দুর্গাপূজা শক্তিবাদীয় সমাজবাদ

অসুরবাদে উৎপীড়িত রাজ্যভ্রষ্ট সর্বস্ব লুণ্ঠিত দেবতাগণ অসুরবাদকে উচ্ছেদ করিবার জন্য সংঘবদ্ধ হন। তাঁহারা নিজ নিজ অস্ত্র ঐ সংঘকে দান করিয়াছিলেন। সংঘশক্তির সঙ্গে অসুরের যুদ্ধই দুর্গামূর্ত্তির মূল কথা। অসুর, সিংহ এবং যুদ্ধরতা মহাশক্তিই দুর্গা প্রতিমার প্রধান মূর্ত্তি। দুর্গামূর্ত্তির সঙ্গে অন্যান্য দেবদেবীর মূর্ত্তিও রহিয়াছে। তাঁহারা হইতেছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ, নীলকণ্ঠ শিব এবং নবপত্রিকা। লক্ষ্মী – ধনশক্তি, খাদ্যশস্যের সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য্য, গ্রাম শহর জাতি ও দেশের সৌন্দর্য্য। সুপরিকল্পিত অর্থ শক্তি।

সরস্বতী – বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, যোগ, তপস্যা, সাহিত্য, ভাষা, গণিত, অঙ্ক, শাস্ত্র, দর্শন, বেদ, বেদান্ত, অর্থশাস্ত্র, ব্যবহার শাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, অনুবাদ বুঝিবার জন্য শাস্ত্রজ্ঞান, দিব্য অস্ত্রশক্তির প্রস্তুত করণ ও ব্যবহার।

কার্ত্তিক – অসুরবাদকে উচ্ছেদ করিবার জন্য সংঘবদ্ধ সু-শিক্ষিত যুব শক্তি।

গণেশ – গণশক্তি।

নীলকণ্ঠ শিব – শক্তিবাদীয় সমাজের আদিগুরু মহাত্যাগী, মহান তপস্বী, মহাযোগী, মহান পিতা মহাদেব ও শক্তিমান পুরুষোত্তম শিব। সাগর মন্থনে সমাজ ধ্বংসী হলাহল উত্থিত হইয়াছিল। সেই হলাহল শিব কণ্ঠে ধারণ করিয়া সমাজ রক্ষা করিয়াছিলেন। সেই হলাহলই শিবের কণ্ঠে বিদ্যমান। এজন্য তিনি নীলকণ্ঠ মহাদেব।

নবপত্রিকা – মানে ফল, ধান্য, খাদ্য ও ঔষধ বৃক্ষের ব্যাপক চাষে দেশকে সম্বৃদ্ধি ও অর্থ শক্তিতে শক্তিমান করা।

কম্যুনিজম ও সোসিয়াসিজম মূর্খগণের ভ্রান্ত নবীন সমাজবাদ – এই সমাজবাদে কার্ত্তিক (যুবকশক্তি) সরস্বতীর (স্কুল, কলেজ, শিক্ষা বিভাগ, সাহিত্যিক, ধর্মপ্রচারক ধর্ম্মপ্রতিষ্ঠানের) বিধ্বংসী আসুরিক নীতি গ্রহণ করিয়াছে। মূর্খদের এই সমাজবাদে গণেশ (গণবাদীরা) লক্ষ্মীর উচ্ছেদ সাধন করিতে তৎপর। এসব গণবাদীরা নির্ব্বিচারে ধনী, শিল্পপতি, বৃহৎ চাষবাদী, মৎস্যচাষীদের উচ্ছেদ করিয়াছে। রাজা, জমিদার ও বিত্তশালীকে ধ্বংস করিয়াছে। কিন্তু লক্ষ্য করিবার বিষয় যে এরা কোথাও মক্কাবাদী মুসলমানদের কোনও প্রকার ক্ষতি করে নাই। কেন্দ্রীয় সরকার, প্রাদেশিক সরকার, পুলিশ, বিচার বিভাগ সকলেই এসব গণবাদীদের অরাজকতা ও দুষ্কার্য্যের সমর্থক ছিল। এসব ঘটনা ইন্দিরাজীর রাজ্যকালেরই সুব্যবস্থা। ইহা চলিল না দেখিয়া ইন্দিরাফ্রন্ট নব কংগ্রেস সোসিয়ালিজম এর শপথ নিয়াছেন। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ভূট্টো যে পূর্ববঙ্গের সমগ্র অত্যাচার অনাচার রক্তপাত ব্যাপক হত্যা ব্যাপক লুণ্ঠন গৃহদাহ জনতা বিতাড়নের রাষ্ট্রপতি, ইহাতে সন্দেহ নাই। সেই ভুট্টোর সাথে ইন্দিরাজী সিমলা শৈলে ভাল ভাবে কোলাকুলী করিলেন। সিমলা চুক্তির এই মর্মকথা। ইনিই নবীন কম্যুনিজমের কর্তা। কাজেই ভারতের সমস্ত দলই সিমলা চুক্তির সমর্থক। রাষ্ট্রপতি গিরিজীও সিমলা চুক্তির সমর্থক। দুর্গামূর্ত্তির মধ্যে অসুরের সঙ্গে যুদ্ধরতা দুর্গামূর্ত্তির (ইন্দিরাজীর) এইরূপ ভয়ঙ্কর অসুরপ্রিয়তা ভারতের জন্য ভয়াবহ বলিতেই হইবে। কারণ পৃথ্বীরাজ, গান্ধী, জহরলাল, শাস্ত্রী ও ইন্দিরার নীতি এক রেখায় আসিয়াছে। ইন্দিরা, ইন্দিরার গুরুগণ এবং ইন্দিরার সমর্থকগণ কি এক মুহূর্ত্ত ভাবিতে পারেন, ভুট্টোর হাতে যদি কখনও দিল্লীর পতন হয় তবে ভারতের কিরূপ দুর্দ্দশা হইবে!…

