আজকে রাতের রাজা – ১

ধারাবাহিক উপন্য়াস - ১

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

ওই ছেলেটা বইয়ের পোকা, ওই মেয়েটা সিনেমার পোকা, এরকম তো হামেশাই শুনি। কে কী খেতে ভালোবাসে তা বোঝাতে মাছের পোকা, মাংসের পোকাও বলা হয়,শুনেছি। জলের পোকা যেমন চেনা একটা কথা, মাটির পোকা শব্দটাও কানে এসেছে। কিন্তু আকাশের পোকা বলে কিছু হয় কি? না হলেও বলতে কী অসুবিধে ছিল, পাখি কিম্বা এরোপ্লেনকে দেখিয়ে বলাই যেত, ‘ওই দেখো,আকাশের পোকা’। বলা হয়তো যেত, কিন্তু কেউ বলে না। যেমন, অসংখ্য, অজস্র থাকলেও, ‘নর্দমার পোকা’ বলে কেউ চট করে ডাকে না কাউকে।

আমার মা ডাকত। একটা সময়ের পর থেকে, মা আমাকে, ‘নর্দমার পোকা’ বলে ডাকত। আড়ালে, আবডালে নয়, একদম সবার সামনে এবং প্রায় সবসময়। বিশেষ করে ভাত বেড়ে খেতে ডাকার সময়, মা’র চিৎকার আশেপাশের প্রত্যেকটা ঘর থেকে শুনতে পাওয়া যেত। সবাই কমবেশি হাসত সেই ডাক শুনে কিন্তু যতদিন যেতে লাগল তত ওই ডাক পচে গেল লোকের কানে। কেউ আর তেমন করে পাত্তা দিত না মায়ের চিৎকারকে। তবে রাস্তায় ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে আর আমি পাস করে যাচ্ছি এমন সময় যদি রাবারের বলটা কারও ব্যাটের বাড়ি খেয়ে নর্দমায় পড়ত তাহলে সে আমাকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠত, ‘নর্দমার পোকা, নর্দমা থেকে বলটা তুলে দিয়ে যা…’। এই বলাটা এত স্বাভাবিক ছিল যে বাক্যটা শেষ করার সময় ছেলেটা একটা ‘প্লিজ’ পর্যন্ত বলত না আর পুরো প্রক্রিয়াটা চলাকালীন,অন্য ছেলেরা এমন হাসিমুখে তাকিয়ে থাকত যে এটা আমার অবশ্যকর্তব্য। প্রথমপ্রথম দুএকবার তুলেও দিয়েছি আমি। তারপর, এটা একেবারে আইন হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে, ‘পারব না যা’ বলে চলে আসতে শুরু করি। তখনই পিছন থেকে আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘ নর্দমার পোকা / একনম্বরের বোকা…’। আমি সেই টিটকিরি খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে উলটোপালটা বলেছি, মারপিট করতেও ছুটে গেছি কয়েকবার কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। রাত জেগে একাএকা ভেবেছি আর ভাবতে ভাবতে টের পেয়েছি, অনেকের অত্যাচার থেকে একা একটা মানুষ তখনই রক্ষা পেতে পারে যখন সে সেই অত্যাচার মেনে নেয় কিম্বা অত্যাচারটাকে পাত্তা না দেয়। আমি দ্বিতীয় পন্থাটা নিলাম। প্যাঁক খেতে খেতে এমনভাবে হেঁটে গেলাম যেন, প্যাঁক নয়, ফিল্মস্টারকে দেখে জয়ধ্বনি দিচ্ছে কেউ। একদিন,দু’দিন, তিনদিন এইরকম ঘটার পর দেখলাম, যা ভেবেছিলাম, তেমনই ঘটছে মোটামুটি। মায়ের চিৎকারের মতো, আমার নামটাকেও আর তেমন পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। আর পাত্তা দিচ্ছে না বলে আমার অস্তিত্ব খেয়াল করছে না। খেয়াল করছে না বলে নিজেদের খেলার বল নর্দমায় পড়লে পরে নিজেরাই হাত ডুবিয়ে তুলে আনছে। চুপচাপ ব্যাপারটা নজর করতে করতে আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘কেল্লাফতে’। ভিতরে ভিতরে করলাম বলে,কেউ শুনতে পেল না কিন্তু সেই চিৎকারের আওয়াজ আমার মনে কোকিলের ডাক হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আমি বুঝে গেলাম যে এই খতরনাক দুনিয়ায় সারভাইভ করার মূলমন্ত্র হচ্ছে, পাত্তা না দেওয়া।

