আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি: কেন এই মুসলিমরা ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেছেন এবং সে জন্য গর্ববোধ করছেন?

0
2298

বেশ কিছুদিন যাবৎ “আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি” শিরোনামটি ট্যুইটারে ব্যাপকহারে ভেসে বেড়াচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রাক্তন মুসলিমরা অর্থাৎ যারা ইসলাম ত্যাগ করেছেন তারা রীতিমতো এই ব্যাপারটা নিয়ে উৎসব পালনের মতো মাতামাতি করছেন এবং এক‌ই সঙ্গে শারিয়া আইনের শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসার আনন্দ ও তাদের নবলব্ধ স্বাধীনতার স্বাদ  যা তারা পূর্বে কেবল কল্পনা করতো  সেই বার্তা ট্যুইট করে শেয়ার করছে।

উত্তর আমেরিকার ভূতপূর্ব মুসলমানগণ (এক্স‌এম‌এন‌এ)  অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও তাদের উদ্দেশ্যে প্রচার করে চলেন। এটি বিভিন্ন সরকারি স্থানে বিলবোর্ড লাগিয়েছেন। একজন লিখেছেন “যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চারজন মুসলমানের মধ্যে একজন ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করছে”। তিনি এটাও যোগ করে বলেছেন, “নাস্তিক, একজন প্রাক্তন মুসলিম। “

এক্স‌এম‌এন‌এ- র অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা ইসলাম ত্যাগ করছেন তাদের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ করা। এরা মূলত ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলো প্রচার করে এবং ধর্মীয় মতবিরোধকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে। এই উদ্যোগটি 2012 সালে সৈয়দ মুহাম্মদ নামের একজন মানবাধিকারকর্মী প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলামকে আদতে একটা কানাগলির সঙ্গে তুলনা  করা হয়েছে। বাইরের কারোর জন্য ইসলামের দরজা সর্বদা উন্মুক্ত কিন্তু কেউ যদি ইসলাম ত্যাগ করতে চায় তাহলে শারিয়া আইন অনুযায়ী তার জন্য অপেক্ষা করছে চরম শাস্তি, মৃত্যু।

ইসলাম পরিত্যাগের জন্য  কাউকে হত্যা আকছারই ঘটে। এগুলো মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে প্রায়শই ঘটে থাকে শুধু তাই নয় পশ্চিমা দেশগুলিতে যেখানে শরিয়া আইন বলবৎ নয় সেখানেও ঘটে। যেসমস্ত দেশগুলো  ইসলামীয় দেশ নয়  সেখানকার উগ্রবাদী মুসলমানরা  নিজেরাই নিজেদের হাতে দায়িত্ব তুলে নেয় যারা আল্লাহর পথ থেকে সরে গেছে তাদের শাস্তি প্রদানের জন্য। গত সপ্তাহে  বৃটিশ সরকার দুজন মুসলিম পুরুষকে এব্যাপারে গ্রেফতার করেছেন কারণ তারা  তাদের এক ইসলামত্যাগী  মহিলা আত্মীয়াকে হত্যা করার ছক কষেছিল যিনি ইসলামকে অস্বীকার করেছেন।

এমন এক ভয়াবহ পরিবেশ যেখানে মুরতাদদের প্রতিনিয়ত নিহত হবার ভয়ে বাঁচতে হচ্ছে সেখানে এই সংস্থাটি সাহসিকতার সঙ্গে যে কাজ করছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। টুইটারে আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি প্রচারকার্যের ডাকে সাড়া দিয়ে বহু প্রাক্তন মুসলিম ইসলাম ছেড়ে কেন ভালো আছেন সেই গল্প ভাগ করে নিচ্ছেন। এবং এটি অবশ্যই কোনো অবাক করার মতো বিষয় নয় যে তাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি, ইসলাম ধর্মে যাদের গৌণ মর্যাদা দেওয়া হয়।

অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন মুসলিম সমর্থক নেটওয়ার্কের সহপ্রতিষ্ঠাতা নিক তার টুইটার হ্যান্ডেলে হেরেটিক্যাল গ্রে হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইট করে জানিয়েছেন কেন তিনি আল্লাহ ব্যতীত চমৎকার রয়েছেন। কারণ সহযোগে তিনি ট্যুইট করে বর্ণনা করেছেন “কোন শিশুকে জোরপূর্বক হিজাব/ নিকাব পরানো উচিত নয় কারণ আমার মূল্য কোন কাপড়ের টুকরো দ্বারা নির্ধারিত নয়। আমার হিজাব সরিয়ে নেওয়ার অর্থ এই নয় আমি ধর্ষণের দাবিদার প্রাপ্ত একজন অনৈতিক ব্যক্তি। কারণ আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ রয়েছে।”

