মানবতা ও কাচিন জাতীয়তাবাদ – প্রচারের অন্তরালের জীবনচরিত

0
899

‘হাড়েরও ঘরখানি’ কবিতায় ওপার বাংলার প্রভাবশালী কবি রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখে গিয়েছিলেন,

‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে

রাজনীতিকের ধমনী ও শিরায় সুবিধাবাদের পাপ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ’-

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে শাসকের পদলেহনকারী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর ভুমিকায় সরব হয়ে রুদ্রর লেখা এই অংশটি দেশকাল ভেদে বাস্তব। সাম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গা সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ব্যাপক হা-হুতাশের প্রেক্ষিতে পুনরায় এই লাইন কটিই মন পড়ে। – কিন্তু কেন এমন বলছি? আসলে বলতে বাধ্য হচ্ছি ভারতবর্ষে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সিলেক্টিভ আউটরেজ বা সোজা কথায় এক চোখামির জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের বিশিষ্টরা ভারতের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তের সার্বভৌম রাষ্ট্র মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চলতে থাকা বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় শুরু হওয়া রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নে স্থানীয় রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর মানুষের আবাসচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলিতে আশ্রয় প্রার্থী হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও পক্ষপাতিত্বমূলক অবস্থান নিয়েছেন। যারা রোহিঙ্গা পীড়ন নিয়ে এই কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছেন তারাই আবার পূর্বপাকিস্থান ও বর্তমান বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন, জমিজমা দখল, রাষ্ট্রীয় হিংসা ও ব্যাপক হারে জন্মভিটে ত্যাগে বাধ্য হওয়া মানুষের যন্ত্রণা  নিয়ে মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন।

লক্ষ্যণীয়, মায়ানমারে সংঘটিত রাষ্ট্রীয় হিংসা শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই নয়, সেখানে বসবাসকারী বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রতিও ঘটছে। বরং গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অপেক্ষা সেখানে কাচিন, কারেন, সান প্রভৃতি প্রাচীন জনগোষ্ঠী অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্ত ও অত্যাচারিত। কিন্তু যেহেতু ভারতীয় রাজনীতিতে এই জনসম্প্রদায়গুলির অনুসৃত ধর্ম ভোটব্যাঙ্ক নয় তাই এদের নিপীড়ন আমাদের দেশের মানবতাবাদী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কানে পৌঁছয়না। বস্তুতঃ রোহিঙ্গা নিয়ে রাজনীতি করলে যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় ততটা কাচিন নিয়ে করা যায় না। অথচ বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে কাচিন জনজাতির লোকেরা মায়ানমারে এক গভীর সঙ্কটে জীবনযাপন করছেন বা বলা ভালো, তাঁরা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছেন। অথচ, আজ পর্যন্ত সাধারণ ও বিশিষ্ট ভারতবাসী এই সিলেক্টিভ আউটরেজের দরুন কাচিন কি ও কারা, কি তাদের সমস্যা জেনে উঠতে পারেনি। আজকের এই লেখা প্রদীপের নীচের সেই অন্ধকারে আলো ফেলার এক প্রচেষ্টামাত্র।

সর্বপ্রথম, মায়ানমার রাষ্ট্রটির প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। ২লক্ষ ৬১ হাজার বর্গমাইলের মাঝারি রাষ্ট্র মায়ানমারের ৬০% সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার জনজাতির হলেও বাকি দুকোটিরও বেশী মানুষ অন্যান্য ছোট ছোট ৮-৯টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্য। সংক্ষেপে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যেমন একাধিক স্বল্প সদস্যের উপজাতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তেমন মায়ানমারেও বিভিন্ন পাহাড়ি জনজাতির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে এরা অধিকাংশই তিব্বতি-বার্মিজ নৃতাত্ত্বিক পরিবারের অংশ, চেহারার ধাঁচের বিচারে মঙ্গোলয়েড ছাপ যুক্ত। এদের মধ্যে মায়ানমারের উত্তরাংশে কাচিন পর্বতের পাদদেশে ‘জিংপো’ ভাষাভাষী যে জনগোষ্ঠীটি খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকে বসবাস করছে তাদের ঔপনিবেশিক দলিল অনুসারে ‘কাচিন’ বলা হয়। যদিও এই তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি আছে, কারণ কাচিনরা কবে তিব্বত মালভূমির নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং বার্মাতে বসতি গড়ে সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকদের আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে ভৌগলিক বিস্তৃতির নিরিখে ‘জিংপো’ dialect বলা জনগোষ্ঠীটি একাধিক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে আছে।

