পশ্চিমবঙ্গের বাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এক নিঝুম নিষ্ঠুরতার কাহিনী খুঁড়ে দেখা

0
2087

সুমন দেব রায়

 

কত কিছু জানি আমরা। দুনিয়ার প্রত্যন্ত অংশে কোথায় কি অনাচার-অবিচার হচ্ছে, সব আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হৃদয় উদ্বেলিত হয় প্রতিবাদের ভাষায়। রোয়ান্ডার গণহত্যা, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যমূলক অত্যাচার- অবিচার, ইরাকের উপর ‘সাম্রাজ্যবাদী’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, বসনিয়ায় জঘন্য মানবতা-বিরোধী নির্যাতন আমাদের কবিতায়, নাটকে, দৈনন্দিন বৌদ্ধিক আলোচনায় বারংবার উঠে এসেছে । অফিস-কারখানার ক্যান্টিনে আমরা চা পান করতে করতে কতবার কল্পনায় পাশে দাঁড়িয়েছি প্যালেস্টাইনের মানুষদের, ইজরায়েলের দখলদারি মনোভাবের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছি। আর স্বদেশের গুজরাট নিয়ে আমাদের ‘লজ্জিত বিবেক’ তো আজীবন পীড়া দিয়েই চলেছে।

কিন্ত বিশ্বমানবতার বোঝা বয়ে বেড়ানো, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ঠিকে নিয়ে চলা, এই মানবগোষ্ঠীর কাছে যদি ঘরের ভেতরের কথাই জানতে চাওয়া হয়? মরিচঝাঁপিতে কি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ফেলেন, সব প্রগতিশীল মুখগুলো কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে যায়। “মানে ঠিক জানি না দেখতে হবে”, এই বলে সবাই আসতে আসতে সরে পড়েন। বড্ড স্পর্শকাতর আমরা আমাদের প্রগতিশীল-আন্তর্জাতিক পরিচয় নিয়ে। যেন কেউ শুনে ফেললেও আমাদের জাত চলে যাবে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতিভেদপ্রথা, অস্পৃশ্যতা নিয়ে গলা কাঁপানো বিপ্লবী চরিত্র কখন যে প্রগতিশীলতা আর ধর্মনিরপক্ষেতার প্রবল ছুৎমার্গে আটকে গেছে সে নিজেও বোঝে নি। তাই তো একঘরে বা নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কত প্রকৃত প্রগতিশীল মানুষও নীরবতাকেই একমাত্র অবলম্বন করে নিয়েছে। ঢোক গিলতে গিলতে মনের প্রশ্নকেও গিলে ফেলাকেই সহনশীলতা বলে চালাতে শিখেছে এবং শিখিয়েছে। এভাবেই তো চলে যাচ্ছিল।

কিন্তু জীবন তো একভাবে বয়ে চলে না । অরণ্যাচারী, অজ্ঞাতবাসে লুকিয়ে থাকা ভাইয়েরা একদিন মাত্র পাঁচখানা গ্রাম চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ধর্মযুদ্ধ জয় এনে দিল তাদের । শুরু হল নতুন রাষ্ট্রনির্মাণের যাত্রা। ইতিহাস তো ফিরে ফিরে আসে। রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি পরাজিত হয়ে যখন রাষ্ট্রবাদী শক্তির উত্থান হয়, নির্মম সত্যিগুলোকে আর আলাদা করে খুঁড়ে বের করতে হয় না। জানা-অজানা , দৃশ্য-অদৃশ্য, শ্রুত-অশ্রুত কিছুর প্রভাবে যেন সব ভয়াবহ সত্যিগুলো হামাগুড়ি দিয়ে হলেও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। মরিচঝাঁপির ঘটনা এমনই এক ভয়ংকর সত্য যার কঙ্কাল দীর্ঘ সময় ধরে সযত্নে লুকিয়ে রাখলেও আর সম্ভব হচ্ছে না।

