রাম নামে অরুচি শুধু ভূতেরই হয়

0
1609

শেখর ভারতীয়
সম্পাদক, বঙ্গদেশ

লকডাউনটা ঠিক পড়ল ৫ তারিখে। ৪ বা ৬ নয়, ঠিক ৫-এ। আসলে রামমন্দিরের ভূমিপূজার দিন অনেকের মুখ যে বাংলার পাঁচের মতো হয়ে যেতে পারে সে সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব ৫ -এ লকডাউন। এ যাত্রায় করোনা বাঁচিয়ে দিল। সাপও মরল, আবার লাঠিও ভাঙ্গল না! এসব কথা যাক, অন্য একটা গল্প বলি পাঠকদের।

কয়েক’শো বছর আগের কথা, উত্তরপ্রদেশের চিত্রকূটের মন্দাকিনী নদীর তীরে রামঘাটে প্রায়শই এসে বসতেন এক হিন্দু যুবক। মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করতেন নদীর ওপারে একজন মুসলিম ছেলে নদীর পাড় থেকে মাটি কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মাথায় ছুঁড়ে দিচ্ছে। মুসলিম ছেলেটি হিন্দু যুবকটির পরিচিত হওয়াতে একদিন সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
-ধুল ধরত নিজ শিশ পর কহ রহিম কহি কাজ?
(অর্থ- ধূলা বা মাটি কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মাথায় রাখছো, এটা কী করছো রহিম?)
ওপার থেকে মুসলিম যুবকটি উত্তর দেয়,
-জিহ রজ মুনি পত্নী তরী সো খোঁজত মহারাজ।
(অর্থ- যার স্পর্শে “মুনি পত্নী”র(অহল্যা) উদ্ধার হয়েছিল মাটিতে সেই স্পর্শটুকু খুঁজছি ” মহারাজ”)

কাদের মধ্যে এই বাক্যলাপ চলছিল? চিত্রকূটের এপারে রামঘাটে বসে থাকা হিন্দু ছেলেটি ভারতীয় সাহিত্যজগতের সেই বটবৃক্ষ যা আজও ভারতীয় সাহিত্যকে ছায়া দিয়ে চলেছে। ছেলেটি, ‘রামচরিৎ মানস’এর রচয়িতা নাম তুলসী দাস। আর ওপারের মুসলিম ছেলেটি? হুমায়ন এবং আকবরের সময়কার এক বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন বৈরাম খাঁ। জীবদ্দশায় যার তরবারি কখনও শুকোয়নি সেই বৈরাম খাঁ-র ছেলে রহিম। আকবরের সভার নবরত্নের একজন বিখ্যাত কবি। মোঘল যুগে একজন মুসলিম যুবকের এই ছিল রামের সম্পর্কে ধারণা।

রাম নামের অপূর্ব স্বাদ বুঝলেন, এ এমন এক নাম যা রক্তপিপাসু বৈরামের বংশধরকেও তরবারি ছাড়িয়ে কলম ধরিয়ে দেয়। সেনাপতির ছেলেকে কবি বানিয়ে দেয়। আবার অতীত ঘেঁটে দেখে নিন এঁর বিরুদ্ধে যারা যারা দাঁড়িয়েছেন তাদেরই সোনার লঙ্কার রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে৷

এবার খোঁজ নেওয়া দরকার শ্রীরাম প্রাচীন বঙ্গদেশেও একইভাবে জনমানসে বিরাজমান ছিলেন? নাকি বিজেপির মোদী-অমিত শাহ জুটি কাঁধে করে উত্তর ভারত থেকে রামকে তুলে নিয়ে এসে জোর করে বাংলায় রেখে গেছেন?

আনুমানিক ১০৫০ সালের আশেপাশে সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’ লেখেন। যেখানে তিনি রামপাল এবং শ্রীরামচন্দ্রের প্রশস্তি করেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর আগেও কিন্তু পাল বংশেরই আর এক কবি অভিনন্দন রামকে নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। এ যুগেরই ‘উদয়সুন্দরী কথা’ গ্রন্থেও রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর বাংলায় সুলতানি যুগে কৃত্তিবাস ওঝা বাল্মীকি রামায়ণকে বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে জড়িয়ে দেন, ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ লিখে।

বাঙালির রামপুজো নিয়ে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বই বাঙালির ইতিহাসে লিখেছেন, ‘ বাঙালি বাড়িতে বাড়িতে রামের মন্দির বানিয়ে পুজো হয়ত করেনি। কিন্তু সারা বাংলা জুড়ে ভক্তি সহকারে রামের পুজো হত সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়৷ সেন ও বর্মণ রাজত্বে রাম-সীতার মূর্তি পূজাও বেড়ে গিয়েছিল বাংলায়।’

এ তো গেল যেদিন লকডাউন রয়েছে সেই রাম মন্দির ভূমিপূজার দিনটিকে নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গ। কিন্তু জানেন কি এই করোনা কালেও যে উৎসবের দিনটি সহ আশেপাশের কয়েকদিনকে লকডাউনের আওতায় রাখা হয়নি সেই ‘ঈদ’ কবে থেকে বাং,লায় শুরু হয়েছে? পাল, সেন তো ছাড়ুন ১২৫০-এও বাংলা ও বাঙালির উৎসব ছিল না ঈদ। ১২০০ খ্রীস্টাব্দের আগে ঈদ বিষয়টার সঙ্গে পরিচিতও ছিল না বাংলার মানুষ। ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে আরবের আদর্শ চাপানো হয়েছে বাঙালির উপর। এই ইতিহাসকে অস্বীকার করেই পশ্চিমবাংলার কিছু মানুষ আজও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রামের বিরোধিতা করার কোনও সুযোগ ছাড়ছেন না৷ অবশ্য বাঙালির কবি কৃত্তিবাসী লেখা পড়েই আমরা জানি, রাম নামে ভূতের অরুচি থাকে।