জনসংখ্যার নিরিখে বৃহত্তম অংশটি মায়ানমারে কাচিন, চিনে জিংপো আর ভারতে সিংপো নামে পরিচিত। উচ্চারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকেলও ভাষার লেখ্যরূপটি সকলের মোটামুটি একই। আবার আচার, ব্যবহার, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সমরূপতা লক্ষ্যনীয়। ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জিংপোরা সর্বপ্রাণবাদী। তারা মনে করে জগতসংসারে সমস্ত কিছুর মধ্যেই প্রাণ আছে। আসলে তাদের জনজাতির ঐতিহ্যগত বিশ্বাসের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসার নীতি মিশে এতে অন্য গতি সঞ্চার করেছে। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রবেশের পর খ্রিষ্টান মিশনারিরা বার্মায় কাচিনদের মধ্যে ধর্ম প্রচার চালিয়ে সেখানে খ্রীষ্ট ধর্মের বিস্তার করে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে দুই-তৃতীয়াংশ কাচিনই খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাসী এবং এই ধর্মীয় আনুগত্যের ইতিহাসের অপব্যাখা করে উগ্র বর্মিজ জাতীয়তাবাদীরা কাচিনদের ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তারাধিকার বহনকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, রাষ্ট্রবিরোধী ও ষড়যন্ত্রকারী শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।

কাচিন প্রদেশে মূল সমস্যাটি শুরু হয় ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ত্যাগ করার পর। বস্তুতঃ ভারতের উপজাতি গোষ্ঠীগুলির সাথে সংঘাতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশরা উত্তরপূর্বের জনজাতিগুলির সাথে সন্তর্পণে রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করত। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মিরা মনে করে এই স্বাধীনতা তাদের অর্জিত এবং ঔপনিবেশিক আমলে কিছু উপজাতি ব্রিটিশদের সহযোগিতা করে এসেছে ফলে নতুন রাষ্ট্রে তাদের ক্ষমতা কাঠামোয় জায়গা হওয়া উচিত নয়। নতুন শাসকরা একজাতি ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়। ইতিপূর্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর্বে ব্রিটিশরা আদিবাসী জনজাতিগুলোর অধিকার ও নানা বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করা ও রাজনৈতিক গড়িমসি চালাচ্ছিল। ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা উদ্ধারে বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল আউন সাং (বর্তমান নেত্রী শ্রীমতী সুকির পিতা) আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির সাথে সমঝোতায় আসতে উদ্যোগী হন এবং তিনিই কাচিন নেতৃত্বকে ১৯৪৭র ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ‘পেংলং চুক্তি’ প্রস্তাব করেন। চুক্তিতে কাচিন, চিন, সান ইত্যাদি উপজাতিগুলিকে নিজস্ব বসতি এলাকায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ওই বছর জুলাইয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উ সাউের অঙ্গুলিহেলনে আউন সাংকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে সমস্ত উদ্যোগ বিসর্জিত হয়, বার্মাতে সংখ্যাগুরুর স্বৈরশাসন কায়েম হয়। সমস্ত আদিবাসী এলাকায় স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে রেঙ্গুনের প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হয়। কাচিন সহ অন্যান্য জনজাতি এই উদ্যোগকে প্রতিশ্রুতিভঙ্গ ও আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বিরোধের পথ প্রস্তুত হয়।

ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির পর নতুন ব্যবস্থায় কাচিনরা মোটের উপর দশ বছর সহযোগিতার বাতাবরণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কেন্দ্রীয় সরকার এই সমস্ত জনজাতিগুলির পৃথকত্ব ও নিজস্বতা নিয়ে ভাবিত ছিল না; উপরন্তু শাসন ব্যবস্থায় তাদের অংশীদারিত্ব এবং ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী চিনে কুয়োমিনটাংদের হটিয়ে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় চলে আসে। এই সময় চিনের কম্যুনিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী চৌএন লাই বার্মা সরকারের সাথে এক সীমান্ত চুক্তি বলে কাচিন রাজ্যের কাচিন অধ্যুষিত কিছু অঞ্চল চিনের অন্তর্ভুক্ত করে (১৯৬০)। যদিও এই চুক্তির আগে কোনভাবে স্থানীয় নেতৃত্ব ও বাসিন্দাদের সাথে কথা বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই পদক্ষেপে কাচিনদের মধ্যে ক্ষোভ চরমে ওঠে, কাচিনরা বুঝে যায় স্বশাসন বা স্বাধীনতা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। অধিকার ও স্বশাসন আদায়ের লক্ষ্যে এই সময় রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের পাঁচ কাচিন ছাত্র ‘কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশন’ প্রতিষ্ঠা করে। সত্বর বার্মি সেনাবিহিনী ত্যাগ করে কাচিন সৈন্যরা নতুন সংগঠনের ছায়ায় এসে প্রতিষ্ঠা করেন, ‘কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি’। এদের লক্ষ্য হল নিজের মাতৃভূমিকে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বর্মিদের দখন থেকে মুক্ত করে স্বাধীন ‘কাচিন’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা।

