একটি গরুর রচনা

0
916

বড়ই অভাগা প্রাণী। নূর-এ-ইসলাম, আমাদের শ্রদ্ধেয় আল্লার পয়গম্বর আরব মরুভূমিতে দেখতেই পেলেন না, তাই  এই বস্তুটি খাওয়া উচিত না মাথায় দেওয়া উচিত, হাদিথ সমগ্রতে লেখা হয়ে উঠলো না। উল্টো দিকে আল্লাতালা নিজে তাঁর পয়গম্বরকে বললেন পৃথিবীর শ্রেষ্ট ‘রিলিজিওন’ বানানোর জন্য বাকী লোকেদের ভয় ভালোবাসা দিয়ে এক ছাতার তলায় দাঁড় করানোর জন্য। তাই বাকি ফালতু ‘রিলিজিওন’দের অপমান করে তাদের ভ্রান্তি দূর করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘রিলিজিওনের’ অবলম্বনকারীদের হবি হিসেবে পরিগণিত হতে লাগলো।

৭১২ খ্রীষ্টাব্দে  সিন্ধুপ্রদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও যেই সব জাঠ উপরাজারা মোহাম্মদ বিন কাসিম এর সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা প্রমাদ গুনলেন। অঞ্চলটি তখন পাকাপাকি ভাবে খলিফাদের উপনিবেশ। মুলতানের বিখ্যাত সূর্য মন্দিরে সোনার বিগ্রহের উপর তাই একটি গরুকে হত্যা করে তার মাংস মালায় গেঁথে পরিয়ে দেওয়া হয়। এই সূর্যমন্দিরের কথা ভবিষ্য পুরাণে এবং ফাহিয়েনের লেখাতে পাওয়া যায়। ঘটনাটির বিবরণ পাওয়া যায় ওই সময় লেখা চাচনামায়। সিন্ধের ইসলামী শাসন যেমন এক পংক্তিতেই শেষ প্রচলিত ইতিহাস বইগুলিতে, ঘটনা হলো এই অধ্যায়টি তেমনি আসল ছায়াছবির ট্রেইলার মাত্র।

তুজুক-ই-তিমুরিতে যেমন লেখা লেংড়া তিমুরের জম্মু বিজয়ের পর যখন জম্মুর রাজা দয়াভিক্ষাতে ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণ করলেন, যুদ্ধে ক্লান্ত ও ক্ষতবিক্ষত রাজাকে ওষুধ থেকে বঞ্চিত রাখা হলো যতক্ষণ তিনি গো-মাংস ভক্ষণ করে তার ‘রিলিজিওন’ পরিবর্তন করলেন।

এর কিছুকাল পরের কথা। ধর্ম-নিরপেক্ষ ‘সেকু’ দের আইকন আকবর সাহেব হিন্দু-শায়েস্তা করতে নাগরকোট আক্রমণ করলেন। সেখানকার বিখ্যাত জ্বালামুখী মন্দিরের একটি পরিত্যক্ত আশ্রয়খানাতে প্রায় দু’শোটি নিটোল কালো গাই গোলাগুলিতে ভয় পেয়ে আশ্রয় নিলেন। আকবর সাহেবের নবরত্ন সভায় তখন এনিম্যাল রাইটস ও এনিম্যাল এক্টিভিজম এর চর্চা হতো না বললেই চলে। তাই সৈনিক যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন যতক্ষণ না বারুদ দিয়ে মন্দিরের অবরোধ তুলে না দেওয়া হয় টাইমপাস হিসেবে গো-নিধনে মগ্ন হলেন। সমস্ত রাজপুত যুদ্ধে দেহত্যাগ করলেন। যেই সব ব্রাহ্মণ দেবীর সেবা করতেন, তাঁরা আরো বীর। তাঁরা তো জানেন তাদের একদিন মরতে হবেই, এই সংসারের মায়া পরিত্যাগ করতে তারা নিজেদের প্রত্যেক অমাবস্যাতে বলিদান দিতেন। পলায়ন দূরে থাক, তারা হাসতে হাসতে হাড়িকাঠে গলা ঠেকালেন এই সংসারের মায়া ছেড়ে মা মহামায়ার চরণে নিজেকে নিবেদন করার জন্য। উপনিবেশকারীরা এই ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। তাদের পড়ানো হয়ে যে কাফিরকুল অত্যন্ত ভীতু। অঙ্ক বইয়ের শেষ পাতায় দেওয়া উত্তর না মিললে কিছু লোক যেমন নিজের অঙ্ক ছেড়ে পাবলিশার আর লেখক মহাশয়ের ওপর রেগে যান, তেমনি সেনাপতি হুসেইন কুলি খান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। তাঁকে অঙ্ক করা শিখিয়েছেন আল্লাতালা স্বয়ং, না মিললে বইয়ের দোষ, তাদের নিজেদের নয়। তাই আদেশমত সব সৈনিক নিজেদের বুট সেই দু’শোটি গরুর রক্তে লিপ্ত করে মন্দিরের প্রত্যেক অংশে সদর্পে হেঁটে বেড়ালেন। অবশিষ্ট রক্ত ছিটিয়ে মন্দিরের দেয়াল, উঠোন রঞ্জিত করা হলো।