এই উপলব্ধি এমন একটা রং ছড়িয়ে দিল আমার ভিতর যার সঙ্গে লড়াই করে আবির পর্যন্ত হেরে যাবে। কিন্তু উপলব্ধি শুধু রং ছড়ায় না, বোধের জন্ম দেয় তাই হোলির দুপুরে লাউচিংড়ির ঘণ্ট খাওয়াতে এসে পুতুল যখন আলতো করে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বুক থেকে শাড়ি ফেলে দিয়ে বলল, ‘রং দিবি না’ আমি বেশ সহানুভূতির সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছিলাম ওর দিকে।

কাছে আয়, আরও কাছে এসে রং দে আমায় । পুতুল বিড়ালের মতো চোখ বন্ধ করে বলল।

আমি কাছেই ছিলাম। তাই বুঝতে পারছিলাম, পুতুল আসলে কাছে আসতে বলার নাম করে জাপটে ধরতে বলছে ওকে। পুতুল কুচ্ছিত, ওর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত, কিছু দেখেই ওকে জাপটে ধরার ইচ্ছে আমার মধ্যে আসছিল না। কিন্তু আমার সদ্যজাগ্রত বোধ আমাকে বলছিল, স্বামী পরিত্যক্তাদের কষ্টের কথা। এখন না হয় সমাজে সেই চোখরাঙানি কিম্বা একঘরে করে রাখার ব্যাপার ততটা নেইকিন্তু সেক্স? সেখানে তো একটা বিরাট শূন্যতা ,তাই না?

আমি গভীর মায়ায় পুতুলের গালে আবির ঘষতে ঘষতে বললাম, তোর বর তোকে ঘরে নিল না কেন পুতুল?

পুতুল নিদারুণ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, শুয়োরের বাচ্চার ঘরে আর একটা বউ আছে দেখে আমিই ওর ঘরে উঠিনি।নইলে বে করে নিয়ে গিয়ে আমায় ঘরে তুলবে না, এমন মরদ জম্মায়নি এখনও। ওসব ছেনালি বাদ দে তো। তুই কাছে আয়।

অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা স্বামীর ঘরে গিয়ে যদি দেখা যায় যে একটি জলজ্যান্ত সতীন বর্তমান তখন কার না মাথায় আগুন জ্বলে? সেই রাগে পুতুল যদি নিরন্তর গঞ্জনা শোনার ঝুঁকি নিয়েও বাপের বাড়িতে ফিরে এসে থাকে, তাহলে ঠিকই করেছে, আমার মনে হল। আর ওর বরের অবহেলার শোধ নিতে আমার সঙ্গে একটু সেক্সের ইচ্ছা যদি ওর মনে জেগে থাকে,তাতেই বা অন্যায় কোথায়?

