেনি। পরিকল্পনা ছিল বোমা আর টাইমার লাগিয়ে একইসঙ্গে একাধিক স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সকলকে ভয় পাইয়ে দেওয়া।

হ্যাঁ, ওই পিশাচগুলোর কাছে বিস্ফোরক আর টাইমার ছিল। সব সরঞ্জাম প্রত্যেকের পিঠে ঝোলা এক একটা চাইনিজ রুকস্যাকে রাখা ছিল। পিঠের ব্যাগগুলোতে একটা ইংলিশ কোড ওয়ার্ডও লেখা ছিল, গাঢ় লাল রঙের হরফে।

‘দ্য চেঞ্জিং টাইড’। এই কোড ওয়ার্ডের প্রয়োজন কী ছিল? যাতে লেখাটা মুম্বাইয়ের সাগরতটে অপেক্ষারত সেই গদ্দারের চোখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রঙ তো লালই, তাই লাল হরফে লেখা হয়েছিল। ঠিক ছিল, সেই বেইমান ওই লেখা দেখেই চিনে নেবে যে সুদূর পাকিস্তান থেকে তার ভাইজান এসে গেছে।

দশজনের টিম ছিল। দশজনের মধ্যে একজনের নাম ছিল ইসমাইল — দলের নেতা — সে দলের বাকিদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত ছিল। জি পি এস ইউজ করে অপারেশনের কোঅর্ডিনেট নিশ্চিত করছিল ইসমাইলই।

 

*****

ইসমাইল ২৬/১১ ঘটানোর মাত্র এক বছর আগে স্বেচ্ছায় জেহাদিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। জয়েন করার পর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ইসমাইলকে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকায় গোপন শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর ট্রেনিং শেষ হওয়ার পরে তাকে লুকিয়ে রাখা হয় করাচির সুরক্ষিত ঠিকানায়।

ঠিক একই ভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলার পর গুপ্ত আস্তানায় রাখা হয়েছিল মুম্বাই হামলার বাকি নয় আততায়ীকেও। এবং হামলার ঠিক চারদিন আগে, ২২ শে নভেম্বর, তাদের বলা হল, ‘চল ভাই, ঝোলা ওঠা! মুম্বাই তোদের জন্য ওয়েট করছে।’

করাচি থেকে মুম্বাইয়ের কোনো জলজাহাজে চেপে বন্দরে নেমে বিনা সমস্যায় মূলনগরীতে প্রবেশ করা কার্যত অসম্ভব। তাই ইসমাইল অ্যান্ড কোম্পানির পরবর্তী টারগেটই ছিল ভারতের কোনো মাছধরার জাহাজকে ছিনতাই করা। সত্যি বলতে কী এটা ওদের উৎসাহ-পরীক্ষার জন্য একটা মহড়াই ছিল। ট্রেনিংয় রেজিমের বাইরে তারা কিছু করতে পারে কিনা সেটা দেখার মোক্ষম উপায়।

রাবার বোটে করে এসেছিল শয়তানের দল। রাডারে ধরা যাতে না-পড়ে তাই রাবার বোট। মাঝদরিয়ায় তারা একটা ভারতীয় মাঝধরা ট্রলারকে হাইজ্যাক করে। পাকিস্তানি সঙ্গীদের তারা অলবিদা বলে দিল। যারা বিদায় দিল এবং যারা বিদায় নিল এই উভয়পক্ষই জানত যে, এই যাত্রা একতরফা, এর শেষে কেবল মৃত্যু আছে। তারা সফল হলে একটা তামাশা তো হবে, কিন্তু সেই তামাশা তারা উপভোগ করতে পারবে না।

তারা জানত যে, তাদের বাহাদুরিকে অমর করে দেওয়ার জন্য হয়তো কোনো পাকিস্তানি মসজিদে শহিদের স্মারক বানিয়ে দেওয়া হবে। কেউ হয়তো পোস্টার লাগিয়ে দেবে কোনো চৌরাস্তায়। দু-একটা জেহাদি কাগজ তাদের প্রশস্তি ছাপবে। দ্যাটস্ ইট! এই কর্মের প্রাপ্তিফল এটুকুই।

ওই দশটা ছেলে, হাইজ্যাক করা ভারতীয় ট্রলারের চালকের মাথায় বন্দুক ধরে বলল, ‘মুম্বাই চল!’