না হিন্দুরা লেখেনি এটা, এই ঘটনা স্বয়ং আকবরের দরবারী লিখেছেন আকবরনামাতে, আপনি যদি না জানেন তার দোষ আপনার এবং আপনার নির্বাচিত সরকারের এবং তাদের বাছাই করা টেক্সটবুক কমিটির সদস্যদের।

ইসলামী শাসনের প্রত্যেক সময়েই গরু নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। ব্রাউন সাহেব লিখছেন যে গো-হত্যা এতো সাধারণ নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছিল ইসলামী শাসনে যে হিন্দুরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।  আরেক ইতিহাসবিদ গাবড়েও (Gaborieu ) লিখেছেন যে স্থানীয় মতাদর্শকে অপমান করা এবং নিজেদের ক্ষমতা জাহির করে ছিল এই গোহত্যার মূলে। সত্যি গরুদের মতো বোকা প্রাণী আর হয় না। দল বেঁধে যদি আরবে  গিয়ে পয়গম্বরের সামনে ল্যাজ নেড়ে নিজেদের উপস্থিতি যদি জাহির করত, হাদিথে লেখা থাকতো যদি তিনি গরুর দুধ পান করেছিলেন, তাই রিলিজিওনের বাকীঁ লোকেদের উচিত তাঁকে অনুসরণ করে গরুর দুধ খাওয়া।

ইয়াসিন এর লেখা দাবিস্তান-উল-মাজহাবে একদল সন্ন্যাসী এবং মাদারী-জালালী (মুসলমানি ফকির) দের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে লেখা আছে। ইতিহাসবিদ এলিয়ট আর ডসন লিখছেন যে আহমেদাবাদ ১৭১৩ সালে গরু হত্যা নিয়ে বিশাল দাঙ্গা হয়েছিল।

গুপ্তের লেখা থেকে জানা যায়, যে ১৭৫৭ সালে মারাঠা আর আফগানদের মধ্যে যখন তুমুল রেষারেষি; যুদ্ধ আটকাতে দুই পক্ষ যমুনা তীরে তাঁবু খাটালেন। পেশোয়ার সেনাপতি রঘুনাথ রাও-এর  ভোরবেলা যমুনাতে স্নান করতে যাওয়ার রাস্তাতে গরু কাটা হতো রোহিলা আফগান নাজিব-উদ-দাউলাহের নির্দেশে তাঁর নিজের বাছাই করা তাঁবুতে। রঘুনাথের ভেতরের গোরক্ষক উঠলো জেগে, তিনি এটাকে মারাঠা আত্ম-গৌরবের প্রশ্ন হিসেবে দেখলেন। মালিহার রাও হালকার তাঁকে না আটকালে উভয় পক্ষের যুদ্ধ হয়তো অনেক আগেই হয়ে যেত এবং হয়তো তা মারাঠাদের হিতেই হত।

ব্রিটিশদের আসার পর গোরক্ষা আন্দোলন রোদে রাখা বারুদ-স্তূপের মতো বিস্ফোরিত হলো। ওয়ারেন হেস্টিংস এর কাছে যোধপুর, উদয়পুর ও জয়পুরের রাজপুত রাজারা আর্জি জানালেন যে, সন্ধিতে আসতে হলে তাঁদের নিষ্পত্তিতে থাকা অঞ্চলগুলিতে গোহত্যা বন্ধ করতে হবে। এ হল ১৭৮০-এর ঘটনা। ইতিহাসবিদ ধর্মপাল ও মুকুন্দনের লেখা থেকে জানা যায় হেস্টিংসের তেরছা মন্তব্য “আপনাদের না বলার আগে এই সুখাদ্যটি আমরা চেখেও দেখিনি। যারপরনাই দুঃখিত।”