কিন্তু আরও কাছে আসার আগে ওই লাউচিংড়ির বাটিটাকে মিটসেফের ভিতরে রেখে আসা উচিত নয়তো মেঝের উপর থেকে ওটার ভিতরের মালপত্র যেকোনও মুহূর্তে লুঠ হয়ে যেতে পারে। আমি অলরেডি একটা মোটা গোঁফওলা হুলোকে দু’বার আমার জানলার শিকগুলোর ওপরে উঠে উঁকি মারতে দেখেছি।আর এইসব মান্ধাতার আমলের জানলার প্যাটার্ন এমন যে বন্ধ থাকলেও ওপরের ফাঁক দিয়ে গলে আসতে পারে, বিড়ালফিড়াল। শালা, আগেকার লোকের এত ফাঁকফোকর কেন দরকার হত বুঝতে পারি না। সবকটা কি হাঁপানি রুগি ছিল নাকি যে অজস্র ছোটবড় ভেন্টিলেটর দিয়ে হাওয়া আসার দরকার হত? এখন কি সুন্দর ব্যবস্থা সব উঁচুউঁচু ফ্ল্যাটে। কোথাও কোনও ফাঁকাফুকো নেই, ঘুলঘুলি নেই, রসগোল্লা ভরতি টিন যেমন শক্ত করে আটকানো, তেমন করে মানুষকে আটকে রেখেছে ভিতরে। হাওয়া? চব্বিশঘণ্টা হাওয়া আসছে এসি মেশিন থেকে। বাইরের হাওয়ার দরকার কী? আর হাওয়াবাতাস যেখানে ঢুকতে পারে না, সেখানে কুকুরবিড়ালচড়াইশালিখ ঢুকবে কী করে? ওইসব এপার্টমেন্টে মানুষের যুদ্ধ শুধু মানুষের সঙ্গে। আর আমাকে দ্যাখোকাককোকিলহুলো বিড়ালের ভয়ঙ্কর লোভের পাশাপাশি এই নাসধবা,নাবিধবা পুতুলের জাগ্রত বাসনার সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে।

মিটসেফের ভিতর বাটিটা ভরে রাখতে রাখতে আমি আড়চোখে পুতুলকে দেখলাম একবার। চোখেমুখে এমন একটা ভাব যেন গরম শিঙাড়া ভাজিয়ে নিয়ে এসেছে, এবার আমি একটু চা না বসিয়ে যাই কোথায়? কোথাও যেতাম না কিন্তু আবার পুতুলের কাছাকাছি আসতেই শুনলাম যে পুতুল কাল ভোররাতে একটা দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখেছে।

কী স্বপ্ন দেখলি? আমি ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলাম।

দেখলাম একটা নর্দমার পোকা আমার সারা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমাকে ডলেপিষে শেষ করে দিচ্ছে, নিজের মুখে আমার মুখটা ভরে অনেক চুমু খাচ্ছে। পুতুল আর অপেক্ষা করতে না পেরে আমার হাতটা ধরে টান দিয়ে ফেলল।

যদি শেষ কথাটা না বলত, তাহলে হয়তো আমি স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো পুতুলের গায়ে গিয়ে পড়তাম কিন্তু ওই ‘চুমু’র সঙ্গে নর্দমার পোকাকে জড়িয়ে পুতুল আমার নতুন বোধের ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দিল। আমি কুস্তিগিরের কায়দায় নিজেকে সামলে নিয়ে পুতুলকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। পুতুল অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।

ফ্রিতে দিলেই সব জিনিস নেওয়া যায় না বুঝলি? আর তাছাড়া নর্দমার পোকা কি কাউকে চুমু খায়? খেতে জানে?

আমি এমনিই বললাম।

এমনি না ওমনি আমার জানার দরকার নেই। তুই বেরো এক্ষুনি এখান থেকে। আর ইচ্ছে হলে পরে তোর ওই লাউচিংড়ি নিয়ে যা। দু’পা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা হাট করে দিলাম আমি।

পুতুল মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণসেই সময়টা ওর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ল বোধহয় একদু’ ফোঁটা।

পৃথিবীতে সবসময় যেমন চায়ের জল, ভাতের জল,ডালের জল ফুটছে কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও গ্যাস কিম্বা স্টোভ কিম্বা উনুনে, তেমনই কারও না কারও চোখ থেকে জল গড়িয়েও পড়ছে সারাক্ষণ। ওইসব ব্যাপারকে একদম গুরুত্ব দিতে নেই।অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আমি তাই আমার সিগারেট আর দেশলাই কোথায় রেখেছি, ভাবছিলাম।

ওদিকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে যেতে পুতুল ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো হটাৎ জেগে উঠে লাভা উদ্গীরণ করতে শুরু করল, হারামজাদা,শয়তান,ঢ্যামনা, নর্দমার পোকা, নর্দমাতেই ডুবে মর।

