‘একুশে’র মিথ, ‘জয় বাংলা’র মিথ্যা – ৩

অধিবেশন পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ (১৯৪৮-১৯৫২)

0
1116

পর্ব ৩ অধিবেশন পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ (১৯৪৮১৯৫২)

(দ্বিতীয় পর্বের পর)

পূর্বেই বলেছি, গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব ভাষা আন্দোলনে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ায় ১৯৪৮র ২রা মার্চ ঢাকায় ফজলুল হক হলে ছাত্রদের এক সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সভায় বাংলা ভাষার দাবীতে ১১ই মার্চ সমগ্র দেশব্যাপী ধর্মঘট আহবান করা হয়। ধর্মঘটের দিন শহরের বহু ছাত্র আহত ও গ্রেফতার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৩ই মার্চ পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় যা চলে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত। দেশের জেলা শহরগুলোতে ও সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এই অশান্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিন বিক্ষোভকারীদের সাথে সমঝোতা চুক্তি করেন যার মধ্যে আটক ছাত্রদের মুক্তিদান, আইন পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন, পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত, ১৪৪ ধারাসহ সংবাদপত্রের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয় অন্তর্ভূক্ত ছিল।

কিছুদিন পরে জিন্না পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে একাধিক স্থানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবি মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সেপ্টেম্বরে জিন্নার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নভেম্বরে ঢাকায় এসে উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতি করলেও জনমত পরিবর্তন করতে তিনি ব্যর্থ হন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়, যেখানে বলা হয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর সমর্থনে ২৭শে ডিসেম্বর করাচীতে আয়োজিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়।

এর কয়েক মাস পর, সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার সমাধানে বাংলাকে আরবী হরফে প্রচলন করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে  ৯ই মার্চ ১৯৪৯ মাওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে গঠন করা হয় পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি। ১৬ সদস্যের একটি ভাষাকমিটিতে সরকারি আমলা, মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্য ছাড়াও ছিলেন ডঃ শহীদুল্লাহর মতো দু’একজন ভাষাবিদ।

এই ডামাডোলের মধ্যেই ভাষা সহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিবিধ বঞ্চনার প্রতিবাদে ২৩শে জুন, ১৯৪৯এ প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ‘, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক ও সহসাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন যথাক্রমে শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান।

বামপন্থী ছাত্ররাও ভাষা আন্দোলনে এগিয়ে আসে। ১৯৫০র  মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন Dhaka University State Language Movement Committee। পরবর্তী দুবছর ভাষা আন্দোলনে এই কমিটির সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

এপ্রিলে পাক গণপরিষদে আরবী হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এর তীব্র প্রতিবাদ জানান; বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় আন্দোলন দানা বেধে ওঠে।

সেপ্টেম্বরে গণপরিষদের দ্য বেসিক প্রিন্সিপালস কমিটি অব দ্য কনস্টিটিউশন এ্যাসেম্বলি অফ পাকিস্তান (The Basic Principle Committee of the Constituent Assembly of Pakistan) তার রিপোর্টে উর্দুকেই  একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি অফ অ্যাকশন ফর ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন (Committee of Action for Democratic Federation) ১৪ই নভেম্বর ১৯৫০ ঢাকায় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনের ডাক দেয়। কনভেনশন থেকে অন্যন্য  দাবী সমূহের সাথে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

ইতোমধ্যে ১৯৫০র ৭ই ডিসেম্বর তারিখে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে অবাস্তব রায় দিয়ে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে, কিন্তু ১৯৫৮র আগে এটি প্রকাশ করা হয়নি। ২৭শে  মার্চ ১৯৫১এ পুনরায় গণপরিষদেতে আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব পেশ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের সংসদ সদস্যদের একাংশের তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।

আসে ১৯৫২ সাল। জানুয়ারি মাসে বেসিক প্রিন্সিপালস কমিটি আর একবার উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে। ২৭শে জানুয়ারি ঢাকা সফররত খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।  প্রতিবাদে ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। একই দিনে আওয়ামী মুসলিম লীগ মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

পরের দিন মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ২১শে ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে।

পাকিস্তান সরকার সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ২১শের দুপুরে ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের দিকে মিছিল নিয়ে যাবার উদ্যোগ করলে পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে, নিহত হন একাধিক জন।

সালামবরকতরফিকজব্বার, ভাষা শহীদ হিসেবে এই চার জনের নাম এক নিঃশ্বাসে বলা হলেও প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মোট ছয়জন (কারও মতে আট) সেদিন নিহত হয়েছিলেন, তার মধ্যে অহিউল্লাহ নামে ৯১০ বছরের একটি বালকও ছিল।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তথ্যবিকৃতি, মূল্যায়নবিকৃতি ঘটেছে নানাভাবে, কিন্তু এই ভাষা শহীদদের নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রথমত, আবুল বরকতকে বাদ দিলে, এঁরা কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না, এবং তাঁদের ওই ঘটনাস্থলে উপস্থিতির কারণ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁরা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন নি। যেমন, সংঘর্ষের সময় সফিউর রহমান যাচ্ছিলেন অফিসে, নিহত আব্দুল জব্বার ঢাকায় এসেছিলেন শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অনিমিত্র চক্রবর্তী করেছেন তাঁর একটি প্রবন্ধে।[1]

(ক্রমশঃ) 

পাদটীকা

[1] অনিমিত্র চক্রবর্তী, ‘৫২ র ভাষা আন্দোলন সদ্যপ্রাপ্ত তথ্যের আলোকে’, বঙ্গদেশ, সংস্করণ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, https://www.bangodesh.com/2019/02/bengali-language-movement-1952-startling-facts/