কোভিড ভ্যাক্সিনের দামের বৈষম্য এবং অক্সিজেনের অভাব

0
699

এই দুটো বিষয়ই নির্ভেজাল অপপ্রচার। কোনোটির বাস্তব ভিত্তি নেই, যদিও আপাতদৃষ্টিতে দুটোই সত্যি বলে মনে হচ্ছে।

গত ২রা জানুয়ারী কেন্দ্রীয় স্বাস্হ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে সারা ভারত জুড়ে ১ কোটি স্বাস্হ্যকর্মী ও ২ কোটি ফ্রন্টলাইন কর্মীকে বিনামূল্যে করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে। সেইমতো চুক্তি করা হয় সেরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেকের সাথে। চুক্তি অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট আপৎকালীন অবস্থা ও সমাজের প্রতি কর্পোরেটদের কর্তব্য এর কথা উল্লেখ করে জানায় যে তারা প্রথম ১০ কোটি কোভিশিল্ড ডোজের জন্য সরকারকে একটি বিশেষ দর দিচ্ছে, যা হল ২০০ টাকা প্রতি ডোজ (ট্যাক্স নিয়ে ২২০ টাকা), কিন্তু এরপর তারা ডোজ প্রতি ১০০০ টাকা চার্জ করবে এবং খোলা বাজারে বিক্রি করবে। ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের সরকারের ক্রয়মূল্য ছিল ৩০৯ টাকা (ট্যাক্স সহ)। খবরটি প্রকাশিত হয় এই বছরের ১২ই জানুয়ারি। মূল কম্পানি অ্যস্ত্রাজেনেসিয়া কে আয়ের ৫০% দিতে হয় সেরাম ইনস্টিটিউটকে। ফলে, ডোজ প্রতি ওদের লাভের পরিবর্তে ক্ষতি হচ্ছিল। এরমধ্যেই বিদেশ থেকে বিভিন্ন সরকার-সমাজসেবী সংস্হা থেকেও তারা ভ্যাক্সিন সরবরাহের বরাত পায় (time bound) এবং দেশেও ভ্যাক্সিনের চাহিদা বেড়ে চলে। ফলে প্রয়োজন হয় প্রডাকশান ক্যাপাসিটি বাড়ানোর। সেজন্য গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকার কোনো ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি ছাড়াই তাদের ৩০০০ কোটি টাকা (এবং ভারত বায়োটেককে প্রায় ১৫০০ কোটি) ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় (এসবই খরচ এবছরের বাজেটে উল্লেখিত কোভিড ভ্যাক্সিন বাবদ ধরা ৩৫,০০০ কোটির তহবিল থেকে)। এর পরিবর্তে সরকার তাদের আরো ১১ কোটি ডোজ ৩১শে জুলাই এর মধ্যে নূন্যতম মূল্যে দিতে বলে, যা হল ১৫০ টাকা/ডোজ। অ্যস্ত্রাজেনেসিয়া কে আয়ের অর্ধেক দিয়ে এই দামে সেরাম ইনস্টিটিউটের ডোজ প্রতি ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১৫০ টাকা, তা সত্ত্বেও তারা রাজি হয়। কারণ, সময়ের মধ্যে বিদেশে কমার্শিয়াল কমিটমেন্ট রক্ষা না করলে তাদের উপর চাপবে বিশাল ফাইন ও পেনাল্টি। কিন্তু, তাই বলে তাদের আগের ঘোষিত ১০০০ টাকা/ডোজ অনুযায়ী বাজারে ভ্যাক্সিন বিক্রির ব্যাপারটা কিন্তু ভারত সরকার মেনে নেয় না। কেন্দ্রীয় সরকার দর কষাকষি করে বলে যে রাজ্য সরকারগুলোকে ৪০০ টাকা/ডোজ ও বেসরকারি সংস্থাকে ডোজ প্রতি ৬০০ টাকায় তাদের ভ্যাক্সিন বিক্রি করতে হবে (মোট উৎপাদনের ৫০%)। এর ফলেই এই আপাত বৈষম্য। আদতে এই ১০+১১=২১ কোটি ডোজের পর কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার বা খোলা বাজারে সেরাম ইনস্টিটিউট কিন্তু প্রতি ডোজ কোভিশিল্ড ১০০০ টাকাতেই বিক্রি করবে। তখন অবশ্য ভোট থাকবে না বলে আর কোন রাজনৈতিক দল এমন হুক্কাহুয়া করবে বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, ফাইজারের মত বিদেশি কোম্পানিগুলোর ভ্যাক্সিনের দাম দেড় হাজার টাকা বা তার অধিক। এবং সেগুলো উৎপাদনের জন্য এখানকার কোম্পানীগুলোর ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি প্রয়োজন।