ট্রলার স্রোত ভেঙে বয়ে চলল তিনশো নটিক্যাল মাইল দূরের উদ্দেশে — মায়ানগরী মুম্বাই।

 

*****

পুরো ঘটনা পরম্পরার ডীপ অ্যানালিসিস করলে এটুকু বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না যে, ওই দশজন পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীর কাছে সি – নেভিগেশন সংক্রান্ত কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এবং ওরা কেউ ট্রলার চালাতেও পারত না।

পারবেই বা কীভাবে? কয়েকটা মুখ্যু পাকিস্তানির জমায়েত। জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই ওরা ভেড়া চড়িয়ে, মুর্গি পুষে কাটিয়েছে। এরা ট্রেনিং সেন্টারে নিশানা লক্ষ্য করে যত না গুলি চালিয়েছে, তার থেকে বেশি বুলেট আকাশের চাঁদ তারাদের লক্ষ্য করে চালায়।

এরকম লোকজনের হাতে স্যাটফোন দিলেই বা কী হয়? ইউজ করতে মাথাখারাপ করে ফেলবে। তারা সকলে পাটাতনে দাঁড়িয়ে দুইহাত শূন্যে মেলে আকাশকে এমন ভাবে দেখছিল যেন জন্নত থেকে ডাক এসে গেছে।

দশ সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে একজন আবার আরব্য রজনী থেকে শোনা সিন্দবাদের গল্প শুরু করল। সেই সিন্দবাদ, যার হাত ধরে ইসলামিক বিশ্ব আরব সাগরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। বাকি ন’জন সিন্দবাদের কথা শোনার পর ভাবল, আহা, যদি এই অভি্যান শেষ করার পর সিন্দবাদের মতোই সুরক্ষিত ভাবে পাকিস্তানে ফিরতে পারতাম!

অবশেষে, হ্যাঁ অবশেষে ছাব্বিশ এগারোতে তারা মুম্বাইয়ের তটে পা রাখল৷ নিজেদের স্যাটফোন বের করে তারা করাচিকে প্রশ্ন করল, ট্রলারের চালককে কী করব? মার দিয়া জায়ে, ইয়া ছোড় দিয়া জায়ে?

আজমল কাসভ, ওই দলের কনিষ্ঠতম সদস্য ছিল। পাকিস্তানের সম্পদ আজমল কাসভ। তাকে বলা হল, তুমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করো। কাফির কো ভি জিব্হ করনে কি বাত কা সবুৎ দো! দেখিয়ে দাও তোমার জিগরের তাকৎ!

আজমল ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে জেহাদের পথে হাঁটা শুরু করে। সঙ্গে, তারই সমবয়সী একটি ছেলে ছিল। দুজনে মুজাহিদ – শৈলীতে শপথ নিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত একসাথে লড়ব।

কিন্তু অপর ছেলেটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছিল। তাই তার তো ঘর – ওয়াপসি হয়ে যায়। ২০০৮ সালের মে মাস পর্যন্ত আদ্ধেক যোদ্ধা ট্রেনিং শিবির থেকে পালিয়ে যায়। আজমল যায়নি। সে নিজের ফেরার কোনো পথ রাখেনি।

তাই কাফিরকে জিব্হ করার জোশ তো তার মধ্যে থাকবেউ। দুজন ছেলে যখন ভারতীয় নাবিকটিকে ধরল, তখন আজমল নিজের হাতে হালাল পদ্ধতিতে জিব্হ করেছিল। লাল রক্ত আর হলুদ রঙের নৌকো, দুটোই একসাথে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল।

