বঙ্গজ বামপন্থা – এক দুর্বোধ্য পরিভাষা

সেটি এক অতি অস্থির সময় ছিল। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত, ধর্মীয় বিভাজন দ্বারা সৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে।  মন্বন্তর, দাঙ্গাজনিত রক্তস্রোত, জলস্রোতের মতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুর ঢল, আর্থিক অস্থিরতার প্রকোপ রাজ্যে তখন চরমসীমায়। বারংবার বলা সত্ত্বেও, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের শার্দুলসম জনবিনিময়ের দাবী প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর বধির কর্ণে প্রবেশ করতে বড়ই অক্ষম প্রমাণিত হচ্ছে। ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত পাঞ্জাবের প্রতিই দিল্লীস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের অপার স্নেহবর্ষণ, পশ্চিমবঙ্গ সতীনের সন্তানের ন্যায় বঞ্চিত। সেই যুগে ওঁদের দেখা যেত রাজপথে বা কানাগলিতে। স্লোগান থাকতো কিন্তু অত দৃপ্তকণ্ঠে নয় বরঞ্চ কিছুটা যেন নববধূর ন্যায় আড়ষ্ট। তাঁরা বলতে চান কিন্তু বলতে পারেন না, কথা কইতে চান কিন্তু কইতে পারেন না। মধ্যিখানে বৈপ্লবিক সংগ্রামের চিন্তা আর কিঞ্চিৎ কর্মহেতু ওঁরা নিষিদ্ধ হলেন। রাজদ্রোহীতার দোষ থেকে মুক্ত হয়ে কারাগারের বাইরে এসে তাঁরা দেখেন জগৎ বেশ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে – আরও।

‘৫০ র পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু গণহত্যার দরুন এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের এবঙ্গে প্রবেশ, প্রশাসন এবার আর কাঁপলোনা, প্রায় ভেঙে পড়ার দুয়ারে এসে উপস্থিত হল। উপায় না দেখে শুরু হল দুর্বার উদ্বাস্তু আন্দোলন হিন্দু বাঙ্গালীর স্বার্থে, তাঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নির্দিষ্ট ব্যবস্থার লক্ষ্যে। নিখিল বঙ্গ বাস্তুহারা কর্মপরিষদ স্থাপিত হল কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা-আরএসপি র যৌথ নেতৃত্বের দ্বারা।  তাঁদের অর্থাৎ মস্কোর প্রেমে উদ্ভাসিত কমিউনিস্টদেরও প্রচেষ্টা আরম্ভ হল, কিছুটা স্তিমিতভাবে।  কিন্তু ‘৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের অকাল মৃত্যু তাঁদের সামনে সুযোগের এক নব দুয়ার উন্মোচিত করল। বুদ্ধিমানের ন্যায় তাতে সাড়া দিয়ে এঁরা দিনেদিনে স্ফীত হয়ে উঠলেন ক্রমশ। ক্রমে বঙ্গসমাজে স্থাপিত হল সামাজিক অস্থিরতার শ্রেষ্ঠতম যুগ। নিকৃষ্টতমও বলতে পারেন। আপত্তির কিছু নেই।