আমি প্রথমে একটু চমকে গেলেও হাসতে শুরু করলাম পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেআমায় হাসতে দেখে পুতুল আরও তেড়ে গালাগালি দিতে লাগল। কিন্তু কোনও ফল হচ্ছে না দেখে হতাশ হয়ে সরে গেল সামনে থেকে।

আমার দরজা খোলাই রইল।

ছোটবেলাতেও আমাদের বাড়ির মস্ত দরজা খোলাই থাকত। কতগুলো ঘর ছিল সেই বাড়িতে এখন আর মনেও পড়ে না। একতলাদোতলা মিলিয়ে আটন’টা তো হবেই। কেবলমাত্র ঘর নয়, বাড়িতে ঢুকতেই মস্ত একটা উঠোন, সেই উঠোনে কী সুন্দর একটা তুলসীমঞ্চ, সেই তুলসীমঞ্চে সন্ধে হলেই মায়ের জ্বেলে দেওয়া প্রদীপ আর পিছনের গোয়াল থেকে ভেসে আসা গোরুর ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠাকুমার সুর করে রামায়ণ পড়া। শুধু কি তাই? কতরকমের মানুষ, পশুপ্রাণী আর আওয়াজ যে দিনরাত ঘুরে বেড়াত বাড়িটার হাওয়ায়হাওয়ায়। বাবার এক শহুরে বন্ধু বেড়াতে এসে বলেছিল, ‘তোমাদের বাড়িতে তো দিনরাত অর্কেস্ট্রা চলে হে’ অর্কেস্ট্রা কাকে বলে, সেটা খায় না মাথায় দেয়, তাই জানতাম না তখন তবু বাবাকে খুশি হতে দেখে আমরা সবাই খুশি হয়েছিলাম। আর সেই খুশি ধানের গোলা থেকে বাড়িলাগোয়া পুকুরে উছলে উঠেছিল। মাছে, দুধে , ধানে, সবজিতে, অতিথিতে ভরপুর আমাদের বাড়ি যেন সবার কানেকানে নিঃশব্দে বলে উঠেছিল, আছে, সব আছে। আছে কারণ, আন্তরিকতা আছে, ভালোবাসা আছে।

হ্যাঁ, আমরা গ্রামে থাকতাম। কিন্তু কতদূর সেই গ্রাম কলকাতা শহর থেকে? বারোপনেরো মাইল, ম্যাক্সিমাম। তবু সেইটুকু তফাত যেন এক যুগ,একটা দেশের তফাত। গ্রামের লোক মজা করে একে অন্যকে বলত, ‘কলকাতা যাচ্চো, তা পাশপোট নিয়েছ?’; যাকে বলা হত,সেও হেসে উত্তর দিত, ‘তা নিইচি কিন্তুক ভিশা এখনও পাই নে।’ পাসপোর্টকে ‘পাশপোট’, ভিসাকে ‘ভিশা’ বলত প্রায় সবাই কিন্তু তাতে কীসের অসুবিধে ? কলকাতার বাবুদের,বিবিদের যেমন নিজের ফ্ল্যাট থেকে পাশের ফ্ল্যাটে যেতে পাসপোর্টভিসা লাগে আমাদের তো তেমন লাগত না। আমরা জানতাম গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িই আমার বাড়ি, তেমনি আমার বাড়িটাও গ্রামের আর সবার। কতদিন বিকেলে ফুটবল খেলে ফেরার পথে একে অন্যকে কাদা মাখিয়ে দিয়েছি তারপর আবার সবাই মিলে ঝাঁপ দিয়েছি পুকুরে। সেই পুকুরের মালিক কে, কার দায় পড়ত খোঁজ নিতে? আবার স্নান সেরে উঠে শর্টকাটে ফিরতে গিয়ে যখন দেখেছি ভোলার বাগানের মস্ত শেয়াল তীরবেগে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে গাঘেঁষে তখন ভয়ের চোটে যার বাড়ি আগে পড়েছে, সেখানেই ঢুকে গেছিসেই বন্ধুর নাম কী, তার বাবা কী করে, তারা বড়লোক না গরিব, সেসব ভাবব, এমন বর্ণপরিচয় আমরা পড়িনি