রাত ৮:২০। পিশাচগুলো মুম্বাইতে পা – রাখল। মৌলবী আমিরকে তারা যে কথাগুলো দিয়ে এসেছিল, সেগুলো সব মনে পড়ে গেল একে একে। মৌলবী বলত –‘লড়কো! অপনি মৌত কে লিয়ে তৈয়ার রহনা। জব তুমহারি পাক রূহ তুমহারে নাপাক জিস্ম কো ছোড়েগি, তুমহারে চেহরে চান্দ কি তরহ চমকেঙ্গে। জিস্ম সে গন্ধ্ নিকলেগি অউর তুম জন্নত কো পাওগে।’

সন্ত্রাসবাদীরা কোলাবার কাছে জেলেদের একটি চাল-এর কাছে এসে নামে। এলাকাটা এমনিতেই শুনশান। সেদিন টিভিতে ভারত – ইংল্যান্ডের ওয়ান ডে ম্যাচ ছিল। যারা ওখানে ম্যাচ দেখছিল, তারা জলের শব্দ শুনে বিরক্ত হল।

কেউ বিশেষ কিছু না বললেও একজন মুখ খুললেন। নাম ভরত তন্দেল। তিনি প্রশ্ন করলেন –‘কৌন হ্যায়?’ কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সারা মুম্বাইকে তার পরের তিন দিন এই প্রশ্নটাই তাড়িয়ে বেড়াল — কৌন হ্যায়। উত্তরটা আগে পাওয়া গেলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেত।

 

|| ২৬.১১.২০০৮||

রাত ৯.৪৮
মুম্বাইয়ের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের কন্ট্রোল রুমে প্রথম ফোন। গুলি চলেছে লিওপোল্ড কাফেতে। নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটক।

রাত ৯.৫৪
এবার তাজ হোটেল।

রাত ৯.৫৮
ট্রাইড্যান্ট ওবেরয়। ততক্ষণে পাগলাঘণ্টি হয়ে বাজতে শুরু করেছে কন্ট্রোলরুমের ফোন।

রাত ৯.৫৯
সি এস টি স্টেশনে ফায়ারিং করেছে আততায়ীর দল।

রাত ১০.০২
আক্রান্ত হল চাবাড হাউস। মুম্বাই জ্বলছে !

হ্যাঁ, সেদিন রাত থেকে শুরু করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লড়াই চলেছিল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে। নিহত হয়েছিলেন অজস্র মানুষ।

যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা-ই নিষ্কবচ। সহজে আক্রান্ত হয় তা-ই। এই সূত্র মেনেই ভারতের বুকে আঁচড় নেমে এসেছে বারে বারে। সেই বুক রক্ষা করতে যুগে যুগে পিঠ পেতে দিয়েছেন ভারতমাতার বীর সন্তানেরা। নৃশংসতার উত্তর ভারত প্রতিশোধের ভাষায় দেয়নি, দিয়েছে সংহতির ভাষ্যে।

ফিনিক্স পাখি হয়ে ওড়ার আগে জ্বলে ছাই হতে হয়েছে মুম্বাইনগরীকে। নিহতদের বলিবেদীতে দাঁড়িয়েছে মায়াশহর। ভারতকে খানখান করতে চাওয়া শক্তিকে সম্মুখ সমরে পরাস্ত করেছে ভারতীয়দের শুভবুদ্ধি। সেই কোন সুদূর অতীত থেকে গজনীর মামুদ, ইরানের নাদিরশাহের মতো বর্বরের দল আক্রমণ হেনে এসেছে ভারতের বুকে। পাকিস্তানের আজমল কাসভও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এরা কেউ ভারতকে হারাতে পারেনি। এদের তৈরী মৃত্যু উপত্যকাকে ফুলে ফুলে ঢেকে কোমল করে তুলেছে এই রাষ্ট্রের বাসিন্দারা।