‘এক চুটকি সিন্দুর কি কিমত’ — একটা পশ্চিমবঙ্গ

0
1575

-বজ্রবাহু সান‍্যাল

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় নাট্যাভিনেতা, চলচ্চিত্র তারকা চঞ্চল চৌধুরী। সেদেশের বিনোদন জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। সুলভ নেট তাঁর জনপ্রিয়তাকে কাঁটাতারের সীমানা পার করে এই বাংলার মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তকদীর’ নামক একটি ওয়েব সিরিজ হিন্দিভাষী দর্শকদের সাথেও তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয় দক্ষতার পরিচয় ঘটিয়েছে।

এহেন চঞ্চল চৌধুরী গত ৯ই মে আন্তর্জাতিক মাতৃদিবসে তাঁর মায়ের সাথে একটি ছবি আপলোড করে চূড়ান্ত বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, তাঁর মায়ের সিঁথির সিঁদুর এই বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়!! বিস্মিত বাকরুদ্ধ ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশি মুসলিম সমাজ ছবির কমেন্ট বক্সে চঞ্চলবাবুর হিন্দু পরিচয়ের জন্য ক্ষোভ ঘৃণা উগড়ে দিতে থাকে। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ তাঁকে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার ‘উদাত্ত আহ্বান’-ও জানিয়ে রেখেছে।

চঞ্চল বাবু আহত হয়েছেন, আমরা বিস্মিত হয়েছি। শেখ মুজিবের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এ কি প্রতিচ্ছবি!! চঞ্চল বাবু আরও খেদ ব্যক্ত করে বলেছেন যে তাঁর সহকর্মী শিল্পী, কলাকুশলীবৃন্দ এই জঘন্য ঘটনার কেউ কোন প্রতিবাদ করলেন না।

চঞ্চলবাবু কিংবা আমরা যদি বাংলা সাহিত্যের সবথেকে জনপ্রিয় সাহিত্যিক স্বকীয়তায় উজ্জ্বল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুরদৃষ্টিসম্পন্ন উক্তি যদি এই বিষয়ে জানতাম, তাহলে হয়ত আজ বিস্মিত হওয়ার অবকাশ থাকত না। অবিভক্ত বঙ্গে ‘এক চুটকি সিঁদুর’ পরার মূল্য কী’ভাবে হিন্দু মহিলারা চোকাতেন, সে ব্যাপারে আলোকপাত করতে গিয়ে কথাশিল্পী তাঁর ‘বর্তমানের হিন্দু-মুসলিম সমস্যা’ প্রবন্ধে লিখেছেন-

“হিন্দুনারীহরণ ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন, মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁহাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃ পুনঃ এত বড়ো অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কীসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দে থাকার অর্থ কী? কিন্তু আমার তো মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল৷ তাঁহারা শুধু অতি বিনয়বশতঃই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করব কী, সময় এবং সুযোগ পেলে ও-কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি’৷”

শরৎচন্দ্র ‘চাড্ডি’ অর্থাৎ বিজেপি আরএসএস সদস্য ছিলেন না। তাঁর বিদ্যাবুদ্ধির বিচার করার ধৃষ্টতা আমাদের নেই, শুধু বক্তব্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার করার ক্ষমতাটুকু আছে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলায় বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে ঢাকায় তার সমর্থনে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের উপর পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ ‘লাল ইশতেহার’ নামক কুখ্যাত প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিভীষিকা নামিয়ে আনে। অরুণ মুখার্জীর ‘পাবলিক ডিজর্ডার ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ বই থেকে জানা যায়, ১৯০৬-১৯১২ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দু সমাজের উপর ছোটবড় ২০০টি অত্যাচারের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও এই অত্যাচার থামেনি। ১৯২৪ সালের পাবনা গণহত্যা, ১৯৩০ সালের ঢাকা কিশোরগঞ্জ গণহত্যা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বস্তুতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমভাগে উদ্বাস্তু স্রোত দেশভাগের ত্রিশ বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় এমনকি দেশভাগের পরেও ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৭১, ১৯৯২ সালে বাঙ্গালী হিন্দুরা ভূমিহীন হয়ে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে থাকে। তাই ‘উদ্বাস্তুরা দেশভাগের বলি’ — এটি একটি আদ্যন্ত মিথ্যা অপপ্রচার।

বিষয়টি আরেকটু বিশদে ব্যাখ্যা করা যাক। ১৯৬৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ থেকে নবী হজরত মহম্মদের সংরক্ষিত চুল উধাও হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে পূর্ববঙ্গ সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে জ্বলে উঠেছিল!!! তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুস সাবুর খান ও আব্দুল হাই নামের অপর একজন বাংলাভাষী মুসলিম নেতার নেতৃত্বে খুলনায় ১৯৬৪ সালে ৪ই জানুয়ারি হিন্দু গণহত্যার আয়োজন হয়। বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ কোম্পানি ইস্পাহানি মুসলিম আক্রমণকারীদের আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেছিল। শুধু মংলা বন্দরেই ওইদিন প্রায় ৩০০ হিন্দু নিহত অথবা আহত হয়েছিল। দাঙ্গা রাজশাহী, ময়মনসিঙ্ঘ, সিলেট ও রাজধানী ঢাকাতেও ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। যদিও বাংলাদেশের হতভাগ্য হিন্দুদের সাথে হজরতবালের ঘটনার কী সম্পর্ক থাকতে পারে, তা দূরতম কল্পনাতেও ‘সুস্থ মস্তিষ্কে’ বোঝা অসাধ্য!!