প্রশ্ন – এঁরা কারা? পাঠককে আর উৎকণ্ঠায় না রেখে এঁদের পরিচয় প্রকাশ করা উচিত অবিলম্বে – এঁরা হলেন বামপন্থী; আপনি যদি আরো বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছুক হন সেইক্ষেত্রে উত্তরটি হবে – এঁরা হলেন শ্রেষ্ঠতম, ভেজালবিহীন বিশুদ্ধ বামপন্থী অর্থাৎ কমিউনিস্ট।  যাঁরা সর্বক্ষত্রেই চপল, মানবমুক্তির লক্ষ্যে উন্মত্ত, অর্থনীতি আর সামাজিক বিশ্লেষণে সবাইকে পরাস্ত করতে সদা তৎপর, নিজ দেশের পরিবর্তে বিশ্বমানবতা সম্পর্কে বড়ই উদগ্রীব, ধর্মবিশ্বাসের শ্রাদ্ধ সমেত এঁরা সুদূরের পিয়াসী। বিপ্লবই এঁদের একমাত্র লক্ষ্য – অবশ্য তার বিভিন্নতা আছে – বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক, নয়া গণতান্ত্রিক, জনগণতান্ত্রিক। আপনি আবার তন্ত্রসাধনার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না, ভদ্র। তাহলেই ভারী বিপদ। অবশ্য সেই তন্ত্রের কোন ছায়া যে এঁদের মধ্যে নেই সেটিও জোর সহকারে বলা যায়না। কারণ ইতিহাস সাক্ষী, বিপ্লবের শ্রেষ্ঠতা, তার কর্মপদ্ধতিরও শ্রেষ্ঠতা প্রমাণের জন্য এঁদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ, কমরেডের হস্তে কমরেডের রক্ত কোন আশ্চর্য ঘটনা নয়। এখন অবশ্য লাল ঝাণ্ডার প্রাবল্য সমাজে নিতান্তই কম কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলে তাঁরা যে এখনো অজেয় সেটি প্রমাণে এঁরা সুযোধন মানে সেই দুর্যোধনকেই স্মরণ করে বলবেন…বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো সুচাগ্র মেদিনী।

‘৫৩ সালে বামপন্থার উত্থান বঙ্গে; দুর্জনে অবশ্য বলে, সেই এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আস্ফালন ও সংগ্রাম সমেত বাম আন্দোলন নাকি শ্যামাপ্রসাদের অকাল মৃত্যু (হত্যা?) জনিত জনমনের আবেগটি দমানোর জন্য এবং সেটি নাকি আইবি-সিপিআই র গোপন আঁতাতের ফল।  নইলে নেহরুজী বঙ্গে আবার প্রবেশ করতে পারছিলেন না। তা, জমিদার মহল পরিদর্শনে যাবেন না – হয় নাকি? অতএব, গণআন্দোলনের স্ফুরণ এবং সেই শুরু। পরবর্তী বছরগুলির গণআন্দোলন যে অযৌক্তিক তা কোনোমতেই বলা যায় না তবে হিংসায় সেই যে হাত পাকালো বঙ্গসমাজ তা থেকে পরিত্রাণ আর পাওয়া গেলোনা পরবর্তী দশকে, এমনকি এই মুহূর্ত পর্যন্ত যখন এই অভাগা এসব ছাইপাঁশ লিখছে। এটিও অবশ্য চুপিচুপি বলা ভালো, ৫০ র দশকে কলেজ স্ট্রীট অঞ্চল মুখরিত থাকতো অবিভক্ত সিপিআই ও আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে সংঘর্ষে। সবাই বাম, তবে পরের দুইটির সঙ্গে কিঞ্চিৎ জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ জড়িয়ে ছিল। সুভাষচন্দ্রের স্খলন সিপিআই কর্তৃক তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। ‘৬২ সালে হল মহাপ্রলয়। না চীনের ভারত আক্রমণ নয়. সেটি তো সামান্য বিষয়। তাহলে? অবিভক্ত সিপিআই তে ভাঙন, তাও আবার আদর্শজনিত অবস্থাকে কেন্দ্র করে!! এ হয় নাকি! কিন্তু হল যে রাশিয়া কাকা আর চীন মামা কি বলছে তার ওপর কেন্দ্র করে পার্টিতে ভাগাভাগির জোয়ার আসলো। কে কোনদিকে, আবার কে কোনদিকে নয়, কে সকালে কোথায় আর বিকেলে কোথায় – তা ঠাহর করতেই একপক্ষ কেটে গেল। পরে অবশ্য শোনা গেল, এক পক্ষ নাকি সংশোধনবাদী, অপর পক্ষ বিপ্লবী। আবার এক পক্ষ নাকি বিপ্লবী, অন্যপক্ষ নাকি হঠকারী। যাই হোক, দু-পক্ষই সোভিয়েত আর চীনের সোল্লাসে সমর্থন পেয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হল। আচ্ছা, জনগনের কি অবস্থা? আরে মশাই, জনগণ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারাই তো vanguard (নাকি cannon-fodder)..তা এঁরা যে বিপ্লব করবেন ভারতে সে সম্পর্কে কিছু কথা নেই? আহ, বড়ো বাজে বলেন মশাই। এঁরা আন্তর্জাতিক, জাতির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এঁরা মাথা ঘামাবেন!! এঁদের গৃহে পুরাণ উপনিষদের মতো অর্বাচীন বইপত্র থাকেনা। এঁরা রাশিয়ার ছোটগল্প, চীনের উপকথাতেই বেশী স্বচ্ছন্দ। মাঝেমধ্যে ওই রুমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ডের গল্প পড়েন বটে তবে রাশিয়া, চীন চাইই চাই।