যখন জমিদার উচ্ছেদ হয় তখন আমরা আমাদের কংগ্রেসী ভক্তদের বলিয়াছিলাম তোমরা জমিদারদের উচ্ছেদ না করিয়া তাঁহাদের দ্বারা বৃহৎ চাষ ও গোপালনের ব্যবস্থায় মন দাও। এখনও এঁরাই সমাজ জীবনের শক্তিশালী অংশ, কর্ত্তৃত্ব, ধন ও সমাজ সংগঠন এখনও ইঁহাদেরই হাতে বিদ্যমান। আমরা রাজন্য উচ্ছেদের সমর্থক কখনও ছিলাম না (দ্রঃ শক্তিবাদ পুস্তক) এবং রাজন্য ভাতা উচ্ছেদেরও বিরুদ্ধে। আমরা সর্ব্বদাই বলিয়াছি রাজন্যগণ দ্বারা বৃহৎ গোপালন, পশুপালন, বৃহৎ চাষ, এবং ফলের বৃহৎ আবাদের ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মন দেওয়া কর্তব্য। ইহার ফলে রাজন্যদের প্রতিষ্ঠা উচ্চে থাকিত, লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্ম ও অন্নের ব্যবস্থা হইত, ভারতের শস্য ও খাদ্য বৃদ্ধি হইত। জনতার উপর ট্যাক্স করিয়া সোসিয়ালিজম বা নোট ছাপিয়া সোসিয়ালিজম এর দুষ্কার্য্য হইতে মূর্খ শাসকদল সহজে আত্মরক্ষা করিবার পথ করিতে পারিতেন। ইন্দিরাজী একদিকে “গরিবী হঠাও” অন্যদিকে নোট ছাপিয়া প্রগতিবাদীদের জন্য বেতন বৃদ্ধি ও শক্তিমানদের উচ্ছেদ করিয়া শস্যহীন ভারত প্রস্তুত করিতেছেন। দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা মানে খাদ্য, শস্য, ফল ও ঔষধের ব্যাপক আবাদের ব্যবস্থা। ইন্দিরা দেবী ভুট্টোর সঙ্গে ভালভাবে কোলাকুলী আরম্ভ করিয়াছেন। ভারতের নবীন সমাজতান্ত্রিক দলগুলি খুব আনন্দ উৎসবের হাততালী বাজাইতেছেন। ভুট্টো ইন্দিরা মিলনে পূঃ বঙ্গ (বাংলাদেশ) নীরব এবং জনসংঘ বিরোধী হইয়াছেন। মুজীব ও পূর্ব্ব বঙ্গ এবং জনসংঘকে আমরা শক্তিবাদ গ্রহণ ও প্রচার করিতে বলি। দুর্ব্বলবাদ বা অসুরবাদ ভারত বা বাংলার মঙ্গল করিবে না।…

সপ্তসিন্ধুবাদ

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, পাঞ্জাবের পঞ্চনদ, ইহারা প্রসিদ্ধ সপ্তসিন্ধুর পবিত্র তপঃভূমি। এই স্থানে অনেক ঋষি, যোগী, মুনি ও তপস্বীর আবির্ভাব হইয়াছিল। তাঁহাদের দ্বারা এক মহান সভ্যতার প্রবর্ত্তন হইয়াছিল। সেই সভ্যতার মূল সূত্র হইতেছে অসুরবাদ নাশ এবং আত্মজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। সপ্তসিন্ধু সভ্যতার নাম শুনিলে যাহারা ক্ষিপ্ত হয় তাহারা কিন্তু সকলেই অসুরতোষক। সপ্তসিন্ধু সভ্যতাই হিন্দুসভ্যতা। সপ্তসিন্ধুর দুইটি ধারা বংগদেশে আসিয়াছে। বং মানে জল, গ মানে গমন। জল যে দেশে গমন করিয়াছে উহার নাম বংগদেশ। সপ্তসিন্ধুর মহান তপঃ ভূমিতে ভারতের অন্যান্য প্রান্ত এবং পৃথিবীর নানাদেশ হইতে মহান ব্যক্তিগণ আসিয়াছেন এবং তপস্যা করিয়া পৃথিবীর নানাদেশে যাইয়া মঠ ও আশ্রম স্থাপনা করিয়া সপ্তসিন্ধু সভ্যতার প্রবর্ত্তন করিয়াছেন।

 

১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে রচিত শক্তিবাদীয় দুর্গাপূজা ও সোসিয়ালিজম গ্রন্থ থেকে সংকলিত।

সৌজন্য: www.shaktivad.net