পূর্ণ হিন্দুত্ব ২: হিন্দু ধর্মতত্ত্ব

0
3556

ইতিপূর্বে লেখক বঙ্গদেশে বাঙ্গালীর জাতিসত্তা নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করেছেন। এবার হিন্দুত্বের পালা। জাতিসত্তার পাঠ ছাড়া রাষ্ট্রসত্তার পাঠ অসম্পূর্ণ। তাই পাঠককে অনুরোধ করবো এই প্রবন্ধটিও পড়তে।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পূর্ণ হিন্দুত্ব ২: হিন্দু ধর্মতত্ত্ব


বিষয়সূচী
হিন্দুধর্ম প্রসঙ্গে
ধর্মের চার প্রকার ব্যাখ্যা
হিন্দুধর্মের আবির্ভাব
হিন্দুধর্মের মৌলিক সিদ্ধান্ত
হিন্দু সাধনপথ
হিন্দু দেবতত্ত্ব
হিন্দু সম্প্রদায়
শ্রীমদ্ভগবদগীতার অবতারতত্ত্ব
আব্রাহামীয় ধর্মমতের সাথে হিন্দুধর্মের পার্থক্য 

পরিভাষাকোষ
জাত – Caste
জাতি – Ethnic group
জাতিসত্তা, জাতীয়তা – Ethnicity
জাতীয় – Ethnic
দেশ, বর্ষ – Country
প্রশাসন – Administration, Management
রণ-রাজনীতি – Geopolitics
রাষ্ট্র – Nation (Country অর্থে)
রাষ্ট্র-জাতি – Nation (People অর্থে)
রাষ্ট্রবাদ – Nationalism
রাষ্ট্রবাদী – Nationalist
রাষ্ট্রসত্তা, রাষ্ট্রীয়ত্ব – Nationality
রাষ্ট্রীয় – National
স্বরাজ্য – Nation-State
শাসনশক্তি – State
শাসনযন্ত্র – State machinery 

হিন্দুধর্ম প্রসঙ্গে

হিন্দু ধর্মতত্ত্ব প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে একটা বিষয় আমাদের ভেবে দেখা উচিত—হিন্দুধর্ম আজ যে রূপে পালিত ও প্রতিভাত, তার দার্শনিক ব্যাখ্যা যে রূপে প্রচলিত, তা কি হিন্দু জাতির অস্তিত্বের সংগ্রামের পক্ষে সহায়ক? মোক্ষ প্রাপ্তির উপায়, সংসার বৈরাগ্য তথা সন্ন্যাসের আদর্শই কি হিন্দুধর্মের একমাত্র শিক্ষা? এরূপ শিক্ষা কি জাতিকে সবল করে তুলতে পারে? এ প্রসঙ্গে মতিলাল রায়কে এক পত্রে শ্রীঅরবিন্দ লিখেছিলেন,

Renunciation of life is one thing, to make life itself, national, individual, world-life greater and more divine is another. You cannot enforce one ideal on the country without weakening the other. You cannot take away the best souls from life and yet leave life stronger and greater.

(বঙ্গানুবাদ: ব্যক্তি জীবন, জাতীয় জীবন এবং মানবজীবনকে উন্নত ও দিব্য করে তোলা, আর সংসার ত্যাগ ভিন্ন বস্তু। এর কোন একটিকে জাতির আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে হলে অপরটির প্রভাব দুর্বল হতে বাধ্য। জাতির সর্বোত্তম ব্যক্তিদের সংসার হতে নিবৃত্ত করে জাতীয় জীবনকে উন্নততর ও মহত্তর করা যায় না।)[1]

স্বামী বিবেকানন্দও এই সমস্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সন্ন্যাসী হয়েও উদ্বোধন পত্রিকার প্রস্তাবনায় তিনি লিখেছিলেন,

ত্যাগের অপেক্ষা শান্তিদাতা কে? অধ্যাত্মবিদ্যার তুলনায় আর সব ‘অবিদ্যা’—সত্য বটে, কিন্তু […] সে মহাবীরত্ব কয়জনের আছে, নির্মম হইয়া সর্বত্যাগী হন? সে বিশাল হৃদয় কোথায়, যাহা সৌন্দর্য ও মহিমাচিন্তায় নিজ শরীর পর্যন্ত বিস্মৃত হয়? যাঁহারা আছেন, সমগ্র ভারতের লোকসংখ্যার তুলনায় তাঁহারা মুষ্টিমেয়।—আর এই মুষ্টিমেয় লোকের মুক্তির জন্য কোটি কোটি নরনারীকে সামাজিক আধ্যাত্মিক চক্রের নীচে নিষ্পিষ্ট হইতে হইবে?[2]

ভিন্ন আঙ্গিক থেকে রবীন্দ্রনাথও অনুভব করেছিলেন ধর্মশিক্ষায় নূতনত্বের প্রয়োজনীয়তা। শাস্ত্রচর্চায় ত্যাগ, বৈরাগ্য, মোক্ষ ইত্যাদি গুরুত্ব পেলেও লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে রামায়ণ-ভাগবত প্রভাবিত যাত্রা-কথকতায় “দেবতা সাধু পিতা গুরু ভাই ভৃত্যের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য, তাঁহাদের জন্য কতদূর ত্যাগ করা যায়”[3] ইত্যাদির শিক্ষা হিন্দু সমাজে বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, “সেইসঙ্গে সাধারণের প্রতি, দেশের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য তাহাও নূতন করিয়া আমাদিগকে গান করিতে হইবে…।”[4]

বর্তমান ধর্মীয় শিক্ষা যখন জাতিগঠনের সহায়ক নয়, তখন সমকালীন হিন্দুধর্মের পুনর্মূল্যায়ন কি বাঞ্ছনীয় নয়? যে হিন্দুধর্মকে আমরা ধর্মতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব অধ্যায়ে উপস্থাপন করেছি তা সেই ধর্ম যা আমাদের জাতি ও সংস্কৃতিকে বলীয়ান করে তুলতে সহায়ক হবে।

ধর্মের চার প্রকার ব্যাখ্যা

হিন্দুধর্ম কী? ‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি সিন্ধু শব্দের অপভ্ৰংশ হতে। ভারতবর্ষে উদ্ভুত বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, সার্না ধর্ম সহ সকল ধর্মীয় মত এই সুবিশাল হিন্দুধর্মের অন্তর্গত। কিন্তু হিন্দুধর্মের আরও বিস্তৃত পরিচয় দেবার পূর্বে ‘ধর্ম’-এর অর্থ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

ধর্মকে আমরা সাধারণতঃ চার রূপে ব্যাখ্যা করে থাকি:

১. ঋগ্বেদের ‘ঋত’ অর্থাৎ প্রাকৃতিক রীতি বা ধর্ম অর্থে—যেমন বৃদ্ধি-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু শরীরের ধর্ম, কর্ম অনুযায়ী ফল প্রাপ্তি, অথবা জলের ধর্ম উপর হতে নীচে প্রবাহিত হওয়া। ধর্ম শব্দ উৎপন্ন হয়েছে ‘ধৃ’ ধাতু থেকে যার অর্থ ধারণ করা। উপরোক্ত সকল প্রাকৃতিক রীতি স্থূল এবং সূক্ষ্ম জগৎকে পরিচালিত করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে, সুতরাং এসবের সমষ্টি হলো ধর্ম।

২. কর্তব্য বা নৈতিক কর্ম—যেমন পিতা-মাতার সেবা, শিক্ষার্থী জীবনে বিদ্যা ও শরীর চর্চা, চাকরি ও ব্যবসায় সততা, দেশ ও সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন ইত্যাদি। কর্তব্যকে ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে কারণ কর্তব্যকর্ম করলে পরে নিজের ও অপরের জীবন বর্ধিত এবং বিধৃত হয়—‘যেনাত্মনস্তথান্যেষ্যাং জীবনং বর্ধনাঞ্চপি ধৃয়তে সঃ ধর্ম্মঃ’। অনৈতিক বা কর্তব্যকর্ম বিরোধী কিছু করা হলে ফল হয় অন্যথা, সুতরাং তা অধর্ম।

৩. যা আমাদের দৈহিক, মানসিক ও লৌকিক উন্নতির সহায়ক, এবং মোক্ষ বা জন্মজন্মান্তর থেকে মুক্তি প্রদায়ক তাই ধর্ম—যেমন মহর্ষি কণাদ তাঁর বৈশেষিক সূত্রে লিখেছেন, ‘যতো অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ’।

৪. ধর্মমত বা religion—যেমন হিন্দুধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ইত্যাদি। সকল ধর্ম সমান নয়। যারা মনে করে সকল ধর্মই সমান, তারাও কিন্তু আফ্রিকার পিগমিদের ধর্মকে উৎকর্ষতার নিরিখে বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর সাথে একাসনে বসাবে না। এর মুখ্য কারণ পিগমিরা সংখ্যায় কম এবং তথাকথিত সভ্য জগতের বহির্ভূত। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রমাত্মক কারণ এক সাধকের আধ্যাত্মিক উচ্চতা যেমন তাঁর শিষ্য সংখ্যা বা আশ্রমের বৈভব দ্বারা পরিমাপ করা যায় না, তেমনই কোন ধর্মমতের অনুসারীদের সংখ্যা কয়েক কোটি হলে বা তাদের দ্বারা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলেই তাদের ধর্মমত মহৎ বা উন্নত হয়ে যায় না। একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা ও দর্শন দ্বারা ধর্মমত সকলকে উত্তম-মধ্যম-অধম, দৈবিক-আসুরিক, ধর্ম-অপধর্ম প্রভৃতি ভাগে চিহ্নিত করা যায়। যে ধর্মশিক্ষা মানুষকে ‘অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়স’-এর (উপরোক্ত তৃতীয় ব্যাখ্যা) পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে তাই উত্তম বা দৈবিক ধর্ম। যে ধর্মশিক্ষায় হিংসা-দ্বেষের মাধ্যমে লৌকিক উন্নতি হয়, এবং স্বাভাবিকভাবেই যেখানে মোক্ষের কোন ধারণা নেই, তা আসুরিক ধর্ম। যে ধর্মশিক্ষা মোক্ষকামী হলেও মানুষের লৌকিক উন্নতি বা মোক্ষ কোনটিরই সহায়ক নয়, বরং তার পরিপন্থী তা অপধর্ম।

হিন্দুধর্মের আবির্ভাব

আমাদের আলোচনার বিষয় ধর্মমত। মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই ধর্মমতের উদ্ভব। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা অন্যান্য মতবাদের সাথে ধর্মীয় মতবাদের একটি মৌলিক পার্থক্য, এর কেন্দ্রে রয়েছে পরকালের ভাবনা—ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী তত্ত্বের অবতারণা তারই ফলশ্রুতি মাত্র। মৃত্যুর পর জীবের কী হয়? জন্মের পূর্বে সে কোথায় ছিল? কোন শক্তি আমাদের জন্ম-মৃত্যুকে পরিচালিত করে? একাধারে মৃত্যু ভয়ে ভীত এবং অমরত্বের অভিলাষী মানুষ সেই আদি যুগ থেকেই এইসব প্রশ্ন নিয়ে বিব্রত হয়েছিল।

অন্যান্য দেশ-মহাদেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিল নিজেদের কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিয়ে, কোথাও আবার অতীন্দ্রিয় জগতের আভাসও তারা পেয়েছিল। কিন্তু একমাত্র আমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষেই, সেই সুদূর বৈদিক যুগে আমাদের কতিপয় পূর্বপুরুষ ঈশ্বরের অমোঘ আশীর্বাদে, এক অতি উচ্চ চেতনার স্তরে উন্নীত হয়ে সেই সকল প্রশ্নের সদুত্তর পেয়েছিলেন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ, জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্ক, জন্ম-মৃত্যুর রহস্য তাঁরা অবগত হয়েছিলেন সেই উন্নত মনোভূমিতে অধিষ্ঠিত হয়ে। তাঁদের আবিষ্কৃত এই সকল সত্য দেশ-কালের দ্বারা সীমিত নয়, তাই এই সত্যের উপর আধারিত যে ধর্মমত সেই হিন্দুধর্মের অপর নাম সনাতন ধর্ম।

হিন্দুধর্মের মৌলিক সিদ্ধান্ত

সেই অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি থেকে যে সাহিত্য ঋষি-মুনিরা রচনা করেছেন, তাকে বলে হিন্দু শাস্ত্র। হিন্দুধর্মের আদি শাস্ত্র চতুর্বেদ—ঋক, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব। প্রত্যেক বেদের আছে চার বিভাগ—সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ বা বেদান্ত। তৎপরবর্তী কালে আবির্ভাব হয় ছয়টি মুখ্য দর্শনের—ঋষি গৌতমের ন্যায়, ঋষি কণাদের বৈশেষিক, মহর্ষি পতঞ্জলির রাজযোগ, বঙ্গের কপিল মুনির সাংখ্য, এবং বেদের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডকে ভিত্তি করে পূর্ব ও উত্তর মীমাংসা। রামায়ণ, মহাভারত, অষ্টাদশ পুরাণ এবং বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত আগম শাস্ত্র রচিত হয় তার অনেক পরে।

এসকল শাস্ত্ররাজি থেকে আমরা হিন্দুধর্মের কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি—

ক। পুনর্জন্ম-জীবাত্মা-কর্মফল: মৃত্যুর পর জীবের পরিণাম কি? একাধারে মৃত্যু ভয়ে ভীত এবং অমরত্বের অভিলাষী মানুষের ধর্মজিজ্ঞাসার মুলে আছে এই প্রশ্ন। সকল ধর্মমতের ভাবনার কেন্দ্রে আছে এই প্রশ্নের সমাধানের প্রচেষ্টা। ভারতের সত্যদর্শী ঋষিমুনিগণ যুগ যুগান্তরে ঘোষণা করে গেছেন, মৃত্যুই শেষ কথা নয়, মৃত্যুর পর পুনরায় দেহপ্রাপ্ত হয়ে জীব জন্ম গ্রহণ করে। এই মধ্যবর্তী যাত্রা সম্ভব হয় কারণ ব্যক্তির ধ্রুব সত্তা তার দেহ নয়, আত্মা। মৃত্যুর সময় সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর সহযোগে আত্মা স্থুল শরীর ত্যাগ করে এবং পুনরায় গর্ভে স্থুল দেহে প্রবেশ করে নব জন্ম লাভ করে। এই আত্মার বৈশিষ্ট্য উক্ত হয়েছে শ্রীশ্রীগীতার তিনটি বিখ্যাত শ্লোকে—