এতেই অধৈর্য হয়ে গেলেন? আরে সবেমাত্র ৬০ র দশকের মাঝে এসেছি। ‘৬৬ র খাদ্য আন্দোলন, ‘৬৭ র পালাবদল, কংগ্রেসের দুরছাই, সব মিটিয়ে বামেরা আসীন হলেন সরকারে। এসেই শুরু হল ঘেরাও নীতি। মাশুল সমীকরণ নীতির সহযোগে চাচা নেহেরু যে চিতা সাজিয়েছিলেন বাঙ্গালীর তাতে অগ্নিসংযোগ হল। দুরদুর করে পুঁজির পলায়ন, কিন্তু চিরন্তন “বারো রাজপুত্রর তেরো হাঁড়ি” বামপন্থী রাজনীতির এই সামান্য বিষয়ের ওপর মনোনিবেশ করার সময় নেই। আবার ১৯৬৭ তেই হল আর এক বিপদ। সেই সুদূর নকশালবাড়িতে এক দল কৃষক প্রায় বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তাঁরা আবার সিপিআইএম র কৃষক সভার জঙ্গী সদস্য। কিন্তু সেই একই সিপিআইএম র শীর্ষস্থানীয় নেতা শ্রী জ্যোতি বসু, সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রীর সেটি হল নাপসন্দ। তাঁর হুকুমেই পুলিশ অভিযান, ফলতঃ পুলিশের গুলিতে নয়জন কৃষক রমণী ও একটি শিশুর মৃত্যু ঘটলো ২৫ মে তে। শুরু হল ধুন্ধুমার কান্ড এবং জন্ম নিল বিধ্বংসী নকশালবাড়ি আন্দোলন যা ‘৭২ সাল পর্যন্ত শুধু রক্ত দিয়েই ধৌত করল বঙ্গভূমিকে। সিপিআইএম-নকশাল সঙ্ঘর্ষে ও অন্যান্য বামপন্থী দলের পারস্পরিক হানাহানিতে (শ্রেষ্ঠতা প্রমাণের হেতু) বিদীর্ণ হল জনজীবন। তৎকালীন বঙ্গে এমন কোন পরিবার ছিলোনা যাঁর আত্মীয় বা সুহৃদ এর দ্বারা প্রাণ হারাননি। এক পক্ষ যুবক সজল চোখে যায় শ্মশানে তাঁদের নিহত কমরেডকে দাহ করতে, কিছুক্ষণ পরেই প্রতিপক্ষ আসে তাঁদের কমরেডের দাহর জন্য প্রতিশোধের বাণী উচ্চারণের সাথে। ফল কি হল? বাঙ্গালী হিন্দু জনজাতির একটি প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত প্রজন্মের সর্বনাশ সাধন হল। একই সময়ে  প্রতিবেশী পূর্ব পাকিস্তানে খান সেনাদের হাতে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী হিন্দুর প্রাণনাশ। সেই ক্ষতি এখনো সামাল দেওয়া যায়নি বলেই পন্ডিতদের বিশ্বাস। এতো রক্তপ্রবাহে হল কি? বিপ্লবের পিচ্ছিল পথ পরিষ্করণের জন্য ব্যবহৃত হল রক্ত কিন্তু তা যে কোন বিপ্লবের যজ্ঞাগ্নিতে সমর্পিত হল তা বোঝা গেলোনা।

