বাঙ্গলা ভাষা আন্দোলনের অমর দিন ২০শে সেপ্টেম্বর

একুশের বার্তা যখন আরব সাম্রাজ্যবাদের কবলে

ভাষা, সংস্কৃতি এবং সাম্রাজ্যবাদ

ভাষা আর সংস্কৃতি এর কোনটিই একে অপরের সাথে আলাদা নয়। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে ধারণা করা কঠিন। ভাষা হল মানুষের সংস্কৃতি নির্মাণের কারক। ভাষা সংস্কৃতি নির্মাণ করে একথা যেমন সত্য তেমনি সংস্কৃতিও ভাষা নির্মাণ করে। ভাষাতেই ছাপ থাকে ব্যবহারকারীর সংস্কৃতির। কথাক’টি কি খুব তাত্ত্বিক বোধ হচ্ছে? কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিয়ে দেখা যাক।

যদি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করি, দেখবো ভাষার মধ্যে অবিরত সংস্কৃত উক্তির প্রাচুর্য। স্পষ্টতঃই আমাদের তদানীন্তন সংস্কৃতি ছিল ভারতীয় সভ্যতার আদর্শে পরিপূর্ণ। তাই কবিগুরু যখন বলেছেন,

“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,

লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর

হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,

দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,

গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,

সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,

নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,

মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন

মহাতত্ত্বগুলি।”

তখন আমাদের তা কাল্পনিক আদর্শ লাগে নি। আজ এরকম কথা শুনলে হয়ত সামবেদের কথা বলার জন্য কবিগুরুকে সেকুলারধর্মীরা ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন এবং সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতেন!

আর যদি অধুনা কোন বাংলা সাহিত্য পড়ি, তাতে সংস্কৃত উক্তি বিরল, বরং ইংরেজী উক্তির ছড়াছড়ি। এই সাহিত্য বা ভাষাভঙ্গীও আমাদের সংস্কৃতির পাশ্চাত্যমার্গী হবার নিদর্শন মাত্র। আজ নাগরিক আর আমেরিকাবাসী হতেই আমরা আগ্রহী, গ্রাম্যরা গ্রামে থাকার কারণেই নিন্দিত। নিঃসন্দেহে আমাদের ভাষার ইংরাজীমার্গিতা এবং আমাদের সংস্কৃতির পাশ্চাত্যগামিতা এক সূত্রেই জড়িত।

লিবারেল মহলে একটি চলিত অভ্যাস হচ্ছে ভাষাকে সংস্কৃতির সঙ্গে আলাদা করে উত্থাপন করার। বর্তমান লিবারেলরা সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা ইংরাজী ভাষা এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার জয় এবং বাকী সমস্ত সভ্যতাকে মিউজিয়ামে পাঠানোর পক্ষপাতী। কাজেই আমরা তাঁদের ভাষাকে সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে দেখার প্রকৃত উদ্দেশ্য সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম।

বিশ্ব ইতিহাসেও দেখি যখন যখন কোন সংস্কৃতি দেশে দেশে বিস্তৃত হয়েছে, তখনই সেই সংস্কৃতির বাহক ভাষাও উপযুক্ত সব স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত থেকে সংস্কৃত ভাষা মঙ্গোলিয়া, জাপান বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যাওয়ার মূলে আছে ভারতীয় সংস্কৃতি বিশেষতঃ তথাগত বুদ্ধের বার্তার ঐসব দেশে গমন।

ইউরোপীয় দেশগুলি যখন যে যে ভূমি আপন সাম্রাজ্যবাদের পুষ্টির জন্য জয় করেছে, সেই সেই ভূমিতে আপন ভাষার প্রসার ঘটিয়েছে। তাই আজ পর্তুগালের চেয়ে অ্যাঙ্গোলার অভিজাত বর্গ পর্তুগীজ বলায় বেশি পারদর্শী! স্পেনের চেয়ে অনেক বেশী স্প্যানীশ ভাষাভাষী মানুষ দক্ষিণ আমেরিকায় বাস করেন। সবচেয়ে বেশি দেশ জয় বা সর্বাপেক্ষা বেশী দেশের সঙ্গে লড়াইয়ের রেকর্ড আছে গ্রেট বৃটেনের। আশ্চর্যান্বিত হবার কিছু নেই যে ইংরাজী আজ সারা বিশ্বের ভাষা।

 