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ৷
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে৷।। ২/২০
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷
ন চৈনং ক্লেদযন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। ২/২৩
অচ্ছেদ্যোযমদাহ্যোযমক্লেদ্যোশোষ্য এব চ৷
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোয়ং সনাতনঃ।। ২/২৪

(বঙ্গানুবাদ:

এই আত্মা কখনো জাত বা মৃত হন না। তাঁর উৎপত্তি বা বিনাশ হয় না। আত্মা জন্মরহিত, শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন। দেহ নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হন না। শ্রীমদ্ভগবদগীতা ২/২০

অস্ত্র আত্মাকে ছেদন করতে পারে না, অগ্নি ইহাকে দগ্ধ করতে পারে না, গেল আত্মাকে আর্দ্র করতে পারে না এবং বায়ু ইহাকে শুষ্ক করতে অক্ষম। শ্রীমদ্ভগবদগীতা ২/২৩

এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, নিত্য, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন। শ্রীমদ্ভগবদগীতা ২/২৪)

বারংবার জন্মলাভের কারণ আমাদের কর্মফল। পূর্ব পূর্ব জন্মের যে কর্মের ফল এখনো ভোগ করা হয়নি, তা সঞ্চিত; সঞ্চিতেরর যে অংশ এই জন্মে ভোগ করতে হবে, তা প্রারব্ধ; এই জন্মের কর্মের ফলে যা আমার ‘একাউন্ট’-এ জমা হচ্ছে তা ক্রিয়মান।

এই সকল সিদ্ধান্ত কি নিতান্তই মনগড়া? Speculative? তা নয়। যোগ-তন্ত্রে যে সপ্তচক্রের কথা আছে—মূলাধার হতে সহস্ররার—তা চেতনার বিভিন্ন স্তর। সাধনপ্রসূত চিত্তশুদ্ধির ফলে মানুষ অতীন্দ্রিয় জগতের সাথে পরিচিতি লাভ করে। ক্রমে একটি স্তরে উপনীত হলে ইষ্ট দেবতা, গুরু বা কোন সিদ্ধ মহাত্মা দ্বারা, অথবা অন্য কোনভাবে (যেমন, সিনেমার পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার মতো করে) জন্মান্তর ও কর্ম রহস্য, ত্রিগুণ তত্ত্ব, জগৎ ও আত্মার স্বরূপ প্রভৃতি সম্পর্কে সাধক জ্ঞান লাভ করেন। এমন একটি দৃষ্টান্ত পাই শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়—

“তিনি শুধু অন্তরে নয়। অন্তরে বাহিরে! কালীঘরে মা আমাকে দেখালেন সবই চিন্ময়!—মা-ই সব হয়েছেন!—প্রতিমা, আমি, কোশা, কুশি, চুমকি, চৌকাট, মার্বেল পাথর,—সব চিন্ময়!”[5]

উচ্চতর চেতন ভূমি থেকে এই যে দর্শন, এ যেন অনেকটা মহাকাশে পাড়ি দিয়ে আবিষ্কার করা যে আমাদের পৃথিবী গোলাকার এবং সূর্যকে সে প্রদক্ষিণ করে, অথচ পৃথিবীতে থেকে আমাদের মনে হয় এই গ্রহ সমতল, এবং সূর্যই প্রত্যেক দিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে! এসব দর্শন যে মনের বিকার নয়, তার প্রমাণ সাধন উপলব্ধি শুধু দর্শনেই সীমিত থাকে না, সাথে প্রকাশিত হতে থাকে যোগবিভূতির লক্ষণ, বিশেষ করে অন্তর্যামিত্ব। মহর্ষি পতঞ্জলির যোগ সূত্রে সাধনার অন্তিম অবস্থা আলোচনার পূর্বে তৃতীয় অধ্যায়, বিভুতিপাদে আছে বিভিন্ন বিভূতির লক্ষণ, যা যুগ যুগ ধরে সকল উচ্চকোটির সাধকের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে আসছে।

খ। ঈশ্বর-ভগবান-ব্রহ্ম: বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মুলে যিনি, সেই পরম চৈতন্যময় সত্তাকে নির্গুণ রূপে দেখলে তিনি ব্রহ্ম, সগুন রূপে তিনি ঈশ্বর (জগতের উপর যাঁর ‘ঈশিত্ব’ বা প্রভুত্ব আছে) বা ভগবান। ভগবান বা ভগবতী শব্দের অর্থ ‘ভগ’ বা ছয়টি গুণ—ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, বৈরাগ্য এবং জ্ঞান—যাঁর মধ্যে সমন্বিত। তিনি ‘সৎ’, তাঁর আদি বা অন্ত নেই; তিনি সর্বব্যাপী, নিখিল ব্রহ্মাণ্ডে তিনি বিনা দ্বিতীয় নেই—

ঈশাবাস্যং ইদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ (ঈশোপনিষৎ, ১)

তিনি সকল জীবের অন্তরে বিরাজ করেন, তিনিই সকলের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়ের আধার—

অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ৷
অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ।। (শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ১০/২০)

তিনি সৎ, এক এবং অদ্বিতীয়, কিন্তু প্রাজ্ঞগণ তাঁকে নানা দেবতা রূপে আহ্বান করেন—

ইদ্রং মিত্ৰং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।। (ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৬)

আর সেই অদ্বয় জ্ঞানকে উপলব্ধি করে [জ্ঞানী, যোগী এবং ভক্ত] তত্ত্ববিদগণ নিজেদের ভাব ও সাধন অনুযায়ী সেই তত্ত্বকে যথাক্রমে ‘ব্রহ্ম’, ‘পরমাত্মা’ ও ‘ভগবান’ শব্দ দ্বারা অভিহিত করে থাকেন— 

বদন্তি তত্তত্ত্ববিদ্বস্তত্ত্বং যজজ্ঞানমদ্বয়ং।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে।। (শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/১১)

বিভিন্ন সম্প্রদায়ে ঈশ্বরের, এবং জীব ও ঈশ্বরের সম্বন্ধ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এর কারণ ত্রিবিধ—

প্রথম কারণ, যৌগিক দৃষ্টিতে ঈশ্বরোপলব্ধি ঘটে ষট্চক্র পেরিয়ে, অর্থাৎ প্রকৃতি রাজ্যের ওপারে, যা বাক্য ও মনের অতীত। এই অনির্বচনীয় অনুভূতিকে সাধক তাঁর সম্প্রদায় বা পরম্পরার ভক্তদের কাছে প্রকাশ করেন এমনভাবে যা তাদের বোধগম্য।

দ্বিতীয়তঃ, সাধকের ব্যাখ্যা তাঁর সংস্কার এবং সাধনমার্গ দ্বারাও প্রভাবিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন মা কালীর সাধক, স্বাভাবিকভাবে তাঁর প্রবচনে, উপদেশে অন্যান্য দেবদেবীর তুলনায় মায়ের স্থান ছিল মুখ্য। তাঁর পূর্বোক্ত মন্তব্য, ‘মা-ই সব হয়েছেন’ কোন বৈষ্ণব সাধকের মুখে হয়ে যাবে “শ্রীকৃষ্ণই সব হয়েছেন”।

তৃতীয়তঃ, সিদ্ধ সাধকের শিষ্য-প্রশিষ্যগণ তাঁদের পরম্পরার প্রচার হেতু নিজেরাও সাহিত্য সৃষ্টি করে থাকেন। সাধারণতঃ, পরম্পরার স্থপয়িতাদের দর্শনের ভাষ্য এঁদের দ্বারাই রচিত হয়, এবং ক্রমে সেই সকল সাহিত্যকর্ম মূল শিক্ষার থেকে মুখ্য হয়ে ওঠে। বৌদ্ধ এবং গৌড়ীয় ধর্মতত্ত্ব এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শ্রীবুদ্ধ জগতের স্বরূপ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতেন না, অন্যকেও নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি জোর দিতেন ক্রিয়ামূলক আধ্যাত্মিকতায়। একবার তাঁর শিষ্য মালুঙ্ক্যপুত্র (পালি ভাষায় মালুঙ্ক্যপুত্ত) এইসব প্রশ্ন নিয়ে পীড়াপীড়ি করলে শ্রীবুদ্ধ বলেন,

“ধরো যে একজন লোক বিষাক্ত তীর দ্বারা আহত এবং তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন বৈদ্যকে ডাকতে চলেছে। কিন্তু সে যদি তাদের থামিয়ে বলে, ‘আমাকে যে তীর ছুঁড়েছে তার জাত না জানলে আমি এই তীরটি সরাতে দেব না। আমাকে জানতে হবে তার উচ্চতা, তাঁর পরিবার কোথা থেকে এসেছে, তারা কোথায় থাকে, কী ধরণের কাঠ থেকে এই ধনুক তৈরি হয়েছে, তীরটি কে তৈরি করেছিল। একমাত্র এসব প্রশ্নের উত্তর পেলেই তীরটি আমি বের করতে দেবো, এবং এর বিষের প্রতিষেধক নেবো।’ এমন লোকটি সম্পর্কে তুমি কী বলবে?”

“লোকটি নির্বোধ,” মালুঙ্ক্যপুত্র উত্তর দিলেন, “কারণ এ সকল প্রশ্ন তাকে তীরমুক্ত করবে না, উত্তর পাবার আগেই সে মারা যাবে।”

তথাগত এবার বোঝালেন, “ঠিক একইভাবে, মালুঙ্ক্যপুত্র, জগৎ সৎ কি অসৎ, তা অনন্ত না সানন্ত, দেহ আর আত্মা এক কিনা, মৃত্যুর পর নির্বাণপ্রাপ্ত মানুষের অস্তিত্ব থাকে কিনা প্রভৃতির শিক্ষা আমি দিই না। আমি শুধু শেখাই কিভাবে মানুষ সেই তীর হতে মুক্ত হবে, আমি শেখাই দুঃখের স্বরূপ কি, কিভাবে তার উৎপত্তি ও বিনাশ হয়, আর শেখাই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ [সেই দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে]।”[6]

দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে শ্রীবুদ্ধের এই অবস্থান সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্মে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দার্শনিক ঘরানা, রচিত হয়েছে অসংখ্য দার্শনিক গ্রন্থ ও ভাষ্য। একই কথা প্রযোজ্য শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরার ক্ষেত্রে। যিনি ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা, যাঁর প্রণীত সাহিত্যকর্ম মাত্র আট শ্লোকে (‘শিক্ষাষ্টকম্’) সীমিত, তাঁর অনুগামীদের মধ্যে সেখানে কালান্তরে গড়ে উঠেছে নানা মতবাদ, সৃষ্টি হয়েছে সুবিশাল সাহিত্য ভাণ্ডারের।

হিন্দু সাধনপথ

পূর্বোক্ত সকল সত্যদ্রষ্টাগণ হলেন আমাদের পরম পূজ্য মুনি-ঋষিগণ। তাঁরা শুধু ঈশ্বরদর্শন করে ক্ষান্ত হননি, পরন্তু হিন্দু তথা সমগ্র মানব সমাজকে সেই সচ্চিদানন্দ পরম পুরুষকে উপলব্ধি করার সাধনপথ নির্দিষ্ট করে গেছেন। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে সাধনা তিন প্রকার—বৈদিক, তান্ত্রিক ও মিশ্র (১১/২৭/৭)। বৈদিক সাধন এখন অগ্নিহোত্র ও অন্যান্য হোমযজ্ঞেই সীমিত, বৈদিক ত্রিসন্ধ্যাকে হয়ত মিশ্র হয়ত বলা যেতে পারে, এবং তন্ত্রসাধনা মূলতঃ দেহতত্ত্বের সাধনা। তন্ত্রসাধনার পথ সাধারণতঃ দু’প্রকার—মন্ত্রসাধন এবং যোগসাধন। মন্ত্রসাধনে জপ, ধ্যান এবং দেব-দেবীর পূজা মুখ্য, যোগসাধনায় আছে মূলত প্রাণায়াম, ধ্যান ও বিচার। প্রথমটিতে ভক্তির প্রাধান্য, অপরটিতে জ্ঞানের। অবশ্য সকল সাধনাই গুরুমুখী বলে যোগমার্গেও গুরুভক্তি বিনা সাধনে অগ্রগতি কষ্টসাধ্য। পথ ও ভাবের পার্থক্য থাকলেও, বিভিন্ন হিন্দু সাধনমার্গের অন্তিম উপলব্ধি এক। শ্রী রামকৃষ্ণের মুখে তাই পূর্বোক্ত শ্রীমদ্ভাগবতের বক্তব্যেরই (শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/১১) প্রতিধ্বনি, “জ্ঞানীরা যাকে ব্রহ্ম বলে, যোগীরা তাঁকেই আত্মা বলে, আর ভক্তেরা তাঁকেই ভগবান বলে।”[7]

