সমরশক্তিতে চীনের বিনিদ্র রজনীর কারণ; কৈলাস থেকে সেনা সরাচ্ছে না ভারত

-সোমদীপ ভট্টাচার্য 

২৯ ও ৩০ আগস্ট মাঝরাতে অন্ধকারের আড়ালে চূড়ান্ত গোপনীয়তার সাথে ভারতীয় সেনা একটি সাহসী অপারেশন চালায় ভারত চীন সীমান্তে। তিব্বতের শরণার্থী সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিচালিত, বিশেষ সীমান্ত বাহিনীর একটি ইউনিটের কমান্ডোদের সহায়তায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কৈলাশ রেঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শৃঙ্গ ক্যাপচার করে, প্যাংগংসোর দক্ষিণে অবস্থিত এই অঞ্চল।

ভারতের এই পদক্ষেপ চীনকে জোর ধাক্কা দেয়। তারা হ্রদের উত্তরভাগে কিছু অঞ্চল দখলের পরে প্যাংগংসোর দক্ষিণে আরও উচ্চ শৃঙ্গ দখলের জন্য, আগেই এই জাতীয় পরিকল্পনা করেছিল।

নভেম্বরে, ভারত এবং চীনের মধ্যে আলোচনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে একটি আপস করা হয়। চীনের আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনী যে কৈলাশ রেঞ্জ দখল করে নিয়েছিল, সেগুলি ছেড়ে দেবে এবং অন্যদিকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিও পরিস্থিতি শান্ত করতে, একাধিক অঞ্চল থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করবে বলে কথা হয়। ফিঙ্গার ৮ এর পূর্ব দিকে-যেটি মে মাসের গোড়ার দিকে চীন দখল করে এবং ফিঙ্গার ৪ ও ৮ এর মধ্যবর্তি এলাকা তারা খালি করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

এখন আলোচিত চুক্তি শিরোনামে আসার এক মাসের পরেও এই বিষয়ে সামান্যতম অগ্রগতিটুকুও হয় নি। তাই সামরিক ও সরকারিভাবে এই সূত্রের উল্লেখ করে জানানো হয়েছে যে, কৈলাশ শৃঙ্গ অঞ্চল থেকে হঠকারিতা করে কোনো সেনা প্রত্যাহার হবে না (সূত্র: স্বরাজ্যের প্রতিবেদন)।

এদিকে শীত শুরু হওয়ায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নেমে গেছে। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কৈলাশ পাহাড়ের সীমানায় যে উচ্চতা দখল করেছে তা খালি করতে কোনও তাড়াহুড়ো করছে না।

একটি পর্বতপ্রমাণ দরাদরির অস্ত্র

২৯ ও ৩০ শে আগস্টের চুষুল সাব-সেক্টরে মধ্য রাতে ভারত কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ চীন আগেই একচ্যুয়াল নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর একটি অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তারা সেখান থেকে ফিরে যেতেও রাজি হয়নি। পিপলস লিবারেশন আর্মির উপর আস্থা রাখতে ভারতীয় সেনার অনাগ্রহিতার একটি অন্যতম কারণ হল গ্যালওয়ান উপত্যকায় বিনা প্ররোচনায় তাদের অতর্কিত আক্রমণ।

চীন জিনজিয়াংয়ের একটি মহড়া থেকে সেনাবাহিনীকে লাইন অব কন্ট্রোল বরাবর এলাকা দখল করতে পাঠায় এবং তিন মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও তারা এই অঞ্চলটি খালি করে না। সেই সময়ে অর্থাৎ আগস্টে ভারত পালটা পদক্ষেপ তখনই নেয় যখন তারা নিশ্চিত হয় যে পিপলস লিবারেশন আর্মিকে বাধ্য না করা পর্যন্ত তারা দখলীকৃত অঞ্চল ত্যাগ করবে না।