১৯৭৯ সালের মে মাসে এক সর্বহারার সরকার কি ‘বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা’ এবং তার  ‘গাণিতিক রূপায়ন’ করেছিলেন মরিচঝাঁপি নামক সুন্দরবনের এক অনামা অখ্যাত দ্বীপে, বিদ্বজ্জনেরা এড়িয়ে গেলেও ইতিহাস তো দাবি জানায় তার কথা শোনার জন্য। ইতিহাস তো নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছে কি করে প্রগতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুমে’ বিশ্বাসী হয়েও মুসলমানের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সমর্থন করতে পারে, কিভাবে মুসলিম লীগের পৃথক ‘পবিত্র ভূমি’র দাবিকে তাত্ত্বিক,বৌদ্ধিক এবং সাংগঠনিক সমর্থন যুগিয়ে চলতে সক্ষম হয়। উপাসনা পদ্ধতির ভিন্নতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পৃথক রাষ্ট্র যে লক্ষাধিক মানুষকে গৃহহীন করবে, তা কি করে এত বিদগ্ধ মানুষদের উপলব্ধি করতে ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’র জন্য অপেক্ষা করতে হল, এটা একটি যুগান্তকারী গবেষণার বিষয় অবশ্যই হতে পারে। দেশভাগের পরে সেই রাজনৈতিক গোষ্ঠী সুতীব্র ‘লড়াই’ শুরু করল সেই ‘পবিত্র ভূমি’ থেকে উৎখাত হওয়া বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য। ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ লড়াইটা মুসলমানের আত্মনিয়ন্ত্রণের দুনিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে উদ্বাস্তুদের অধিকারের জগতে চলে এল বিদ্বজ্জনেরা আলোচনা না করলেও ইতিহাস নীরবে হিসেব রেখেছে। তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল সেই উদ্বাস্তুদের অধিকারের আর সম্মানের লড়াই ?

প্রগতিশীল শক্তির সহায়তায় ‘পবিত্র ভূমি’ যখন অর্জন করা গেল, প্রায় সাথে সাথেই শুরু হল ‘কাফের বিতাড়ন‘। অসংখ্য মানুষ তাদের প্রাণ আর মান রক্ষার্থে যখন পা রাখল এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ ‘ মাটিতে ,তাদের হয়ে ‘প্রতিবাদ’ সংগঠিত করল সেই প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন যারা রিলিজিয়ন ভিত্তিক পৃথক রাষ্ট্রের দাবীতেও সহায়তামূলক সংগ্রাম করেছিল। ছিন্নমূল মানুষগুলোর মধ্যে যারা তথাকথিত নীচু জাতির তাদের অসহায়তা ছিল সীমাহীন। মাটির সাথে প্রকৃত অর্থে জুড়ে থাকা এই মানুষগুলোর আর্থিক এবং সামাজিক দুর্দশা যদিও বা বোঝা সম্ভব ছিল সামান্য হলেও, তাদের আত্মিক বিচ্ছিন্নতা নিজেদের পক্ষেই উপলব্ধি ছিল অসম্ভব।

সেই মানুষগুলোকে যখন তৎকালীন সরকার পুনর্বাসনের জন্য পাঠাতে শুরু করল আন্দামান বা দন্ডকারণ্যে, তীব্র বাধা এর প্রগতিশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। তারা বলল যে বাঙলার উদ্বাস্তু ভাইবোনদের আমরা বাঙলার মাটিতেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দাবী জানাই। যাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গে করা গেল না, তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো যে রাজনৈতিক ক্ষমতা পেলেই তাদের ফিরিয়ে আনা হবে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে । আশায় বুক বেধে রইল মানুষগুলো। আশাভঙ্গ হতে শুরু করল যখন এই প্রতিশ্রুতি প্রদানকারী মানুষগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হল। এবার সেই আশার প্রতীক মানুষগুলোই যেন রাত পোহালেই পাল্টে ঘোর ‘বাস্তববাদী‘ হয়ে নিরুৎসাহিত করতে শুরু করল, পশ্চিমবঙ্গের সীমিত সংস্থানের কথা, জমির অপ্রতুলতার কথা এখন চেয়ারে বসে তাদের ‘বিশেষ উন্নত মস্তিষ্ক‘ দিয়ে বুঝতে এবং বোঝাতে শিখল।

সেই চাষাভুষো মানুষেরা এটুকু বুঝল যে কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে তারা আর পশ্চিমবঙ্গে স্বাগত নয়।সরকারের থেকে আর কোন সহযোগিতা পাওয়া যাবে না বুঝে দন্ডকারণ্য থেকে একঝাঁক উদ্বাস্তু বাঙলার মাটির স্থায়ী স্বাদ পেতে হাওড়া স্টেশনে হাজির হল। পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়িয়ে তারা কলকাতা থেকে পঁচাত্তর কিলোমিটার দুরে সুন্দরবনের এক দ্বীপে পৌছে গেল ধাপে ধাপে। কেন বেছে নিল এরকম একটি অঞ্চল তাদের বসবাসের উপযোগী হিসেবে? আপাতদৃষ্টিতে ওই দ্বীপ তো মনুষ্য বসবাসের জন্য সহজ ছিল না। আসলে জল জংলার দেশের ওই লড়াকু, তথাকথিত নিম্নবর্ণের লোকগুলো নিজেদের ফেলে আসা দেশকেই যেন খুঁজে পেল ওই মরিচঝাঁপি নামক দ্বীপে। সরকারী অনুগ্রহ বা কোন রাজনৈতিক দলের সহায়তা ছাড়াই ছিন্নমূল মানুষগুলো যখন মরিচঝাঁপিকে মনুষ্য বাসযোগ্য করে ফেলবে এটা কি করে সম্ভব? কিন্তু সেই আপাত অসম্ভবকেই যেন সম্ভব করে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অক্লান্ত শ্রম আর জল-মাটির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

