আষাঢ় মাসের কৃষিকাজ

আমনধান :

আমনধানের জন্য আষাঢ়ের মাঝামাঝির মধ্যে বীজতলা তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। একবিঘাতে রোয়ার  জন্য ২ কাঠা বীজতলা বানাতে হবে। নীরোগ, পুষ্ট, বাছাই বীজ হলে বীজতলার জন্য ৪ কেজি যথেষ্ট হলেও সাধারণভাবে চাষীরা ১০ কেজি বীজ ব্যবহার করে ফেলেন। বীজতলাগুলির মাপ হতে পারে সাড়ে তিন ফুট চওড়া আর ৬৫ ফুট লম্বা; এরকম চারটি বীজ তলা তৈরি করে প্রতিটিতে এককেজি করে শোধন করা পুষ্ট বাছাই বীজ ফেলতে হবে। বীজতলা তৈরি করতে বীজ লাগানোর পূর্বে ২০ কেজি মতন জৈবসার, ৮ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ২ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ প্রয়োগ করে জমি তৈরি করতে হবে। দেড় লিটার জলে এক কেজি বীজধান ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে তার সঙ্গে দুই গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম মিশিয়ে আরও ১০ ঘন্টা রেখে, তারপর অঙ্কুর বার করার জন্য জাঁক দিতে হবো। দুদিন বাদে অঙ্কুর বের হলে বীজতলায় বীজ ছড়াতে হবে।

গোখাদ্য:

আষাঢ়মাসে তণ্ডুল জাতীয় ঘাস যেমন জোয়ার, ভুট্টা, দীননাথ ঘাস ও কোয়েক্স বীজ বোনা যাবে। জোয়ার লাগানো শুরু হতে পারে জ্যৈষ্ঠমাস থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি; ভুট্টা ফাল্গুনমাস ঘেকে আশ্বিনের প্রথমার্ধ পর্যন্ত; দীননাথ ঘাস জ্যৈষ্ঠমাসের শেষ থেকে ভাদ্রের প্রথম পর্যন্ত; কোয়েক্স ঘাস জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণের প্রথম পর্যন্ত।  এছাড়া বোনা যাবে শিম্বি গোত্রীয় বরবটি আর গাইমুগ। বরবটি বৈশাখের শেষ থেকে আষাঢ়ের প্রথমার্ধ এবং গাইমুগ জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। বহুবর্ষজীবী তণ্ডুল জাতীয় ঘাস হাইব্রিড নেপিয়ার এবং প্যারা ঘাসের কাটিং লাগানো চলবে যথাক্রমে জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের প্রথমার্ধ এবং বৈশাখের শেষ থেকে ভাদ্রের প্রথমার্ধ পর্যন্ত।

চন্দ্রমল্লিকা: 

আষাঢ়মাস চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরির সময়। কাটিং করে এই ফুলের চারা তৈরি করতে হবে। এজন্য নীরোগ, স্বাস্থ্যবান গাছ থেকে ৪-৫ টি গাঁটযুক্ত ডগা কেটে, কর্তৃত অংশের কাছে গাঁট সংলগ্ন পাতা ছেঁটে কাটা অংশে রুটিং হরমোন লাগিয়ে (যেমন রুটেক্স, কাটিং এড, সিরাডেক্স, এরোডেক্স) বালির কেয়ারি তৈরি করে তা ব্লাইটক্সের গোলা জলে (২ গ্রাম/লিটার) ভিজিয়ে রোপণ করতে হবে। দু’ সপ্তাহ বাদে তাতে শিকড় গজাবে, চার সপ্তাহের মধ্যে চারা রেডি হয়ে যাবে। এই চারা মূল জমিতে লাগানোর সময় শ্রাবণ থেকে আশ্বিনের মধ্যে। 

আষাঢ় মাসের একেবারে শেষ থেকে অথবা শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চন্দ্রমল্লিকার জন্য জমি তৈরির জন্য পরিকল্পনা নিন। এজন্য মাটিতে কয়েকবার লাঙ্গল দিয়ে ঘাসমুক্ত করে শেষ চাষের জন্য বিঘাতে ২৫ -৩০ কুইন্টাল গোবর সার, ১০ কেজি নিমখোল, ১০ কেজি সরষের খোল, ২০ কেজি ইউরিয়া, ৮০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট, ২০ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ মিশিয়ে দিতে হবে। জমিটি এরপর কয়েকটি কেয়ারিতে রূপান্তরিত করতে হবে। কেয়ারিগুলি যেন ৩ ফুট চওড়া এবং আধ-ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। দুটি কেয়ারির মাঝে একফুট ছাড় দিতে হবে। খুচরো ফুল পেতে কেয়ারিতে ১.৫ x ১.৫ ফুট দূরত্বে চারা লাগানোর কথা, সে হিসাবে কেয়ারিতে দুটি সারির সুযোগ আছে, কিন্তু কাট-ফ্লাওয়ার লাগাতে হলে তিন বা চার সারিও সম্ভব। 

