বাঙালীদের মধ্যে, যারা রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের “কমিউনিস্ট-বিরোধী” এবং “বিজেপি-আরএসএস” সমর্থক বলে দাবি করে , তাদের মনের মধ্যে রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতির সম্বন্ধে কিছু ভুল ধারণা আছে। ভুল ধারণা বিশেষ করে যাদের কে নিয়ে, তারা হচ্ছেন চল্লিশের দশকের পর কংগ্রেস দলের ভিতরে একটি ধারা বা গোষ্ঠী, যাদের গাঁধীবাদী বলা হত । প্রচলিত ধারণা এই যে 1940 এর পরেও (মানে সুভাষচন্দ্র বসুকে দল থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর) কংগ্রেস দলের মধ্যে প্রচুর “ভাল” নেতা ও গোষ্ঠী বেঁচে ছিল, যাঁদের নেতৃত্ব দিতেন সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল। এই গোষ্ঠীর নেতা (দেশের স্বাধীনতার পর) পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন বিধান রায় ও অতুল্য ঘোষ, যাঁদের “হুগলী-গ্রুপ” বলা হত । অনেক মানুষের ভুল ধারণা এই যে বিধান রায়–প্রফুল্লচন্দ্র সেন–অতুল্য ঘোষ–অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এই হুগলী গ্রুপ/গাঁধীবাদীরা 1947 থেকে 1967 এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকার সময় রাজ্যের অনেক উন্নতি করেন, এবং জহরলাল নেহরু এবং কমিউনিস্টরা একাই সমস্ত কুকীর্তি করে ভারতবর্ষকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দেয় ।
সত্যি কথা হচ্ছে যে কংগ্রেস দলের এই গান্ধীবাদী নেতারা ছিলেন নেহরুর থেকেও অধিক হিন্দু-বিরোধী, এবং নেহরু-গাঁধীরকৃত সমস্ত কুকর্মের সমর্থনকারী। সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে সরিয়ে দেওয়াকে প্যাটেল ও বিধান রায় দুজনেই সমর্থন করেন। তারপর দেশভাগের সময় এই নেতারা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তা অবিশ্বাস্য । দেশ ও বঙ্গের বিভাজন নিয়ে প্রথমে কংগ্রেস নেতৃত্ব হিন্দু মহাসভার (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা) সাথে একমত হয় যে তারা বঙ্গের 55 শতাংশ জমি ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য দাবি করবে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অবস্থান তারা বদলে ফেলে। এ কারণে প্রচুর হিন্দু-বহুল এলাকা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে চলে যায় । খুলনা, দিনাজপুরের পূর্বের অংশ , অর্ধেক ফরিদপুর, বরিশালের ও যশোর জেলার সামান্য অংশ এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিলেট কেও এই ভাবেই পাকিস্তানের কাছে সমর্পণ করে দেওয়া হয়। এর “কৃতিত্ব” বর্তাবে কংগ্রেসের উপর। কিছু কংগ্রেস নেতা সমগ্র নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর পাকিস্তানের হস্তে সমর্পণ করতে উন্মুখ ছিলেন । কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই সমস্ত ষড়যন্ত্র কে “হুগলী-গ্রুপ” সমর্থন করে। এদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, প্রদেশ কংগ্রেসে ও রাজ্যে ক্ষমতা দখল। পূর্ববঙ্গের যেই সমস্ত কংগ্রেস নেতারা এই নীতির বিরোধিতা করেন তাঁদের কংগ্রেসের ভিতর কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। হুগলী-গ্রুপের সুবিধাও ছিল, অবাঙালী শিল্পপতি ও বড়বাজারের ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে প্রদেশ কংগ্রেসের পুঁজি এদের হাতে ছিল। তার সাথে ছিল গাঁধী–প্যাটেলের ছত্রছায়া ও সমর্থন ।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর কংগ্রেস নেতারা যা করেছিল তা আরো লজ্জাজনক।