আগুনের পরশমণি

ক্যারাবিয়ান সাহিত্যিক জর্জ ল্যামিং (১৯২৭-) একটি অদ্ভুত উপন্যাস লিখেছেন :  ‘Castle of My Skin’ ! আমার চামড়াই আমার দুর্গ ! আফ্রিকা থেকে আসা ক্রীতদাসদের কালো মানুষ বলে যাবতীয় ঘৃণা আর অপমান করার প্রবণতাকে তিনি তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে এই লেখায় ফিরিয়ে দিতে চান তাঁর আপত্তি ৷ বিশ্বব্যাপী এই নিষ্ঠুরতার কোন উত্তর নেই ৷ মানুষ যেখানে মানুষের মর্যাদা পাবে কি না স্থির হয় গায়ের চামড়ার রং দিয়ে, সেখানে দেহটিকে দুর্গ বানানো ছাড়া উপায় নেই ৷ তিন চারটি শতাব্দী ধরে এইরকম বিকৃত সভ্যতাকে কলুষিত করছে ৷

মার্কিন লেখক অ্যালেক্স হেলি (১৯২১-১৯৯২) পেয়েছেন পুলিতজার পুরস্কার ৷ তাঁর বই ছিল ‘The Roots’. তাঁদের পরিবারে প্রচলিত কিছু শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে তিনি অবাক হয়ে যান ৷ শব্দগুলি পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যবহৃত হয় ৷ কারণ সন্ধান করতে থাকলেন হেলি ৷ খৃস্টধর্মের গির্জা ঘরে ধর্মান্তকরণের তথ্য খুঁজে তিনি জানলেন, তাঞ্জানিয়ার এক তরুণকে পোর্তুগিজ দাসব্যবসায়ীরা জালে ধরে জাহাজে তুলে নিয়ে  আসে ! মার্কিন মুলুকের দাসের হাটে বিকিয়ে যায় তাঁর পূর্ব পুরুষ ! এক অনিবার্য বেদনা আর নিরন্তর প্রতিবাদ এইভাবে ব্যক্ত হতে থাকে ৷ সারা বিশ্ব খুঁজতে চায় সভ্যতার নতুন মানে ৷ কেন এমন হবে ? কেন অত্যাচারী মুখোশ খুলে হাত ধুয়ে এসে বলবেন ইউরোপ হল সভ্যতার আদি ক্ষেত্র ? তারা তো হিংস্র বন্য পশুর চেয়ে বর্বর ! এই ধারণার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠল ৷ নতুন চেতনার জন্ম হল ৷ বের হল ‘Black Orpheus’-এর মত সংকলন ৷ গড়ে উঠল নতুন নন্দনতত্ত্বের দিগন্ত ৷

আফ্রিকাই সভ্যতার আদি, এরকম প্রচার শুরু হল ৷ ফ্রাঞ্জ ফ্যানন লিখলেন — দুনিয়ার হাঘরে ‘Wretched of the Earth’ ! বললেন আমি চাই না আমার বই ফরাসী পণ্ডিতরা পড়ুন ৷ আলজিরিয়ার লেখকের মনের উত্তাপ টের পেলেন জাঁ পল সর্ত্র ! এগিয়ে এসে বললেন তা কি করে হবে ?  লিখলেন বইটির  ভূমিকা ৷ নতুন করে এক উত্তর-উপনিবেশিক ব্যবস্থার চাহিদা তৈরি হল ৷

অন্ধকার ভারতবর্ষ ! একদা কালিদাস তন্বী শ্যামা শিখরী দশনা নায়িকার রূপ ভেবেছেন ! মন্দিরগাত্রে দেখেছি তেমনি সব নারী ৷ কাব্য কথায় ‘কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ’ আমাদের মুগ্ধ বিহ্বল করেছে ৷ অথচ এখন ? মেদিনীপুরের টুম্পা সামন্তের কথা জেনে মুখটা বিস্বাদে তেতো হয়ে পড়ল ৷ এ কোন শ্যামা সঙ্গীতের শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমি আমাদের ? বিমূঢ়-বিষণ্ণ নির্বাক হতে হয় ৷ কালো মেয়ে বলে বাপের বাড়ির পরিবারকে পণের পরিমাণ দিতে হয়  সাধ্যাতীত উপায়ে ৷ তাতেও রক্ষা নেই ৷ স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁকে পুড়িয়ে মারে, কারণ টুম্পা কালো ! ছিঃ, আমাদের সমাজজীবন এতটাই নির্মম পাশবিক ? আসলে আমরা চোখ মেলে দেখি না ৷ গরু বকনা বিয়োলে খুশি হই, আর মায়ের কোলে মেয়ে দেখলেই আনন্দের উলুধ্বনি বাজে না !