১৮০৬ সালে বর্তমানে ইউপির জেলা মাউ তে গোহত্যা নিয়ে তুমুল দাঙ্গা হয়। ব্রিটিশদের এমনকি দেশী কাফিরদের তাড়াতে বাংলার বুকে জন্ম নেয়  ওয়াহাবী আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ তিতুমীর কাফিরদের শায়েস্তা করতে বহু জনপ্রকাশ্য জায়গায় গোহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিতুমীরের প্রতাপে অতিষ্ঠ বৃটিশ সরকার সৈন্য় পাঠালেন এবং তিনি তাঁর বাঁশের কেল্লাটি সমেত ধ্বংস হলেন। এ  ছিল ১৮৩০ সালের ঘটনা। ১৮৩৮ সালে রেবাড়িতে (দিল্লির উত্তরে শহর বিশেষ) হিন্দু বণিকগণ গোহত্যা বন্ধ করতে ব্রতী হন। দিল্লির ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মন্তব্য করেন যে হিন্দুরা আর গোহত্যার মাধ্যমে নিজেদের এই প্রাচীন লাঞ্ছনা মেনে নিতে চায় না। সব ঘটনায়ই বায়লী (Bayly ) সাহেবের লেখা থেকে নেয়া।

স্থানীয় পুরবোর্ডগুলোর মাধ্যমে হিন্দুরা গোহত্যা বন্ধ করতে বদ্ধ-পরিকর হন। চাঁদপুরে আইন করে গো-হত্যা বন্ধ করা হয়। মোরাদাবাদ এ চামড়া ব্যবসায়ের সাথে জড়িত নিচু জাতিদের কথা মাথায় রেখে নিয়ম করা হয় যে গরুর চামড়া শহর সীমার বাইরে শুকোতে হবে। বিজনোর শহরের হিন্দু কোতয়ালের দ্বারা সলমান কসাইদের উপর শারীরিক শাস্তিপ্রদান ইতিহাসে নথিভুক্ত। উল্টো দিকে যখন নাজিবাবাদে মিউনিসিপ্যালিটির সংখ্যাধিক সদস্য মুসলমান নির্বাচিত হয়, তখন তারা দলবদ্ধ ভাবে শহরের জায়গায় জায়গায় গোনিধন করে বিজয়-উৎসব পালন করেন। রবিনসন সাহেবের লেখা থেকে এগুলি জানা যায়।

রাজধানী দিল্লীতে  মুঘলরা নামেই রাজত্ব করতো আর ছড়িটি  মিউজিক্য়াল চেয়ারের মতো  শিখ-রাজপূত-জাট-মারাঠা সর্দার, বা রোহিল্লা-আফগান-শিয়া নবাবের অনুগামীদের এবং ব্রিটিশদের মধ্যে ঘুরে বেড়াতো, তাই তার গরু রাজনীতিও চমকপ্রদ। স্পিয়ার সাহেবের লেখা থেকে জানা যায়। ব্রিটিশ রেসিডেন্টদের হিন্দু দিল্লিবাসীরা আবেদন করেন গো-হত্যা বন্ধ করার জন্য। উল্টো দিকে মুসলমানেরা এর তীব্র বিরোধিতা করে যান। মেটক্যাল্ফ সাহেব রেসিডেন্ট থাকাকালীন রেভিনিউ কমিশনার টমাস ফোর্তেস্কুই এর সাথে ঠিক করেন যে গরু-জবাই কোনো ভাবেই শহরের জন-অরণ্যে করা যাবে না, বাড়ির উঠোনের ভেতরেই গরু হত্যা করতে হবে। ১৮৫২ সালে আরেকবার এই নিয়ে ব্যাপক ঝামেলা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট এ. এ. রবার্টস মহাশয়ের নির্দেশে একটি ফর্দ বানানো হয়ে সেইসব লোকেদের এবং ঘরগুলির যারা  দৈনিক গোহত্যা করে মাংস ভক্ষণ করেন। অনেক মুসলমান যাঁরা স্বাস্থ্য, অনুপস্থিতি প্রভৃতি কারণে নিজের নাম জমা দিতে পারলেন না ফের নামলেন নিজেদের হকের লড়াইতে। ব্রিটিশ রেসিডেন্টের ইশারাতেই মুঘল রাজবাড়িও হ্যাঁতে হ্যাঁ মেলালো। ১৮৫৪ সালে ঈদে দিওয়ান-এ-খাস চত্বরে গরুর বদলে জবাই হলো উট। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায় যেখানে হিন্দুদের দাবি সরকার বাহাদুরের চোখে অন্তত কিছু মূল্য রাখে।