চন্দ্রমল্লিকার উন্নত জাত: কাট-ফ্লাওয়ারের জন্য পুসা সেন্টিনারি, পুসা অরুণিমা, পুসা তাইচেন কুইন, ইয়োলো জেম, বিগ ভায়োলেট, হোয়াইট জেম ইত্যাদি।  সারা বছর ফুল পেতে অজয়, আনমোল, পুসা আদিত্য, বিধান প্রদ্যোত, বিধান পূর্ণা, বিধান মল্লিকা, বিধান মাধুরি ইত্যাদি।

 কাজুবাদাম:

লাল কাঁকুড়ে মাটি যেমন ঝাড়গ্রাম,  পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ায় এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী বালিয়াড়ি লবণাক্ত মৃত্তিকায় আষাঢ়মাসে কাজু বাদাম চারা লাগানোর অন্যতম উল্লেখযোগ্য সময়। জোড় কলমের চারা লাগাতে হবে যাতে পছন্দমত জাতের পরশাখী বীজের গাছের মাথায় বাড়তে পারে। চারার বয়স হবে ছ’ মাস থেকে এক বছর। এমন চারা পলিথিন প্যাকেটে কিনতে পাওয়া যায়। চারা যখন বসাতে হবে খেয়াল রাখা দরকার পলিথিন প্যাকেট থেকে বের করার সময় চারার মাটি যেন আলগা হয়ে না যায়। গর্তের মাঝখানে চারা বসানোর নিয়ম। জোড় কলমের জোড়টি যেন মাটি থেকে ৫ সেন্টিমিটার উপরে থাকে। গাছ লাগানোর পর একটি খুঁটি বেঁধে দিতে হবে গাছের সঙ্গে। গোড়ার মাটি খানিক উঁচু থাকলে গোড়ায় জল জমার ভয় থাকে না।

এ রাজ্যে কাজুর উন্নত জাতগুলি হল ঝাড়গ্রাম – ১, বি.এল.এ. ৩৯-৪, বিপিপি – ৮, ধানা, কানকা, সুলভ, ধারশ্রী, প্রিয়াঙ্কা, ভেঙ্গুরলা প্রভৃতি।

চারা বসানোর দু’ তিন সপ্তাহ আগে ৬x৬ মিটার দূরে ৬০x৬০x৬০ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত খুঁড়তে হবে। গর্তে ১০ কেজি গোবর সার বা পাতা পচা সার, ২৫০ গ্রাম নিমখোল এবং ২০০ গ্রাম রক ফসফেট আর মাটি দিয়ে গর্তের দুই-তৃতীয়াংশ ভরাট করে দিতে হবে।

পূর্ব বছরগুলিতে লাগানো কাজুবাদাম গাছে আষাঢ়মাসেই সার দেওয়ার সময়। রাসায়নিক সারের অর্ধেক এবং জৈবসারের পুরোটা এই পর্যায়ে দেওয়া হবে। বাকী রাসায়নিক সার পড়বে বর্ষার পর। গাছের চারপাশে গোড়া থেকে খানিক দূরে গর্ত খুঁড়ে গাছ প্রতি প্রায় ১৫ কেজি জৈবসার দিতে হবে। তিন বা ততোধিক বছর বয়সী গাছে ১১০০, ১২৫০ এবং ৪২০ গ্রাম হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট এবং পটাশ দিতে হবে। এক অথবা দু’ বছর বয়সী গাছে এই পরিমাণ রাসায়নিক সারের এক ও দুই তৃতীয়াংশ সার দেওয়া হয়। এই পরিমাণ সার দু-দফায় দিতে হবে — এই সময় এবং বর্ষার পর। 

জারবেরা:

আষাঢ় মাস জারবেরার ক্লাম্প বা কাণ্ডের গোছ বিভাজন করে রোপণ করার সময়। পলি হাউসে বা উন্মুক্ত প্রান্তরে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি রাখতে হবে, সারিতে গাছের দূরত্ব হবে ২৫-৩০ সেন্টিমিটার। প্রতি বর্গমিটারে ৭ থেকে ১০ টি চারা লাগানো যাবে। জারবেরার উন্নত জাতগুলি হল: লাল রঙের রুবি রেড, রেড ইম্পাল্স, ডাস্টি ইত্যাদি ; হলুদ রঙের সুপারনোভা, ইউরেনাস, ফুলমুন, পানামা, নাডজা, ডোনি প্রভৃতি; কমলা রঙের অরেঞ্জ ক্লাসিক, গোলিয়াথ, মারাসল, কোজাক প্রভৃতি; গোলাপি রঙের রোজালিন, সালভাডোর ইত্যাদি ; ক্রীম রঙের ডলমা, স্নো ফ্লেক, উইন্টার কুইন প্রভৃতি; সাদা রঙের হোয়াইট মারিয়া,  ডেলফি; পার্পেল রঙের ট্রেজার; পিঙ্ক রঙের টেরাকুউন, পিঙ্ক এলিগেন্স, ভ্যালেন্টিনা, মারমারা, এসমারা প্রভৃতি।