আমাদের গ্রামের নাম ছিল, সাজনে। কেন এরকম নাম, জানি না। কেউ কি কাউকে বলছিল, ‘সেজে নে’ আর সেই কথাই ঘুরতেঘুরতে, ভাঙতেভাঙতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ‘সাজনে’য়? হবে হয়তো। আশেপাশের গ্রামের নামগুলোও কম ইন্টারেস্টিং ছিল না। যেমন আমাদের পাশের গ্রামের নাম, ‘হস্তীকাঁদা’ সেখানে কি হাতিদের কান্নার কোনও কারণ ঘটেছিল? কী কারণ? কত গল্প ঘুরে বেড়াত। ওই গ্রামে নাকি একজন মস্ত বড়লোকের পোষা হাতি পাগল হয়ে গিয়ে কেঁদে বেড়াত। কে জানে, মিথ্যে না সত্যি। কিন্তু শোনার সময় মজা পেতাম খুবসেই মজার খোঁজেই কিশোরী রায়ের নাতিকে আমরা বলতাম যে কিশোরপুর গ্রামটা ওর দাদুর নামে। গ্রামটা দেড়শো বছরের পুরোনো আর ওর দাদু তখনও বেঁচে তাই এমন কিছু হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু নাতিটা এমন আকাট যে এরকম কিছু শুনলেই আমাদের খাওয়ানোর জন্য দু’টাকা, পাঁচটাকা বের করত। তাই নাতি এলেই কোনও না কোনও অছিলায় দাদুর নাম আর গ্রামের নাম মিলেমিশে যেত

আমাদের অঞ্চলটার নাম ছিল, রাজাপুর।হয়তো তাই আমরা ভাবতে পারতাম, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…’ আর শুধু ভেবেই রণে ভঙ্গ দিতাম না, আমাদের শয়নেস্বপনে কোথাও একটা সুর বাজত যে আমরা রাজা।

সেই রাজাপুর এখন কলকাতার লেজে গজিয়ে ওঠা নতুন কলকাতা। সেখানে সতেরোআঠেরোতলা কত বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে। বিপ্লব আসছে; লেনিন, স্তালিনের নির্দেশিত পথে উন্নয়ন আসছে বলতে বলতে যারা এগিয়ে এল, গ্রামের সরলসিধা লোকরা খেয়াল করেনি তাদের পিছনেপিছনে কারা আসছিল। আসছিল সব টাকার কুমির মারোয়ারিরা। কিন্তু ওরা বেওসাদারের জাত, বেওসা করতে এসেছে। ওরা তো মুনাফার জন্য সবকিছু করতে করতে পারে। ওদের দোষ দেবার আগে ভাবতে হবে বাংলার মাটিতে বসে বাঙালির সর্বনাশ ওরা করতে পারত কি যদি না নতুন মীরজাফরের দল নতুন ষড়যন্ত্র করত? সেই নতুন মীরজাফররা নামেপদবীতে বাঙালি কিন্তু পরিচয়ে ইন্টারন্যাশনাল। তারা চিকিৎসা করাতে যায় চিনে, ছেলেমেয়েকে পড়তে পাঠায়, অ্যামেরিকায়। আর বইয়ের তাকে মার্কস, রাসেল, পাশাপাশি সাজিয়ে রাখলেও বাড়ির বাসনমাজা ঝি দু’দিনের জায়গায় চারদিন কামাই করলেই মাইনে কেটে নেয় একদম ক্যালকুলেটরে হিসেব করে।

