বাংলার গণধর্ষিতাদের সুপ্রিম কোর্টে গমন

0
901

পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী হিংসায় তৃণমুল কর্মীরা দুজন বিজেপি কর্মীদের আত্মীয়দের হত্যা করেছিলেন, এই অপরাধে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে অভিযোগ করার পর সুপ্রিম কোর্ট মামলাটিকে গ্রহণ করায় বাংলার আরো অনেক মহিলারা আশান্বিত হয়ে শাসক দল তাঁদের কী প্রকারে ভয়াবহ গণধর্ষণ করেছেন, তাঁর ব্যাখ্যা করে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের দরবারে উপস্থিত হয়েছেন এবং সহিংসতার সমস্ত ঘটনা ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জন্য তদন্তের দাবি করেছেন।

গুজরাটে গোধরার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা এই সেই সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশ উদ্ধৃত করে তাঁরা দাবি করেন যে একইরকম ভাবে আগে নিয়ে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেইরকম গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনাগুলি নিয়ে আদালত নির্দেশিত এসআইটি তদন্তের, যা বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাপক জয়ের ফলে অবিশ্রান্তভাবে চলেছিল।


একজন ৬০ বছর বয়স্কা ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করেন যে ভোটের ফলাফল বেরোনোর পর ৪-৫ তারিখের মাঝের রাতে তাঁর পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামের বাড়িতে তৃণমূল কর্মীরা প্রথমে ঢুকে পড়ে মূল্যবান জিনিস ডাকাতি করতে চেয়েছিল এবং পরে তাঁর ছয় বছরের নাতির সামনে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে গণধর্ষণ করেছিল। তিনি বলেছিলেন যে, যদিও বিজেপি সেই বিধানসভা ক্ষেত্র (খেজুরি) থেকে জিতেছিল, তবুও ১০০-২০০ তৃণমূল সমর্থক ৩রা মে তারিখে তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং বোম মারার হুমকি দেয়। ভয়ে তাঁর পুত্রবধূ পরদিন বাড়ি ত্যাগ করেছিল। মে মাসের ৪-৫ তারিখের মাঝের রাতে, পাঁচজন তৃণমূল কর্মী জোর করে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েন এবং তাঁর শ্লীলতাহানি করেন, খাটিয়ার সঙ্গে বেঁধে তাঁর নাতির সামনেই তাঁকে গণধর্ষণ করেন। সুপ্রিম কোর্টে ভদ্রমহিলা তাঁর আবেদনে এরূপ অভিযোগই করেছেন।