১৮৫৭ সালে তিতুমীরের মতন এক দল মন্দবুদ্ধি মুজাহেদীন ও গাজী কাফির-সাম্রাজ্য তাড়াতে উদ্যত হলেন। যদিও বিদ্রোহ শুরু করেছিল কোম্পানির নুন খাওয়া সেপাইরা  যাদের অধিকাংশই হিন্দু এবং তাদের মূল সংশয় পাছে  গরুর মাংসে মুখ দিতে হয়।একাধিক ভারতীয় জাতি নানা কারণে এতে যোগ দ্যান। তেনারাই বা বাদ যায় কেন?

যেই মীরাটের সেনারা তাঁদের ঊর্ধ্বস্তন ইউরোপীয়দের মেরে দিল্লিতে এলেন, দিল্লির ইমাম মৌলভী মুহাম্মদ সাইয়্যিদ জামা মসজিদ এর ওপর থেকে জিহাদের ডাক দিতে শুরু করলেন। ব্রিটিশ রেসিডেন্টের মুন্সী জীবন লাল তার দিননামচাতে লিখছেন যে ধারামপুরের লোকেরা এবং শহরের নিচুতলার সাধারণ মানুষেরা এই ঘোষণাতে রীতিমতো ভয়গ্রস্ত হয়ে পড়েন।  বেঁকে বসেন হিন্দু বণিকগণ এবং মহাজনেরা। মুজাহিদীনদের দিল্লী যাত্রার মূলে আসলে জিহাদ। কিন্তু সেটা করতে যে অস্ত্র লাগে, লোকজন পুষতে যে খাদ্য লাগে, যুদ্ধ জিততে যে বিপুল অস্ত্রের প্রয়োজন, সেটা তারা ভেবেও দেখেন নি। হিন্দুরাও ছিলেন নাছোড়, তাঁদের দাবির মধ্যে অন্যতম গো-হত্যা বন্ধ করতে হবে। এই দাবি মেনে নেওয়ার পরেই হিন্দুরা সেপাই এবং বাকি ইসলামী বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

১৮৫৭এর পরবর্তী অধ্যায়তে গোরক্ষা স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে পড়ে। দেশের সংবিধানের চতুর্থ পার্টের একটি আর্টিকেল পুরোপুরি সমাদৃত, কিন্তু বাঁধ সাধলো “সেক্যুলারিজম”। সেকুরা যে নিজেদের ছেলে মেয়েদের ইংল্যাণ্ডে পাঠাবে মানুষ হতে, বীফ না খেলে কিভাবে হবে তারা ভালো ছেলে? দেশই বা লণ্ডন হবে কি ভাবে? হিন্দুরা কুসংস্কারের ডিপো আর মুসলিমরা বড়ই গেরো প্রকৃতির। তাই দুই বেড়ালের মধ্যে মধ্যস্থতা করার দায়ভার উঠলো সেকু বাঁদরদের ঘাড়ে।

গেঁও-দেহাতী হিন্দুরা কি বুঝবে ফাবিয়ান সোশালিজম এর মাহাত্ম্য! আবার গণতন্ত্র না হলে পূর্ব-উপনিবেশকেরা তুচ্ছ তাচ্ছিলো করবে, তাই গণতন্ত্রই ঘুরিয়ে দেওয়া হলো। গ্রাম কুসংস্কারের ডিপো, তাই পঞ্চায়েত বাদ। সব ক্ষমতা দিল্লীর হাতে, ছুটছাট ক্ষমতা রাজ্যের রাজধানী গুলোর কাছে আর সমগ্র দেশের ভার একদল সরকারি বাবুদের ঘরে। তারা অল্পবিস্তর পড়াশোনা করেছে, তারা জানে ভারতের স্বর্ণযুগ বলে আসলে কিছুই নেই, দেশতো ইংল্যাণ্ডে বানানো এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর আদর্শে দেশ গড়াই শ্রেষ্ঠ উপায়। পাঁচ বছরে একবার ঝাঁকি দর্শন, তাও সেটা মসৃণ করার জন্য FPTP (ফার্স্ট পাস্ট টি পোস্ট-অর্থাৎ ১% এর কম ভোট পেয়েও লোকে ভোটে জিতে যাবে যদি না তার থেকে বেশি ভোট আর কারোর থাকে, দ্বিতীয় রাউণ্ডে কম প্রত্যাশীদের মধ্যে নির্বাচন ফের করানোর প্রশ্নই ওঠে না…)। আবার কংগ্রেস রইলো বহাল। যাতে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কান্নাকাটি আর ঢাকঢোলের মধ্যে আসল প্রশ্ন গুলি চাপা পড়তে থাকে। প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেস মাত্র ৪৫% ভোট পেয়েছিলো। কোনো নির্বাচনেই এই সংখ্যা ৫০% অতিক্রম করে নি।