বর্তমান যুগে ‘যোগা’-র জনপ্রিয়তার নিরিখে যোগ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। যোগের দু’টি দিক হলো দর্শন ও সাধনা; দর্শনের দ্বারা সাধনার উদ্দেশ্য, সাধনের মার্গদর্শন হয়ে থাকে। যোগ সাধনের প্রণালীর অন্যতম হঠযোগ, যার প্রাথমিক স্তরের অভ্যাস জনসাধারণের মাঝে ‘যোগ’ বা ‘যোগা’ নামে জনপ্রিয়। এই স্তরের যোগাভ্যাসের অন্তর্গত বিবিধ আসন, মুদ্রা ও প্রাণায়াম। ঊনিশ শতকের শেষার্দ্ধে ও বিংশ শতকের প্রথমার্দ্ধে স্বামী বিবেকানন্দ এবং পরমহংস যোগানন্দ যথাক্রমে পাশ্চাত্যে অধ্যাত্ম সাধনার পথ হিসেবে যোগের ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তবে যোগকে শরীর চর্চার অঙ্গ হিসেবে ভারতে জনপ্রিয় করে তোলেন যোগানন্দভ্রাতা বিষ্ণুচরণ ঘোষ এবং মহীশূরের তিরুমালাই কৃষ্ণমাচার্য। এছাড়া যোগাভ্যাসের প্রভাব নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ ছিলেন মহারাষ্ট্রের স্বামী কুবলয়ানন্দ। এই তিনজন এবং ঋষিকেশের স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর শিষ্য-প্রশিষ্য বিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে পশ্চিমে বিপুল জনপ্রিয় করে তোলেন। ভারতবাসী অবশ্য এই প্রকার যোগাভ্যাসকে চিকিৎসা বা থেরাপি হিসেবেই গ্রহণ করেছে এবং দেশের গৃহে গৃহে এই সরল যোগসাধনকে জনপ্রিয় করে তোলার সর্বাধিক কৃতিত্ব স্বামী রামদেবের। তবে আমাদের স্মরণে রাখতে এই ‘যোগ’ মূল যোগ সাধনার প্রাথমিক স্তর মাত্র।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো বিদেশে হঠযোগের বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও হিন্দুধর্মকে কিন্তু হেয় নজরে দেখা হয়। এর অন্যতম কারণ আব্রাহামীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত পশ্চিমী সমাজ খ্রিস্টধর্ম থেকে সরে এলেও বহুদেবত্বকে এখনো হীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করে। সাধারণ হিন্দুধর্মের পরিবর্তে বৌদ্ধ ও ইস্কনীয় মতের জনপ্রিয়তার মুখ্য কারণ এই দুই সম্প্রদায়ে মাত্র একজনই, অর্থাৎ শ্রীবুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণকেই একমাত্র আরাধ্যরূপে উপস্থিত করা হয়েছে। এই একদেশদর্শিতার ফলে পাশ্চাত্যের অনেকেই আজ যোগকে শিকড়চ্যুত করে ‘অহিন্দু’ প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত। তাদের প্রচেষ্টা আরও মদত পেয়েছে ভারত হতে আগত প্রফেশনাল ‘যোগা গুরু’ ও আন্তর্জাতিক হিন্দু ধর্মগুরুদের দ্বারা, যারা নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতেই হোক বা বিশ্বমানবতাবাদী ভাবমূর্তি বানাতে, যোগকে হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করতে অপারগ। ভারত সরকারও এক্ষেত্রে একই অবস্থান নিয়ে এই অপপ্রয়াসকেই উৎসাহিত করছে। এই সুযোগে খ্রিস্টান ও ইহুদী ধর্মীয় প্রচারকরা যোগের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ‘খ্রিস্ট যোগা’ ও ‘ইহুদী যোগা’-র প্রচারে ব্যস্ত!

প্রকৃত সত্য হলো যোগ শুধু হিন্দু সাধনমার্গ নয়, হিন্দুধর্মের অন্তর ও বাহির, সবই যোগময়। যোগের অর্থ ‘যুক্ত হওয়া’—পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার। সুতরাং হিন্দুধর্মের উদ্দেশ্য যেমন ‘যোগ’, আবার সেই উদ্দেশ্য পূরণের পথকেও অভিহিত করা হয়েছে ‘যোগ’ বলে। ভগবদ্গীতার প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শেষে বলা হচ্ছে, ‘ওঁ তত্সদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষত্সু ব্রহ্মবিদ্যাযাং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে [অমুক]যোগো নাম [সংশ্লিষ্ট] অধ্যাযঃ’। ব্রহ্মবিদ্যা যোগশাস্ত্রের বিষয়বস্তু, ব্রহ্মবিদ্যা লাভ যোগ সাধনার উদ্দেশ্য, এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে সমগ্র জীবনকে যোগময় করে গড়ে তুলতে হয়, নান্য পন্থা। স্যামুয়েল হান্টিংটনের এক স্মরণীয় উক্তির[7] অনুকরণে বলতে হয় ‘হিন্দুধর্মের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ, দুইই যোগময়’; হিন্দুধর্ম যোগধর্ম ব্যতীত কিছু নয়। আশার কথা, মার্কিন মুলুকের প্রবাসী হিন্দুরা আর নীরব হয়ে বসে নেই, এবং যোগ যে একান্তভাবে হিন্দুধর্মের অঙ্গ সেই বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট।

হিন্দু দেবতত্ত্ব

‘দেব’ শব্দের ধাতুগত অর্থ যিনি দ্যোতমান বা দীপ্তিমান—দ্যোতনাদ্দেবঃ। হিন্দু সাধনার ন্যায় আমাদের দেবদেবী দু’ভাবে বিভক্ত—বৈদিক ও তান্ত্রিক (বা পৌরাণিক)। 

বৈদিক যুগের ঋষিগণ এই জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যেই সর্বনিয়ন্তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। মুখ্য বৈদিক উপাস্যরা হলেন অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, ইন্দ্র এবং প্রজাপতি। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ—সূর্য, উষা, ইন্দ্র, সরস্বতী, পৃথ্বী, বায়ু, বরুণ, প্রভৃতিতে প্রাণিক সত্তা আরোপ করে, তাঁদের ব্যক্তিত্ব দান করে, তাঁদের প্রাকৃতিক গুণাবলীর বন্দনাকে অতিক্রম করে, ধ্যানের আরও গভীরে গিয়ে সকল দেবদেবীর মধ্যে বিবিধ আধ্যাত্মিক শক্তি ও চেতনার স্তরকে আবিষ্কার করে তাঁরা দেবতাদের পরমচৈতন্যের প্রতীক রূপে ভজনা করতেন। যেমন,

চিত্রং দেবানামুদ্গাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরুণস্যাগ্নেঃ।
আ প্রা দ্যাব্যাপৃথিবী চান্তরিক্ষং সূর্য আত্মা জগতস্তস্থুষশ্চ।। (ঋগ্বেদ ১/১১৫/১)

এ যুগের বৈদিক ঋষি শ্রী অনির্বাণ এই ঋকের ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—

ভোরের বেলায় দেখছি সূর্য উঠছেন; দিব্য জ্যোতির এক আশ্চর্য চিন্ময় ব্যঞ্জনা—‘চিত্রং দেবানামুদ্গাদনীকম্’। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার পানে। এ কা’র চোখ? ‘চক্ষুর্মিত্রস্য বরুণস্যাগ্নেঃ’—এ সেই বিশ্বভাবন মিত্রের চোখ, সেই বিশ্বোত্তীর্ণ বরুণের চোখ, এই অন্তর্যামী চিদগ্নির চোখ। দেখতে দেখতে সে অনিমেষ দৃষ্টির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীতে, অন্তরিক্ষে, দ্যুলোকে—‘আ প্রা দ্যাব্যাপৃথিবী চান্তরিক্ষম্’। একটি পরম অনুভূতিতে আমার অন্তর স্তব্ধ হয়ে গেল। অনুভব হ’ল, ‘সূর্য আত্মা জগতস্তস্থুষশ্চ’—যা কিছু স্থাবর, যা কিছু জঙ্গম, এই সূর্যই তার আত্মা।[9]

হৃদয়ের এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, এই সারল্য বৈদিক যুগে ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান। পরবর্তীকালে সাধনা অন্তর্মুখী হলেও, বৈদিক ঋষিদের এই অতলস্পর্শী অনুভবের স্বীকৃতি স্থান পেয়েছে শ্রীশ্রীগীতার দশম অধ্যায়ে (বিভূতিযোগ), যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন—

দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে তিনি বিষ্ণু (১০/২১)
একাদশ রুদ্রের মধ্যে তিনি শঙ্কর (১০/২৩)
অষ্ট বসুর মধ্যে তিনি অগ্নি (১০/২৩)
দেবগণের মধ্যে তিনি ইন্দ্র (১০/২২)
প্রকাশকগণের মধ্যে তিনি সূর্য (১০/২১)

তান্ত্রিক দেবতত্ত্ব বৈদিক দেবতত্ত্ব হতে চারিত্রিক দিক থেকে স্বতন্ত্র এবং অতীব গুহ্য। বৈদিক দেবতারা ঋষিদের মানসিক সত্তা (psychic entity) মাত্র, কিন্তু তান্ত্রিক দেবতাগণ মানুষের মতোই জীবন্ত সত্তা কিন্তু সূক্ষ্ম দেহী। প্রত্যেক দেবতা ঈশ্বরের এক একটি শক্তির আধার, আবার পরমেশ্বরের সাথে অভিন্ন। এই শক্তিসমূহ সূক্ষ্মজগতে বিরাজমান, এবং সকল লোকে তাঁরা ব্যাপ্ত। মানবসমাজের মতো দেবতাগণের মধ্যেও স্তরভেদ বা শ্রেণীবিন্যাস আছে। উচ্চস্তরের দেবতাগণ ভক্তদের মুক্তি ও ভুক্তি উভয়েই প্রদান করতে সক্ষম, অন্যান্য দেবতাগণ কিন্তু দিতে পারেন শুধু ভুক্তি।

দেবগণ সহ জগতের সকল সত্তা নামরূপাত্মক। দেবতার রূপ তাঁর মূর্তি, নাম তাঁর বীজমন্ত্র। সাধনকালে, বীজমন্ত্র হতে দেবতার শরীর উৎপন্ন হয়ে থাকে—‘দেবতায়াঃ শরীরন্তু বিজাদুৎপদ্যতে ধ্রুবম্’। বীজ মন্ত্র (অথবা ইষ্ট মন্ত্র) জপ করতে করতে হৃদয়ে অথবা মানস নেত্রে ইষ্টদেবতার মূর্তির উদ্ভব হয়। তবে এই মূর্তিও দেবতার ভাবঘন রূপ, প্রকৃত রূপ নয়। সাধকের কাছে তাঁরা ঐরূপে প্রকাশিত হয়েছেন মাত্র। স্থূল বিগ্রহরূপে দেবতার আরাধনা শুধুই প্রতীকী নয়। যথার্থ প্রাণ প্রতিষ্ঠায় অথবা ভক্তি নিবেদনে সেই মূর্তি দেবতার চেতনায় চিন্ময় হয়ে ওঠেন। শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছেন,

ভগবান্  সর্ব্বত্র, সর্ব্বকাল, সর্ব্বভূতে বিরাজমান, কোন এক স্থানে ক্রমাগত ভক্তি করিতে থাকিলে ভক্তিবলে তিনি সেই স্থানে প্রকাশিত হন। এই প্রকারে বিগ্রহ মূর্ত্তিতে ভগবত্তা সংস্থাপিত হয়।[10]

সাধারণতঃ তান্ত্রিক দেবতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও গুহ্য সাধনার সাথে সম্পৃক্তহীন হবার কারণে, এবং পাশ্চাত্য প্রভাবে অনেকে হিন্দু ধর্মের ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেবদেবীর মূর্তিকে প্রতীকী রূপে উপস্থাপন করে থাকেন। সাধক ও ভক্তের প্রয়োজন নিজের ইষ্টের সাথে নৈকট্য ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলা, তা সখ্য, দাস্য ইত্যাদি যে ভাবেরই মাধ্যমেই হোক না কেন। সুতরাং পূর্বোক্তরূপ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত না হলেও অর্থহীন, এবং মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ। দেবতাগণের বিগ্রহতত্ত্ব ব্যতীত শালগ্রামশীলা, বাণলিঙ্গ, যন্ত্র ইত্যাদিরও গভীর রহস্যমূলক ব্যাখ্যা আছে।

হিন্দু সম্প্রদায়

বিবিধ ইষ্টদেবদেবী, সাধনমার্গ এবং গুরুপরম্পরার মাধ্যমে হিন্দু সমাজে গড়ে উঠেছে একাধিক সম্প্রদায়—শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি। এই সকল সম্প্রদায়ের আছে নিজস্ব দর্শন যা গড়ে উঠেছে বেদান্ত, সাংখ্য অথবা তন্ত্রকে ভিত্তি করে।

এত মত, এত পথ, এত সম্প্রদায়কে সমন্বয় করে একটি সুবিশাল হিন্দুধর্ম ও মহাজাতি গড়ে উঠেছে। এই সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়েছে তার কারণ এই সকল মতের পরকালের ভাবনায় আছে একই মৌলিক সিদ্ধান্ত—মৃত্যুর পর নতুন দেহে জীবের পুনরাগমন ঘটে, এবং এই জন্ম-মৃত্যু চক্র হতে নিবৃত্তিই আধ্যাত্মিক-সাধনার লক্ষ্য। মতপার্থক্য যা আছে তা জীব-জগতের স্বরূপ ব্যাখ্যা, পথ ও আনুসাঙ্গিক ক্ষেত্রে। কিন্তু আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি এই সকল বিবাদ মূলত বৌদ্ধিক, আধ্যাত্মিক নয়। সুতরাং, এক হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা অপর সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবদেবী অথবা ধর্মগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার ক্ষেত্রে কোন প্রাচীর গড়ে ওঠে না।

এতো গেলো শাস্ত্রীয় হিন্দুধর্মের (Classical Hinduism) কথা। এছাড়া আছে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা প্রভৃতি উপজাতিদের বিবিধ লোক হিন্দুধর্ম (Folk Hinduism)। জন্মমৃত্যুর চক্র হতে নিষ্কৃতি নয়, প্রকৃতির উপাসনা এবং পিতৃপুরুষদের আরাধনা এই সকল ধর্মের মুখ্য বৈশিষ্ট্য। তাহলে এসকল মত হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত হচ্ছে কিভাবে? কারণ, প্রথমতঃ, প্রকৃতিকে দৈবগুণ সম্পন্ন বলে গ্রাহ্য করা, প্রকৃতিকে পরমেশ্বরেরই অংশ এবং বিভূতি বলে স্বীকার করা হিন্দুধর্মের অন্যতম মৌলিক সিদ্ধান্ত। এর বিস্তারিত আলোচনা আমরা দেবতত্ত্ব অংশে করেছি। শ্রীশ্রীগীতায় উক্ত ভগবানের বিভূতির প্রকাশ শুধুমাত্র বৈদিক দেবদেবীর মধ্যে সীমিত নয়, লোক হিন্দুধর্মের ন্যায় নদী, সাগর, পর্বত, পশুপক্ষী প্রভৃতি সকলই তাঁর বিভূতির অন্তর্ভুক্ত—

