বৈদেশিক অর্থ সংক্রান্ত অস্বচ্ছতার কারণে এফসিআরএ লাইসেন্স নবীকরণ হল না মিশনারিজ অফ চ্যারিটির

0
557

অবশেষে মিটে গিয়েছে সব দ্বন্দ্ব। অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ নিয়ে মুখ খুলেছে মিশনারিজ অফ চ্যারিটি। পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, কেন্দ্র তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেনি। বরং, কেন্দ্রীয় সরকার সংগঠনের পক্ষ থেকেই সব শাখাকে বিদেশি মুদ্রা সংক্রান্ত লেনদেন বন্ধ রাখতে বলেছে। কেন্দ্রের তরফেও বিবৃতি দিয়ে এই একই তথ্য জানানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মিশনারিজ অফ চ্যারিটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ করা হয়নি কেন্দ্রর তরফে। বরং অ্যাকাউন্ট বন্ধের আর্জি এসেছিল ওই সংগঠনের পক্ষ থেকেই। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, মিশনারিজ অফ চ্যারিটি তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধের আর্জি জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার আরও জানিয়েছে, ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী যে ছাড়পত্রের প্রয়োজন ২৫ ডিসেম্বর তার পুনর্নর্বীকরণ আটকে যায়। কেন্দ্র দাবি করেছে, শর্তপূরণ না হওয়ায় ওই ছাড়পত্রের পুনর্নর্বীকরণ হয়নি। একই বক্তব্য জানিয়েছে মিশনারিজ অফ চ্যারিটি। তাদের বক্তব্য, বিদেশি মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত যে কেন্দ্রীয় ছাড়পত্রের প্রয়োজন ছিল, গত ২৫ ডিসেম্বর সেই ছাড়পত্রের পুনর্নবীকরণ আটকে গিয়েছে। সে জন্যই আপাতত বিদেশি মুদ্রার লেনদেন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই ‌ সংস্থা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গতকাল দুপুর থেকে ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’র (Missionaries of Charity ) সবক’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়ার ভুয়ো অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। মোদি সরকারের তীব্র বিরোধিতা করে টুইটারে সরব হয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পোস্ট করেছেন,‘বড়দিনের উৎসবের মধ্যেই মাদার টেরিজার মিশনারিজ অব চ্যারিটির সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ করে দিয়েছে শুনে আমি অবাক ও বিস্মিত।’ যদিও এই খবর সম্পর্কে কলকাতার মাদার হাউজ কোনও মন্তব্য না করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ট্যুইট করেছেন, ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটির ২২ হাজার রোগী এবং কর্মীরা খাবার এবং ওষুধ পাচ্ছেন না। আইন সবার উপরে কার্যকরী হলেও মানবিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়া একদম ঠিক নয়।’

কোন ঘটনার তদন্তের প্রয়োজনে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা জানা না গেলেও সম্প্রতি গুজরাতে একটি বিতর্ক তৈরি হয় টেরিজার সংস্থাকে ঘিরে। ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ তুলে এই রাজ্যে মিশনারিজ অব চ্যারিটির বিরুদ্ধে FIR-ও দায়ের হয়েছে। গুজরাতের ভাদোদরা শহরে ওই সংগঠনের যে হোম রয়েছে, তার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরকরণ ছাড়াও হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগ‌ও তোলা হয়েছে। যদিও সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে সংগঠন। তারা দাবি করেছে, ওই হোমে কোনও ভাবেই জোরজবরদস্তি ধর্মান্তরকরণ হয়নি। এই অভিযোগের পরে কলকাতায় মাদার হাউসে যোগাযোগ করা হলে আধিকারিকরা জানিয়েছেন, এ নিয়ে তাঁরা এখন কিছুই বলতে চান না।