১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারতের উত্তরপ্রদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে হিন্দুদের উপর ঈমানী জনতার আক্রমণ শুরু হয়। খোদ ঢাকা শহরে ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির সহ হিন্দুদের বহু প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ক্ষেত্র ধ্বংস করা হয়। মাণিকগঞ্জ থেকে ময়মনসিঙ্ঘ, নরসিংদী থেকে নারায়ণগঞ্জ সর্বত্র ইসলামিক মৌলবাদী হিংসার বলি হন হিন্দুরা। এবারেও উত্তরপ্রদেশের ঘটনার জন্য বাংলাদেশের হিন্দুরা কী’ভাবে দায়ী — তা দুর্বোধ্য থাকে।

ভারতীয় বিপ্লবী চিন্তাধারার জনক বিপিনচন্দ্র পাল ১৯১২ সালে ‘বিজয়া’ পত্রিকায় ‘রাষ্ট্রনীতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “ভারতীয় মুসলমানেরা আগে মুসলমান, পরে ভারতীয়। সৈয়দ আমির আলির মত মুসলমান নেতারা বলেন যদি ইসলামিক দেশ থেকে আক্রমণকারীরা আসে, তবে ভারতের মুসলমানদের দায়িত্ব হল ভারতের বিরুদ্ধে সেইসব আক্রমণকারীকে সাহায্য করা। কারণ মুসলমান আইডেন্টিটি তাঁদের কাছে অধিক জরুরি।‘ তাঁর আশঙ্কা যে একেবারেই অমূলক ছিল না, তা কয়েক বছরের মধ্যেই খিলাফত আন্দোলনের সময় পরিষ্কার হয়ে যায়। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের খলিফাকে তাঁর হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ তৈরি করা। কোন রাখঢাক না করেই খিলাফত আন্দোলনের প্রধানতম হোতা শওকত আলি ও মুহাম্মদ আলি বলেছিলেন, ”ভারতের মুসলিমদের স্বার্থ ভারতীয় হিন্দুদের সাথে এক নয় বরং তা ত্রিপোলি, আলজেরিয়া বা বিশ্বের যেকোন প্রান্তের মুসলিমের সঙ্গে এক।“ ১৯২৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ন্যাশনালিটি এন্ড এম্পায়ার্স’ বইয়ের ‘ন্যাশনালিজম এন্ড পলিটিক্স’ প্রবন্ধে বিপিনচন্দ্র তাই লিখেছিলেন, “ভারতের কাছে ভবিষ্যতে ব্রিটেন বা ইউরোপ নয়, আসল বিপদ হয়ে উঠবে প্যান-ইসলামিজম।”

দেখা যাচ্ছে উপরোল্লিখিত বাংলাদেশের দুটি ঘটনায় যে প্রশ্নের উত্তর পাঠক হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন, তা বিপিনচন্দ্র পালের মত প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব কয়েক দশক আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙ্গালী নয়, বরং তারা বৃহত্তর ইসলামিস্ট জাতিসত্ত্বার অংশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নেশন কী?’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন- “ভাষাই জাতির একমাত্র পরিচয় একথা ঠিক নয়।”

গত ২০শে জুন ছিল বেসরকারি পশ্চিমবঙ্গ দিবস। প্রভাবশালী মহল এটিকে বঙ্গভঙ্গ দিবস, কালা দিবস ইত্যাদি নানাভাবে নামাঙ্কিত করে গ্রেট ক্যালকাটা থেকে নোয়াখালী অনেক হিন্দুর রক্তের দাগ মোছার অপচেষ্টায় রত থাকে। কিন্তু সত্যিটা এটাই যে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা থেকে ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার থেকে বিজ্ঞানী শিশির মিত্র, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ থেকে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার সেদিন ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বেঙ্গল পার্টিশন লীগের উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন, যাতে পশ্চিমবঙ্গে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ গাঙ্গুলী, মিমি চক্রবর্তীদের হিন্দু আচার পালন করলে চঞ্চল চৌধুরীর মত কটূক্তি, ঘৃণার সম্মুখীন না হতে হয়। যাতে বিশ্বের কোন প্রান্তে কোন মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ছুতোয় যেন বাঙ্গালী হিন্দুর ধনপ্রাণ মানসম্মান বারংবার ভুলুণ্ঠিত না করার সুযোগ মৌলবাদীরা পায়।