সশস্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর কাচিনরা সরাসরি কেন্দ্রের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ব্রিটিশ আমলে প্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, দক্ষ এই যোদ্ধাবাহিনী শীঘ্রই তাদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষের বসতি অঞ্চলে এক সমান্তরাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে লাগাতার সংঘর্ষ চালিয়ে যেতে থাকে। চীন- সীমান্তবর্তী এই অঞ্চল বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার। বিশ্বখ্যাত জেডাইট বা নেফ্রাইট পাথরের বৃহত্তম উত্তোলন হয় কাচিনে, এছাড়াও বিভিন্ন গাছের কাঠ, সোনা ও বিরল প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের আধিক্য রয়েছে এই অঞ্চলে। সংশ্লিষ্ট জিনিসগুলি চীনে চোরাচালান করে কাচিন স্বাধীনতা বাহিনী বিপুল অর্থ রোজগার করে যা তাদের বাহিনী পরিচালনা ও খরচের প্রধান উৎস। বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রের দাবি অনুযায়ী ‘কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি’ই হল দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে সংগঠিত শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী। বস্তুতঃ ১৯৬১-৯৪, টানা তেত্রিশ বছর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ করে তারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। দীর্ঘকাল সংঘর্ষের পরেও কোন সমাধান সূত্র না বেরনো, তীব্র অনুন্নয়ন, রক্তপাত, হাহাহানি, অর্থব্যয়ের অসার্থকতা বুঝে সরকার বিদ্রোহীদের কিছু দাবি স্বীকার করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়।

দুইপক্ষের মধ্যে সমঝোতা, যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং একটি ‘রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা পুনর্বহাল পর্ষদ’(SLORC) প্রতিষ্ঠা হয় যেখানে কাচিন রাজ্যের মধ্যে কাচিন জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে তাদের স্বশাসনের দাবি প্রায় মেনে নেওয়া হয়। সমঝোতা আলোচনায় KIA তরফ থেকে প্রস্তাব ছিল, তাদের বিদ্রোহী বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বা তাতমান্দোর অধীনে কাচিন প্রদেশেই সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (BGF) হিসেবে গ্রহণ করা ও পুনর্বাসন দেওয়া হোক। সরকারের তরফে তাদের সেনার অঙ্গীভূত করা ও অন্যান্য বিষয়ে মতান্তর বাড়তে থাকে। অবশেষে ২০০২ সালে ‘মায়ানমার আনলফুল অ্যাসোসিয়েশন অ্যাক্ট’ পাশ হলে সরাসরি এই জাতীয় সংগঠনগুলিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। এই পদক্ষেপ দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতার সেতুটি বিছিন্ন করে দেয়, সম্পর্কে অচলাবস্থা ও বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় সরকার বিতর্কিত অঞ্চলে চীনকে ‘দাপিয়েন বাঁধ’ নির্মাণের ছাড়পত্র দিলে ক্ষুব্ধ কাচিনরা পুনরায় অস্ত্র তুলে নেয়। সতের বছরের যুদ্ধবিরতি ত্যাগ করে ২০১১ র জুনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুনরায় বিদ্রোহী বাহিনীকে আক্রমণ করলে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংঘাত শুরু হয়।

প্রথম পর্যায়ের সমঝোতা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে মায়ানমার সরকার বিদ্রোহীদের উপর ব্যাপক ক্ষুব্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। এছাড়াও দক্ষিন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ভারত-চিন দ্বন্দ্বের ফলে মায়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধেজনক অবস্থায় ছিল। দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আস্কারা এবং আর্থিক-সামরিক মদতে প্রান্তিক মানুষের স্বশাসনের দাবি মিলিটারি বুটের তলায় পিষে দিয়ে মায়ানমারকে বিরোধী স্বরমুক্ত করতে ব্যাপক অল-আউট মিশন শুরু হয়। কার্যত ২০১২ সাল থেকেই KIO শাসিত এলাকায় ব্যাপক হারে বলপ্রয়োগ শুরু হয়। ২০১২র সেপ্টেম্বরে বিদ্রোহীদের সদর দপ্তর লেইজাতে বিমান হামলা করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষে দুপক্ষেরই প্রচুর যোদ্ধা, অসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হয়। সেনাবাহিনী বিপুল ধ্বংস, লুঠ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চালায় বলে জনজাতির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়। বিগত সাত বছর ধরে চলা এই হানাহানিতে ২০১৮র এপ্রিল মাস পর্যন্ত পাওয়া রিপোর্ট অনুসারে প্রায় এক লক্ষেরও বেশী মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী চিন, ভারত ও থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চিন ও থাইল্যান্ডের মধ্যস্থতায় বেশ কয়েকবার নিরপেক্ষ ভূখণ্ডে আলোচনা ও সমঝোতার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু এখনও সমাধানসূত্র অধরা।

