ফৈজ আহমেদ ফৈজের কবিতা ও সিএএ-বিরোধীদের ‘লিবেরাল’ ভণ্ডামি সংক্রান্ত

0
1081

পাকিস্তানি কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ “ওয়া-ইবকা-ওয়াঝ-ও-রাব্বিক” (কোরান ৫৫:২৭ হতে গৃহীত এই আরবি বাক্যটির বাংলা করলে দাঁড়ায় “এক আল্লাহ্‌ ছাড়া বাকি সমস্তই বিনষ্ট হবে”) শীর্ষক একটি উর্দু কবিতা লিখেছিলেন, যা পরবর্তীকালে ঐ কবিতার প্রথম লাইন ‘হম্‌ দেখেঙ্গে’ অনুসারে ‘হম্‌ দেখেঙ্গে’ নামেই অধিক প্রসিদ্ধ হয়। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ডিক্রী জারি ক’রে শাড়ি পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পাকিস্তানের খ্যাতনামা গায়িকা ইকবাল বানো একটি কালো শাড়ি প’রে লাহৌরের এক স্টেডিয়ামে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের সামনে এই কবিতাটি গেয়ে পরিবেশন করেন।

আজকাল ভারতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আগত নিপীড়িত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিষ্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানকারী আইন সিএএ-এর বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের একটি অংশ তথা তথাকথিত লিবেরাল বা উদারপন্থীরা ঐ একই গান গেয়ে অথবা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট, শেয়ার ইত্যাদি ক’রে নিজেদের ‘প্রতিবাদ’ ব্যক্ত করছেন। বিশেষ ক’রে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও জেএনইউ-এর মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের কিয়দংশের লাগাতার বুক-চাপড়ানো এবং ভারতের ইংরেজিভাষী মিডিয়া ও বিদেশী সংবাদমাধ্যমগুলির একপেশে অপপ্রচারের দৌলতে নবীন প্রজন্মের অনেকের কাছে ফৈজের এই গান/কবিতা আওড়ানোর মাধ্যমে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রদর্শনের ব্যাপারটি চলতি শীতের মরসুমে বেশ উপভোগ্য, ‘ফ্যাশনেবল’ বয়ান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে মজার কথা, এঁদের অনেকেই জেনে অথবা না জেনে মনে করছেন এবং বলছেন যে এই গান/কবিতাটি নাকি প্রতিবাদ জানানোর একটি ভীষণ ‘সেকুলার’ মাধ্যম।

ভারততত্ত্ব বিষয়ের গবেষক, উদ্যোগপতি তথা প্রকাশক-সম্পাদক শ্রী সংক্রান্ত সানু ফৈজের এই উর্দু কবিতাটিতে ব্যবহৃত ইসলামী প্রতীক ও শব্দপ্রয়োগগুলির কিঞ্চিৎ হেরফের ঘটিয়ে তার জায়গায় ভারতীয় ধর্ম, দর্শন ও মননের সঙ্গে মানানসই শব্দাবলী বসিয়ে ‘প্রতিবাদ’কারীদের উদ্দেশ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। সে প্রশ্নটি হচ্ছে এইরকম : যদি ইসলামী ধর্মবিশ্বাস, ঈশ্বরতত্ত্ব ও ধর্মগ্রন্থের থেকে গৃহীত ভূরি ভূরি প্রতীক ও শব্দ-সংবলিত গান/কবিতাও ‘সেকুলার’ হয়ে থাকে, আর যদি সে গান/কবিতা গাইবার অথবা আওড়াবার কারণে মুসলিম সমাজ ও তথাকথিত লিবেরালদের ব্যক্ত ‘প্রতিবাদ’-এ আগ্রাসী ধর্মীয় আধিপত্যবাদ, ‘আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, চিরন্তন ও একমাত্র সত্য; বাকি সব ভুল ও সেইসূত্রে নশ্বর’ – এই জাতীয় ধর্মান্ধতার প্রকাশ এবং অপরাপর ধর্মবিশ্বাসীদের মনে আঘাত দেবার মতো গুরুতর দোষ না লেগে থাকে, তাহলে ঐ একই কবিতা/গানের শরীরে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতীক ও শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করলে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিতে ঐ কবিতা/গান আওড়ালে সে কাজ ‘সেকুলারবাদী’দের মতে যথেষ্ট সেকুলার হবে তো? আসুন দেখে নেওয়া যাক বাংলা অনুবাদে ফৈজের মূল কবিতা এবং শ্রী সংক্রান্ত সানু-কৃত তার রূপান্তরিত দশা – এই দুটিকে পাশাপাশি রেখে পড়লে কীরকম দাঁড়ায়। আশা করা যাক যে এই তুলনামূলক পাঠের দ্বারা শ্রী সংক্রান্ত সানু কর্তৃক উত্থাপিত প্রশ্নটির উত্তর পাঠক নিজেই খুঁজে বার করতে পারবেন।