উচ্চশৃঙ্গযুক্ত পর্বতসকলের মধ্যে তিনি মেরুপর্বত (১০/২৩)
জলাশয়সমূহের মধ্যে তিনি সাগর (১০/২৪)
স্থাবর পদার্থসমূহের মধ্যে তিনি দেবতাত্মা হিমালয়  (১০/২৫)
বৃক্ষসকলের মধ্যে তিনি অশ্বথ্থ (১০/২৬)
অশ্বগণের মধ্যে তিনি উচ্চৈঃশ্রবা (১০/২৭)
হস্তিগণের মধ্যে তিনি ঐরাবত (১০/২৭)
গাভীগণের মধ্যে তিনি কামধেনু (১০/২৮)
সর্পগণের মধ্যে তিনি সর্পরাজ বাসুকি (১০/২৮)
পশুগণের মধ্যে তিনি সিংহ (১০/৩০)
পক্ষীগণের মধ্যে তিনি গরুড় (১০/৩০)
বেগবানদিগের মধ্যে তিনি বায়ু (১০/৩১)
নদীসকলের মধ্যে তিনি গঙ্গা (১০/৩১)

প্রকৃতির সবকিছুই তাঁর বিভূতির প্রকাশ কারণ তিনি সর্বপ্রাণীর হৃদয়ে অবস্থিত আত্মা, এবং তিনিই প্রাণীগণের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়ের স্থান (শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১০/২০)।

দ্বিতীয়তঃ, পিতৃপুরুষদের শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ, তাঁদের অর্ঘ্যজ্ঞাপন হিন্দু ধৰ্মাচরণের অঙ্গ। শাস্ত্রে স্বীকৃত মানুষের পঞ্চঋণের অন্যতম পিতৃঋণ, যা পরিশোধিত হয় শ্রাদ্ধ ও তর্পণাদি অনুষ্ঠান, এবং বংশ তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা রক্ষার দ্বারা। পঞ্চঋণের বিস্তারিত আলোচনায় আমরা পরে আসব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, ইন্দোনেশিয়ার বালি-তে (বলিদ্বীপ) প্রচলিত হিন্দুধর্ম শাস্ত্রীয় এবং লোক হিন্দুধর্মের এক সুন্দর সমন্বয়।

শ্রীমদ্ভগবদগীতার অবতারতত্ত্ব

বৈদিক যুগ থেকে মৌর্য যুগ পর্যন্ত অবতারতত্ত্ব, অর্থাৎ ভগবান স্বয়ং যুগপ্রয়োজনে কোন রূপে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, এমন কোন ধারণার অস্তিত্ব হিন্দু ধর্মতত্ত্বে ছিল না। প্রাচীনত্বের দিক থেকে হিন্দুধর্মে অবতারতত্ত্বের উৎস নিঃসন্দেহে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন পুরাণের কলেবর বৃদ্ধির মাধ্যমে সত্য, ত্রেতা আদি চতুর্যুগ এবং দশাবতারের ভাবনা হিন্দুধর্মে স্থান করে নিয়েছে। মৎস্য অবতার দিয়ে শুরু করে অন্তিমে কল্কি, বিভিন্ন পুরাণের তালিকায় প্রথম সাত ও অন্তিম অবতারের নাম এক হলেও, অষ্টম ও নবম অবতারের ক্ষেত্রে সামান্য মতভেদ দেখা যায়। আঞ্চলিক ভেদ বাদ দিলে অষ্টমে কোথাও শ্রীকৃষ্ণ আর কোথাও শ্রীবলরামের উল্লেখ আছে। আবার নবম স্থানে আছে শ্রীকৃষ্ণ অথবা শ্রীবুদ্ধের নাম।

অবতারের এই তালিকা দশম শতকের মধ্যেই সম্ভবত স্থির হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ‘যুগে যুগে ধর্মের গ্লানি হলেই তিনি অবতীর্ণ হন’, এমন ভাবনা বঙ্গে দীর্ঘ দু-তিন শতকের মুসলমান শাসনে নাভিশ্বাস ওঠা হিন্দু সমাজকে প্রচ্ছন্নভাবে শ্রীচৈতন্যকে অবতাররূপে দেখতে উদ্বুদ্ধ করে। বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী প্রণীত গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্র দ্বারা গৌড়ীয় পরম্পরায় মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব প্রভাবে বঙ্গদেশে অবতারবাদের ধারণা এতটাই পুষ্টিলাভ করে যে শ্রীরামকৃষ্ণের মতো শাক্ত সাধকও তাঁর অনুগামীদের কাছে শ্রীগৌরাঙ্গের অবতার রূপে প্রতিভাত হন। পরে অবশ্য কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীদের সৌজন্যে তাঁর অবতারত্বের বিবর্তন ঘটে যা পরে আমরা আলোচনা করেছি। যাই হোক, স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম প্রচারের সাফল্য, কথামৃতের জনপ্রিয়তা এবং রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রীবৃদ্ধির ফলে আজ সাধারণ ধর্মপ্রবণ বাঙ্গালীর মানসে তিনি অবতাররূপে বিরাজিত।

কিন্তু শ্রীশ্রীগীতার বাণীতে অবতীর্ণ হবার কারণ ছাড়া অবতারের আগমণের উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করা হয়েছে—‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং’—দুষ্কৃতির বিনাশ করে তিনি ধার্মিকদের পরিত্রান করেন; বস্তুতঃ এভাবেই তিনি ধর্মসংস্থাপন করতে সক্ষম হন। শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সেই শর্ত পূরণ হয়েছিল, তাই তাঁরা অবতারের মর্যাদা লাভ করেছেন। কিন্তু শ্রীশ্রীগীতার সেই বাণী অনুযায়ী বিদেশী শাসিত বঙ্গদেশে সেরূপ অবতার এলেন কোথায়? শ্রীমন্মহাপ্রভু নিজেই যবন শাসিত বঙ্গদেশ ত্যাগ করে হিন্দু শাসিত উৎকলে গমন করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের সাত দশকের মাথায় পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে বাস্তুচ্যুত করে প্রতিষ্ঠা হয় ইসলামী পূর্বপাকিস্তানের। ধর্মপ্রচার ও লোকসংগ্রহ করলেও দুষ্কৃতির বিনাশ তাঁরা করেননি, তাই ধর্মসংস্থাপনও হয়নি।

স্মরণকালের ইতিহাসে যদি শ্রীশ্রীগীতার অবতারত্বের শর্ত কারুর দ্বারা পূরণ হয়ে থাকে তাহলে তিনি মহাতপা ‘সমর্থ’ স্বামী রামদাসজী। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হরিহর ও বুক্কারায়ের গুরুদেব শৃঙ্গেরীর শারদা পীঠাধিশ স্বামী বিদ্যারণ্যের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও বিজয়নগরের পক্ষে ভারতের ইতিহাসের ধারার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেই কৃতিত্ব অবশ্যই শ্রীরামদাসজী এবং শিবাজী মহারাজের প্রাপ্য। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকার ন্যায় সর্বত্যাগী শ্রীরামদাস নিজে অস্ত্রধারণ না করে তাঁর শিষ্য শিবাজীকে প্রেরণা দিয়েছেন বিধর্মীয় দুর্বৃত্তদের দমন করতে।

শ্রীশ্রীগীতায় ‘তস্মাদযোগী ভবার্জুন’(শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৬/৪৬)—অর্জুনকে যোগী হবার আহবানের ন্যায় শ্রীরামদাস স্বামী শিবাজীকে ‘যোগী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যোগী বলতে আমাদের মনে পর্ণকুটির অথবা গুহায় ধ্যানস্থ কোন সাধকের ছবি ভেসে ওঠে। অথচ শিবাজী ছিলেন মহাক্ষত্রিয়, এবং বিবাহিত। এতদসত্ত্বেও শিবাজীর কোন গুণাবলী দেখে তাঁর এরূপ মনে হয়েছিল তার বর্ণনা রয়েছে শিবাজীকে প্রদত্ত রামদাসজীর এক কাব্যপত্রের অংশে—

মহামেরুর ন্যায় সংকল্পে স্থির, বহু মানুষের আশ্রয়স্থল,
সিদ্ধান্তে অবিচল, শ্ৰীমন্ত যোগী।।
নরপতি, অশ্বপতি, গজপতি, দুর্গ, ধরণীর অধিপতি,
দেবরাজ ইন্দ্র ও দেবী ভগবতী যাঁর সহায়।।
যশস্বী, কীর্তিমান, ক্ষমতাবান, ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত,
পুণ্যবান, নীতিশীল, প্রজ্ঞাবান রাজা।।
আচারশীল, বিচারশীল, দানশীল, ধর্মশীল,
সকল স্থানে বিদ্বানদের প্রতি সুশীল।।
ধৈর্যশীল, উদার, গম্ভীর, বীরকর্মে তৎপর,
সতর্কতার সহিত শত্রুদের পরাজিতকারী।।
হৃদয়স্থিত নারায়ণের প্রেরণায়,
হিন্দুধর্ম, গোব্রাহ্মণের রক্ষাকারী।।
সমগ্র ভূমণ্ডলে যাঁর ন্যায় ধর্মের রক্ষাকর্তা কেউ নেই,
মহারাষ্ট্র ধর্ম রক্ষা পেয়েছে সেই আপনারই কৃতিত্বে।।
কত পাপাত্মাকে সংহার করেছেন, কতজনকে অভয় দিয়েছেন,
কত সহস্ৰজনকে আশ্রয় দিয়েছেন, শিব-কল্যাণ-রাজা আপনি, শিব-কল্যাণ-রাজা।।[11]

শিবাজীও অর্জুনের মতো ‘শিষ্যস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্’, গুরু অনুগত এই ভাব দ্বারা রামদাসজীর কাছে নিজেকে সমর্পিত করে,[12] গুরুর যন্ত্রস্বরূপ হয়ে হিন্দু স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন। স্বামী রামদাসও শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় শিবাজীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন ধর্ম সংস্থাপনে—

যবনগণ বহুদিবস হইতে যথেচ্ছাচার করিতেছে; […] দুষ্টগণের অত্যাচারে দেব-ব্রাহ্মণের উচ্ছেদ সাধিত হইয়াছে, সমস্ত ধর্মকর্ম ভ্রষ্ট হইয়াছে; নামসংকীর্তন বিলুপ্ত হইয়াছে। পাপিগণের বলবৃদ্ধি হওয়ায় ধার্মিকগণ দুর্বল হইয়াছেন; এই সঙ্কটকালে সকলের সুখসম্মান লোপ পাইয়াছে। […] এক্ষণে সময়ের অনুরূপ ধর্মস্থাপন করা তোমার কর্তব্য। ধর্মের জন্য জীবন বিসর্জন কর; নিজের প্রাণপণ করিয়াও শত্রুদিগের সকলকে বিনাশ কর। […] এ সময়ে শৌর্য্য প্রকাশ করিয়া ভগবৎ কৃপা লাভ কর। বাহুবলে ধর্ম স্থাপন কর। এ বিষয়ে আলস্য করিও না। কাপুরুষতা ও ভীরুতা পরিত্যাগ কর। […]

তুমি ক্ষত্রিয়, অতএব ক্ষাত্রধর্মী পুরুষদিগের ন্যায় রাজরক্ষা ও প্রজাপালন করিয়া দেবব্রাহ্মণের সেবা, ধর্মসংস্থাপন ও দেশের ম্লেচ্ছভাব দূরীভূত কর। এ বিষয়ে রঘুপতির ইচ্ছা এই যে,—ম্লেচ্ছদিগের এই বহু দিবসের অত্যাচার ও উদ্দাম ব্যবহারের জন্য তাহাদিগকে ‘দ্বিখণ্ড’ করিয়া তুমি রাজ্যপালনের ভার গ্রহণ করিবে।[13]

রামদাসজীর আশীর্বাদ ও শিবাজী এবং তাঁর উত্তরসূরিদের পুরুষকারের দ্বারা শিবাজীর জীবনাবসানের মাত্র ছয় দশকের মধ্যে মুঘল শাসন পদানত হয়েছে তাঁর স্থাপিত স্বরাজ্যের কাছে।[14] গুরু-শিষ্যের দীর্ঘমেয়াদী এই সাফল্য শ্রীশ্রীগীতার মহত্ত্বপূর্ণ অন্তিম বাণীর সনাতন সত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—

যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজযো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।। (শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ১৮/৭৮)

(বঙ্গানুবাদ: যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং ধনুর্দ্ধর অর্জুন, সেইখানেই সমৃদ্ধি ও বিজয়, সেইখানেই অভ্যুদয় (ভূতিঃ) ও নিঃশ্রেয়স (ধ্রুবা), সেইখানেই সুনীতি বিরাজমান—ইহাই আমার অভিমত।)

এই শ্লোকের ক্রিয়ার কাল ও শব্দচয়ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের যৌথ অভিযান পাণ্ডবপক্ষকে বিজয়ী করবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী সঞ্জয় করলেন না, পরন্তু তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো এক চিরন্তন বার্তা—যেখানে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের যুগ্ম উপস্থিতি সেখানে বিজয়, বৈভব প্রভৃতি অনিবার্য। শব্দচয়নও লক্ষ্য করার—শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর ও শিষ্যরূপী পার্থকে ধনুর্ধর বলে অভিহিত করলেন। অর্থাৎ ধর্মের বিজয় তখনই সুনিশ্চিত যখন যোগসিদ্ধ সাধক এবং অস্ত্রধারী, বীর, ক্ষাত্রতেজ সম্পন্ন শিষ্য সমবেতভাবে ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ন হন।[15] যেখানে প্রজ্ঞা ও বীরত্ব অধিষ্ঠিত, সেখানে বিজয়, লক্ষ্মী, সুনীতিরূপে ভগবান নিত্য বিরাজমান। কোনো একের অনুপস্থিতিতে আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় অথবা ধর্মপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ব্যক্তিগতস্তরেও শাস্ত্র এবং শস্ত্র—উভয়ের সাধনায় রত হওয়া আমাদের কর্তব্য; স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুর উদ্দেশ্য এই আহ্বানই জানিয়েছিলেন—“Body and mind must run parallel।”[16]