1947 থেকে 1950 এর মধ্যে লক্ষ–লক্ষ হিন্দু পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসে । পাকিস্তানে ভয়াবহ দাঙ্গায় মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে, নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই ভারতে শরণার্থী হয়ে আসা তাদের। হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রায় 70 শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে এসে শরণ নেয়। সেই সময়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ও প্রদেশের নেতৃত্ব এই উদ্বাস্তুদের সাহায্য না করে, তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যখন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ কিছু পূর্ববঙ্গের হিন্দুকে সরকারী চাকরি দেন তখন এই হুগলী-গ্রুপের নেতারা তার প্রতিবাদ করে। অতুল্য ঘোষ, অজয় মুখার্জী , প্রফুল্লচন্দ্র সেন কিছু মুসলিম নেতাদের সাথে হাত মিলিয়ে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। দাবি তাদের একটাই যে পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা ভিনদেশী, তাদের ফেরত পাঠানো হোক। এই সমস্ত কংগ্রেস নেতারা এমনও দাবি করে যে হিন্দু উদ্বাস্তুরা নাকে মনে প্রাণে পাকিস্তান প্রেমী, ভারত–পাক যুদ্ধ হলে তারা পাকিস্তান কে সমর্থন করবে। এই সবের উদ্দেশ্য একটাই, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। এই সমস্ত কুকর্ম সংগঠিত হয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ নিয়ে, যাতে হিন্দু বাঙালীরা সম্মিলিত না হতে পারে। 1948 সালের শুরুতে গান্ধী–নেহরুর নির্দেশে প্রফুল্ল ঘোষকে সরিয়ে বিধান রায়কে মুখ্যমন্ত্রী বানানো হয়।
কংগ্রেস সরকার পাঞ্জাবী (হিন্দু ও শিখ) ও সিন্ধি হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশ শরণার্থীদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। পাঞ্জাবের 95 শতাংশ মুসলমানকে বলপ্রয়োগ করে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাদের ফেলে যাওয়া জমি জাট–শিখ কৃষক দের হাতে তুলে দেওয়া হয়। শহুরে হিন্দু ও শিখদের জন্য নতুন আবাসন বানানো হয়, যদিও অনেকক্ষেত্রে উদ্বাস্তু দলিতরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু বাঙালী উদ্বাস্তুদের জন্য সেই ভাবে কোনো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি, যাতে তারা আবার পূর্ব-পাকিস্তান ফেরত চলে যেতে বাধ্য হয়ে। যখন 1950 সালে নেহরু–লিয়াকত চুক্তি হয়ে তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং অসংখ্য বাঙালী তার বিরোধিতা করে। (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এই প্রসঙ্গেই নেহরুর মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেন) কিন্তু প্যাটেল–রাজাগোপালাচারি সহ কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতারা নেহরুর সমর্থন করে। হুগলী গ্রুপের নেতারাও নেহরু-লিয়াকাত চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। নেহরু-লিয়াকত চুক্তির আসল উদ্দেশ্য ছিল, উদ্বাস্তু বাঙালী হিন্দু দের সুরক্ষার দায়িত্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। যখন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাক মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে আসেন, তাঁর সাথে লক্ষাধিক হিন্দু ভারতে আসে। তারা যাতে ভারতে না আসতে পারে তার জন্য কংগ্রেস সরকার পাকিস্তান সীমন্তে পাহারার ব্যবস্থা করে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং ফরওয়র্ড ব্লক–আরএসপির মত বামপন্থীদলগুলি যখন প্রস্তাব দেয়ে 1950 সালে যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পাকিস্তান পাঠিয়ে, পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে এনে পুনর্বাসন করা হক, সেই প্রস্তাব ও প্যাটেল-নেহরু জুটি অমান্য করে।বিধান রায়ের নেতৃত্বে হুগলী গ্রুপ/গান্ধীবাদী’রা নেহরু–প্যাটেলের নির্ণয়কে সমর্থন করে। প্যাটেল এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা কংগ্রেস কর্মী (যারা সর্বস্ব হারিয়ে মুসলিমদের হাতে আক্রান্তহয়ে কোনো রকমে নিজেদের পরিবারের প্রাণ বাঁচিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসে) দের উপদেশ (নির্দেশ ?) দেন যে তারা যেন পূর্ব-পাকিস্তানে ফেরত গিয়ে সেখান কার হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য পাক–সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। 