আরেকটি ব্যাপার: কেন্দ্র সরকার ভ্যাক্সিন ডোজ ১৫০ টাকায় কিনুক কিংবা ৩০৯ টাকায়, ভ্যাক্সিন কেনার পর তার যথোপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজ, রাজ্যগুলোতে পরিবহণ এবং সবশেষে হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স ও স্টাফদের মাধ্যমে জনসাধারণকে টিকাকরণ – এইসবের পিছনেও কিন্তু একটা বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হয়, যা ভ্যাক্সিনের মূল্যের প্রায় কাছাকাছি। ফলে তহবিলে রাখা ৩৫,০০০ কোটি টাকা দিয়ে দেশের অন্তত ১১৬ কোটি নাগরিককে টিকা দেওয়ার বামপন্থী মিডিয়া যে আষাঢ়ে গপ্প দিচ্ছে তা হাস্যকর। বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনের ব্যাপারটা সার্বজনীন করার বিষয় সরকার কোনোদিনই দাবি করেনি, এবং তা সম্ভবও নয়, এমনকি উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রেও।

এবার আসা যাক অক্সিজেনের অভাব এর প্রসঙ্গে। কেন্দ্রীয় স্বাস্হ্য দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষ এমন একটা দেশ যেখানে লিকুইড অক্সিজেনের উৎপাদন তার সাধারণ ব্যবহারের থেকে অন্তত ১০ গুণ বেশি। আমাদের দেশে সাধারণত লিকুইড অক্সিজেনের দৈনিক চাহিদা ৭০০ মেট্রিক টন। করোনার প্রথম পর্যায়ে গতবছর ওই চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮০০ মেট্রিক টন/দিন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বর্তমানে তার চাহিদা প্রায় ৫০০০ মেট্রিক টন/দিন। অথচ আমাদের দেশে লিকুইড অক্সিজেনের উৎপাদন ক্যাপাসিটি দিন প্রতি ৭২৮৭ মেট্রিক টন এবং স্টোরেজে রয়েছে প্রায় ৫০,০০০ মেট্রিক টন লিকুইড অক্সিজেন। অর্থাৎ, এখনও আমাদের কাছে এত চাহিদা সত্ত্বেও উদ্বৃত্ত লিকুইড মেডিক্যাল অক্সিজেনের যোগান রয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ? সেটা কিছুটা পরিকাঠামোগত ও কিছুটা লজিস্টিকাল: যেহেতু এর আগে কখনও এদেশে লিকুইড মেডিক্যাল অক্সিজেনের এমন চাহিদা হয়নি (অর্থাৎ, নর্মালের তুলনায় ৭ গুণ বেশি), এখানে অক্সিজেন পরিবহণের জন্য অত সংখ্যায় সিলিন্ডার ও ট্যাঙ্কারও কখনো মজুদ রাখা হয়নি। তাই এখন অক্সিজেনের থেকে বেশী তা স্টোর ও ট্রান্সপোর্ট করার জন্য সিলিন্ডার ও ট্যাঙ্কার তৈরী করা হচ্ছে এবং শীঘ্রই সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। আরেকটি সমস্যা, কোনো কোনো রাজ্য সরকার আশঙ্কার বশে উদ্বৃত্ত অক্সিজেন থাকা সত্ত্বেও অন্য রাজ্যকে তা দিচ্ছে না।এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।

এখন মোটের উপর আগামী কয়েক সপ্তাহ এই ভ্যাক্সিন ও অক্সিজেন সংক্রান্ত সমস্যাটা হয়তো থাকবে। সেটাকে মাথায় রেখে, আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে বাড়ীর বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে, মাস্ক ও স্যানিটাইজার এবং দু’গজের দূরত্ব যতটা সম্ভব মেনে চলতে হবে। গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মৃত্যুর সম্ভাবনা আটকাতে ডাক্তারবাবুদের পরামর্শে স্টেরয়েড ও ব্লাড থিনার জাতীয় ওষুধের উপর সাময়িক নির্ভরশীল হওয়ার ব্যাপার হতে পারে।

তথ্যসূত্র:

Govt buys Covishield at Rs 200 and Covaxin at Rs 295 per dose, set to deliver across India

https://www.cnbctv18.com/healthcare/covishield-vaccine-for-centre-state-governments-at-rs-400dose-says-siis-adar-poonawalla-9008651.htm

https://www.thehindu.com/news/national/free-vaccination-for-3-crore-frontline-workers-in-the-first-phase-says-health-minister/article33479636.ece

https://www.aninews.in/videos/national/special-price-rs-200-first-100-million-doses-only-goi-adar-poonawalla/

Adar Poonawalla of Serum Institute thanks PM Modi, FM Sitharaman for financial package, vaccination policy

https://m.timesofindia.com/business/india-business/finance-minister-approves-advance-payment-of-rs-4567-crore-to-serum-institute-of-india-bharat-biotech/amp_articleshow/82149322.cms

https://www.deccanherald.com/national/covax-says-indias-serum-institute-bound-to-supply-covid-vaccines-972343.html

Pfizer Demands Governments Gamble With State Assets To Secure Vaccine Deal

https://www.indiatoday.in/coronavirus-outbreak/story/explained-can-states-block-oxygen-supply-why-surplus-producer-india-faces-crisis-1793815-2021-04-22

https://www.newindianexpress.com/cities/bengaluru/2021/feb/14/blood-thinners-may-reduce-risk-of-death-in-covid-patients-2263852.html

https://www.firstpost.com/health/using-steroids-blood-thinners-avoiding-intubation-doctors-make-progress-in-treating-covid-19-8799081.html