ইয়াসমিন মহাম্মদ টুইট করে বলেছেন “এখন আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী জীবন উপভোগ করতে পারি, আমাদের মন‌ও চিন্তা ভাবনার ব্যাপারে পুরোপুরি উন্মুক্ত। আমরা আমাদের পছন্দ অনুযায়ী যে কাউকে ভালবাসতে পারি। আমরা আর কোনো স্বার্থান্বেষী আত্মনিমগ্ন ব্যক্তির অধীনস্থ ন‌ই।” তাঁর প্রোফাইলে লেখা রয়েছে কাবার বাইরে চিন্তা করুন যা ইমোজি দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে।

অপ্রত্যাশিত ম্যাডো প্রেমী  অনার কিলিং-এর হাত থেকে যিনি বেঁচে গেছিলেন তিনি বলেছেন, “নারীবাদের জন্য ইসলাম ত্যাগ করেছেন”। তিনি ট্যুইট করে জানিয়েছেন, “একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী হিসেবে আমি একসাথে মুসলিম ও নারীবাদী হতে পারি না। তাই আমি নারীমুক্তির পথকেই বেছে নিলাম। আমি একাকী ট্রাভেল পছন্দ করি, নিজের ইচ্ছামত পোশাক পরতে পারি এর জন্য আমাকে দোষী সাব্যস্ত হতে হয় না এবং সমকামীদের সমানাধিকারকে আমি সর্বতোভাবে সমর্থন করি।”

“আমার মা চেয়েছিলেন হিজাব খুলে ফেলার জন্য এবং তার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য আমার যেন মৃত্যু ঘটে। আমি যেই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম তিনি ঈশ্বরের কাছে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করতে শুরু করেছিলেন আমাকে যেন খুব তাড়াতাড়ি হত্যা করা হয় এবং তিনি দৃঢ়ভাবে এটাও বিশ্বাস করতেন আমার খুব শীঘ্রই মৃত্যু হবে কারণ আল্লাহ তার প্রার্থনা শুনছেন।”

জিনান মুর্তাদ ট্যুইট করে জানিয়েছেন যে তিনি একজন মুসলমান যিনি পরবর্তীতে নাস্তিক হয়েছেন। তিনি আপন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তিনি আরো বলেছেন, “আজ দু বছর হয়ে গেলো আমি এখনও জীবিত এবং সুস্থ আছি কিন্তু এর বেশিরভাগটাই #আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি উদ্যোগের জন্য সম্ভবপর হয়েছে।”

মেরেম, যিনি উত্তর আমেরিকার প্রাক্তন মুসলিম সংস্থার প্রচারের জন্য ভিডিও রেকর্ড করেছিলেন তার মতে  ইসলাম ত্যাগের সর্বোত্তম অংশটি হলো তিনি আর প্রার্থনা বা  উপবাস করেন না। তিনি বলেন আমি একটি বিষাক্ত অবমাননাকর ও পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এসেছি। তিনি আরোও বলেছেন, “কেউ আমাকে জোর করে কিছু পরতে বা কিছু করতে বা কোন কিছু অনুভব করতে বাধ্য করতে পারে না। এমন কিছুই হতে পারে না যা আমি নই।”

জারা কেয়া একজন তানজিনিয়া বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান তার কুকুরের সঙ্গে একটি ছবি টুইট করেছেন।  কারণস্বরূপ তিনি বলেছেন, “আমি আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি তার কারণ হলো কুকুরছানাদের স্পর্শ করতে গেলে এখন আর মনে হয়না এটা করা উচিত নয় কারণ তারা অস্পৃশ্য।” একজন প্রাক্তন মুসলিম হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই তিনি টুইটারে আপত্তি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন কিন্তু তিনি একেবারের জন্য ভেঙে পড়েননি।

তিনি টুইট করে জানান, “আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ইনবক্সে প্রায় তিরিশটা মতন মেসেজ এসেছে যেখানে মানুষজন আমার মৃত্যু কামনা করেছে কেউবা নরকের জঘন্য কীট বলেছে কেউ আবার জাহান্নামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন অথবা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে।” তিনি  যেসব হুমকি পাচ্ছেন তার প্রমাণস্বরূপ কিছু স্ক্রিনশট পোস্ট করেছেন।

বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি প্রচারকার্য এগিয়ে চলেছে, উত্তর আমেরিকার প্রাক্তন মুসলিম সংস্থার কার্যনির্বাহী সভাপতি সারাহ হায়দার জানিয়েছেন, “আমি বেশ বিস্মিত‌ই হয়েছি যখন অনেক ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তি আমাদের বিলবোর্ড এবং আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি ট্রেন্ডের পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়েছেন, “হায় ঈশ্বর!এদের অন্তিম সময় আগত। কিন্তু আমার কাছে সুসংবাদ আছে। এটা কোন অন্তিম সময় নয়। এটা শুধুমাত্র একটা সময়ের সমাপ্তি– ধর্মীয় সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহার ও অত্যাচারের সমাপ্তির সময়।”