আরব সাম্রাজ্যবাদ

সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে ভাষার প্রসারের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন আরব সাম্রাজ্যবাদ যা ইসলামের মাধ্যমে দুনিয়া জয়ে সচেষ্ট হয়েছে। এই নিয়ে পণ্ডিতপ্রবর শ্রীআনোয়ার শেখ আপন অমূল্য গবেষণা তাঁর “Islam – the Arab Imperialism” গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন। আগ্রহী পাঠক এই দুষ্প্রাপ্য বইটি পড়লে আরব সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হবেন।

আরব সাম্রাজ্যবাদের কারণে পৃথিবীর বহু দেশ আপন আপন ভাষা বিস্মৃত হয়েছেন। যেমন মিশর, সীরিয়া, লিবিয়া, ওমান, বাহরীন, ইরাক (মেসোপটেমিয়া) এই সমস্ত দেশে প্রচলিত ছিল আপন আপন ভাষা।

মিশরের ভাষা, উদাহরণস্বরূপ, খুব প্রাচীন, অন্ততঃ আড়াই থেকে তিন হাজার বছরের পুরানো। রসেটা স্টোন নামক আবিস্কৃত পাথরে এই ভাষার লিখিত প্রমাণ আছে। কিন্তু আরব সাম্রাজ্যবাদের কারণে আজ মিশরের মানুষ নিজেদের অতীত ভাষা এবং গৌরবময় সংস্কৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত। তাঁরা আরবী ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করেন এবং নিজেদের আরবী সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে ভালোবাসেন।

সীরিয়ার সংস্কৃতিও মিশরের চেয়ে কিছু কম প্রাচীন নয়। প্রাচীন সীরিয়ার সীরিয়ান ভাষা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা। ইসলামের জন্মের পাঁচশো  বছরের মধ্যে, খ্রীঃ দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকে মধ্যপ্রাচ্যে যত সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছিল, তার শতকরা নব্বই ভাগই সীরিয়ান ভাষায় রচিত। কিন্তু আরব সাম্রাজ্যবাদের কবলে সীরিয়ার সমৃদ্ধ ভাষা আজ অবলুপ্ত। সীরিয়ানরা আজ আরবী ভাষা এবং আরবী সংস্কৃতির অতিরিক্ত কিছু ভাবতে অপারগ।

এইরকম একের পর এক দেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে গ্রাস করেছে আরব সাম্রাজ্যবাদ। একটি তথ্যের মাধ্যমে সারটি জানাই। লিখিত আধুনিক আরবিকে একটি “ম্যাক্রোভাষা” আখ্যা দেয়া হয়; এর ২৭ রকমের উপভাষাI এক-একটি এক-এক দেশে চলে।

 

 কি কারণে ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঘটেছিল?

ভারতীয় উপমহাদেশে আরবীয় সাম্রাজ্যবাদ বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতে আরবী ভাষা আসে নি, ভারতের কোথাওই আরবী বা ফার্সীর কোন উপভাষা চলে না। ভারতে আরবী লিপি আর প্রাকৃত ভাষার সংমিশ্রণে ঊর্দু নামক ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা ভারতে আরবীয় সাম্রাজ্য়বাদের সেবক, তাঁদেরকে ঊর্দু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মুসলমানেরা আরবীর সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ভেদ নিয়ে সম্য়ক ওয়াকি বহাল ছিলেন। যেমন আসা যাক মোহাম্মদ আকরম খাঁর কথায়। ইসলামীয় আন্দোলনের পুরোধা খাঁ সাহেব কোরআন শরীফের একটি বঙ্গানুবাদ করেছেন। খাঁ সাহেবের কোরআন বিশুদ্ধ তৎসম-খটিত বাংলায় রচিত। তৎসত্ত্বেও সেখানে তিনি একমাত্র উপাস্য়কে ঈশ্বর বা ভগবান্ নামে চিহ্নিত করেন নি, আরবীয় আল্লাহ শব্দটি বজায় রেখেছেন । শব্দচয়নের এই মুন্সীয়ানা খাঁ সাহেবের ভারতীয় এবং আরবীয় সংস্কৃতির পার্থক্যের জ্ঞানকেই নির্দেশ করে।

পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা এটাই ছিল যে বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষ সেখানে ঊর্দু নয়, বাংলা ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। মীর মোশারফ হোসেন থেকে শুরু করে জসীমুদ্দিন, অধিকাংশ পূর্ববঙ্গীয় মুসলীগ লীগী চিন্তাবিদ্ ঊর্দু ভাষা নয়, বাংলা ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন। তাই মাদ্রাসায় যে আরবী পড়ানো হত, তা মানুষকে স্পর্শ করত না। বিশ শতকের গোড়ায় অবিভক্ত বাংলার মাদ্রাসায় সাধারণ বাংলার পরিবর্তে মুসলমানী বাংলা (তৎসম শব্দের পরিবর্তে আরবী-ফারসী শব্দের আধিক্যপূর্ণ) পড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার।