আমি জানি কারণ আমাদের রাজাপুর অঞ্চলের গৃহস্থ বাড়ির বউঝি’রাই তো এখন ওইসব সতেরোআঠেরোতলা বিল্ডিং’এর প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে ‘কাজের মাসি’ হয়েছে। যেখানে আমাদের ধানের গোলা ছিল সেখানে বেডরুম হয়েছে একের ওপরে এক। যেখানে আমাদের পুকুর ছিল, সেখানে ডাইনিং টেবিল বসেছে আর সেই টেবিলে অন্ধ্রপ্রদেশের বাসি কাটাপোনা ঝকঝকে কাচের পাত্রে থকথকে গ্রেভির ভিতরে শুয়ে আছে। যেখানে আমাদের তুলসীমঞ্চ ছিল, সেখানে এখন ব্যালকনির ওপরে ব্যালকনি। সেই ব্যালকনিতে ফাঁকা মদের বোতলে মানিপ্ল্যান্ট আছে। তুলসীগাছ নেই। আর যেখানে স্বপ্ন ছিল? ওই মাঠ, ক্ষেত, দীঘি, গাছপালা, গোয়ালের যেখানে যেখানে স্বপ্ন ছিল আমাদের? চেনাঅচেনা অনেকেই বলে যে হারিয়ে গেছে কিন্তু আমি জানি যে স্বপ্নগুলো হারায়নি। ওইসব স্বপ্নের বুকের ওপরেই গোলাপিসাদাখয়েরিনীল কমোড বসেছে। ফারনিশড ফ্ল্যাট কেনা রইস আদমিদের কমোড। ‘উন্নয়ন’ আছোলা বাঁশ হয়ে আমাদের পাছায় ঢুকে গেছে না পারছি বসতে, না দাঁড়াতে।

কীভাবে এই বৈপ্লবিক উন্নয়ন হল, সে গল্প বলতে অনেক সময় লাগবে। সেই সময় আমার হাতে নেই। কারণ বসা আর দাঁড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে বলে এখন রাত্রিদিন ছুটে বেড়াতে হয়। ছুটছি। সকালে টিউশন মাস্টার ছুটছে, দুপুরে সাট্টার পেন্সিলার ছুটছে, সন্ধ্যায় ঘুগনি বিক্রেতা ছুটছে। ওই মাস্টার, ওই পেন্সিলার, ওই ঘুগনিওলাতিনটেই আমি। ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরের মতো আমি এখন তিনে এক, একে তিন। বসা কিম্বা দাঁড়ানোর সময় নেই। কোনওদিনই থাকে না। শুধু মানুষের চেহারাটা ধরে আছি বলেই হয়তো ক্বচিৎকখনও একটা শোয়ার চান্স এসে পড়েওই পুতুলের মতো কোনও সর্বহারা মহিলা আমার মতো সর্বহারা পুরুষকে নিজের নাথাকাটুকু সমর্পণ করতে চায়। কিন্তু সেই সমর্পণের আগের মুহূর্তে ও যেই ওর স্বপ্নের কথা বলে ফেলে, যে স্বপ্নে একটা নর্দমার পোকা ওর সারা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,ওকে চুমু খাচ্ছে, অমনি আমার সর্বাঙ্গে কে যেন কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কে লাগাল, আগুন কে লাগাল? আমি পাগলের মতো খুঁজতে থাকি আর তখনই টের পাই, আগুন লাগিয়েছে আমার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের অল্প একটু জানে বলে পুতুল আমাকে আদর করেই ‘নর্দমার পোকা’ বলে ডাকে, এই আধাবস্তিতে উঠে আসার পর থেকে আমার পাগল হয়ে যাওয়া মা যে নামে আমায় ডাকত। কিন্তু নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য আমাকে দায়ী করা মা যখন সৌভাগ্যবতী ছিল? চওড়া করে সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া আমার সেই ঢাকাই শাড়ি পড়ে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়া মা’কে পুতুল তো কখনও দেখেনি। দেখেনি বলেই ওর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে এই ‘নর্দমার পোকা’ একদিন নিজের মায়ের কাছে, ‘সোনাবাবা’ ছিল, ‘গোপাল’ ছিল। সব হারানোর সঙ্গেসঙ্গে আমি নিজের নামগুলোও হারিয়েছি তাই আজ কেউ আমাকে, ‘মাস্টার’ বলে ডাকে, কেউ ‘এই পেন্সিলার’ বলে ইশারা করে, কেউ বা ‘ওই ঘুগনিওলা’ বলে আওয়াজ দেয়। আমি তিনটেতেই সাড়া দিতে দিতে ভাবি আমার মতো সর্বার্থে সর্বহারা আর কে আছে? পুতুল? ওর কবে কী ছিল যে হারাবে? কুড়িবছর বয়সে যেলোকটা অন্ধ হয়েছে তার বেদনা, জন্মান্ধ কখনও বোঝে না। আমার আর পুতুলের ভিতর তাই কোনও সম্পর্ক দূরে থাক, শরীরের লেনাদেনাও চলতে পারে না। বিকজ, ওয়ান্স আপন আ টাইম আই ওয়াজ সামওয়ান স্পেশাল। আমার একটা আলাদা পরিচয় ছিল।