উত্তর আমেরিকার প্রাক্তন মুসলিম সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মহাম্মদ সায়েদ টুইট করে বলেছেন যদি প্রাক্তন মুসলমানরা তাদের উপর ঘটে যাওয়া মানসিক নিপীড়ন বারোটির‌ও বেশি দেশে আইনত বৈধ হত্যা,  তাদের বন্দিদশা ও অত্যাচারের ব্যপারে মুখ খোলে বা তাদের যে মারাত্মক ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে হয়েছে শুধুমাত্র ইসলামের কারণে সেই কথা বলে তবে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন, আয়নায় নিজেকে দেখে সহ্য করতে পারবেন না লজ্জায় ঘৃণায় মুখ নামিয়ে নেবেন।

এটা শুধুমাত্র মহিলারা নয় যারা এ ব্যাপারে মুখ খুলছে এবং বেরিয়ে আসছে, মুসলিম পুরুষরাও দলে দলে একই কাজ করছে।

জন্মসূত্রে একজন আহমদী  মুসলমান সোহেল আহমেদ জানিয়েছেন “ইসলাম ত্যাগের সর্বোৎকৃষ্ট অংশ হলো কুরআনের আয়াতকে রক্ষা করার আর কোন দায় থাকে না যেখানে পুরুষ ও নারীর বৈষম্য স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।”

আলী মালিক,  এখন একজন নাস্তিক, ট্যুইট করে জানিয়েছেন “আল্লাহ ছাড়াই চমৎকার আছি কারণ এটা আমাকে অনেকটা স্বাধীন, মানবিক, বিনম্র ও হৃদয়বান করে তুলেছে।”

উত্তর আমেরিকার প্রাক্তন মুসলিম সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত একটি ভিডিও শ্যুটে  আবদুল্লাহ সমীর  বলেছেন, “ইসলাম ত্যাগের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আলিরেজা আজামি তার মাঝে আঙ্গুল দেখিয়ে হ্যাশট্যাগ দিয়ে একটি ফটো পোস্ট করেছেন।”

এই মতবিরোধকে  সমর্থন করে পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান এবং “দ্য এথেয়িস্ট মুসলিম”-র লেখক আলী. এ. রিজভী বলেছেন মুসলমানরা যুক্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুক্ত নয়। তিনি টুইট করে বলেছেন “আমরা বীতশ্রদ্ধ ক্যাথলিক, ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদী এবং প্রাক্তন মরমোনদের পাশ্চাত্য সমাজে গ্রহণ করেছি। এখন উপযুক্ত সময় এসেছে প্রাক্তন মুসলমানদের সমাজে স্বাভাবিক বলে মেনে নেবার।”

ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বে ধর্মে অবিশ্বাসীদের প্রতি কোনরূপ দয়ামায়া দেখানো হয়না। কাফেরদের প্রতি তারা চরম শত্রুতা প্রদর্শন করে থাকে। মুমিনদের অবশ্যই তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত এবং যদি তারা সম্পর্ক রাখতে চায় তবে প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তাদের ক্ষেত্রে সম্মান প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। তাদের সম্মান প্রদর্শন করে কোন কথা বলার অধিকার পর্যন্ত দেয়া হয় না। এমনকি তাদের মৃত্যুতেও সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। তাদের জন্য দোয়া করাও হারাম। মনে করা হয় তাদের প্রার্থনা গৃহে শয়তানের বসবাস। তাদের উৎসব-অনুষ্ঠান‌ও হারাম। তারা শারীরিকভাবে ঘৃণ্য এবং অবিশ্বাসযোগ্য।

আশ্চর্যের কিছুই নেই যখন একজন মুমিন ইসলাম ত্যাগ করে এবং নাস্তিক হয়ে ওঠে তখন সেটা এই ধর্মে‌ গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। এজন্যই ধর্ম ত্যাগের শাস্তি মৃত্যু অপেক্ষা কম নয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রাক্তন মুসলিম যদি প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসে তাদের পূর্ব ধর্মের সমস্যাযুক্ত দিকগুলির বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলার জন্য সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে তাদের মতবিরোধটি  কেবলমাত্র কঠোরভাবে রক্ষা করা হবে তাই নয় সেটার প্রচারও করা হবে। এনারা মানবতার জন্য দুর্দান্ত কাজ করছেন। সমালোচনা এবং মতানৈক্য ছাড়া কবেই বা কোন সমাজ সংশোধন ঘটেছে?

অরিহন্ত পাওয়ারিয়ার মূল প্রবন্ধটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন দীপান্বিতা।