আমরা কি বহু পুস্তকের মানুষ নাকি এক আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী মানুষ?

0
446

পুত্তাপূর্তি নারায়নচারালু তেলেগু সাহিত্যের একজন অসামান্য প্রতিভাধর এবং কবি যিনি বহু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। প্রায় ১৪ টি ভাষা তাঁর দখলে ছিল। কিন্তু এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটির কোনো প্রথাগত শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না এবং এখানেই জড়িয়ে আছে এক গল্প।

তাঁর বয়স যখন সবে মাত্র ১২  বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, ততদিনে তার “পেনুগোণ্ডা লক্ষ্মী” নামক একটি ব‌ই প্রকাশিত হয়ে গেছে। যেহেতু বইটি ভাব, কল্পনাশক্তি এবং ভাষার সমন্বয়ে অসাধারণ ছিল, তাই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় এটিকে “বিদ্বান” পরীক্ষার পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তাঁর এক বন্ধু তাঁকে প্রথাগত শিক্ষা অর্জনের জন্য বিভিন্নভাবে তাঁকে অনুপ্রেরণা যোগায়। সেই বন্ধুর কথা মতো তিনি বিদ্বান পরীক্ষায় বসেন এবং আশ্চর্যজনক ভাবে ব্যর্থ হন। গল্পটি শুনে এটি অনুমান করা হয় যে তিনি তার স্বরচিত কবিতাকে ঘিরে পণ্ডিতদের কল্পিত  বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত ছিলেন না তাই অনুত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

আমি এই গল্প কাহিনীটি কেন স্মরণ করছি তা বোঝার জন্য আপনাকে  পুত্তাপূর্তিকেকে শ্রদ্ধেয় আম্বেদকর হিসাবে কল্পনা করতে হবে এবং “পেনুগণ্ডা লক্ষ্মী”-কে সংবিধানের আসনে স্থান দিতে হবে। একথা খুব সহজেই অনুমেয় যে, যেসব মতবাদ সংবিধান থেকে নির্মাণ করা হয়েছিল সেসব আদতে অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর এমনকি আম্বেদকর সহ অন্যান্য সংবিধান-নির্মাতা পরিষদের সদস্যরাও এই ভেবেই বিস্মিত হতেন যে এই কি সেই হযবরল যা তৈরি করার জন্যই কি তাঁরা পরিশ্রম করে গেছেন?

যখন থেকে সংবিধানকে আমরা পূর্ণাঙ্গরূপে পেয়েছি প্রাথমিক কাঠামো (The Doctrine of Basic Structure বা ডিবিএস) হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন বিষয়ক ঘোষণা। সংবিধান নিজে যতটা গুরুত্বপূর্ণ এটিও ঠিক ততটাই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সংবিধান তৈরি হয়েছিল গণপরিষদের দ্বারা আর এই প্রাথমিক কাঠামোটি  বিচার ব্যবস্থা সংক্রান্ত কার্যকলাপের জন্য এক‌ই উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারপতিদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল ।

ঠিক তেমনি, ধর্মের ক্ষেত্রেও আইনি হস্তক্ষেপ হয়েছে। একান্ত প্রয়োজনীয় ধর্মীয় আচার (the Doctrine of Essential Religious Practices বা ডিইআরপি) এইরকমই একটা ব্যাপার। ১৯৫৪ সালে প্রস্তাবিত করা হলেও এটিকে ডিবিএসের অগ্রদূত বলে ধরা হয়। যে কোনো উৎসব, আচার, প্রথা, বংশ পরম্পরায় অনুশীলন করে আসা ঐতিহ্যকে ডিবিএসেপ অগ্নিপরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে হবে।

ডিইআরপি কি দেশীয় উদ্ভাবন বা অন্যত্র থেকে অনুপ্রাণিত?? আদি দেশীয় ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম যা আমাদের প্রাচীন সভ্যতার ধারণা সম্পর্কে অবহিত করে, তাকে একেশ্বরবাদ বা একবিধির প্রতিভূ কোনটাই বলা যায় নযা। দেশ কালের পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু হিন্দু ধর্ম পরিবর্তনশীল এবং এর কোন সর্বজনীন একরূপতা নেই, তাই এটি কখনও ডার্পের উৎস হতে পারে না। আর কোন দ্বিতীয় প্রামাণ্য তথ্য সামনে আসেনি যা ডিইআরপি-র দেশজ মূল সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়।

বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে ধর্ম বা রিলিজন সাধারণত দুই প্রকারের — বহু পুস্তকে সমৃদ্ধ ধর্ম আর এক আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী ধর্ম। আমাদের পূর্বসূরীরা ধর্মীয়, দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সজীব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন যা  সহস্র সহস্র বছর জুড়ে বিবর্তিত হয়েছিল। এর নির্দিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠাতা বা ধর্মগ্রন্থ নেই এমনকি এর কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থাও নেই। কিন্তু এর বিপরীত প্রত্যেকটি আসমানী কিতাবের ধর্মগুলি (সম্মিলিতভাবে যাদের আব্রাহামবাদ নামে অভিহিত করা হয়)। সহজেই বোধগম্য কান্ত প্রয়োজনীয় ধর্মীয় আচারগুলির যথাযথ বিবরণ রয়েছে আসমানী কিতাবগুলিতে যা থেকে ডিইআরপি-র ধারণাটি উৎপন্ন হয়েছে বলে ধরা হয়। আমাদের দেশের সংবিধানের শুরুতেই যেহেতু “ইণ্ডিয়া যার নাম ভারত” রয়েছে, তখন কিভাবে আব্রাহামীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত ভারতীয় উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, ঐতিহ্য সংস্কৃতি যা যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে সেগুলো নিষিদ্ধ করা যায়?

সংবিধানের বিডিএস-এর সারমর্ম এবং লক্ষ্য বস্তুতঃ আব্রাহামীয় ডিইআরপি-র  ক্লোন বলে ধরা নেওয়া যেতে পারে। যেহেতু এক আসমানী কিতাবের ধর্মে তার কিতাবটির উপাদানগুলি চিরদিনের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনশীল, ডিবিএসও আমাদের সংবিধানের বহু দিককে অপরিবর্তনশীল করে দেয়।  মূল সংবিধান প্রণেতারা কি আদৌও ডিবিএসের পরিকল্পনা করেছিলেন, তা আমাদের বিচার্য বিষয় নয়! আসল চিন্তার বিষয় অন্য। আমাদের সংবিধানের ওপর এই আব্রাহামীয় ভাবনা একবার জেঁকে বসলে তা আমাদের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতাকে উত্তরোত্তর আব্রাহামীয় করে তুলবে।

একরূপতার সন্ধান করা আব্রাহামবাদের মূল বিষয় যেখানে আমাদের সভ্যতায় এবং সভ্যতার পরিপোষক হিন্দুধর্মে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকেই  প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন, ডিইআরপি এবং ডিবিএস আমাদের প্রাচীন সভ্যতার একেবারে মূলনীতিগুলোর বিরোধিতা করে কারণ তারা সর্বাত্মকভাবে আমাদের উৎসব, আচার, রীতিনীতি ঐতিহ্য-সংস্কৃতির মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্নতার মাধুর্যকে বিলোপ  করার চেষ্টা করে। আমাদের প্রাচীন সভ্যতার বৈচিত্র্যময়তা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় দিককে প্রতিফলিত করে যা  একরূপতার পরিপন্থী করে। কিন্তু এতটা গভীরে কেই বা ভাবে?

আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম তাঁদের সমসাময়িক চিন্তা ভাবনা এবং ধারণাগুলিকে সংবিধানের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তাঁরা কখনই চায়নি যে এটি ঐশ্বরীয় ভাবে নির্ধারিত আসমানী কিতাবের আকারে আত্মপ্রকাশ করুক। তাঁরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জীবনের সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা অধিকার গুলিকে অঙ্গীকার করানোর জন্য কোন একটি প্রজন্মের সর্বময় কর্তৃত্ব  ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, যেহেতু মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন তাই কিভাবে তারা তাদের পূর্বসূরীদের দাসত্ব স্বীকার করে নিতে পারে? যদিও হিন্দুধর্ম এই শিক্ষা দেয় যে অতীত আমাদের পথপ্রদর্শক হতেই পারে, কিন্তু মানুষকে অতীতের দাস তৈরি করার কথা সে বলে না। তবুও ডিইআরপি এবং ডিবিএস তার্কিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মকে আব্রাহামীয় করার কথাই বলে। আদপে তাদের বাকচাতুর্র্যের দ্বারা তারা বহু পুস্তকের মানুষ আমাদের এক কিতাবের মানুষ করার চেষ্টাই করছে।

আমাদের প্রাচীন সভ্যতার  সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিস গুলির মধ্যে একটি হল, তার গভীর ও সুচিন্তিত ধারণা যে এই মহাবিশ্বের অন্তর্গত কোন কিছুই স্থায়ী বা অমর নয়। ভারতীয় ধর্মগুলি থেকে একথা জানা যায়। এই সভ্যতার ধারণা অনুযায়ী বিশ্বচরাচরের সবকিছু অস্থায়ী বা অনিত্য। ইহা পরিবর্তনের নিয়মের অন্যতম প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞাত করে। এবং আব্রাহামীয় মতবাদ প্রসূত চিরন্তনতার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে।

সাংবিধানিক পারিষদরা  হিন্দুধর্মের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ব হতেই যথেষ্ট জ্ঞাত ছিলেন, প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তি মাথায় রেখে তারা একটি নমনীয় সংবিধান রচনা করেছিলেন। তারা সংবিধানের মধ্যে কালের অমোঘ নিয়ম এবং অনিত্যতার মৌলিক ধারণাকে অঙ্গীভূত করেছিলেন, ধারা ৩৬৮ লাগু করা হয়েছিল, এর অশ্মীভবন বা চিরন্তনতা রোধ করার জন্য। তথাপি সর্বতোভাবে প্রমাণিত, ডিইআরপি এবং ডিবিএস হিন্দুধর্মকে আব্রাহামীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আনার চেষ্টা করছে এবং আমাদের বহু পুস্তকের মানুষ থেকে এক কিতাবেরমানবে রূপান্তরিত করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রাচীনতম সভ্যতার মৃত্যু ঘন্টার আওয়াজ শোনাতে চাইছে।

আমাদের সভ্যতার ধারাবাহিকতা এবং ধর্মীয় অস্তিত্ব প্রবল সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক প্রবল হুমকি যা আমাদের প্রাণভোমরা কে ধ্বংস করার জন্য উদ্যত হয়েছে। অতএব একটি গভীর প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়েছে বিধিব্যবস্থা মানুষের জন্য নাকি মানুষ বিধিব্যবস্থার জন্য?

সংবিধান রচনার ৭০ তম বর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। তিনটি প্রজন্ম তখন থেকে আজ অবধি পার হয়ে এসেছে। তাই সাংবিধানিক এবং আইনি ব্যবস্থার গতি প্রকৃতি এবং দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে একটি বিতর্ক আজ ভীষণভাবে জরুরী। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করার আগে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন সভ্যতার প্রতিশব্দ ভারতবর্ষকে আমরা আরও ক্ষয়িষ্ণু তুলবো না তো?

“সবকা বিকাশ”-এর সংজ্ঞানুসারে আমাদের প্রাচীন সভ্যতা, দেশজ ধর্মগুলির  পাশাপাশি ঐতিহ্য সংস্কৃতির বিকাশকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ ধর্মীয় বা  সাংস্কৃতিক বিকাশ আমাদের পরিচয় বহন করে কিন্তু আর্থিক বিকাশ তা করে না।

 

এম নাগেশ্বর রাওয়ের লেখা মূল প্রবন্ধটি টাইমস অফ ইণ্ডিয়ায় প্রকাশিত। লেখক বরিষ্ঠ আই পি এস অফিসার। অভিমত ব্যক্তিগত। বাংলায় অনুবাদ করেছেন দীপান্বিতা।