যে অঞ্চলটি তারা আগে নিয়ন্ত্রণ করেনি এমন অঞ্চল দখল করাই, চীনের সাথে আলোচনার টেবিলে ভারতকে একটি ‘পর্বতাকৃতির’ দর কষাকষির অস্ত্র দিয়েছে।

চুষুল রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা

ভারত দ্বারা অধিকৃত কৈলাশ রেঞ্জের উচ্চ শৃঙ্গগুলি, যার মধ্যে গুরুং হিল, মাগার হিল, মুখপড়ি, রেজং লা এবং রেচিন লা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; এগুলি ভারতকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে।

পাইলাং হ্রদের দক্ষিণ পাড়ে, প্রায় লম্বালম্বিভাবে কৈলাশ রেঞ্জের পূর্বে, স্পাংগুর সো লেক অবস্থিত। ভারত এই হ্রদের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে, তবে চীন কার্যকরীভাবে এর পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে।

চীন একবারে স্পাংগুর গ্যাপ অবধিই রাস্তা তৈরি করেছে। এই রাস্তাগুলি স্পাংগুর গ্যাপের চারপাশের চীনা ঘাঁটিগুলিকে আরও পূর্বে, রুদোকের তিব্বত শহরের তিব্বত-জিনজিয়াং হাইওয়ে (বা হাইওয়ে ২১৯) -এর সাথে সংযুক্ত করে।

এত উচ্চতায় উপস্থিতি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এই অঞ্চলের একটি সম্পূর্ণ দর্শন দেয়। কৌশলগতভাবে এটি ভারতকে শুধু গুরুত্বপূর্ণ স্পাংগুর গ্যাপের নিয়ন্ত্রণই দেয় না, চীন চুষুল বাউলে এবং আরও লেহের দিকে আক্রমণ ঘটলে ভারত সেই হামলাকে সম্পূর্ণরূপে ভেস্তে দিতে পারবে, এই সুবিধাও দেয়। আবার স্পাঙ্গগুর গ্যাপের চারপাশে অবস্থিত চীনা শিবির এবং যোগাযোগের লাইনগুলিও ভারতীয় আক্রমণের রেঞ্জেই রয়েছে।

ইতিহাস থেকে পাওয়া শিক্ষা

উভয় পক্ষই চায় কৈলাশ রেঞ্জের উচ্চতাটিকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য ১৯৭২ সালে যুদ্ধের সময় চুষুল সাব-সেক্টরটিতে তুমুল লড়াই হয়েছিল উভয় পক্ষের।স্পাংগুর গ্যাপের মাধ্যমে চুষুলের উপরে চীনা আক্রমণ প্রত্যাশা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী ২০ টি ল্যান্সারের এএমএক্স – ১৩ ট্যাঙ্ক মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিল।চন্ডীগড় থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ৪৪ স্কোয়াড্রনের একটি এ.এন-১২ পরিবহন বিমানের দ্বারা ছয়টি ট্যাংককে এয়ারলিফট করে নিয়ে আসা হয়েছিল।

২৫ ও ২৬ অক্টোবর এ এন ১২ ট্যাঙ্কগুলি স্পাংগুর গ্যাপের একদম পশ্চিমে অবস্থিত চুষুল এয়ারফিল্ডে পাঠানো হয়। স্পাংগুর গ্যাপকে পিএলএ-র অধীনে যাওয়া থেকে আটকানোর জন্য এগুলিকে গুরুং হিলের গোড়ায় মোতায়েন করা হয়েছিল।গুরুং হিল, স্পাংগুর গ্যাপ এবং চুষুল এয়ারফিল্ড ১/৮ গোর্খা রাইফেলসের থেকে আসা সৈন্যরা রক্ষা করছিল। ১৩ কুমাওনের একটি একটি মাত্র কোম্পানি মাগার হিলকে রক্ষা করছিল, এবং একটিমাত্র কোম্পানি আর একটা সেকশান রেজাং লা -তে উপস্থিত ছিল।