পরবর্তী ইতিহাস বিশেষ কিছু নয়। ১৯৭৭ সালে চুড়ান্ত জনবিরোধী কংগ্রেসের পাপের দায়ে বামফ্রন্ট আসীন হল পশ্চিমবঙ্গের শাসনের কেন্দ্রে এবং বঙ্গের যেটুকু সর্বনাশ বাকি ছিল তা সম্পন্ন হল সুচারুভাবে। ১৯৫৯ সালে সমগ্র ভারতে, জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবদান ছিল ২৯%, যা ৭০ র দশকে মহা গোলযোগ হেতু নেমেছিল ১০.৪% তে। বামফ্রন্ট আমলে তা ঘোরাফেরা করল ৪% ধারেপাশে।  কারণ তখন বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মণির মতো রক্ষাই একমাত্র কর্তব্য আর বামফ্রন্টের স্থায়িত্ব মানেই জনগণের চিত্তের উন্নতি। বাকি কিছু ভাবার সময় কোথায়? একটি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর আপনারা অপেক্ষা করতে পারবেন না?

নেহেরু সাহেব সমাজতান্ত্রিক নয়, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, ব্যাঙ নয় ব্যাঙাচি, কিন্তু এভাবে রণসজ্জায়সদা সজ্জিত বামফ্রন্ট চলেনা।  বামফ্রন্ট, মুখ্যত সিপিআইএমর শাসনে বাড়ির ডাল কখন গলবে, ঢেঁকিছাটা চাল না সেদ্ধ চাল লাগবে সব খবর পার্টি অফিসে আছে। কেন? আরে এটা কম্যুনিস্ট পার্টির শাসন, কোন শ্রেণিশত্রুর শাসন নয়। ওই মেনিমুখো হিন্দুদের তো নয়ই।  আর কি তার মহিমা!! ১৯৯১ সালে জগৎজুড়ে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান হলেও বামফ্রন্ট রইলো অটল, নিশ্চল যা একমাত্র ভাঙলো এই সেদিনের সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনে। সেই কবে স্তালিন সাহেব বলে গেছেন বেয়াড়া লোকেদের শায়েস্তা করার জন্য প্রয়োজন একমাত্র বেয়োনেটের। তারই কিঞ্চিৎ প্রদর্শনে বামফ্রন্টের ঘটি উল্টালো। অবশ্য, যাঁরা স্থলাভিষিক্ত হলেন তাঁরা হলেন সুপার বামপন্থী – সেই তৃণমূলী অক্ষৌহিনীতে কে নেই? বামাচারী থেকে কামাচারী সবাই। মা-মাটি-মানুষ জিন্দাবাদ আর দিদির কসম খাওয়া প্রত্যেকের জন্য অবারিত দ্বার।

বিপ্লবের কি হল? ও মশাই!! কি জ্বালাতন, আগে লালীরা ফিরুক দেখা যাবে। তখন বিপ্লব হবে তো? এতো রক্ত যে বয়ে গেলো? আচ্ছা, এই কথা বলছেন। সেটির জন্য অবশ্য ওই মান্ধাতার আমলের মার্কস-লেনিন চলবে না। এখন বিপ্লবের অগ্রদূত হল হফম্যান জিন্স, টিশার্ট পড়া একদল নয়া যোদ্ধা যাঁদের সবকিছুই নাপসন্দ। পছন্দ না হলেই তারা টুকরে টুকরে হোঙ্গের স্লোগান দিচ্ছেন। এটি আবার কোন বামপন্থা? জিজ্ঞস করে লাভ নেই। জানতে গেলেই বিপ্লবীরা ফেসবুকে আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এসএস নিয়ে কাটাছেঁড়া করে আপনাকে ঝাঁঝিয়ে দেবে। কি বললেন? বুঝছেন না – দুর্বোধ্য লাগছে!! আরে মশাই, বঙ্গজ বামপন্থা তার চেয়েও দুর্বোধ্য। এর ঘ্রাণ নিতে হয় শুধু…..আহ্হ্হ হ্যাঁচ্চো।