আব্রাহামীয় ধর্মমতের সাথে হিন্দুধর্মের পার্থক্য

আব্রাহামীয় ধর্ম সংখ্যায় তিন—ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইসলাম। এই তিনকে একত্রে আব্রাহামীয় ধর্ম বলার কারণ খ্রিস্ট মত ও ইসলাম ইহুদি বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে অবলম্বন নিজেদের ইহুদি ধর্মের উত্তরসূরী হিসেবে দাবি করে থাকে। যে মৌলিক সিদ্ধান্তের একতা ভারতের বিভিন্ন মতকে হিন্দুধর্মের ছত্রছায়ায় এনেছে সেই মৌলিক সিদ্ধান্তের প্রভেদই হিন্দুধর্মের সাথে আব্রাহামীয় ধর্মমতের পার্থক্য সূচিত করেছে।

প্রথমতঃ, এই তিনটি ধর্মমত জগৎকে সৃষ্টিকর্তা হতে বিচ্ছিন্ন করে দেখে, প্রকৃতিকে দৈবরূপে দেখে না। হিন্দু দৃষ্টিতে মৃন্ময়ী পৃথিবী চিন্ময়ী, তিনি বিষ্ণুপত্নী স্বয়ং। তাই হিন্দু পরম্পরায় প্রাতঃকালে ‘বিষ্ণুপত্নী নমস্তুভ্যং পাদস্পর্শ ক্ষমস্ব মে’ বলে পৃথিবীরূপিণী বিষ্ণুপত্নী শ্রীলক্ষ্মীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে তাঁকে পাদস্পর্শ করার রীতি। এছাড়া আছে বঙ্গ ও আসামে ‘অম্বুবাচী’ এবং ওড়িশাতে ‘রজ উৎসব’। পৃথিবীর উর্বরতার ধারণা থেকে তাকে রজঃস্বলা নারী রূপে কল্পনা করা হয়েছে। আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে বর্ষার জলে পৃথিবী সিক্ত হয়ে উঠলে তাকে ঋতুমতী বলে মনে করা হয়। আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তৃতীয় পদ শেষ হয়ে চতুর্থ পদের শুরুতে অম্বুবাচী উৎসব শুরু হয়। অম্বুবাচীর আগের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী প্রবৃত্তি’। তিন দিনের পরের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী নিবৃত্তি’। মাঝের এই তিন দিন কৃষিকাজ থেকে বিরত থেকে বসুমতিকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। ওড়িশাতে এটি ‘রজ উৎসব’ নামে পালিত হয়। এই সময় মহিলারাও সকল কৃষি ও গৃহকর্ম থেকে ছুটি নেন। এখানে চতুর্থ দিনে হয় ভূদেবীর স্নান। পুরীর মন্দিরে শ্রী জগন্নাথের পাশে ভূদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিতা আছেন। আব্রাহামীয় বিশ্বদর্শনে ধরিত্রীকে এমনরূপে দেখা অকল্পনীয়; তাদের কাছে ভূমি শুধুই কর্ষণের বস্তু, মানুষের ভোগ ও জীবনধারণের জন্যই এর অস্তিত্ব। এমনতর দৃষ্টিভঙ্গির ফলে একদিকে যেমন নদী-পর্বত, পশুপক্ষীর প্রতি জাগে না শ্রদ্ধা, তেমনই প্রকৃতিকে নিঃশেষে শোষণের ক্ষেত্রে ওঠে না কোন নৈতিকতার প্রশ্ন। 

দ্বিতীয় পার্থক্য জন্মান্তর প্রসঙ্গে। ইহুদি ধর্মে একাধিক জন্মের প্রশ্নে ধোঁয়াশা থাকলেও খ্রিস্ট ও ইসলাম মতের দাবি মানুষের একটিই জন্ম, এবং এই দুই ধর্মের প্রতি বিশ্বাস এবং নিষ্ঠা না থাকলে মানুষের জন্য রয়েছে অনন্ত নরক, আর বিশ্বাসীদের জন্য আছে অনন্ত স্বর্গ। অবিশ্বাসীদের জন্য অনন্ত নরক কেন? কারণ প্রত্যেক আব্রাহামীয় ধর্মমত ‘সত্য’-এর একচেটিয়া দাবিদার—একমাত্র তাদের মতই সত্য, তাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য, এবং অন্য দেবদেবীর আরাধনা পাপ এবং ভ্রান্ত! এই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় আধিপত্যবাদী মানসিকতার, চলে যেনতেন প্রকারে মানুষের ধর্মান্তরকরণ, বিধর্মীদের সংহার এবং পরধর্মের দেবদেবী ও মন্দিরের ধ্বংসসাধন। সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ায় আব্রাহামীয় ধর্মমতের বিস্তারের ইতিহাস তার সাক্ষী।

তৃতীয় পার্থক্য, আব্রাহামীয় ধর্মে দেবীর আরাধনা অনুপস্থিত। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামী শাস্ত্রে যিহোবা অথবা আল্লার ক্ষেত্রে পুরুষ বাচক সর্বনাম ব্যবহার করা হয়। খ্রিস্টানরা তাঁকে ‘পিতা’ বলে সম্বোধন করে থাকে, এবং যিশু তাঁর একমাত্র ‘পুত্র’। আব্রাহামীয় ধর্মের নবী বা প্রবক্তারাও সবাই পুরুষ। এর অন্যতম কারণ এখানে নারীর মর্যাদা পুরুষের তুলনায় হীন যার বীজ রয়েছে আব্রাহামীয় সৃষ্টিতত্ত্বে—যিহোবা বা আল্লা মানবজাতির মধ্যে প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন এক পুরুষ, নাম আদম। আদমের পাঁজর থেকে প্রথম নারী ঈভ-এর সৃষ্টি, সুতরাং নারী কোনদিন পুরুষের সমগোত্রীয় হতে পারবে না। 

এর বিপ্রতীপে, হিন্দুধর্মে নারী জন্মদায়িত্রী, সুতরাং তাঁর সম্মান সর্বাগ্রে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মন্ত্রে পিতা-আচার্যের পূর্বে আছে মায়ের স্থান—

মাতৃ দেবো ভবঃ।
পিতৃ দেবো ভবঃ।
আচার্য দেবো ভবঃ।
অতিথি দেবো ভবঃ।। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ১/১১/২)

বেদের দৃষ্টিতে জগতের মাতৃমূর্তি হলেন অদিতি, যিনি অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এবং ইন্দ্র সহ সকল দেবতার মা। এরূপে হিন্দুধর্ম মাতৃসত্তাকে অতি উচ্চে স্থান দিয়েছে। শুধু মাতৃসত্তা নয়, নারীসত্তাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে বৈদিক ঋষিগণ কোন কার্পণ্য করেনি। আব্রাহামীয় ধর্মে যেখানে একজনও নারী প্রফেটের অস্তিত্ব নেই, সেখানে বৈদিক সাহিত্যের রচয়িতাদের মধ্যে অদিতি, অপালা, লোপামুদ্রা সহ প্রায় ত্রিশজন ঋষিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় অম্ভৃণের কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক-এর, যিনি দেবীসুক্ত-এর রচনা করেন।

ইসলামী আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত সাধন ও শাস্ত্র অধ্যয়নে নারীদের অধিকার রক্ষিত ছিল। শঙ্করাচার্যের সাথে মণ্ডন মিশ্রের তর্কসভায় মিশ্রের স্ত্রী পরমা বিদুষী উভয়া ভারতী বিচারকের আসন পরিগ্রহণ করেছিলেন এবং স্বামীকে পরাজিত হতে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে। ইসলামী অপশাসনে হিন্দুর আর্থ-সামাজিক দুর্দশা এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তার অভাবে মহিলাদের সামাজিক পদমর্যাদা ক্ষুন্ন হলেও আধ্যাত্মিক জগতে সাধিকাদের আত্মপ্রকাশ থেমে থাকেনি। লালেশ্বরী (কাশ্মীরী), আক্কা মহাদেবী (কন্নড়), সোয়রাবাঈ (মারাঠি), আণ্ডাল (তামিল), আতুকুড়ি মোল্লা (তেলেগু), মীরাবাঈ (রাজপুত)—সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে তাঁরা আবির্ভুত হয়েছেন। বিগত শতকে বাঙ্গলার মা সারদা এবং আনন্দময়ী মা হয়ে উঠেছিলেন সহস্র অধ্যাত্মপিপাসুদের আশ্রয়স্থল।

চতুর্থতঃ হিন্দুর ঈশ্বরতত্ত্ব এবং অদ্বৈততত্ত্ব আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদ ধারণা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা দেখেছি, বৈদিক ঋষিদের দৃষ্টিতে সকল দেবতা সেই এক পরমেশ্বরের ভিন্ন রূপ। ঋগ্বেদে দেবীসূক্তের প্রথম ঋকে দেবী একই কথা বলছেন,

অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা। (ঋগ্বেদ, ১০/১২৫/১)

(বঙ্গানুবাদ: আমিই রুদ্র, বসু, আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে বিচরণ করি। মিত্র ও বরুণের আমিই ধাত্রী। ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমার দু’জনকে আমিই ধারণ করে থাকি।)

এই কারনে, ভক্ত যে দেবতারই শরণাপন্ন হন না কেন, তা ঈশ্বরের নিকটেই হয়ে থাকে (শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪/১১)।

আব্রাহামীয় ধর্মের উপাস্য একথা স্বীকার করেন না। অতএব, বাইবেলের উপাস্য যিহোবা তাঁর দশ আজ্ঞার প্রথমটিতে বলছেন, তাঁকে ছাড়া আর কারুর উপাসনা করা চলবে না। ইসলামের প্রথম চার কালেমাতে একটি কথা বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্—আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, এবং ষষ্ঠ ও অন্তিম কালেমায় বলা হয়েছে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা (‘শির্ক্’) করা চলবে না। সুতরাং আব্রাহামীয় ঈশ্বরতত্ত্বের সাথে হিন্দু ঈশ্বরতত্ত্বের কোন মিল নেই। স্বাধীন ভারতের অন্যতম হিন্দু চিন্তানায়ক এবং যোগী, রামস্বরূপ, এই পার্থক্যটি আমাদের বুঝিয়েছেন অতি প্রাঞ্জল ভাবে—

God alone is, and not that there is only One God.

(বঙ্গানুবাদ: একজন মাত্র ভগবান আছেন তা নয়, একমাত্র ভগবানই আছেন।)[17]

বাইবেলের ঈশ্বরের অন্যকে সহ্য না করার মানসিকতার জন্য তাঁকে বলা হয় ‘ঈর্ষাপরায়ণ ঈশ্বর’। এই মানসিকতা আব্রাহামীয় ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে, রচিত হয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাসের। এই সঙ্কীর্ণতা ও বিদ্বেষপরায়ণতাকে রামমোহন রায় ঈশ্বরের আদিষ্ট বলে মেনে নিতে পারেননি। মুর্শিদাবাদে অবস্থানকালে মুসলিম উলেমাদের উদ্দেশ্যে ফার্সি ভাষায় লিখিত তাঁর তুহফৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন নিবন্ধে বিভিন্ন আঙ্গিকে ইসলামকে সুতীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন রামমোহন। আব্দুল্লাহ আল-আনসারী গাজী লিখেছেন,

Apart from the technical aspects of presentation, one can find in the ideas of the tract very little, if anything, which shows sympathy to the Islamic tradition or regard for Muslim religious sensitivity. Its ideas are directed against all established religions, but being especially addressed to Muslims, they seem to have a special anti-Muslim bias.[18]

উক্ত নিবন্ধে ইসলামের অনেক মৌলিক সিদ্ধান্ত, বিশ্বাস ও পরম্পরাকে তিনি নস্যাৎ করেছিলেন, যার ফলে তাঁকে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করতে হয়—

[I]n the Tuhfat, he tries to prove that falsity and futility are common elements of all religions. His attacks, however, often appear to be directed specifically against Islam, even though they are couched in more general terms. The language in which he deals with such a sensitive issue is, to say the least, unfortunate. He made direct derogatory remarks about the Koran, the Prophet, and Muslim political behavior. His intentional insensitivity to the subject, on which he must very well have known the sentiments of Muslims, appears to be a polemic calculated to infuriate Muslims rather than to establish a point of truth. It appears that these remarks were responsible for the reaction of Muslims of Murshidabad against Roy, which forced him to leave for Calcutta.[19]

একই ভাবে তিনি আক্রমণ শানিয়েছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ১৮২০ বর্ষে বাইবেলের উত্তরাংশ, অর্থাৎ নববিধানের চারটি গস্পেলের নির্বাচিত অংশ নিয়ে The Precepts of Jesus নামক এক সঙ্কলন প্রকাশ করেন যেখানে যিশুর ‘দিব্য পরিচয়’ (‘ঈশ্বরের পুত্র’, ‘মানব জাতির একমাত্র পরিত্রাতা’ ইত্যাদি), অলৌকিকতার কাহিনী, ও খ্রিস্ট ধর্মের ত্রিতত্ব সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিল। এর জন্য সঙ্কলনে খ্রিস্টীয় দৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চতুর্থ গস্পেলের প্রায় সম্পূর্ণটাই রামমোহন বর্জন করেন যা মিশনারীদের উত্তেজিত করে চলে। শুরু হয় বিতর্ক, বিশেষ করে শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্টদের সাথে। প্রত্যুত্তরে রামমোহন মিশনারীদের যুক্তিকে ধূলিসাৎ করে একের পর এক লিখে চলেন An Appeal to the Christian Public, in Defence of the “Precepts of Jesus” (‘প্রথম আবেদন’) A Second Appeal (‘দ্বিতীয় আবেদন’) এবং অন্তিমে Final Appeal (‘অন্তিম আবেদন’)।

এই সকল বিতর্কের মাঝে শ্রীরামপুরের অন্যতম মিশনারী উইলিয়াম এডম রামমোহনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খ্রিস্টীয় যিশুত্বত্ত্বে আস্থা হারিয়ে মূলধারার খ্রিস্ট ধর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, যা শ্রীরামপুরের মিশনারীদের আরও ক্রোধান্বিত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত আসরে নামেন সাধারণ ইংরেজরা, শুরু হয় ব্যক্তিগত আক্রমণ। তাদের আক্রমণ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও জাতিবিদ্বেষের রূপ ধারণ করে কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে—এক ‘নেটিভ’ যুক্তি-তর্ক-তথ্যের মাধ্যমে চিরতরে খ্রিস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন।[20]

রামমোহনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও হিন্দুদের, বিশেষ করে বাঙ্গালীর মধ্যে ‘সকল ধর্মই সমান’ এমন ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন এবং আব্রাহামীয় ধর্মের প্রতি যে শ্রদ্ধা আজ বর্তমান তার পশ্চাতে আছে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ইংরেজি শিক্ষিত বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশের বিজিত জাতি হিসেবে হীনমন্যতা। এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসেন কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা, যাঁদের একাংশ পরে শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং মিশনের ভাষ্যকে প্রভাবিত করে বাঙ্গালীকে সেক্যুলারিজমের আফিমে প্রথম মোহিত করেন। এই হীনমন্যতার কারণে কেশবচন্দ্র খ্রিষ্টধর্মের পাশাপাশি আর্য আক্রমণ তত্ত্বকেও সাদরে আলিঙ্গন করে হিন্দুদের মধ্যে এই তত্ত্বকে জনপ্রিয় করতে সহায়ক হন, কিন্তু সে আর এক কাহিনী।

কেশবচন্দ্র সুবক্তা ছিলেন, প্রচারকার্যেও ছিলেন নিপুণ, কিন্তু রামমোহনের মেধা, প্রখর ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধ ও ক্ষুরধার বিশ্লেষণী শক্তি তাঁর ছিল না। হিন্দুদের উদ্দেশ্যে ইংরেজদের জাতিবিদ্বেষ ও ধর্মবিদ্বেষ প্রসূত অভিযোগ প্রতিবাদের পরিবর্তে প্রকাশ্যে নিজেদের হীনতা স্বীকার করে নিয়ে তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,

We are a subject race and have been so for centuries. We have too long been under foreign sway to feel anything like independence in our hearts. Socially and religiously we are little better than slaves.