লোকে বোকা, একমাত্র রাজনীবিদরাই চালাক। তাই রাজ্যসভা, রাষ্ট্রপতি, ন্যায়ালয় সবখানেই তাই তারা ভোট দিয়ে বা নিজেদের ওজন কাতিয়ে বাছাই করা লোক বসাতে ব্যস্ত। আপনি ভাবলেন ৩৩ কোটি লোক এতো নির্বাচন বারবার আয়োজন করা যায় নাকি? মার্কিন সেনেট কিন্তু লোকে সরাসরি নির্বাচন করে। অন্যদিকে অর্থকষ্ট ঘোচাতে অনেক দেশেই লোকে নিজেরাই নির্বাচনের খরচ মেটায় পোল ট্যাক্স দিয়ে। আসলে সবই অজুহাত, গণতন্ত্র চুলকানি, ভারতকে ইংল্যাণ্ড (মৌলবাদীদের দার-উল-ইসলাম, লালদের  ল্যাণ্ড অফ কমিউনিজম) হওয়ার রাস্তায় বাধা দেয়ার জন্য তৈরী স্পিড বাম্পার।

হায়েক (F. A. Hayek) সাহেব আবার মনে করেন বাজার অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র ওতপ্রোতঃভাবে জড়িত। নির্বাচন জিততে লাগে টাকা, টাকা লাগে খবরের কাগজ চালাতে, সংবাদ মাধ্যমের সৌজন্যে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের কাছে তুলে ধরতে। টাকা আর ক্ষমতা ওতপ্রোতঃভাবে জড়িত। এই দুইটি জিনিস আবার narrative  বা ধারাবাহিক স্ববর্ণনা তৈরী করে। নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমে, কফি হাউসে নোয়াম চমস্কিকে (Chomsky ) নিয়ে আর আঁতলামো হয় না নাকি ? ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেণ্টে তিনি তো লিখেই গেছেন সংবাদ মাধ্যম কি ভাবে রাজনীতি ও অর্থনীতির সাথে জড়িত।

এবার গরুর মতো জাবর কাটতে কাটতে ফিরি গোরক্ষার প্রশ্ন তে। গ্রামের দামাল ছেলে; হয় তার গ্রামে স্কুল নেই, বা সরকারী স্কুলের সেকুদের লেখা বই এবং পরিকাঠামোয় আগ্রহ নেই, একটা ব্যবসা চালাতেও সেকু সরকারি বাবুর পায়ের কাছে পড়ে থাকতে হয় কয়েক দিন। সে তো নিরব মোদী বা বিজয় মাল্য নয় যে দিল্লির এক ফোনেই ব্যাঙ্ক তাকে টাকা ধার দেবে, তাকে হাত পাততে হবে পিসি, মাসি, কাকু, মামার কাছে (অথচ সেকুরা বলে জাত-পাত খারাপ জিনিস), টাকার অভাব, সে বেকার, সে তার পছন্দের রাজনৈতিক কারণের পেছনে টাকা ঢালতে পারছে না। টাকা নেই, তাই সুন্দরী রমণীগণ টিভি স্টুডিওর পেছনে তার কারণের জন্য গলা ফাটিয়ে অন্য নেতাদের কাছে জবাব-দিহি চাইছে না।

তার দোষ এটুকুই যে সে মনে করে গরু বাঁচানো উচিত। হবে নাই বা কেন, গরুর রচনা আর এই দেশের ইতিহাস ওতপ্রোতঃভাবে জড়িত, সে তো আর ইতিহাস সেকুদের লেখা বই থেকে শেখে নি, শিখেছে মা বাপের, ঠাকুমা-ঠাকুরদার মুখে সমাজের সাথে মিশে। বামপন্থীদের স্নেহধন্য হলে এটা হয় ওরাল হিস্ট্রি, না হলে গেরুয়াদের বুজরুকি।

