পানিপথের চতুর্থ যুদ্ধ

0
4664

পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ‍্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (যদিও শোনা যায় বর্তমানে উনি শুধুই ‘মমতা’ নামে পরিচিত হতেই আগ্রহী) ভারতে এক নয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আপন সাংবিধানিক পদমর্যাদা অগ্রাহ্য করেই তিনি এই ডাক দিয়েছেন। কার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন? ভারতের রাজধানী দিল্লীতে সংখ্যাধিক্য জনগণের সমর্থনপ্রাপ্ত, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে অধিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধ!! যা কিছুক্ষণ আগেও কল্পনার বাইরে ছিল তা আজ এক কঠোর বাস্তব রূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে, তাঁর এই যুদ্ধপ্রিয়তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ভারতের সভ‍্যতার সংগ্রাম যাকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পানিপথের চতুর্থ যুদ্ধ – ২০১৯।

ভারতের বহুত্ববাদী সভ‍্যতার উপর বর্বর আক্রমণ নতুন কিছু ঘটনা নয়। কিন্তু ভারতের সভ‍্যতার রক্ষকরা প্রতিরোধ করেই চলেছেন গত কয়েক শতাব্দী ধরে। এই প্রতিরোধ মূর্ত হয়েছে পানিপথের যুদ্ধগুলিতে। ভারতপন্থী শক্তিরা ভারত বিখণ্ডনকারী (Breaking India Forces) শক্তির বিরুদ্ধে।

ভারতপন্থী শক্তিরা রাণা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরকে আহ্বান করেছিলেন বর্বর শক্তির প্রতিভূ ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করতে। কিন্তু বাবর যুদ্ধে জিতে ভারতপন্থী শক্তির বিরুদ্ধেই আপন শক্তি প্রয়োগ করলেন। অযোধ্যায় রামমন্দির ধ্বংসের মাধ্যমে তাঁর ভারত বিরোধী মতাদর্শ প্রকট করলেন। আপন ভুল বুঝতে পেরে সংগ্রাম সিংহ বাবরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ওঠালেন। এবং খানুয়ার যুদ্ধে হেরে ব‍্যর্থ হলেন।

এক কথায়, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ তাই ছিল ভারতপন্থী শক্তির কাছে নিদারুণ হতাশাব্যঞ্জক।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ভারতপন্থী শক্তিরা পুনরায় ভারতকে রক্ষার প্রচেষ্টা করল। এবার ভারতপন্থী শক্তির নেতৃত্ব করলেন হিমু বা হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য। তিনি সুকৌশলে পাঠানদেন নিজের দলে সামিল করে নিলেন। দিল্লী তিনি প্রাথমিক যুদ্ধে জয় করলেন।

ভারত বিখণ্ডনকারী শক্তির পক্ষে সওয়ার ছিলেন বৈরাম খাঁ। বাদশাহ হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তিনি মুঘল বাহিনীর নেতৃত্ব করছিলেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সামরিক শক্তিতে হিমু এগিয়ে থাকলেও বৈরাম খাঁ পয়গম্বর মুহম্মদের (সাঃ) মতই জানতেন, “War is deceit.” (আল বুখারী, 3029; মুসলিম, 58). তাই বৈরাম খাঁ তাঁর শক্তি নিয়োগ করলেন হস্তীপৃষ্ঠে আরূঢ় হিমুকে হত্যা করতে। বৈরামের চাল সফল হল। হস্তী হতে পতিত হিমুর শিরশ্ছেদ করা হল।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ভারতপন্থী শক্তির হার হতাশাব্যঞ্জক কিন্তু পানিপথের প্রথম যুদ্ধের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মর্মন্তুদ। কারণ হিমু আরও কিছু সময় আততায়ীদের থেকে বাঁচতে পারলে তাঁর সৈন্য জয়লাভ করতই। হয়তো ভারতপন্থী শক্তির এই মাহাত্ম্য অনুধাবন করে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত আকবর বাদশাহ ভারতের বহুত্বকে বরণ করেছিলেন।

আরংজীবের আমলে ভারতকে ধ্বংস করার প্রয়াস আবার প্রবল হত। আবির্ভাব হল শিবাজীর। কবিগুরুর ভাষায়, শিবাজী সংকল্প নিলেন এক ধর্মরাজ‍্যপাশে খণ্ড ছিন্ন ভারতকে বাঁধবার। শিবাজীর আন্দোলনের উত্তরসূরী নানাসাহেব পেশোয়ার আমলে ভারতপন্থী শক্তিরা সেনাপতি রঘুনাথ রাওয়ের নেতৃত্বে লাহোর এবং পেশোয়ার ১৭৫৮ সালে জয় করেন। আটকের দুর্গে বহু শতাব্দীর পরে গৈরিক পতাকা উড়তে থাকে।

ভারত বিখণ্ডনকারী শক্তিরা আহম্মদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে প্রত‍্যাঘাতে তৈরী হয়।