বদলে যাওয়া রাজাপুর, মস্তমস্ত সব আকাশচুম্বী বাড়ির ঠিকানা,ঝাঁচকচকে রাজাপুর, ‘নিউ সিটি’ হয়ে উঠবে বলে পুরোনো সব গন্ধ ঝেড়ে ফেলে দিতে থাকা রাজাপুরের ভিতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে আমি এইসব ভাবতে থাকি। আমার সাইকেলের হ্যান্ডল থেকে বড় একটা ক্যানেস্তারা ঝোলে যেটার ভিতরে স্টোভএই স্টোভ আমি স্টেশনে পৌঁছেই জ্বালিয়ে দিই আর ট্রেনে উঠে এমনভাবে আঁচ বাড়াই,কমাই যে স্টোভের ওপরে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ভরতি ঘুগনি একইসঙ্গে গরম আর সুস্বাদু থাকে। ওই দুটো অঙ্ক একসঙ্গে মেলাতে না পারলে পরে ঘুগনি বিক্রি হবে না। সাইকেল চালাতে চালাতে দুদিকে তাকাই আর ভাবি ওই দৈত্যের মতো বাড়িগুলোতে যেমন, বস্তিতেও তেমন,জীবনকে একইসঙ্গে গরম আর সুস্বাদু রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে লোক। কেউ দুটো অঙ্কই মিলিয়ে দিয়ে হাত ভরে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ একটাও মেলাতে না পেরে ফ্যাফ্যা করে ঘুরছে। আর বেশিরভাগই একটা মেলাচ্ছে তো অন্যটা মেলাতে পারছে না,ভুলটা ঠিক করতে গিয়ে দেখছে ঠিকটা কখন যেন ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু অত ফিলোসফি দিয়ে আমার হবে কী ? এই ঘুগনি নিয়ে অফিসফেরতা লোকের ভিড়ে দমবন্ধ ট্রেনে উঠতে না পারলে বিক্রি চৌপাট। তাতে অফিসবাবুদের কাঁচকলা কিন্তু আমার হাতে হ্যারিকেন। জীবন আমার চোখের সামনে এতএত অন্ধকার নামিয়ে এনেছে আর এতএতবার সেই আঁধার কেটে বেরোবার চেষ্টা করেছি যে আবারও হ্যারিকেনের কথা মনে এলেই আমার পা কাঁপতে শুরু করে।আজও করল। আমি সঙ্গেসঙ্গে ‘স্টেডি, স্টেডি’ বলে মাথা থেকে সিগনাল পাঠাতে থাকলাম পায়ে। শক্ত হাতে ধরলাম, সাইকেলের হ্যান্ডেলদ্রুত প্যাডল করতে থাকলামমনে মনে বলতে থাকলাম, আমি ঠিক বিকেল পাঁচটাপঞ্চান্ন’র লোকালটা ধরতে পারব। আমাকে পারতেই হবে।

ক্রমশ…

(প্রতিটি পর্বের জন্য চোখ রাখুন, রবিবার বঙ্গদেশ নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেজে।)