(বঙ্গানুবাদ: আমরা দাসজাতি এবং বহু শতাব্দী ধরে তাই আছি। দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশী প্রভাবের অধীনে থাকার ফলে আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতার স্পৃহা নেই। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে আমরা ক্রীতদাসের চেয়ে সামান্য উন্নত মাত্র।)[21]

বিজিত জাতির একজন হিসেবে নিজের হীনমন্যতা দূর করতে কেশবচন্দ্রের পন্থা হলো ‘এশীয়’ যিশুর আত্মীকরণ, যার জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ল নিজের হিন্দু সত্তাকে অস্বীকার করে নিজেকে ‘বিশ্বনাগরিক’-এ পরিণত করা। কেশব গোষ্ঠী ও দেবেন্দ্রনাথ অনুগামীদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজে যে বিভাজন দেখা দেয় তার অন্যতম, বা হয়ত মুখ্য কারণ ছিল কেশবচন্দ্রের এই খ্রিস্টধর্ম প্রীতি এবং হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রয়াস। আচার্যগণের উপবীত পরিত্যাগের দাবি নিয়ে বচসা শুরু হলেও এর পশ্চাতে প্রচ্ছন্ন হিন্দু বিরোধিতা দেবেন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে,

বস্তুতঃ দেবেন্দ্রনাথ এ সময়ে যাহা কিছু করিয়াছিলেন, কর্ত্তব্য বোধে এবং তাঁহার অবলম্বিত আদর্শ রক্ষার জন্য। ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুভাবে হিন্দুসমাজের মধ্যে প্রচার করা তাঁহার চিরদিনের আদর্শ। তিনি মনে করিতেন রামমোহন রায় তাঁহাকে সেই ভার দিয়া গিয়াছিলেন। তাহার ব্যাঘাতের আশঙ্কাতেই তিনি কেশবচন্দ্রের দলের হস্ত হইতে কার্য্যভার লইলেন। তাঁহাদিগকে ভালবাসিতে ও সাহায্য করিতে বিরত হইলেন না। সকল ভাল বিষয়ে তাঁহাদের উৎসাহদাতা রহিলেন।[22]

দেবেন্দ্রনাথের বিবেচনা ভ্রান্ত ছিল না। রক্ষণশীলতার বিরোধিতার ধুয়ো তুলে কেশবচন্দ্রের দেবেন্দ্রনাথ বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেও দেখা যায় ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ গঠনের পূর্বে কেশবচন্দ্রের প্রধান দু’টি বক্তৃতার বিষয় ছিল যিশু (৫ মে ১৮৬৬, ‘জেসাস খ্রাইস্ট: ইউরোপ এণ্ড এশিয়া’) এবং পৃথিবীর সকল ধর্মীয় পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন (২৮ মে ১৮৬৬), প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের নির্বাচিত বাণী সঙ্কলন, শ্লোক সংগ্রহ।[23] ১৮৭০-এ দুই পক্ষের মধ্যে একটা মধ্যস্থতার প্রয়াস শুরু হয়, এবং সিদ্ধান্ত মতো দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্রের ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’-এর এক অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে কেশব অনুগামীদের কাছে আহ্বান জানান,

ব্রাহ্মগণ! মন্দিরের দ্বারে খৃষ্টরূপ বিভীষিকা রহিয়াছে।……খ্রিষ্টের নামে এমনই যুদ্ধানল প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে কেহ জানে না যে কিরূপে তাহা নির্ব্বাণ করিবে।……স্বাধীনতার বিপরীত যাহা কিছু, তাহাই খ্রিষ্টধর্ম্ম।[24]

এর প্রতিক্রিয়ায় কেশব অনুগামীরা দেবেন্দ্রনাথকে প্রতিবাদ পত্র পাঠালে, দেবেন্দ্রনাথ উত্তরে লেখেন,

ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিষ্টের নাম প্রচার হইয়া না পড়ে তাহাই তোমাদিগকে উপদেশ দেওয়া তোমাদের হিত মনে করিয়াছিলাম[,] আমার সেই উপদেশে যে তোমাদের ক্ষোভ জন্মিয়াছে তাহাতে আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম।[25]

কেশবচন্দ্রের সাথে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম আলাপ হয় ১৮৭৫ বর্ষে। ততদিনে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন পর্ব সমাপ্ত, এবং একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে তিনি শ্রীগৌরাঙ্গের অবতার রূপে স্বীকৃত। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁর তান্ত্রিক গুরু শ্রীভৈরবী ব্রাহ্মণী। শ্রীভৈরবীর প্রেরণায় রানী রাসমণির জামাতা মথুরবাবুর আহুত সভায় ভাবাবেশে শ্রীচৈতন্যের ব্যবহারের সাথে শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যবহারের সাদৃশ্য, এবং গৌড়ীয় শাস্ত্রে উল্লেখিত ‘মহাভাব’ শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে পরিলক্ষিত হওয়ায় বিশিষ্ট বৈষ্ণবপণ্ডিত ও সাধক বৈষ্ণবচরণের নেতৃত্বে পণ্ডিতরা শ্রীরামকৃষ্ণকে শ্রীচৈতন্যের অবতাররূপে স্বীকার করেন। মনে রাখতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের এই অবতারত্ব গৌড়ীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তখনও তাঁর নির্বিকল্প সমাধি লাভ হয়নি।

কিন্তু খ্রিস্ট মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা এতে সন্তুষ্ট হবার পাত্র নন। সুতরাং যিশু খ্রিস্ট ও হঃ মুহম্মদের সাথে তুলনা করে তাঁরা এবার শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্বকে আন্তর্জাতিক স্তরে ‘উন্নীত’ করতে সচেষ্ট হলেন। এর ফলে শ্রীরামকৃষ্ণকে গৌরবান্বিত করা হলো, না তাঁর মহিমাকে খর্ব করা হলো, হীনমন্যতায় ভোগা কেশবগোষ্ঠীর কাছে তা উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। মজার ব্যাপার, এখানে কিন্তু শ্রীগৌরাঙ্গের ভাবকে মানদণ্ড করে যিশু বা নবীর তুলনা করা হলো না, পরিবর্তে যিশুর সাথে শ্রীরামকৃষ্ণের সাদৃশ্য খোঁজা শুরু হলো। তাঁদের ভাবনা ভবিষ্যৎ শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীদের মধ্যেও সংক্রমিত হলো। এর অন্যতম নিদর্শন ‘সুরেন্দ্রের পট’, যেখানে চিত্রিত হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের কেশবকে হিন্দু, মুসলমান আদি ধর্মের সমন্বয়ের শিক্ষা দিতে।[26] প্রকৃত ঘটনা হলো, শ্রীরামকৃষ্ণ সকাশে আসার পূর্বেই কেশবচন্দ্র সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী প্রচার করতেন, আমরা তা ইতিপূর্বে দেখেছি।

১৮৯৩-১৮৯৭ বর্ষে স্বামী বিবেকানন্দের পাশ্চাত্য অভিযানের সাফল্য শ্রীরামকৃষ্ণ অনুগামীদের মধ্যে এই ভাবনাকে আরও বলবতী করে। ১৮৯৭-এ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রকাশ করেন কথামৃতের ইংরেজি সংস্করণ, Gospel of Sri Ramakrishna। কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা শ্রীম ছিলেন কেশবচন্দ্রের অন্যতম অনুগামী। শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন ১৮৮২ বর্ষে। শ্রীরামকৃষ্ণের একনিষ্ঠ শিষ্য শ্ৰীম যিশুরও ছিলেন পরম ভক্ত। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট এবং ঈশানুসরণ তিনি উত্তমরূপে অধ্যয়ন করেছিলেন। যিশুর প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ ও নিজ গুরুকে জগতের কাছে সমতুল্যভাবে উপস্থাপন করতে, খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারক বা ‘evangelist’-এর ন্যায় প্রথমে তিনি কথামৃতের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেন, বাইবেলের আদলে নামকরণ করেন Gospel of Sri Ramakrishna। দু’টি খণ্ড প্রকাশিত হবার পর আর এক ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত প্রস্তাব দেন বাঙ্গলা সংস্করণ প্রকাশের, যার পরিণতি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত। ১৯০২ থেকে কথামৃত প্রকাশিত হতে শুরু করলে মিশনে ভক্ত ও বৈরাগ্যবান যুবকদের আগমন ঘটতে শুরু করে মূলত মহেন্দ্রনাথের গ্রন্থের সুবাদে, স্বামীজীর বাণী ও রচনা পাঠ করে নয়।[27] এরপর ১৯২০-তে শ্রীমা সারদা এবং ১৯২২-এ স্বামী ব্রহ্মানন্দ ইহলোক ত্যাগ করলে কথামৃত প্রভাবিত নবাগত সন্ন্যাসীদের কাছে শ্রীম হয়ে ওঠেন মুখ্য আকর্ষণ। তাঁর যিশুপ্রীতির প্রকাশ কথামৃত ও স্বামী নিত্যাত্মানন্দ প্রণীত ষোল খণ্ডের শ্ৰীম দর্শন-এ ইতস্ততঃ পাওয়া যায়। সুতরাং তাঁর যিশুপ্রীতি এই নবীন সন্ন্যাসীদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।

ওদিকে স্বামী বিবেকানন্দের তিরোধানের পর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কর্তৃপক্ষ দ্বারা শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বধর্মসমন্বয়কারী অবতার হিসেবে উপস্থাপন করার আগ্রহ ও প্রচেষ্টা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯০৯ বর্ষে স্বামী সারদানন্দ বা শরৎ মহারাজ যখন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থ লিখতে শুরু করেন তখন ভক্তমণ্ডলীর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্মসমন্বয়কারী অবতার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। গ্রন্থটি সেই ধারণার অনুসরণ করে এবং উপক্রমণিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের অবতরণের একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন যেখানে সেযুগের পরাধীন হিন্দুদের নিজেদের হীনমন্যতা ও সেকারণে পরমহংসদেবের অবতারত্বে বিশ্বাসের মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে—

যুগ-প্রয়োজন উপস্থিত হইলে অমিতগুণসম্পন্ন অবতারপুরুষের শুভাবির্ভাব এখনো [ভারতে] দৃষ্ট হইয়া থাকে। […] আবার কি সেই কাল উপস্থিত হইয়াছে? আবার কি বিদেশীর ঘৃণাস্পদ, নষ্টগৌরব, দরিদ্র ভারতে যুগ-প্রয়োজন উপস্থিত হইয়া শ্রীভগবানের করুণায় বিষম উত্তেজনা আনয়নপূর্বক তাঁহাকে বর্তমানকালে শরীরপরিগ্রহ করিয়াছে? হে পাঠক, অশেষকল্যাণগুণসম্পন্ন যে মহাপুরুষের কথা আমরা তোমাকে বলিতে বসিয়াছি, তাঁহার জীবনালোচনায় বুঝিতে পারা যাইবে, ঘটনা ঐরূপ হইয়াছ—শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণাদিরূপে পূর্ব পূর্ব যুগে যিনি আবির্ভুত হইয়া সনাতন ধর্ম সংস্থাপিত করিয়াছিলেন, বর্তমানকালের যুগ-প্রয়োজন সাধিত করিতে তাঁহার শুভাগমন প্রত্যক্ষ করিয়া ভারত পুনরায় ধন্য হইয়াছে।[28]

কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় পরমহংসদেব দুষ্কৃতীদের বিনাশ করেননি, সুতরাং সেই অভাব পূরণ করতে ভক্তদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘সর্বধর্মসমন্বকারী’। শ্রীরামকৃষ্ণের এই সর্বধর্মসমন্বকারী ভাবমূর্তির প্রচার এগোয় দু’টি পথ ধরে।

প্রথমতঃ আলোচনার পটভূমি ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘যত মত তত পথ’-এর ব্যাখ্যা করা হলো ‘সব ধর্ম সমান’, অথচ শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই সকল পথকে সমান মর্যাদা দেননি। একটি সাধন পথ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,

“এ-সব সাধন বড় নোংরা সাধন; যেমন পায়খানার ভিতর দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকা!”[29]

সব ধর্মের শিক্ষা এক, এমন দাবিও তিনি করেননি। খ্রিস্টধর্ম প্রসঙ্গে দেখি তিনি কেশবচন্দ্রকে বলছেন,

“খ্রীষ্টানদের একখানা বই একজন দিলে, আমি পড়ে শুনাতে বললুম। তাতে কেবল ‘পাপ’ আর ‘পাপ’! […] কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এই সব কথা কেন? একবার বল যে অন্যায় কর্ম যা করেছি, তা আর করব না।”[30]