তিনি বলেছিলেন যে পরদিন সকালে তাঁর প্রতিবেশীরা তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করেছিল এবং তাঁকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, যখন তাঁর জামাই পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করতে গিয়েছিল, তখন পুলিশ তাঁকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি। তিনি বলেছিলেন যে রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসায় তৃণমূল কর্মীরা ধর্ষণকে প্রতিশোধ নেওয়া, অপমান করা ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চুপ করিয়ে দেওয়ার একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন।
তিনি বলেছিলেন, “যদিও ইতিহাসে শত্রু দেশের নাগরিকদের ভয় দেখানোর জন্য ও শত্রু গোষ্ঠীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য ধর্ষণকে একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানোর ভয়ঙ্কর ঘটনায় ইতিহাস পরিপূর্ণ, কিন্তু, কোনো মহিলা নাগরিকের বা তাঁর পরিবারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য এমন নিষ্ঠুর অপরাধের নজির একেবারে অপ্রতুল। উপরক্ত অপরাধগুলি রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা উৎসাহ পেয়েছিল এবং আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ভোট পরবর্তী অপমানের ঘটনায় এই অপরাধের প্রতিবাদ করার ঔদ্ধত্য দেখানোর জন্য ধর্ষিতাদের শাস্তি পেতে হয়”।
তিনি এসআইটি/সিবিআই এর তদন্তের দাবি করেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাসক দলের সদস্য উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “স্থানীয় পুলিশ তদন্তটাকে নিয়ে যে নোংরামি করছে, তার মাধ্যমে সহজেই বোঝা গেছে যে, ধর্ষণ করেছিল যে পাঁচজন অভিযুক্ত, তাঁদের সবার নামই ধর্ষিতারা নিয়েছেন এবং স্থানীয় প্রতিবেদন দ্বারা ধর্ষণটিকে নিশ্চিত করা হলেও, পুলিশ ইচ্ছা করে এফআইআরে ওই পাঁচজনের মধ্যে কেবল একজনের নাম লিখেছিল”।
একটি ১৭ বছরের তফসিলি জাতিভুক্ত নাবালিকাও ৯ই মে তৃণমূলের কর্মীরা তাঁকে গণধর্ষণ করেছে, এই অভিযোগের ভিত্তিতে এসআইটি/সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে এবং এই শুনানিটিকে রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছে। সে বলেছে যে তাকে কেবল গণধর্ষণ করে জঙ্গলের মধ্যে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে আসা হয়নি, বরং আদালতে তাঁদের টেনে আনার ঠিক পরের দিন একজন স্থানীয় তৃণমূল নেতা বাহাদুর শেখ তার বাড়িতে এসেছিল এবং তার পরিবারকে অভিযোগ দায়ের করার জন্য হুমকি দিয়ে গিয়েছিল। তিনি হুমকি দিয়েছিলেন যে তিনি তাদের বাড়ী জ্বালিয়ে দেবেন এবং তাদের সবাইকে জ্বালিয়ে মেরে দেবেন যদি তাঁরা কেউ এমন করে, মেয়েটি সুপ্রিম কোর্টে নিজের আবেদনে এমনটাই উল্লেখ করেছিল।
সে বলেছিল, তাকে একটি শিশু কল্যাণ আবাসে রাখা হয়েছিল এবং তার বাবা মাকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সে বলেছিল, “তাকে ও তার পরিবারকে সমবেদনা দেওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় পুলিশ/প্রশাসন কী ব্যবহারটাই না করেছিল। পুলিশ তার পরিবারকে চাপ দিচ্ছে এবং বলছে যে তাদের অপর আরেকটি মেয়েকেও এই একই রকম অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে” এবং সে একটি স্বাধীন তদন্তেরও দাবি করেছিল।
অপর আরেকজন পূর্ণিমা মণ্ডল নামে মহিলা, যাঁর স্বামী ধর্ম মণ্ডলকে ভোট পরবর্তী হিংসায় তৃণমুলের কর্মীরা খুন করেছিল, তিনি সুপ্রিম কোর্টকে বলেছেন যে, “এই হিংসার প্রকৃতি এতই প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল যে আবেদনকারীর স্বামী, যিনি বিজেপির হয়ে প্রচার করতেন, তাঁকে অবিলম্বে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং ১৪ই মে তারিখে দিনের উজ্জ্বল আলোয় কুঠার দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়েছিল। বর্তমান আবেদনকারী তাঁর স্বামী ও দেওরের খুনের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার তাঁকে অসহায়ভাবে সাক্ষ্য দিতে হয়েছে, যেখানে ওই হিংস্র গোষ্ঠীর দুইজন সদস্য তাকে জোর করে বেআব্রু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, জোরে চেপে ধরেছে এবং তিনি কোনোভাবে ধর্ষণ থেকে রেহাই পেয়েছেন। এটি একজন স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধির নির্দেশে হচ্ছিল। এই আবেদনকারীর স্বামী ১৬ইমে মারা যান”।
পূর্ণিমা বলেছিলেন, “পুলিশ আবেদনকারী ও তার পরিবারকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটি অভিযোগ করার জন্য জোর দেওয়ার জন্য বেশি চিন্তিত ছিলে এবং শেষমেশ আহত দেওরের আবেদনে তাঁরা এরূপ একটি করতেও সমর্থ হয়েছিলেন। চাপড়া পুলিশ ঘটনার পুঙ্খানুপূঙ্খ বিবরণ না লিখেই একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির দোষকে সম্পূর্ণ চাপা দিয়ে দিয়েছিল। এই ব্যক্তি কেবল ওই হিংস্র গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তাই নয়, তিনি আবেদনকারীর স্বামীকে আক্রমণ করার ও মেরে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ কালু শেখের আদেশ অনুযায়ী উন্মত্ত জনতার একাংশ যে তাঁর শরীরটিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, সে সম্পর্কেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি”।
তিনি অভিযোগ করেন, “এই ঘটনার পরে যখন আবেদনকারী ভেঙে পড়েছিল, তখন সে কেবল তার স্বামীর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পরেই পুলিশের কাছে গিয়ে একটি বিস্তারিত অভিযোগ করার জন্য যেতে পেরেছিল, কিন্তু তিনি নিজে সেই অপরাধের একজন সাক্ষী ও স্বয়ং এর শিকার হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ কেবল তাঁর বয়ান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, তা নয়, তাঁরা তাকে গালিগালাজ করেছে এবং থানার বাইরে জোর করে বার করে দিয়েছে”।

লেখাটি টাইমস অফ ইন্ডিয়া থেকে অনূদিত, অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।