স্বনির্ভরতা কি ‘গরীব-দরদী’ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পছন্দ হতে পারে ? তাদের তো চাই প্রশ্নাতীত আনুগত্য, চাই নিশ্ছিদ্র নিয়ন্ত্রণ। উদ্বাস্তুদের কিছু অংশ যদি এভাবে জলজ্যান্ত উদাহরণের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার পাঠ শেখাতে সফল হয়, বাকিদের কাছে যদি তা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়, সব নিয়ন্ত্রণের রক্তচক্ষু ফ্যাকাসে হতে হতে রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হতে আর কতদিন। কাজেই সময় থাকতে থাকতেই ওই ‘ছোটলোকগুলোকে’ চরম শিক্ষা দিতে হবে। শুরু হল পরিকল্পনা। নিখুঁত পরিকল্পনা এবং তার আঁটোসাঁটো রূপায়নে চাই এক কৃত্রিম, সংগঠিত ঘৃণার পরিবেশ, যে পরিবেশে একদল ‘উদ্বুদ্ধ ‘ মানুষ সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করবে তারা যে কাজই করছে, ‘পবিত্র কর্তব্য ‘ হিসেবে করছে। এই সংগঠিত ঘৃণা কখনো আত্মহননের পথে ঠেলে দেয় কোন স্বপ্ন দেখা চিকিৎসক – গবেষককে , কখনো আবার কোনো স্থানীয় শিল্পোদ্যোগী তার তিলতিল করে গড়ে তোলা সম্পদকে চোখের সামনে শেষ হতে দেখেন এই ঘৃণার স্বীকার হয়ে।

তাই তো ১৯৭৯ সালের মে মাসে ‘পরিবেশ রক্ষার মহান কর্তব্য’ কে সামনে রেখে প্রশাসনিক পেশী আর জনরোষের তত্ত্বের নিপুণ ব্যবহার শুরু হল। যুদ্ধে যেমন লক্ষ্য থাকে যে প্রতিপক্ষের supply line নষ্ট করে তাকে দুর্বল করে দেওয়া, লড়াইয়ের ক্ষমতা হ্রাস করে দেওয়া, নিজের দেশের কিছু ‘ আত্মনির্ভর হতে চাওয়া’ মানুষের উপর সেই যুদ্ধকালীন নীতি প্রয়োগ করল গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত ‘নিপীড়িত’ মানুষের সরকার। পানীয় জল বন্ধ করে, খাদ্যের রসদ বন্ধ করে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে দুর্বল করে দেওয়া হল মরিচঝাঁপিকে নিজেদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে চাওয়া সেই উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে। কেন হল এমন?

এত আস্পর্ধা ছোটলোকদের! স্বাধীন হবে, আত্মনির্ভর হবে! চিরতরে মিটিয়ে দেওয়া হবে এদের সাধ। এমন উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে যে কেউ যেন আর স্বপ্নেও আমাদের অর্থাৎ শোষিত মানুষদের সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টা করা। কি সাধারণ স্বার্থবিরোধী কাজ। পরিবেশ ধ্বংস করে এরা নিজেদের মতো করে বাঁচতে চাইছে। ভাবুন তো, আমরাও তো কত লোককে এই রাজ্যেই বসিয়েছি। কিন্তু আমরা কিভাবে, কোথায় বসিয়েছি সেটা কি আর এইসব মূর্খ, মাথামোটাদের মাথায় ঢুকবে? মার্কস, লেনিন, মাও , চে-এদের সম্পর্কে কিছুই না জেনে হঠাৎ করে নিজেদের মত করে জগত তৈরি করে বাঁচবে। মাছ ধরবে, চাষ করবে আর স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখবে। এমনকি হসপিটাল আর স্কুল তৈরি করে ফেলল কোন রকম সরকারী অনুমোদনের পরোয়া না করে।

আমরাও সরকারের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে কত লোককে সরকারের খাস জমিতে, রেলের জমিতে আর কিছু শোসক ‘হিন্দু ‘ জমিদারের জমিতে বসিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সে সরকার তো বুর্জোয়া সরকার ছিল, শোষকের সরকার ছিল, তার আবার অনুমতির কি প্রয়োজন।  আমাদের সরকার ক্ষুধার্ত মানুষের সরকার, প্রগতিশীল চেতনার সরকার।  আমাদের অনুমতি নেওয়া মানেই ক্ষুধার্ত মানুষের অনুমতি নেওয়া। আমাদের সংগঠনের আর আদর্শের বাইরে গিয়ে ক্ষুধা নিবারণের যে কোন প্রচেষ্টা তাই বৃহত্তর স্বার্থে জরুরী, তাতে কারোর প্রাণ যাবে, কারোর না হয় মান যাবে, কিন্তু ওটাই সঠিক পথ। এ পথেই জনগণের মুক্তি আসতে পারে।