1950 সালের পর কংগ্রেস সরকার লক্ষাধিক বাঙালী হিন্দু কে পাকিস্তান ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এবং লক্ষাধিক বাংলাভাষী মুসলমান, যারা দেশ ভাগের পর পাকিস্তান চলে যায়, তাদের ফেরত ফেরত নিয়ে আসা হয়। প্রচুর শরণার্থীদের বিজনৌর, আন্দামান ও দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে। কংগ্রেসের এই সমস্ত নীতির জন্যই লক্ষ–লক্ষ হিন্দুকে পূর্ব-পাকিস্তান, ও 1971 এর পরবর্তীতে বাংলাদেশে থেকে যেতে হয়, এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে বিভিন্ন সময় তারা হিন্দু বিরোধী সন্ত্রাসে আক্রান্ত হয়।
এই হিন্দু বাঙালী উদ্বাস্তুরা কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতার পর কংগ্রেস-বিরোধী হয়ে যায এবং 1951-52 এর নির্বাচনে ভারতীয় জন সঙ্ঘ ও বামপন্থী দলগুলোকে সমর্থন করে , তার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যুর (হত্যা ?) পর কংগ্রেস-বিরোধী বামপন্থী রাজনীতি তে সক্রিয় হয়ে যায়। সেই যুগের (1967 সালের আগের) বাঙালী বামপন্থা কে এক ধরনের বাঙালী হিন্দু জাতীয়তাবাদ বললে ভুল হবে না । কংগ্রেসের অবশ্য নীতি পাল্টায়নি। 1950-60′র দশকে যখনই পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দুরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করত, তখনই কংগ্রেস নেতারা তাদের উপর সন্ত্রাস চালানোর, রাষ্ট্র বিরোধী হওয়ার এবং অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগ করত।
এই হল সর্দার প্যাটেল, কংগ্রেসের তথাকথিত দক্ষিণপন্থী/গান্ধীবাদী, পশ্চিমবঙ্গ কংরেসের হুগলী গ্রুপের কথা। এবার দুটো প্রশ্ন – প্রথম কংগ্রেসের এই রাজনীতি কি পশ্চিবঙ্গের স্থানীয় হিন্দুরা কি মেনে নিয়েছিল ? উত্তর হলঃ না, একদমই না। 1951-52 থেকে 1977′এর সময়টা যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব যে হুগলী গ্রুপের গড়ে ( মেদিনীপুর, হাওরা, হুগলী জেলা) কংগ্রেস বিরোধী দল গুল প্রত্যেক নির্বাচনে তুলনামূলক ভাল ফল করে। 1947 এর সময় কংগ্রেসের সবথেকে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল মেদিনীপুর। অন্য রাজ্যের তুলনায় এখানে তাদের সংগঠন সব থেকে শক্তিশালী ছিল।কিন্তু 1950 এর দশক থেকেই মেদিনীপুর কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে যায়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন – বিজেপী–আরএসএস সমর্থকরা কেন এই প্যাটেল, রাজাগোপালাচারি, বিধান রায় ইত্যাদি দের নিয়ে এত মাতামাতি করে ?
তার করণ 1953 তে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যুর পর জনসঙ্ঘ দলের নেতৃত্ব আরএসএস নেতাদের কাছে চলে যায়, এবং তাদের কর্মসূচি ও নীতি পালটে যায়। তার সাথে উত্তর–পশ্চিম ভারতের হিন্দু মহাসভা , রাম রাজ্য পরিষদ, স্বতন্ত্র পার্টি ও কংগ্রেসের গান্ধীবাদী/তথাকথিত দক্ষিণপন্থী সিন্ডিকেটের আর জন সঙ্ঘের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। 1969 সালের কংগ্রেসের বিভাজনের পর সিন্ডিকেটের জনসঙ্ঘর সাথে মহা–জোট হয়ে ইন্দিরার বিরুদ্ধে। 1977 সালে এই দলগুলোএক সাথে মিশে গিয়ে জনতা পার্টি তৈরি হয়। 1980 সালে জনতা পার্টি ভেঙে ভারতীয় জনতা পার্টি তৈরি হয়, তখন সিন্ডিকেটের অনেক কর্মী বিজেপিতে যোগ দেয়। তখনকার কংগ্রেস ও এখনকার বিজেপির মধ্যে সেই জন্য তফাত নেই । তাই এনআরসি করে অসমের বাঙালি হিন্দু দের বিদেশী ঘোষণা করে দেওয়ার নীতির সাথে 1940-50′র যুগের কংগ্রেস নীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
[কংগ্রেসের সম্বন্ধে যা তথ্য এখানে দেওয়া হয়েছে তা সমস্ত বিভিন্ন বই , পুরনো সংবাদ মাধ্যমের আর্কাইভ, ম্যাগাজিন , জার্নালে আছে যা ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। জয়া চ্যাটার্জী, পার্থ ঘোষের বইএবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আর্কাইভ “নেট” এ খুব সহজেই পাওয়া যাবে]