 

ফৈজের মূল উর্দু কবিতা “ওয়া-ইবকা-ওয়াঝ-ও-রাব্বিক”-এর বঙ্গানুবাদ :

আমরা দেখবো

আমরাও নিশ্চয়ই দেখবো

সেই প্রতিশ্রুত দিন –

যার কথা উৎকীর্ণ হয়ে আছে

অনন্তের শিলালিপিতে;

যে দিন অত্যাচারের দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়

পেঁজা তুলোর মতো উড়ে যাবে,

আমাদের মতো শাসিতের পদভারে

ধরণী থর-থর কাঁপবে,

আর শাসকশ্রেণীর মাথার উপর

কড়-কড় রবে বাজ পড়বে,

যেদিন খোদার ভূমি কাবা থেকে

প্রত্যেকটি মূর্তি উপড়ে ফেলা হবে,

যেদিন ঐ পবিত্র ভূমি থেকে একদা বহিষ্কৃত

আমাদের মত খাঁটি লোকেদের

ক্ষমতার মসনদে বসানো হবে,

আর সব তাজ ছুঁড়ে ফেলা হবে,

সব তখ্‌ৎ ভেঙে ফেলা হবে,

শুধু আল্লাহ্‌র নাম ধ্বনিত হবে –

যিনি অদৃশ্য, অথচ অস্তিত্বশীল,

যিনি লক্ষ্যবস্তু, আবার দ্রষ্টাও বটে;

যেদিন ‘অনাল-হক’-এর ধ্বনি উঠবে

যা আমিও এবং তুমিও

আর কায়েম হবে খোদার সৃষ্টির রাজ,

যা আমিও এবং তুমিও।

 

শ্রী সংক্রান্ত সানু-কৃত রূপান্তর “হম্‌ ভী দেখেঙ্গে”-র বঙ্গানুবাদ :   

আমরা দেখবো

যথাবিধি আমরাও একদিন দেখবো

সেই যুগের আগমন, যে যুগ প্রতিশ্রুত;

যে যুগের বর্ণনা বেদ-পুরাণে কীর্তিত,

যখন কলিযুগের দানব সন্ত্রাসীরা

মায়ার মতোই মিলিয়ে যাবে,

আর ধর্মবীরেদের পদভারে যবে

ধরণী থরথর কেঁপে উঠবে,

ঔপনিবেশিকতাবাদীদের মাথায়

বাজ পড়বে কড় কড় রবে;

যখন রামের পুণ্যভূমি থেকে সব

মকবরা উপড়ে ফেলা হবে,

শতাব্দীব্যাপী শোষিত আমরা,

ধর্মকে যারা রক্ষা করেছি –

ফের বসবো সিংহাসনে,

সব তাজ ছুঁড়ে ফেলা হবে

সব তখ্‌ৎ ভেঙে ফেলা হবে

শুধু রামনাম ধ্বনি ধ্বনিত হবে

যিনি নির্গুণ, আবার সগুণও বটে,

যিনি সাধ্য এবং সাধনও বটে,

সকলে বলবে ‘হর হর মহাদেব’

কারণ আমিও শিব, তুমিও শিব

রাজ করবে যত শিবের গণ

বন্দে মাতরম্‌, বন্দে মাতরম্‌

 

[তখ্‌ৎ – বাংলা প্রতিশব্দ ‘সিংহাসন’

তাজ – বাংলা প্রতিশব্দ ‘মুকুট’

ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর মূল উর্দু কবিতা এবং শ্রী সংক্রান্ত সানু-কৃত রূপান্তর – এই দুয়েরই অনুবাদ করেছেন শ্রীজিৎ দত্ত। অনুবাদ দুটির পুরোভাগের ভূমিকাটিও তাঁর লেখা।

তথ্যসূত্র : rekhta.org এবং www.islamicity.org/Quransearch]