বস্তুতঃ রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টন, বিদ্রোহী সেনাদের পুনর্বাসন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ইত্যাদি বিষয়ের উপর আলোচনা থেমে আছে। বিদ্রোহীরা যেখানে সরকারকে চাপে রেখে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে দরকষাকষিতে আসতে চায় তেমনি নেইপিদও বারংবার অভিযান চালিয়ে KIA কে শক্তিহীন ও অপ্রাসঙ্গিক করে পোষ মানাতে আগ্রহী। কিন্তু এইসব বিষয়ের বাইরে আরও একটি সমস্যার প্রতি রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তাদের মতে, চীন সীমান্তে একটি অঞ্চলে এইভাবে দীর্ঘদিন সামরিক সংঘর্ষ ও অশান্তি জিইয়ে রাখার পিছনে চীনের প্রভূত উৎসাহ ও প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। চীন যেমন একদিকে বিদ্রোহীদের প্রতি মায়ানমার সরকারের কড়া নীতির সমর্থক ও আন্তর্জাতিক মহলে রক্ষাকর্তা তেমনি বিদ্রোহীদের অস্ত্রের যোগানদাতা এবং চোরাচালানকৃত জেড পাথর, কাঠের গুড়ি ও অন্যান্য সামগ্রীর ক্রেতা এবং চোরাপথে শুল্কবিহীন পণ্যের বিক্রেতা। চীনের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও দুমুখো নীতির ফলেই কাচিন সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা বলে একটি মহলের অনুমান। তবে সাম্প্রতিক অতীতে কাচিন বিষয়ে আমেরিকার নজর পড়েছে তাই সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণ রুখতে চীন বার্মা সরকারকে চাপ দিয়ে সমস্যার দ্রুত সমাধান ও জটিলতার নিরসন চাইছে।

তবে এইসব রাজনৈতিক দরকষাকষি ও যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার পাল্লায় পড়ে সাধারণ আদিবাসী কাচিন জনতা এবং কাচিন রাজ্যের অন্যান্য উপজাতির মানুষের জীবন থমকে আছে। বিপুল বাস্তুচ্যুত নাগরিকের দেশে ফেরার সমস্যা ছাড়াও অনুন্নয়ন, রোজগারহীনতা, শিক্ষা, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, আধুনিক চিকিৎসা ও নাগরিক পরিসেবার অভাব কাচিন প্রদেশকে একটি পশ্চাদপদ জনপদে পরিণত করে রেখেছে। দিবারাত্র গুলি, বোমা, বন্দুক, ল্যান্ডমাইনের আওয়াজে বেড়ে ওঠা দশলক্ষ কাচিন জনসাধারণ জীবনের দায়ে বরাবর বিবাদমান রাজনৈতিক কর্তাব্যাক্তিদের যুদ্ধের বোরে হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সমগ্র অঞ্চলে মানবতা ও অধিকার বলে কিছু নেই; এদেশে সরকার নেই, বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ নেই, ত্রাণ নেই, অনুদান নেই, আওয়াজ নেই, প্রতিবাদ নেই, বুদ্ধিজীবী নেই। কিন্তু এই সব কিছুকে চাপিয়ে রয়েছে – এক নেই রাষ্ট্রের পরিচয়।

পাহাড়ের কোলে জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে ওঠা পাহাড়ি জনজাতি কাচিনরা এক মুমূর্ষু জনতা, বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা নিয়ে চিলচিৎকারের মাঝে যাদের কথা মানুষ ভুলে গেছে। তবে যাদের পক্ষপাতিত্বের প্রতি আমরা আঙুল তুলছি তাদের বাদ দিয়েও দুনিয়া জুড়ে মানবতার ঠেকা নিয়ে বসে থাকা বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলিও যেন এদিকে নজর দেওয়ার সময় পায়নি। একথা নিশ্চয়ই সত্য রোহিঙ্গা সমস্যা বর্তমান পৃথিবী বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ কিন্তু সেখানেই দুনিয়া বোধহয় শেষ হয়ে যায় না। সমগ্র পরিস্থিতি লক্ষ্য করে যাঁরা সেই বৃহৎ ক্ষমতাশালী তাঁদের প্রতি শ্রী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সেই কালজয়ী দুই লাইন আমার কটাক্ষ রইল,

‘ … এর বাইরে জগত আছে, তোমরা মানো না/ তোমারা নিজেই জানো না’।