পঞ্জাবের এক তরুণীকেতরুণী জোর করে এক খ্রিস্টান যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে বডোদরার ওই হোমের বিরুদ্ধে। স্থানীয় পুলিশ কমিশনার সমশের সিংহ জানিয়েছেন, ওই অভিযোগের ভিত্তিতে আলাদা করে তদন্ত চলছে। আর জেলা সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক আধিকারিক ময়ঙ্ক ত্রিবেদীর অভিযোগ, ওই হোমে হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে এবং ওই হোমের অল্পবয়সি মেয়েদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য প্রলোভন দেখানো হতো। গুজরাতের ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন, ২০০৩-এর আওতায় মকরপুরা থানায় এই মর্মে অভিযোগ তুলে FIR দায়ের করেছেন ময়ঙ্ক। তাঁর বক্তব্য ছিল, গত ৯ ডিসেম্বর জেলার শিশু কল্যাণ কমিটির চেয়ারম্যান ও তিনি স্বয়ং ওই হোমে গিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, সেখানে তিনি দেখতে পান, হোমের মেয়েদের জোরজবরদস্তি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ানো হচ্ছে, তাদের গলায় ক্রস পরতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের খ্রিস্টানদের প্রার্থনায় অংশ নিতেও বাধ্য করা হয়েছে। ময়ঙ্ক আরও অভিযোগ তুলেছেন, হিন্দু মেয়েদের জোর করে আমিষ খাবারও দেওয়া হয় ওই হোমে। তাঁর বক্তব্য, এ ভাবেই জোর করে মিশনারিজ অব চ্যারিটি কর্তৃপক্ষ হোমের মেয়েদের জোর করে ধর্মান্তরকরণের রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছেন। ময়ঙ্ক বলেছেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই সংগঠন নিয়মিতভাবে হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগে আঘাত করে চলেছে। পুলিশ ময়ঙ্কের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে।

তবে এই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ কিনা, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালে কলকাতায় মাদার টেরিজা মিশনারিজ অব চ্যারিটি স্থাপন করেন। কলকাতার পাশাপাশি ভারতের কয়েকটি জায়গায় এবং দেশের বাইরেও বহু জায়গায় সক্রিয় চ্যারিটি তৈরি করেন। বর্তমানে ভারতে ২৪৩টি হোম রয়েছে এই সংস্থার। কলকাতায় প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সরকারিভাবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও একজন সদস্য বলেছেন, ‘‘সমগ্র দেশে এবং বিদেশে অনেক ধরনের সেবামূলক কাজের সঙ্গে আমরা যুক্ত রয়েছি। হাজার হাজার অসুস্থ মানুষের সেবা করে চলি আমরা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে অসুস্থ রোগীদের খাবার থেকে ওষুধ সরবারহ সবকিছুতেই সমস্যার মুখে পড়ব আমরা।’’

এছাড়া, ২০১৮ সালে রাঁচিতে একটি শিশুকে ১৭৪০ ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করার অভিযোগ তুলে শহরের শিশু-কল্যাণ কমিটি অভিযোগ দায়ের করেছিল। পুলিশ তদন্তে নেমে সিস্টার কনসালিয়া বালসা এবং দাতব্য কর্মী অনিমা ইন্দোয়ারকে গ্রেপ্তার করে। মিশনারিজ অফ চ্যারিটির একটি বিবৃতিতে জানিয়েছিল, “রাঁচিতে যা ঘটেছে তাতে আমরা সম্পূর্ণ হতবাক।এটা কখনই হওয়া উচিত ছিল না। এটা আমাদের নৈতিক বিশ্বাসের পরিপন্থী। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি।”
পুলিশ জানায়, যে তারা আরও তিনটি শিশুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং ধারণা ছিল সিস্টার বালসা এবং ইন্দোয়ার তাদের বিক্রি করেছে। যে শিশুটিকে বিক্রি করা হয়েছিল সে একটি অবিবাহিত কিশোরীর সন্তান ছিল এবং শিশুটি শিশু সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের হেফাজতে রয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছিল, প্রায় ১,০০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ টাকার বিনিময়ে, তারা শিশুটিকে এক মাসের কম বয়সে এক দম্পতির কাছে বিক্রি করেছিল। কখন‌ও সরাসরি হাসপাতাল থেকে শিশু বিক্রি করা হতো।