দুৰ্ভাগ্যবশতঃ ভক্তরা বুঝিয়ে বললেন না যে, খ্রিস্টতত্ত্বে এই ‘পাপ’ কোন সাধারণ পাপ নয়, তা হল আদম-ঈভের ‘আদি পাপ’ (‘Original Sin’) যার জন্য তিনি সহ সবাই নরকগামী হবেন যদি যিশুকে সেই পাপ হতে উদ্ধারকর্তা (‘Saviour’) হিসেবে আমরা না গ্রহণ করি। অন্যথা খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর ও মিশনের বার্তা হয়ত সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো।

দ্বিতীয় পন্থা হয় তাঁর তথাকথিত ইসলাম ও খ্রিস্ট মতের সাধনাকে অতিরঞ্জিত করে। শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম সাধনকে আদৌ কোন মুসলমানী সাধন ছিল না। প্রথমতঃ মুসলমানত্বের পরিচয় কলেমায় আস্থা স্থাপনে; সাধনভজনের কোন প্রয়োজন এখানে নেই কারণ এই মতে জীবন একটিই, আর মৃত্যুর পর অপেক্ষা করছে অনন্ত জন্নত (স্বর্গ) অথবা অনন্ত দোজখ (নরক)। দ্বিতীয়তঃ পরমহংসদেব মূলধারার ইসলাম হতে বিচ্ছিন্ন কোন এক সুফী পরম্পরায় দীক্ষা নিয়েছিলেন এক হিন্দু সাধক গোবিন্দ রায়ের কাছে। স্বামী সারদানন্দের লীলাপ্রসঙ্গে যে বিবরণ পাওয়া তাতে দেখি তিনি মুসলমানদের মতো পাঁচবারের পরিবর্তে হিন্দুরীতি অনুযায়ী ত্রিসন্ধ্যা নামাজ পড়তেন এবং ‘আল্লা’ মন্ত্র জপ করতেন। এই সাধনকালে তিনি এক জ্যোতির্ময় পুরুষের দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। লক্ষণীয় হলো, এসময়ে তাঁর মধ্যে হিন্দুভাব লুপ্ত হয়েছিল এবং কালীমন্দিরে একবারও পদার্পন করেননি। তাঁর ভাগ্নে হৃদয়ের বক্তব্য, তাঁর এসময় গোমাংস ভক্ষণের ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু অপরের অনুরোধে নিরস্ত হন। তা সত্ত্বেও স্বামী সারদানন্দ গ্রন্থে আশা প্রকাশ করেছিলেন,  হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পর্বত-প্রমাণ ব্যবধান রয়েছে তা অন্তর্হিত হবার সূচনা হয়েছে পরমহংসদেবের এই সাধনার দ্বারা।[31] সেরকম কোন সূচনাই যে হয়নি তার প্রমাণ বিংশ শতকের দেশভাগ ও ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস, কিন্তু তাতেও মিশন কর্তৃপক্ষ এরূপ প্রচার থেকে বিরত হয়নি।

খ্রিস্টধর্মের ক্ষেত্রে অবশ্য কোন সাধন বা দীক্ষাগ্রহণ পর্ব ছিল না। একদিন যিশুর মূর্তি হতে এক আলোকরশ্মি পরমহংসদেবের অন্তরে প্রবেশ করার পর তিনদিন তাঁর হিন্দু সংস্কাররাশি বিলুপ্ত হয়েছিল এবং জগন্মাতাকে ভুলে গিয়েছিলেন। অবশেষে তিনদিন অতিক্রান্ত হলে এক দেবমানব তাঁর সম্মুখে আবির্ভুত হয়ে তাঁর শরীরে লীন হলে পর পুনরায় নিজের ভাব ফিরে পান।

এই দুই পর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন প্রসঙ্গে রামস্বরূপ বলেছেন যে এতে দৃশ্যের থেকে দ্রষ্টা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। গাছের তলায় থাকা এক বালকের মধ্যে যেমন তিনি শ্রীকৃষ্ণকে অথবা চিড়িয়াখানার বাঘের মধ্যে জগন্মাতার বাহনকে দর্শন করেছিলেন এও তেমনই। সুতরাং এর ভিত্তিতে সকল ধর্ম ও তাদের প্রফেটদের শিক্ষার সমানতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা অর্থহীন —

The students of Yoga know that “visions” are of a limited value and they prove very little. The luminous figure which Ramakrishna saw and which he identified as those of Jesus and Mohammed belong to the category of visions. They tell us more about the visionary than about the object visioned. The fact is that Ramakrishna was a prodigy. Whatever he gave his thought to was coloured by the purity of his mind and appeared to him in ecstatic image. He saw a small European boy under a tree; at once he fell into an ecstasy seeing in the boy the image of Krishna. He went to a zoo and saw a tiger; this induced in him for ecstasy for in the tiger he saw the vahan (vehicle) of Mother Durga. […]

From the Yogic viewpoint also there was nothing unusual or extraordinary about Ramakrishna’s visions of Jesus and Muhammad. When one meditates on the object (karmasthana), it undergoes several successive modifications. It gets internalized; it loses its blemishes; it assumes a luminous form (jyotismati); it assumes a joyous form (visoka). All this is a normal process of yogic modification and ingestion. The same thing happened to the “thoughts” of Muhammad and Jesus when they passed through the crucible of Ramakrishna’s mind. It need not give birth to an indiscriminate theology like the one produced by the Mission—that all prophets and religions are equal and that they all say the same thing.[32]

অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, সর্বধর্মসমন্বয়ের হেতু শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের তত্ত্বকে স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রীমা, উভয়েই গ্রহণ করেননি। রামকৃষ্ণ মঠের নিয়মাবলীর সপ্তম অধ্যায়, ‘ভারতবর্ষের কার্য্যপ্রণালী’-তে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য হিন্দু জাতি ও ধর্মের রক্ষা—

    1. When the Muslims first came to India, there were, according to their historical records, sixty crores of Hindus in India. This calculation suffers rather from underestimation than exaggeration; for lots of people perished solely through the persecution of the Muslims. Therefore it is obvious that the number of the Hindus was even more than sixty crores – on no account less than that. But today the same Hindus have dwindled into twenty crores. Over and above that, with the ascendancy of the Christian powers, about two crores of people have become Christians and more than a lakh of people are becoming Christians every year. It is specially for the preservation of the Hindu race and religion that Bhagavan Sri Ramakrishna, the embodiment of mercy, has incarnated Himself.[33]

মিশনের এক সন্ন্যাসী শ্রীমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “মা, এবারে ঠাকুর কি একটা নূতন ভাব দেবার জন্যে এসেছিলেন—সর্বধর্মসমন্বয় করে গেলেন?” শ্রীমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল—

“দেখো বাবা, তিনি যে সমন্বয়-ভাব প্রচার করবার মতলবে সব ধর্মমত সাধন করেছিলেন, তা কিন্তু আমার মনে হয় নাই। তিনি সর্বদা ভগবদ্ভাবেই বিভোর থাকতেন। খ্রীস্টান, মুসলমান, বৈষ্ণব – যে যে-ভাবে তাঁকে ভজন করে সেই বস্তু লাভ করে, তিনি সেইসব ভাবে সাধনা করে নানা লীলা আস্বাদন করতেন, দিনরাত কোথা দিয়ে কেটে যেত, কোন হুঁশ থাকত না তাঁর।”[34]

শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবশ্য শ্রীমার মত স্বামিজীর থেকে ভিন্ন—

“তবে কি জানো বাবা, এই যুগে, এই কালে তাঁর ত্যাগই হলো আদর্শ। […] তাঁর ত্যাগ দেখেই লোকে আকৃষ্ট।”[35]

কেশবচন্দ্রের ভাবধারা ও তার দ্বারা প্রভাবিত মিশনের সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রচার ভীষণভাবে প্রভাবিত করে অখণ্ড বাঙ্গলার রাজনীতিকে এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু রাষ্ট্রবাদী আন্দোলনকে। মিশনের এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রচারের প্রভাব সর্বাধিক পড়ে ১৮৯০-এর সময় থেকে জন্ম নেওয়া বিপ্লবী ও রাজনীতি সচেতন বাঙ্গালী যুবকদের মধ্যে। স্বামীজীর সৌজন্যে সেযুগের রাজনীতি সচেতন মানুষের অনেকেই মিশনের সংস্পর্শে আসেন। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা তাঁদের কাছে মূল পাঠ্য হলেও মিশনের ধর্মনিরপেক্ষ ভাষ্য দ্বারা তাঁরা প্রভাবিত হন। বাণী ও রচনার সঙ্কলনেও ছিল (এবং আছে) একটি সমস্যা—দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজীর বক্তব্যকে প্রথমদিকের খণ্ডগুলিতে স্থান না দিয়ে, পাশ্চাত্যবাসীর উদ্দেশ্যে রাখা বক্তৃতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলো। তৎকালীন উগ্র পরধর্মদ্বেষী, সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার পাশ্চাত্যবাসীদের উদ্দেশ্য তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতার বাণী ভক্তমণ্ডলীর মনকে অধিক প্রভাবিত করলো।

এই ভাবান্দোলন শুধু বাঙ্গালীর ধর্মীয় ভাবনাকেই দিগ্ভ্রান্ত করেনি, জাতির ইতিহাস চেতনাকেও বিপথে চালিত করেছে। বামৈস্লামিক ইতিহাসবিদ গোষ্ঠীর পিতামহ ইরফান হাবিবের বাবা মুহম্মদ হাবিব ইসলামী শাসক ও আগ্রাসনকারীদের রক্তাক্ত ইতিহাসের উপর চুনকাম করতে যেমন মাহমুদ গজনভিকে বেছে নিয়েছিলেন,[36] কেশবচন্দ্রের ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত বাঙ্গলার নব্য সেক্যুলার সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদরা তেমনই ভাবে বেছে নিয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলাকে। সিরাজের মতো হিন্দুদ্বেষী, নিষ্ঠুর ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে নিয়ে বাঙ্গালীর রোম্যান্টিকতার শুরু ১৮৭৫-এ কেশবচন্দ্রের ভাই কবি নবীনচন্দ্র সেনেরপলাশীর যুদ্ধ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে। এরপর এগিয়ে আসেন রাজশাহীর অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ হলেও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ছিলেন তাঁর পিতা মথুরানাথের মতোই রাজশাহী ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য।[37] ১৮৯৮-এ তিনি প্রকাশ করেন সিরাজদ্দৌলা নামের গবেষণামূলক গ্রন্থ যেখানে তিনি সিরাজের দোষ দেখেও দেখেননি কিন্তু অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন ইংরেজ বিরোধিতার জন্য। এর সাথে লেখায় মিশেছে লেখকের ধর্মীয় সম্প্রীতির কল্পনা এবং বিশ্বাস যে মুসলমান নবাবরা নিজেদের ‘বাঙ্গালী’ বলে পরিচয় দিতেন! প্রথমতঃ আলীবর্দীর রক্ত ছিল আরব-তুর্কি মিশ্র[38], এবং কোন পুত্র সন্তান না থাকার কারণে নিজের ভাই হাজি আহমেদের তিন পুত্রের সাথে নিজের তিন মেয়ের বিয়ে দেন।[39] সুতরাং সিরাজও ছিলেন রক্তে আরব-তুর্কি। দ্বিতীয়তঃ শুধু আলীবর্দী বা সিরাজউদ্দৌলা নন, সে যুগের কোন আশরাফি পরিবার বাঙ্গলা জানতেন না; বঙ্গে আশরাফিরা অন্দরমহলে বাঙ্গলায় কথা বলা শুরু করেন উনিশ শতকের শেষ থেকে। উল্টে কাফেরদের মাতৃভভাষা বাঙ্গলা হবার দরুন নবাবী আমলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বাঙ্গলায় যথেচ্ছ আরবি-ফার্সি-উর্দু শব্দ মিশিয়ে ‘মুসলমানি বাঙ্গলা’ ভাষার সৃষ্টি হয়।

নবীনচন্দ্রের কাব্য ও অক্ষয়কুমারের ঐতিহাসিক গ্রন্থের প্রভাব সীমিত ছিল উচ্চশিক্ষিত মহলে। সাধারণ বাঙ্গালীর মনের মণিকোঠায় সিরাজকে স্থান করে দিতে মুখ্য ভূমিকা নেন শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীর উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক গিরিশচন্দ্র ঘোষ; ১৯০৬ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয় তাঁর রচিত নাটক সিরাজউদ্দৌলা। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সেই উজানে বাঙ্গালীর হৃদয়ে সিরাজের প্রতি সহমর্মিতা জাগাতে ও বঙ্গদেশের রাজনীতির সেক্যুলারায়নের পালে হাওয়া দিতে নাটকটি যথেষ্ট সমর্থ হয়।

এরূপ কেশবচন্দ্র প্রভাবিত রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ভাবধারা, ইংরেজ বিরোধী ইতিহাস চর্চা ও জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক মাধ্যমের প্রভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তরুণ ও মধ্যবয়সী রাজনীতিকরা মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে উপেক্ষা করে, লঘু করে, অথবা তাকে স্বল্প তোষণ করে সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ বিরোধিতায় নিজেদের শক্তি নিয়োগ করেন। ফলতঃ বাঙ্গলার মূলধারার রাজনীতি থেকে হিন্দু রাষ্ট্রবাদের প্রভাব মুছে যায়। বস্তুতঃ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের নিস্পৃহ ও নিষ্ক্রিয় করতে মোহনদাস গান্ধী যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, বাঙ্গলায় সমকালে সেই স্থানটি গ্রহণ করেছিল রামকৃষ্ণ মিশন। এর বিষময় পরিণাম বাঙ্গালীকে ভুগতে হয়েছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগে। দেশভাগ যে রোধ করা যেত তা নয়, সেটা অভিপ্রেত ছিল কিনা তাও বিচার্য, কারণ জনচরিত্রের কারণেই পূর্ববঙ্গ এবং অধুনা পাকিস্তান অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য এবং অখণ্ড বঙ্গের রাজীনীতিতে থাকত মুসলমান আধিপত্য। কিন্তু মিশন যদি হিন্দু সমাজের স্বার্থে অবস্থান নিত তাহলে নিঃসন্দেহে বাঙ্গলার হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃত্ব পূর্ব হতেই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে প্রস্তুতু হতেন, এবং দেশভাগের সময় পাঞ্জাবের মতো জনবিনিময় সুনিশ্চিত করতেন। বাঙ্গালীর ইতিহাসও তাহলে অন্যদিকে মোড় নিতো।