পানিপথের সামনে দুই বাহিনী মাসের পর মাস মুখোমুখি শিবির বিছিয়ে থাকে (বিস্তারিত দেখুন শ্রী উদয় কুলকার্নির Solstice at Panipat)। যুদ্ধ শুরু হয় মকর সংক্রান্তির দিন ১৭৬১ সালে। ভারতপন্থী শক্তিরাই জিতছিল। মূল মারাঠী অশ্বারোহী বাহিনী হুজুরৎ দুপুর নাগাদ আবদালির সৈন্যবাহিনীকে পরাস্ত করার দোরগোড়ায় খাড়া ছিল। কিন্তু এবার আবদালি তাঁর পলায়মান সৈন্যদের জড়ো করে শেষ আঘাত দেন। বিকেল নাগাদ মারাঠারা পরাজয় বরণ করে। সেনাপতি সদাশিব রাও ভাউ এবং পেশোয়া পুত্র বিশ্বাস রাও বীরের মৃত্যু বরণ করেন।

এবারও হার। কিন্তু একচুলের জন্য। আবদালি এক মাসের মধ্যে ভারত ছেড়ে পালাতে বাধ‍্য হন। ব‍্রিটিশরা ভারত দখল করেন।

ভারত পন্থী শক্তিরা আবার নতুন ভাবে সংহত হতে থাকেন। এবার কেন্দ্র বাংলা। বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-শ‍্যামাপ্রসাদের চিন্তায় দীক্ষিত ভারতপন্থী শক্তিরা কিন্তু ব্রিটিশ ছেড়ে যাবার পর ভারতকে সঠিক পথে চালাবার সুযোগ পেলেন না। “By culture Muslim, by education British and Hindu by an accident of birth” নেহেরু এবং তাঁর বংশধরদের কবলে পড়ে ভারতবর্ষ। মাঝে মধ্যে লালবাহাদুর শাস্ত্রী, নরসিমা রাও বা অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধান মন্ত্রী হলেও ভারতের দখল নিতে পারেন নি।

পরিস্থিতি পালটে গেল ২০১৪ তে। মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেন। এই শক্তিশালী নেতাকে দেখে ভারত বিখণ্ডনকারী শক্তি ভীত হয়েছে। তারা পাঁচ বছর ধরে বশম্বাদী সাংবাদিকদের দিয়ে “অসহিষ্ণুতা”, “রাফায়েল” আদি মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে। তাতে জিততে না পেরে তারা আজ মরিয়া। কারণ তারা জানে শ্রীমোদি ক্ষমতায় ফিরলে ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে বলা কানহাইয়া আর উমর খলিদ বিষবৃক্ষের বীজ বপন করতে পারবে না, মাওবাদীদের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না, চীন পাকিস্তান ভারতকে চোখ রাঙাতে পারবে না, দরিদ্র মধ‍্যবিত্তদের ক্ষমতায়ন রোখা যাবে না, দুর্নীতি বিদায় নেবে।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছিল এক ঐতিহাসিক পালাবদল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের গণ-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসীন হলেন মমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার ফিরে আসেন ক্ষমতায় তাঁরা – মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল যে তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবী, প্রত্যাশার সুরাহা হবে। মুছে যাবে গ্লানি ও গত প্রায় ৪ দশকের জরা। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক দুর্নীতি, তছরুপ, সংখ্যালঘু তোষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় হাহাকার, অর্থনৈতিক স্থবিরতা বঙ্গমাতার যন্ত্রণাই বৃদ্ধি করেছে কেবল। বর্তমানে উৎসবে শ্রেষ্ঠতম আর অন্যান্য সবকিছুতেই নিকৃষ্টতম পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ হয়ে উঠেছে এক সম্পূর্ণ ব্যর্থ রাজ্যের সার্থক প্রতিমূর্তি। 

বাকি ভারতের সমৃদ্ধির সাথে পশ্চিমবঙ্গের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিন্তু মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সামান্যতম ভ্রুক্ষেপও দেখা যায় না। পার্শ্ব শিক্ষক নিজের ন্যায্য পাওনার জন্য রাজপথে লড়াইয়ের ময়দানে বারংবার এসে দাঁড়াচ্ছেন, আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজ্য সরকারী কমর্চারীরা তাঁদের ডিএ আদায় করছেন, বঞ্চনা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র অথচ বিগত ৬০ র দশকের প্রথমার্ধেও পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পোন্নত রাজ্য হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী যখন আপ্রাণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভারতের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে অঙ্গীকারবদ্ধ তখন শোনা যায় পশ্চিমবঙ্গে নাকি কেন্দ্রীয় সরকার সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন করছে!! সাম্প্রতিক গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘‘বিদেশ, অর্থ এবং প্রতিরক্ষা দফতরই কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা উচিত।’’ সমস্যা হচ্ছে, এই কথা শেষবারের মতো শোনা গিয়েছিল ডাইরেক্ট একশন ডের নায়ক হুসেন শাহিদ সুরাবর্দির কণ্ঠে। কোথাও যেন সামগ্রিক পরিস্থিতি, অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে দেশপ্রেমিকদের কাছে। 

ভারতের এই সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে ভারত বিখণ্ডনকারী শক্তিরা সতত সক্রিয়। তাদের মুখপাত্র, লজ্জার সঙ্গে বলছি শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ-নেতাজীর বাংলা আর ভুল করবে না, এই প্রত‍্যয় আমার আছে।