জারবেরা চাষ করতে আগে জমি শোধন করে নিতে হবে। মাটিতে ২% ফরম্যালডিহাইড দিয়ে (১০০ মিলি ফর্মালিন ৫ লিটার জলে গুলে প্রতি বর্গ মিটারে প্রয়োগ) জমি ৩-৪ দিন প্লাস্টিক কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর সেচ দিয়ে অতিরিক্ত রসায়ন দূর করে দিতে হবে। জমি তৈরির সময় প্রতি বর্গ মিটারে ৮-৯ কেজি খামার পচা সার দেওয়া দরকার। রোপণের প্রথম তিন মাসের মধ্যে বর্গ মিটার প্রতি ১২, ১৫ এবং ২০ গ্রাম হারে নাইট্রোজেন,  ফসফেট ও পটাশ দেওয়া দরকার; চারা লাগানোর পর চার মাস থেকে ফুল আসা অবধি সময়ে ১৫, ১০ এবং ৩০ গ্রাম হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ দিতে হয়। ০.১৫ %  হারে অণুখাদ্য যেমন ক্যালসিয়াম, বোরোন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ প্রয়োগ করতে হবে (প্রতি লিটার জলে ১.৫ গ্রাম মিশিয়ে মাসে একবার)। পলি হাউস পদ্ধতিতে চারা লাগানোর পর প্রথম তিন মাসে সপ্তাহে একবার এবং পরের তিন মাসে মাসে একবার আগাছা দমন করতে হবে। প্রথম দুমাস ফুলের কলি চলে এলে তা নষ্ট করে দিতে হয়, তারপর বহাল রাখতে হয়। আর পুরনো পাতা ফেলে দিতে হয়। পলিহাউসে ড্রিপ ইরিগেশন বা বিন্দুপাতি সেচের সুবিধা থাকলে দু দিনে একবার ১৫ মিনিটের জন্য ড্রিপ চালিয়ে ড্রিপ প্রতি ৪ লিটার জলের যোগান দিতে হবে।

বর্ষাকালীন সবজি:

বর্ষাকালীন সবজি যেমন ঢ্যাঁড়স (আষাঢ়মাসে), ফরাসী বীন (আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি), লঙ্কা (আষাঢ়ের প্রথম, চৈত্রের শেষ থেকে শুরু), সিম, বরবটি, কচু, মিষ্টিআলু (আষাঢ়), মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ঝিঙ্গে, উচ্ছে, শশা (বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে শ্রাবণের মাঝামাঝি) এবং লাউ (বৈশাখ থেকে আষাঢ়) লাগানোর অন্যতম প্রকৃষ্ট সময় আষাঢ়মাস।

পান:

আশ্বিন-কার্তিক ছাড়াও আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেও পানের লতা লাগানো চলে। অর্থাৎ বর্ষার প্রথমে অথবা বর্ষার শেষে পান লাগাতে হয়। যেখানে বর্ষার প্রাবল্য বেশি এবং জল জমার প্রবণতা বেশি সেখানে চাষীরা বর্ষার শেষে আর যেখানে বৃষ্টি তুলনামূলকভাবে কম হয় সেখানে বর্ষার প্রারম্ভে পানের লতা বা বীচন লাগানোর চল আছে। খনার বচনে পাওয়া যায়, “পান পোতো শ্রাবণে / খেয়ে না ফুরায় রাবণে”। 

পানের চারাগুলি বোরোজের মধ্যে ভাটিতে বা পিলিতে লাগাতে হবে, এগুলি আসলে বোরোজের ভেতরের মাটিতোলা উঁচু বা রিজ অংশ। দুটি ভাটি বা পিলির দূরত্ব হবে ৬০ সেন্টিমিটার, সেখানে চারার দূরত্ব থাকবে ১৫ সেন্টিমিটার। প্রতি এক হাজার পান গাছের জন্য আড়াই শতক বা দেড়-কাঠা জমি লাগবে। আড়াই শতক বোরোজে ৪ থেকে ৬ কেজি নাইট্রোজেন, ২ থেকে ৩ কেজি ফসফেট এবং ২ থেকে ৩ কেজির মত পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।

আজকাল বাঁশ, পাটকাঠি, খড়ের বদলে শেডনেট দিয়ে পানের বোরোজ বানানো যায়। একাজে ৫০ শতাংশ (ফুটোর আকার ও ঘনত্ব অনুসারে বিভাজন) সবুজ রঙের শেড নেটই সবচাইতে উত্তম।