কুসংস্কার বলে এড়ানো যাবে না ! পুরুষ প্রধান সামাজিক অন্যায় বললেও সবটুকু বলা হয় কি ? আমরা ভারতীয়রা কি বৃটিশশাসনকালে ‘ব্ল্যাক নিগার’ বলে ধিক্কৃত হতাম না ? প্রথম শ্রেণীর রেল কামরা থেকে গান্ধিজীকে কি ট্রান্সভালে ছুঁড়ে ফেলেনি মদগর্গোবী গোরারা ? কেন মহিলারা মহিলাদের উপর অত্যাচার করে ? তারা কি আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে না ! এক উৎকট বিচিত্র অন্যায় আজ সামাজিক-মনকে বিষিয়ে দিয়েছে ৷ অক্ষমের উপর অনাচার দুর্ব্যবহার সীমাহীন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ! প্রতিকারহীন এক অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে আমাদের মাতৃজাতিকে ছুঁড়ে ফেলছি আমরা ! সতীদাহের মতো এই অশ্লীল আচরণ আমাদের লজ্জিতও করছে না ৷

একবার লাগালেই ফর্সা হবেন ! এই প্রসাধন সামগ্রী আপনার শরীরকে উজ্জ্বল করবে ৷ না হলে মূল্য ফেরৎ ! এমন কতশত সামগ্রী ছেয়ে আছে বাজার ৷ লক্ষ কোটি টাকায় প্রসাধনী বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠছে ৷ আমাদের বুক পকেটের নীচেই আছে হৃদয় ! মনে পড়ছে না আমাদের ৷ সৌন্দর্যের মায়াবী আবেশে তনুমনপ্রাণ ছটফট করে ৷ ঈশ্বর শুধু রূপ দিয়ে পাঠাননি আমাদের ৷ গুণ কর্ম কর্তব্য আর চরিত্র যার নেই সে শুধু রূপের গর্ব করে ৷ রূপ যখন গুণকে ছাপিয়ে যায়, সমাজ সেই মাকালদের ছবি দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে, বুঝতে হবে কোথাও বড়ো কিছু গোলমাল হয়েছে ৷ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের উপকথা’-য় উদাসীন নায়ক শশী ডাক্তার হাহাকারের মত বলেছিল : ‘শরীর শরীর ! তোমার মন নাই কুসুম ?’ এই হাহাকারে আবিশ্ব তন্ময় এক জীবনাতীতকে না পাবার দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে ৷ কোন সে কাম্য ব্যবস্থা যা রূপাতীত এক আশ্চর্যকে তুলে আনবে ? আমরা আজও জানি না ৷ টুম্পাদের অগ্নিদগ্ধ হবার মধ্যদিয়ে সেই পরশমণি আসবে ? জানি না ৷

ভারতবর্ষে নর্ডিক আর্য জাতিতত্ত্ব ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত ৷ Aryan race theory ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গী এক কৃত্রিম ছদ্ম ইতিহাস ৷ ভাষা ছাড়া এর কিছুমাত্র প্রমাণ নেই ৷ আজ জেনেছি, আর্য অর্থ ভদ্র ৷ সংস্কৃতি যার নেই সে অনার্য ৷ সংস্কৃতি আছে কিন্তু সংযম নেই এমন যারা তারা রাক্ষস ৷ আর আমাদের অবতার ? কখনো নবদূর্বাদলশ্যাম শ্রীরাম কখনো নীলনবঘন শ্রীকৃষ্ণ ! নায়িকাদের মধ্যে আছেন কৃষ্ণা দ্রৌপদী ! তাঁর চেয়ে সুন্দরী আর কে ? মধ্যযুগীয় বর্বর মুসলিমরা আমাদের জায়া জননীদের কালো বলে দাগিয়ে  বর্ণাভিমানের হারেম সাজিয়েছে ৷ তার আগে নগর নটীদের সম্মান ছিল ৷ এই অবনমন বৃটিশশাসনকালে সম্পূর্ণ হয় ৷ আমাদের নন্দনতত্ত্বে এই বিপর্যয়ের কোন তুলনা নেই ৷ দৃষ্টিভঙ্গীটাও পাশ্চাত্ত্যের দাস হয়েছে ! কালোমানিক পুরুষরা তাই চাইছে বার্বিডল বউ আর মেয়েরাও সময় কাটাচ্ছে বিউটি পার্লার আর স্পা-এর খপ্পরে ৷

উগাণ্ডার কবি ওকিতে  পি বিতেক লিখেছেন ‘Song of Lowinow’. লোইনো এক ঝলমলে মিষ্টি মেয়ে ৷ কালো অপূর্ব তার রূপ ৷ স্বামী তার কাম্পালায় এসে এক ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের দিদিমণির পাল্লায় পড়েছে ৷ ক্লিমেটিনা তার নাম ৷ মুখে ঘষেছে চকখড়ি ! অমন ক্যাটক্যাটে ফর্সা হলে কি সুন্দর হয় ? ঠোঁট জোড়া ? বেড়ালকাটা ডাইনি ছাড়া কি ? রক্তে চুবিয়েছে মুখ ! ছিঃ ! তবে  কিনা লোইনো তো ইংরেজী জানে না ! এই বিচিত্র অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে মনকে de- colonize করতে হবে ৷ ফিরতে হবে নিজ নিকেতনে ৷ যে তার চাঁপাফুল মত মা-কে অসুন্দর দেখে, দুধের সারের মত মোলায়েম স্নেহকে চিনতে পারে না, পৃথিবীর কোন বিউটি পার্লার তাকে ফর্সা করবে ? আগুনের পরশমণি চাই ৷ কিন্তু কালো বউকে পোড়াবার এই কাদায় চুবানো হিংসা চাই না ৷ এ জীবন পুণ্য হোক ৷৷

কৃতজ্ঞতা: প্রাত্যহিক খবরে প্রকাশিত এবং অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।

ফীচার: Feminism in India.com;  The Guardian  এবং The Hindu; ছবি প্রতীকী।