ভাষার সাথে সংস্কৃতির এই বিচ্ছেদ নিয়ে তদানীন্তন মুসলমান সমাজ অবগত ছিল এবং সমাধানের চেষ্টাও করেছিল। ১৯৪০এর দশকে যখন পাকিস্তান গঠিত হয়নি, কিন্তু গঠনের উদ্যোগ চলছিল পুরোদমে, তখন বাংলাভাষী লীগী মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা হিন্দুয়ানা-মুক্ত বাংলা ভাষার গঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আবুল মনসুর আহমেদ, সৈয়দ আলি আহসান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ লেখক এইরকম এক বাংলাভাষা রচনার প্রয়াসে প্রয়াসী ছিলেন।  “পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি”, “পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ” প্রভৃতি সংগঠন এই প্রয়াসের শিখরে ঠিল। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে সোসাইটি ইসলামিয়া কলেজে প্রথম বার্ষিক সম্মেলন করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খাজা নাজিমুদ্দীন, খাজা শাহাবুদ্দীন, হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী, হাসান সুহরাওয়ার্দী, নুরুল আমীন, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, তমিজুদ্দীন খাঁ, শাহাদৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, এস ওয়াজেদ আলী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল হোসেন, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবও উত্থাপিত হয়।

কিন্তু পাকিস্তানী শাসকরা সূক্ষ্মভাবে  বাংলাকে আরবায়িত করে আরবীর আর একটি উপভাষা বানানোর দীর্ঘকালীন  প্রকল্প সাধনে ধৈর্যশীল হতে পারেন নি। হালালের চেয়ে ঝটকার উপরেই তাঁদের বিশ্বাস ছিল বেশি। তাই তাঁরা সরকারী ভাষা হিসাবে সরাসরি ঊর্দুকে চাপিয়ে দেন, বাংলাকে এক ঝটকায় নিকেশ করে। লীগী বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারলেন যে ঊর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তাঁদের সম্মান, পদমর্যাদা এবং আর্থিক স্থিতি বিপন্ন হবে।  পূর্ববঙ্গ তাই ঊর্দুর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। পূর্ববঙ্গের তখন প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ জনসংখ্যা ছিল হিন্দু যারা একান্তভাবেই বাংলার পক্ষে। পরিণামে, একুশের আন্দোলন এল। বাংলাদেশ গঠনের বাকী ইতিহাস সকলেরই জানা।

এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল তুরস্কে এবং ইরানে। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক লাঞ্ছিত তুর্কী ভাষাকে আবার পুনরুজ্জীবিত করেন এবং আরবী লিপিকে আপন দেশ হতে বহিষ্কার করেন। ইরানের শাহ আপন সুপ্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতিকে সগৌরবে তুলে ধরেন এবং আরবীয় রীতি বহিষ্কার করে ইউরোপীয় সামাজিক রীতি তুলে ধরেন।

 

একুশে কিন্তু আরব সাম্রাজ্যবাদের সামনে অস্তমিত

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রাতঃস্মরণীয় এই দুই পুরুষই একটি ক্ষেত্রকে উপেক্ষা করেন। তাঁরা মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে আব্রাহামীয় সাম্রাজ্যবাদকে সম্যক মোকাবিলা করতে চাননি। তাই তাঁদের দৃঢ়চেষ্টা সত্ত্বেও আজ আতাতুর্কের তুরস্ক ইসলামবাদের করাল গ্রাসে রাহুগ্রস্ত। ইরানের কথা তো বলাই বাহুল্য। ১৯৭৯ এর ইসলামিক বিপ্লবের পর ইরান নিজের সভ্যতার গর্ব পুরোপুরি হারিয়েছে।

বাংলাদেশের একুশে আন্দোলন তাই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একুশের জ্যোতি অস্তমিত করতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা বাংলাদেশে ভীষণ তৎপর। তারা বাংলাদেশে আরবী ভাষা এবং আরবী লিপির প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করছে। বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার ক্রমে ক্রমে আরবীয় শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে আরবীয় ম্যাক্রোভাষার আর একটি উপভাষা সৃজনে ব্রতী। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বহিষ্কৃত। কাজী নজরুলের মত লেখকদের লেখাও তাই পাঠ্যপুস্তকে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এবার আর আগের ভুলের পুনরাবৃত্তিতে তারা নারাজ। বাংলা ভাষাকে অস্তমিত করতে এক ঝটকায় নয়, দীর্ঘকালীন হালালের উপরেই তাদের আস্থা বেশি। লিপিতে তারা হাত দেবে সবার শেষে, যখন বাংলা তার সংস্কৃতির উৎস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