চোদ্দ-পুরুষ পেরিয়ে গেলেও গণতান্ত্রিক উপায়ে গরু বাঁচানোর নিয়ম সে কোনোদিন আনতে পারবে না। পাঁচ বছরে একবার ঝাঁকি দর্শন: বিকাশ, বুলেট ট্রেন, GST , ৩৭০, UCC , হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই, তিন তালাক, নিকাহ হালাল ……গ্রামের বাবুরা বুফে টেবিলে গোরক্ষা অবধি এগোতেই পারলেন না, তার আগেই খেল খতম।

অথচ তার জন-প্রতিনিধি না চাইলেও বাইবেল বিশ্বাসী, মনে করেন দিল্লীতে সই করে আইন বানালেই, প্রকৃতি, সমাজ এমনকি ফিজিক্সের তত্ত্বগুলোও তার আইন মানতে বাধ্য। রাজ্য-রাজধানীর অবস্থাও মোটেই আলাদা নয়।

এটা দু তরফেই কাজ করে, যেমন রাজস্থান সরকারের আইন বলে গো-হত্যা নিষিদ্ধ, কিন্তু পুলিশ সেটা বাস্তবায়নে অপরাগ। মানুষ আবেগে এসে গোরক্ষা করলে তার দোষ, রাজ্যের নয়।

দেশের আর্টিকেল ৪৪৮ টি, সবথেকে লম্বা। IPC ও নানা আইন নিয়ে এক লাইব্রেরি বই হয় কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে যে পুলিশ লাগে, আর পুলিশ পুষতে যে অর্থ লাগে সেটাই সেকুদের মাথায় ঢোকে নি, এটাই বা ঢুকবে কি করে যে তাদের গণতন্ত্র সমাজের চাওয়ার প্রতিফলন নয়, পশ্চিমীদের সাথে ডিনার টেবিলে বসে বীফ খেতে খেতে অপরাধবোধে না ভোগার টিকিট মাত্র। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটাই লক্ষ্য, সমাজকে ঠেকিয়ে কি ভাবে ইংল্যাণ্ড বানানো যায়। গরু জবাই এবং গরুর রাজনীতি তাই এর অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ।

গরুর রচনার উপসংহার তাই একটাই, যতদিন না এই এলাকাঠে ভর করে লোক দেখানো গণতন্ত্র দূর করে সংবিধান পাল্টে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা খোল নলচে পাল্টানো হচ্ছে, ততদিন ভারতীয় সমাজ গোরক্ষক দের আদরের চোখেই দেখবে, মন্ত্রীরাও এসে তাদের গলাতে মালা গাঁথবে, নিজেদের ভোটারের চোখে ফুলমার্ক্স তুলতে।

 

References

ইতিহাস বইগুলির লেখকদের নাম উল্লেখ করা আছে সেই ক্রমে যে ক্রমে রচনায় বর্ণিত হয়েছে।

Brown, W. Norman. 1957. “The sanctity of the Cow in Hinduism” in Journal of Madras Unisversity, XXVIII, (38-49)

Gaborieau,  Marc. 1985. “From Al-Beruni to Jinnah: Idiom, Ritual and Ideology of Hindu Muslim Confrontation in South Asia,” in Anthropology Today, Vol. I, No.3 (9)

Elliot, H.M. and Dowson, J. The History of India as Told by its own Historians, vol VII, Kitab Mahal. (454-456)

Gupta,  H. R. Gupta . 1961. Marathas and Panipat, Panjab University. (111)

Dharmpal and T.M. Mukundan. 2002. The British Origin of Cow Slaughter in India, Society for Integrated Development of Himalayas. (83-84)

Bayly, Christopher. 1983. Rulers, Townsmen and Bazaars. North Indian Society in the Age of British Expansion, 1770-1870, Cambridge University Press.(337-338)

Robinson, Francis C.R. 2005 “Living Together Seperately: The Ulema of Firangi Mahall c.1700-c.1950,” in Mushirul Hasan and Asim Roy eds. Living Together Seperately, Oxford University Press (82-83)

Spear, Percival. 2003. A History of Delhi under Later Moghuls, Low Price Publications  (195-197)

আরো দেখুন:

Hayek, F. (2011). The constitution of liberty. London: Routledge.

Herman, E. and Chomsky, N. (2010). Manufacturing consent. Johanneshov: TPB.