পুরীর গোবর্ধন মঠের জগৎগুরু স্বামী যোগেশ্বর আনন্দতীর্থ স্পষ্ট বলছেন,”আমরা দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করিতেছি যে, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণকে স্মৃতির বিধান অনুসারে কোন অবস্থাতেই ধর্মান্তর গ্রহণ বলা চলে না এবং জোরপূর্বক বিবাহ স্থায়ী বিবাহ বলিয়া গণ‍্য হইতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কোন আইন নাই যদ্দ্বারা বলপূর্বক বিবাহকে সিদ্ধ বলিয়া গণ‍্য করা চলিতে পারে। একজন হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করিলেও তিনি হিন্দুই থাকিবেন-বলপূর্বক কেহ তাঁহাকে ধর্মান্তরিত করিতে পারে না।”

কামকোটী পীঠের জগৎগুরু শংকরাচার্য বলছেন,
“বলপূর্বক যে সকল হিন্দু ধর্মান্তরিত হইয়াছেন, তাঁহারা স্বধর্মচ‍্যুত হইয়াছেন বলিয়া বিবেচিত হইবেন না, অথবা যে সকল হিন্দু নারী অপহৃতা বা অপমানিতা হইয়াছেন, হিন্দু সমাজ তাঁহাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না। এই সমস্ত ব‍্যক্তিকে সমাজে ফিরাইয়া আনিয়া আবার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।”

ধর্মান্তরকরণ বিষয়ে “কাশী পণ্ডিতসভার বিধান” হচ্ছে, “বারাণসীর পণ্ডিতদের প্রতিনিধিমণ্ডলী কাশী পণ্ডিতসভা বলিয়াছেন যে, বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও নারীদের সতীত্ব হরণে হিন্দুদের জাতিচ‍্যুতি হওয়ার আশংকা নাই। এইরূপ বিপদের সময় ভগবানের নাম জপ করিলেই শুদ্ধ হওয়া যায়। সমগ্র ভারতে কাশীর পণ্ডিতদের বিধানকে শ্রদ্ধা করা হয়।”

“গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মত” হিসেবে বলা হয়েছে,”শ্রীধাম নবদ্বীপে শ্রীশ্রীধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর শ্রীমন্দিরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক সভা-বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি বর্বরোচিত কার্যের নিন্দা করিয়া ও উক্ত কার্যের পরিসমাপ্তি কামনা করিয়া নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেছেন-
জীব মাত্রেই হরি ভজনে অধিকারী।
ধর্ম চিত্তের অভিরুচির উপর নির্ভর করে।
বলপূর্বক কেহ কাহাকেও ধর্মান্তরিত করিতে পারে না।

জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্র বিষয়ের অধ‍্যাপক পণ্ডিত কৃষ্ণগোপাল গোস্বামী জানিয়েছেন, —
“বলপূর্বক কাহাকেও ধর্মান্তরিত করিলে সে তজ্জন্য স্বধর্মচ‍্যুত হয় না, কারণ মনুস্মৃতিতে আছে, ‘বলপূর্বক দান, বলপূর্বক উপভোগ, বলপূর্বক লিখন এবং অপর যাহা কিছু বলপূর্বক করা হয় তৎ সমস্তই মনুর মতে অসিদ্ধ।’গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে, তাই মিশনের আসল উদ্দ্যেশ্যের খোঁজ কেইবা রাখে?
মিশনারীরা বিবেকানন্দের বাণী উদ্ধৃত করে আজও বলে, “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত: , প্রাপ্য বরাণ নিবোধত: ।”
কিন্তু মিশনের পাদ্রীরাই কি জেগে আছেন !?