কিছু অশিক্ষিত, অচেতন মানুষের আত্মনির্ভর হওয়ার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কি প্রগতি আসতে পারে ? কখনই নয়। আমাদের পথই একমাত্র পথ। আজকে আমরা যদি প্রগতির স্বার্থে গাছপালা কেটে বসতি স্থাপন করি, বুর্জোয়া সরকারের পরিবেশ আইনকে লঙ্ঘন করলেও তা আসলে বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এসব পূর্ববঙ্গের হিন্দু জমিদারদের চ্যালাদের কে বোঝাবে এসব? এরা তো জমিদারদের হয়ে পরোক্ষ শোষণ করত মুসলমান প্রজাদের। তাই তো এদের এইভাবে বিতাড়িত হয়ে আসতে হল। অথচ এদেশে এসেও ছোটলোকগুলোর অসভ্যতা গেল না। ভাবছে তাদের পরোক্ষ জমিদারী এদেশে গড়ে তুলবে নিয়ম নীতিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে। কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যাবে না। এদের নির্মূল করতে যে ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, তা ‘সর্বহারা’র স্বার্থে নিবেদিত ।

কাজেই খাবারদাবার, জল বন্ধ করে, বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে, মরিচঝাঁপির বাসিন্দাদের উপর যে দমনপীড়নের নীতি প্রয়োগ করা হল ১৯৭৯ সালের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, তা সম্পূর্ণ এক বিশেষ ‘রাজনৈতিক শাস্ত্র অনুমোদিত’ এবং শুধু বৈধই নয়, পবিত্র কর্তব্য। যারা একসময় নিজেদের জীবন বাঁচাতে, মেয়ে বউয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে, এবং সর্বোপরি নিজেদের ধর্ম অক্ষুণ্ণ রাখতে ছুটে এসেছিল এই পশ্চিমবঙ্গে, তারা দেখল একই ভাবে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। হত্যা, সম্ভ্রম লুট, সব আবার চোখের সামনে আবার দেখল তারা। এই ভয়াবহ ধ্বংসলীলা কি আর মরিচঝাঁপিতে আবদ্ধ থাকতে পারে? ধর্মীয় কারণে উৎখাত হওয়া মানুষগুলো কেন সেক্যুলারিজম এর একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে গেল, বুঝতে গেলে মরিচঝাঁপিকে ভুলে গেলে কি করে চলবে? কোনো রকম বিরোধিতা বা একটু স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাওয়ার পরিণতি যে কি নির্মম হতে পারে, মরিচঝাপি হাতেকলমে দেখিয়ে দিল। উদ্বাস্তু অঞ্চলের তথাকথিত প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ মনস্তত্ত্ব গঠনের পেছনে মরিচঝাঁপির ভূমিকা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়, নীরবে অনুভব করতে হবে।

সিএএ বিল বা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানের আইনি প্রচেষ্টা যে এই রাজ্যে ‘প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। উদ্বাস্তুদের সঠিক পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব লাভ তাদের আত্মনির্ভরতা অর্জনের দিকে যে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া এটা সেই প্রগতিশীলতার’ ধারক-বাহকেরা ভালোই বুঝতে পারছেন। উদ্বাস্তুদের মিছিলের ‘সংখ্যা’ আর স্লোগানের ‘গলা’ ছাড়া প্রাথমিকভাবে যারা আর কিছু ভাবতে অভ্যস্ত নয়, তাদের জন্য মরিচঝাঁপি স্বস্তিদায়ক হলেও সিএএ বিল একেবারেই নয়। মরিচঝাঁপির নির্মম ইতিহাস যতই নিখুঁতভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা হোক, সময় ততোধিক নির্মমতা দিয়ে সব সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে। নতুন ভারত গঠনের প্রক্রিয়ায় আজ তারাই সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে চলেছেন যাদের শুধুমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার ভাবা হয়েছিল । যে মানুষগুলো প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও আমৃত্যু বিশ্বাস করেছিল একটি জীবনদর্শন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ”, তারা এই প্রগতিশীলতার আবহে তাদের মর্যাদা লাভ না করলেও আত্মমর্যাদার পথে এগিয়ে চলা নতুন ভারতে, ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটানো আত্মনির্ভর ভারতে ,লড়াকু পরিশ্রমী মানুষগুলো তাদের স্বপ্ন সার্থক করবেই।