একুশে তাই আজ দিশাহীন। শাহবাগের সময় একুশের সংগ্রাম শেষ একবার জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু আহমেদ রাজীব হায়দার, নীল নিলয় প্রভৃতি ভাষাপ্রেমী নাস্তিকদের হত্যা করে এবং সানিউর রহমানের মত নাস্তিকদের উপর জীবনবিপন্নকারী আঘাত হেনে তাঁঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করে আরব সাম্রাজ্যবাদ বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে কেবল বাংলাদেশে সজীবই নয় বরং জয়ের রাস্তায়ই হাঁটছে।

 

একুশেকে কি দিশা দেখাবে বিশে সেপ্টেম্বর

ভাষা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সন্ধিক্ষণে বিশে সেপ্টেম্বর এক উজ্জ্বল দিন। পশ্চিমবঙ্গের সমাজের প্রত্যন্ত প্রান্তের দুই তরুণ আরব সাম্রাজ্যবাদের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দাড়িভিটে  প্রাণ দিয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধে আরব সাম্রাজ্যবাদ এক কদম পিছু হটেছে।

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সুকঠিন এবং দীর্ঘস্থায়ী। আপামর বাঙালীকে আজ এই লড়াইয়ে সামিল হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালী সর্বদাই শিখরে অবস্থান করছে। পাঠান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, মুঘল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের কাহিনী আমরা সবাই জানি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সর্বাগ্রে ছিল বাংলা – শুধু ভারতের মধ্যে নয়, পৃথিবীর মধ্যেও। সেলুলার জেলে গেলে একের পর এক বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম সেই আভাসই দেয়।

ভাষার ব্যাপারেও বাঙালী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে এগিয়ে। মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধের তুল্য একথা প্রবলভাবে বিশ্বাস করেছে বাঙালী সমাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, আশুতোষ এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়। মাতৃভাষার পক্ষে, ইংরাজী ভাষার অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বাঙালীদের নামের তালিকা করলে আর অন্য কিছু লেখার অবকাশই থাকবে না। আমি তাই নামের বহর আর বাড়ালাম না।

এ হেন বাঙালীর সামনে এখন সুযোগ আপন চিন্তাশক্তি আর কর্মশক্তিকে মিলিত করে আরব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পা বাড়ানোর। বিশে সেপ্টেম্বর আমাদের বাঙালী শোণিতে এনে দিক প্রাণের স্পর্ধা। আমরা দৃপ্ত স্বরে শপথ নিই আরব সাম্রাজ্যবাদকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কার করার। ভাষা, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে সমস্ত বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে আমরা দৃঢ়ব্রতী হই। তা হলে আমাদের এই সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেবে।

কামাল আতাতুর্ক বা পারস্যের শাহ যা পারেন নি, আমরা জাতীয় জীবনকে সংহত করলে মিলিত শক্তিতে তা করতে পারব, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। একুশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই আজ টালমাটাল। বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতিতে একুশের স্থান আজ এক শ্লোগান মাত্র, জীবনদিশা নয়। তাই বাঙালীর উদারনীতি তাঁদের চরিত্রে দিন দিন ক্ষীণ। সেই উদারনীতির ক্ষয় পোশাক আসাক, ভাষায়, ভাবে, ক্রিকেটের মাঠে পাকিস্তানের প্রতি আবেগে, পাকিস্তানপন্থী ছাত্র আন্দোলনে, সর্বত্রই মূর্ত হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী তসলিমা নাসরীন বা সানিয়ুর রহমান যাঁরা হতে পারতেন একুশের সার্থক উত্তরসূরী, তাঁরা আজ বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত।

সীমান্তের ওপারে একুশে আন্দোলন তাঁদের শক্তি ফিরে পাবেন যদি তাঁরা একুশের লড়াইকে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে চালিত করেন। এই লড়াই নিছক পাকিস্তানী সেনার বা পাকিস্তানী সরকারের অথবা পাকিস্তানী জনগণের বিরুদ্ধেও নয়। কারণ পাকিস্তান তো নিজেই আরব সাম্রাজ্যবাদের কবলগ্রস্ত এক দেশ মাত্র।

এই লড়াই আরব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। মানুষের চিন্তাশক্তিকে কেড়ে নেবার বিরুদ্ধে। আর বিশে সেপ্টেম্বর সেই লড়াইকে করবে বিশ্বব্যাপী।