স্পাংগুর গ্যাপের উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত গুরুং হিল এবং মাগর হিলের আশেপাশের অবস্থানগুলিতে সীমিত আর্টিলারি উপস্থিত ছিল, এর রেঞ্জও সীমিত ছিল। রেজাং লা -তে সেনাবাহিনী আগেও চীনের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং তাও কোনো আর্টিলারি সাপোর্ট ছাড়াই।

১৮ ই নভেম্বর প্রথম দিকে যখন চীনা আক্রমণ শুরু হয়, তখন ভারত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। প্রচণ্ড চীনা আক্রমণ ঢেউয়ের মত ধেয়ে আসে ও সেনাকে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তখন ভারত চুষুল উপত্যকার পশ্চিমের উচ্চতায়, এই অঞ্চলে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

পশ্চিমে কৌশলগতভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কৈলাশ রেঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং অন্যদিকে চুষুল বিমানবন্দরও ছেড়ে যাওয়ায় এই প্রত্যাহার চীনকে কৈলাশ সীমার পূর্বে, ভারতীয় অঞ্চল দখলের সুযোগ করে দিয়েছিল।

শক্তিশালী সেনা, উন্নত সমরসজ্জা, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ‘নয়া  ভারত’

১৯৬২-এর তুলনায় ভারত এখন কৈলাশ রেঞ্জের জমি ধরে রাখতে আরও বেশি প্রস্তুত। প্যাংগং সোর উত্তর তীরে চীনা সেনার মুখোমুখি হয়েই ভারত তার সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছে। তারা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ব লাদাখে ৫০,০০০ সেনা ও সাজ সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য ভারতীয় বিমান বহরের পুরো শক্তিকেই ব্যবহার করেছে।

১৯৬২ এর মতো ট্যাঙ্কগুলিকে এয়ারলিফট করে এই অঞ্চলে বিমান মোতায়েন করা হয়েছে, তবে এবার অনেক বেশি সংখ্যায়। কিছু ক্ষেত্রে চাইনিজ ডিফেন্স পজিশন থেকে কয়েকশ মিটার দূরেই মোতায়েন রয়েছে এই ট্যাঙ্কগুলি। ঘাঁটি গেড়ে থাকা ভারতীয় বাহিনীকে উচ্ছেদ করা থেকে চাইনিজদের বিরত করতে কৈলাশ রেঞ্জের কয়েকটি চূড়ায় ট্যাঙ্কও চালানো হয়।

ট্যাঙ্ক-হত্যাকারী নামে পরিচিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর নতুন অর্জিত অ্যাপাচি হেলিকপ্টার মাথার উপরে উঠছে। এবার উপগ্রহ এবং বায়ুবাহিত মুভমেন্টের উপরে নজর রাখা সেন্সরগুলি লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর চীনা চলাচলের উপর নজর রাখবে। সাথে ভারতের নিজস্ব পরিস্থিতিগত সচেতনতাও বেড়েছে।

নেভির পি -8 আই সামুদ্রিক বিমান, “ওভারল্যান্ড সার্ভিলেন্স” এর জন্য তাদের রাডার ব্যবহার করতে পারে। এগুলিকে উত্তর সীমান্তের ফ্ল্যাশপয়েন্টের নিকটবর্তী অঞ্চল দিয়েই উড়তে দেখা গেছে।ডোকলাম সংকটের সময় যেমন হয়েছিল, ভারত এবারও তার সঙ্গী দেশগুলির কাছ থেকে ‘ইন্টেলিজেন্স’ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর অঞ্চলগুলিতে ভারতের পরিকাঠামো ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। এই রাস্তা দ্রুত সেনা ও সরঞ্জামাদি মোতায়েনকে সম্ভব করবে।

আত্মবিশ্বাসী ভারতীয় সেনা উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে নিজস্ব ক্ষমতাবলেই আত্মরক্ষা করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনী, কৈলাশ রেঞ্জে নিজের দখলে থাকা এলাকাগুলি খালি করতে একেবারেই উৎসাহী নয়। এটা নতুন ভারত, “ইয়ে ঘর মে ঘুসেগা ভী, আউর মারেগা ভী।”