স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উপর মিশনের পরোক্ষ প্রভাব পড়ে সঙ্ঘের দ্বিতীয় প্রধান মাধবরাও গোলওয়ালকরের মাধ্যমে। গোলওয়ালকর ছিলেন স্বামী অখণ্ডানন্দের শিষ্য এবং বেশ কিছুকাল তিনি সারগাছি আশ্রমে গুরুসান্নিধ্যে কাটান। সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রভাবে তিনি সরসঙ্ঘচালক থাকাকালীন হিন্দু আন্দোলনে কোথাও ইসলাম বা খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে কোন গভীর অনুসন্ধানের পরিচয় পাওয়া যায় না। বরং বিশিষ্ট নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ‘একাত্ম মানববাদ’ তত্ত্বে দেখি ধর্মতত্ত্বকে হিন্দুধর্ম হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তা হয়ে উঠেছে সার্বজনীন; পাকিস্তানের মতো ধর্মতান্ত্রিক দেশে ইসলাম ধর্মমতের দর্শন ও প্রেরণার প্রভাবকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক বৈষম্যকে পাকিস্তানের ধর্মতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করা হয়েছে—

[পাকিস্তানে] মুসলমান ছাড়া বাকিরা সবাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এই পার্থক্য ছাড়া পাকিস্তানের প্রশাসনে ইসলামের আর কোন চিহ্ন নেই। কুরআন, মসজিদ, রোজা, ইদ, নামাজ ইত্যাদি ভারতে যা পাকিস্তানেও তাই।[40]

ধর্মতত্ত্বকে এভাবে অস্বীকার করার ফলে সঙ্ঘের ‘হিন্দু রাষ্ট্রসত্তা’-র সংজ্ঞাও বর্তমানে আরও ব্যাপ্তি লাভ করে উৎকট রূপ ধারণ করেছে—হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য বিচার্য নয়, ভারতীয় মাত্রই একজন ‘হিন্দু’।[41] ইতিহাস ও বাস্তব বিরোধী এমন বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করতে তাই আজ সঙ্ঘকেও বামদের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হচ্ছে, হিন্দু-মুসলিম সংঘাত ইংরেজদের সৃষ্টি![42] বাঙ্গালীর ক্ষেত্রে যে দুর্ভাগ্য নেমে এসেছিল রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতায়, সমগ্র হিন্দু জাতির উপর সেরকম দুর্ভাগ্য নেমে আসবে কিনা সেটা ভবিষ্যতই বলবে।

প্রসঙ্গসূত্র:

[1] Sri Aurobindo, India’s Rebirth, Institut de Recherches Evolutives (Paris) and Mira Aditi (Mysore), 1997, pp. 106-107

[2] স্বামী বিবেকানন্দ, ‘বর্তমান সমস্যা’, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ঠ খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ, পৃ. ২৬-২৭

[3] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘“স্বদেশী সমাজ” প্রবন্ধের পরিশিষ্ট’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, পৌষ ১৪১০, পৃ. ৬৪৫

[4] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘“স্বদেশী সমাজ” প্রবন্ধের পরিশিষ্ট’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, পৌষ ১৪১০, পৃ. ৬৪৫

[5] শ্ৰীম, ‘১৮৮৪, ৭ সেপ্টেম্বর’, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, জুলাই ১৯৯২, পৃ. ৬৩৮

[6] Eknath Easwaran, The Dhammapada, Nilgiri Press, 2007, pp. 56-57

[7] শ্ৰীম, ‘১৮৮২, ২৭ অক্টোবর’, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, অখণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, জুলাই ১৯৯২, পৃ. ৯৪

[8] “Islam’s borders are bloody and so are its innards.”

[9] বেদ মীমাংসা, ১ম খণ্ড; উদ্ধৃত: গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, ‘শ্রীমৎ অনির্বাণ’, মহাজন সংবাদ, প্রাচী পাবলিকেশনস্, ২০১৩, পৃ. ২৩৭

[10] হরিদাস বসু, সদ্গুরুর লীলা, শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ আশ্রম, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১১৯

[11] ইংরেজি অনুবাদ সহ লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে পাঠ: https://www.youtube.com/watch?v=u3ohSZ1gm9E

[12] সখারাম দেউস্কর লিখেছেন,

নানাস্থানে অনুসন্ধান করিতে করিতে সহসা এক পর্বতে স্বামীর সহিত শিবাজীর সাক্ষাৎকার ঘটে। তিনি সমর্থের চরণ-বন্দনা করিয়া তাঁহার নিকট মন্ত্রপোদেশ গ্রহণের ও তাঁহার সেবার অধিকারী হইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। স্বামী বলিলেন, “তুমি প্রাসাদবিহারী রাজপুত্র, আমরা অরণ্যচর সন্ন্যাসী; ধর্মসাধনও সহজসাধ্য নহে। অতএব তুমি এই বিসদৃশ অভিলাষ পরিত্যাগ কর। অকারণ ‘ভেক ধারণ’ করিয়া জগৎকে প্রতারিত করায় ফল কি।” এই কথা শুনিয়া রাজপুত্র বাষ্পাকুল-লোচনে বলিলেন,—“রাজ্যধন সমস্তই আপনার চরণে সমর্পণ করিয়াছি। এই দাসকে দীনহীন জানিয়া অনুগ্রহপ্রকাশে সনাথ করিবার আদেশ হউক।” শিবাজীর সংকল্প অটল দেখিয়া রামদাস তাঁহার প্রার্থনা পূর্ণ করিতে স্বীকৃত হইলেন।

(সখারাম গণেশ দেউস্কর, ‘শিবাজীর দীক্ষা’, সুবিমল মিশ্র (সম্পাদক), সখারাম গণেশ দেউস্কর বাংলা রচনা সম্ভার, পৃথা মিশ্র (প্রকাশিকা), ২০১৮, পৃ. ২৮৫-২৮৬)

[13] শিবদিগ্বিজয় নামক গ্রন্থ হতে দেউস্করের অনুবাদ।

সখারাম গণেশ দেউস্কর, ‘শিবাজীর দীক্ষা’, সুবিমল মিশ্র (সম্পাদক), সখারাম গণেশ দেউস্কর বাংলা রচনা সম্ভার, পৃথা মিশ্র (প্রকাশিকা), ২০১৮, পৃ. ২৮৬-২৮৭

[14] শিবাজী দেহ রাখেন ১৬৮০ বর্ষে, আর রঘুনাথ রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা মুঘলদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে ১৭৫৭-তে দিল্লীর যুদ্ধে।

[15] শ্রীশ্রীচণ্ডী ও শ্রীশ্রীগীতার বিশেষত্ব এই দুই মহাগ্রন্থ নিবৃত্তি ও প্রবৃত্তি, উভয় মার্গের পাঠকের উদ্দেশ্যে রচিত, প্রয়োজন শুধু বৃত্তি উপযোগী ব্যাখ্যার।

[16] শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামি-শিষ্য-সংবাদ, উদ্বোধন কার্যালয়, জানুয়ারি ২৯১২, পৃ. ১২৬

[17] Ram Swarup, The Word As Revelation: Names of Gods, Voice of India, 2001, p. 135

[18] Abidullah Al-Ansari Ghazi, Raja Rammohun Roy: An Encounter with Islam and Christianity And the Articulation of Hindu Self-consciousness, Xlibris Corporation, 2010, p. 79

[19] Abidullah Al-Ansari Ghazi, Raja Rammohun Roy: An Encounter with Islam and Christianity And the Articulation of Hindu Self-consciousness, Xlibris Corporation, 2010, p. 82

[20] Sita Ram Goel, ‘Encounter with Raja Ram Mohun Ray’, History of Hindu-Christian Encounters (AD 304 to 1996), Voice of India, 1996, p. 55

[21] উদ্ধৃত: বিপিনচন্দ্র পাল, নবযুগের বাংলা, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১২, পৃ. ৮৩

[22] শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন-বঙ্গসমাজ, S. K. Lahiri & Co., ১৯০৯, পৃ. ২৭৩

[23] স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, পুস্তক বিপণি, আগস্ট ২০১৬, পৃ. ৩১৪-৩১৫

[24] উদ্ধৃত: স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, পুস্তক বিপণি, আগস্ট ২০১৬, পৃ. ৩২২

[25] উদ্ধৃত: স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, পুস্তক বিপণি, আগস্ট ২০১৬, পৃ. ৩২৩

[26] স্বামী প্রভানন্দ, ‘সুরেন্দ্রের পট’, আনন্দরূপ শ্রীরামকৃষ্ণ, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১২, পৃ. ১২৪

[27] রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের চতুর্থ অধ্যক্ষ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ শ্ৰীমকে বলেছিলেন, “মাস্টারমশায়, আপনি কি অদ্ভুত ‘কথামৃত’-ই লিখেছেন! তাতে কী যে মোহিনী শক্তি আছে তা মুখে বলে শেষ করা যায় না। যে পড়ে, সে-ই অবাক হয়ে যায়। ‘কথামৃত’ পড়েই অধিকাংশ লোক সাধু হতে আসে।…”

(স্বামী জগন্নাথানন্দ, ‘শ্ৰীম জীবন কথা’, স্বামী চেতনানন্দ (সম্পাঃ), শ্ৰীম সমীপে, উদ্বোধন কার্যালয়, মে ২০১৪, পৃ. ১৭-১৮)

[28] স্বামী সারদানন্দ, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথম ভাগ, উদ্বোধন কার্যালয়, জুলাই ২০০৮, পৃ. ৫-৬

[29] শ্ৰীম, ‘১৮৮৪, ৭ সেপ্টেম্বর’, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, জুলাই ১৯৯২, পৃ. ৬২৭

[30] শ্ৰীম, ‘১৮৮২, ২৭ অক্টোবর’, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, জুলাই ১৯৯২, পৃ. ৯৯

[31] স্বামী সারদানন্দ, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথম ভাগ, উদ্বোধন কার্যালয়, জুলাই ২০০৮, পৃ. ১৭৭

[32] Ram Swarup, ‘Sri Ramakrishna’s Alleged “Practice of Islam and Christianity”’, Hinduism and Monotheistic Religions, Voice of India, 2009, pp. 145-146. 

[33] Swami Vivekananda, ‘Plan of Work for India’, Rules and Regulations of the Ramakrishna Math Belur, 1898, P.K. Chattopadhyaya (Publisher), 1991, p. 11

প্রসঙ্গতঃ বলা দরকার, রামকৃষ্ণ মঠ থেকে কখনও মঠের নিয়মাবলী প্রকাশিত হয়নি। মঠ কর্তৃপক্ষের কিছু পদক্ষেপের প্রতিবাদ করতে তৎকালীন শ্রীমায়ের একমাত্র জীবিত শিষ্য প্রবীণ সন্ন্যাসী স্বামী নিত্যস্বরূপানন্দ Back to Vivekananda শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে মঠের নিয়মাবলী সংযোজিত হয়েছিল। সাহিত্যিক ডঃ রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় নিয়মাবলীটি আলাদা করে প্রকাশিত হয়।

[34] স্বামী ঈশানানন্দ, মাতৃসান্নিধ্যে, উদ্বোধন কার্যালয়, এপ্রিল ২০১১, পৃ. ১০৮

[35] স্বামী ঈশানানন্দ, মাতৃসান্নিধ্যে, উদ্বোধন কার্যালয়, এপ্রিল ২০১১, পৃ. ১০৮

[36] ১৯২০-র দশকে লেখা হাবিবের রচিত গ্রন্থটির নাম সুলতান মাহমুদ অফ গাজনিন। হাবিবের বইটি রচনার উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রতিপন্ন করা যে, মাহমুদের নৃশংসতা ও মন্দির-বিগ্রহ ধ্বংসের কারণ অর্থনীতি ও তাঁর হীন চরিত্র, ইসলাম তার জন্য দায়ী নয়।

[37] Dr. Sudash Lama, Prasenjit Roy , ‘Akshay Kumar Maitreya and His Scholastic World in Historical View’, Journal of People’s History and Culture, Vol. 6, No. 2, December 2020, p. 57:

It would seem unbelievable to hear that the devout Hindu Brahmin Akshay Kumar was an active member of the ‘Rajshahi Brahmo Samaj’. The annual festivals and other festivals of the ‘Rajshahi Brahmo Samaj’ were successful in his endeavors. Notably, Akshay Kumar’s father Mathuranath was also the editor of ‘Rajshahi-Brahmo Samaj’ for a long time.

প্রসঙ্গত বলা দরকার, পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মরা আদি ব্রাহ্মসমাজের চেয়ে বেশি কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বানুরাগী ছিলেন। আগ্রহী পাঠক শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ-এর দ্বাদশ পরিচ্ছেদ এবং ২০১৭-তে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুনতাসীর মামুনের উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্ম আন্দোলন (অনন্যা প্রকাশনী) বইটি দেখতে পারেন।

[38] William Dalrymple, The Anarchy, Bloomsbury, 2020, p. xxiii

[39] অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, সিরাজদ্দৌলা, মজুমদার লাইব্রেরী, ১৯০২, পৃ. ১৩

[40] দীনদয়াল উপাধ্যায় লিখেছেন,

[In Pakistan], apart from Muslims, all the rest are second-class citizens. Apart from this difference, there is no other sign of Islam in Pakistan’s administration. The Quran, Masjid, Roza, Id, Namaz, etc. are the same both in Bharat, as well as in Pakistan.

(Deendayal Upadhyay, Lecture 3, ‘Dharma Rajya Is Not A Theocracy’, Integral Humanism, Deendayal Research Institute, 2002, e-book: http://www.chitrakoot.org/download/IntegralHumanism.pdf)

[41] ‘Muslims are Hindus by nationality, they are Muslims by faith only: Mohan Bhagwat’, Hindustan Times, 8 Feb 2017, https://www.hindustantimes.com/india-news/muslims-are-hindus-by-nationality-they-are-muslims-by-faith-only-mohan-bhagwat/story-KoIfTd0cudVXS1Q23kUmzO.html

[42] ‘Faceoff: Bhagwat blames British for dividing Hindus and Muslims, fuels wars of words’, The Times of India, 7 Sep 2021, http://timesofindia.indiatimes.com/articleshow/86006537.cms