‘হাম দেখেঙ্গে’ থেকে ‘চলো দেখায়েঁ’: দেখা যাক ফৈজ একজন ইসলামবাদী ছিলেন নাকি নিছক একজন কমিউনিস্ট ছিলেন?

0
1241

আমরা বিগত সপ্তাহগুলো ধরে দেখেছি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ নিয়ে কিরকম ভয়ানক হিংসাত্মক আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনগুলোতে যেসব ইসলামিষ্ট স্লোগান আসছে, তা মানুষকে ভীত করার পক্ষে যথেষ্ট – ‘হিন্দুয়োঁ সে আজাদি’ থেকে ‘কাফিরোঁ সে আজাদি’ ইত্যাদি। বেঙ্গালুরুতে প্রতিবাদ জানানোর নামে হিন্দুদের পবিত্র প্রতীক ‘ওম’ কে চিহ্নিত করে একটি চার অক্ষরের ইংরেজি গালাগালি সমন্বিত পোষ্টার দেখা গেছে। পাটনায় সিএএ বিরোধিতার নামে মুসলিমরা একটি হনুমানের মন্দির ভেঙ্গে দিয়েছে।

দেশ জুড়েই সিএএ’র পাশাপাশি নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসিকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদকে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিশেষ করে কেরালায়। সেখানে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুস্লম লিগের নিজস্ব আইনজীবী ফোরাম তাই বাধ্য হয়ে স্থির করেছে মুসলিমদের ঐ দুটো আইন সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার চালাবে, যাতে প্রতিবাদে ধর্মীয় উস্কানি না থাকে। আসলে মুসলিম লিগের নেতারা নিজেরাই বুঝতে পেরেছেন যে, এই ধরণের ধর্মীয় উস্কানির ফলে কেরালার অমুসলিম সম্প্রদায় তাদের ওপর ক্রুদ্ধ হচ্ছে, বিশেষ করে হিন্দুরা।

ভারতে অসংখ্য বিশবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিসের হাতে ‘নিপীড়িত’ ‘নির্যাতিত’ ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে ইন্সটিটিউট অফ কানপুরও আছে। সেখানকার ক্যাম্পাসে একটি পোষ্টারে উর্দুতে লেখা ছিল “হাম দেখেঙ্গে”, যার স্রষ্টা ছিলেন কুখ্যাত ইসলামিষ্ট মানসিকতার অধিকারী পাকিস্তানজাত কমিউনিস্ট কবি ফৈজ় আহমেদ ফৈজ়। তার লেখা গান তথাকথিত ‘প্রতিবাদকারীরা’ গাইছেন।

এখানে বলে রাখা দরকার যারা ফৈজকে চেনেন, তাঁরা প্রতিবাদের নামে তার গান দেখে বিচলিত হয়ে উঠেছেন। কেননা ফৈজ আর পাঁচটা ইসলামিষ্টের ন্যায় প্রতিমাচূর্ণকারী বা আইকোনোক্লাস্ট মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। আর তারই গান গাওয়া দেখে যারা সত্যিকারের সেকুলার, তারা এর বিরোধিতা করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই যেসব ‘মুসলিমপ্রেমী’ লিবারেল, যারা ইসলাম বিরোধী কোনও বক্তব্যই সহ্য করতে পারেন না; তারা প্রকাশ্যেই ফৈজের ও তার সমর্থকদের আড়াল করতে নেমেছেন নির্লজ্জের মতন।

বামপন্থী লিবারেলরা, যাদের কাছে কাশ্মীরি পাথরবাজরা নিছক বিপথগামী, আফজল গুরুর নির্দোষিতার সাফাইকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের চেয়ে বেশী বিশ্বাস রাখেন; তারা ফৈজ়কে আড়াল করতে গিয়ে তাকে ‘ধর্মদ্রোহী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। হাজার হলেও ফৈজ নিজে একজন প্রগতিবাদী, উর্দুতে নামকরা সাহিত্যিক, অত্যন্ত সংস্কৃতিবান চরিত্র ছিলেন। ফলে তার দোষ কে আর ধরবে! বামপন্থী লিবারেলরা উল্টে প্রতিবাদকারী হিন্দুদের ‘অশিক্ষিত’ ‘পরধর্মবিদ্বেষী’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই।

এইরকম ‘বিচিত্র’ মানসিকতার অধিকারিণী জনৈকা বলিউড অভিনেত্রী টুইটারে আমাকে খোঁচা মারার জন্যই একটি শর্ট ফিল্মের নায়িকার উদ্ধৃতি তুলে নিজেকে ‘প্রগতিবাদী’ বলে জাহির করেছেন। প্রেমিকের প্রতি নায়িকার উদ্ধৃতিটা ছিল এরকম – ‘আমিই তোকে কাফকা পড়তে শিখিয়েছি।’ কিন্তু তিনি আদৌ ফৈজের মানসিকতা সম্বন্ধে জানেন বলে আমার মনে হয়নি। সাধারণ মানুষের কাছে ফৈজ় বা কাফকা সেভাবে পরিচিত নয়। তাদের কাছে দুটিই অপরিচিত, বিদেশী নাম ছাড়া আর কিছুই না।

অনেকের কাছেই ফৈজ় আধুনিক পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে পরিচিত । ফৈজ় সারাজীবন ধরে অনেক সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি লেখক, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, এমনকি মুসলিম লিগের নেতাও ছিলেন। ফৈজ় পাকিস্তান সরকারের বেশ কয়েকটা পদে বসেও ছিলেন।

পাশাপাশি ফৈজ় অসংখ্য সম্মানে অভিষিক্ত হয়েছেন। লেনিন পিস প্রাজ পেয়েছেন। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে বেশ কয়েকটা খেতাবও ফৈজ় জিতেছেন। তিনি রাজনৈতিক ভাবে একজন কমিউনিস্ট ছিলেন।

কবি হিসাবেও ফৈজ ছিলেন অত্যন্ত উচ্চমানের। তিনি উর্দু সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। সন্দেহ নেই আধুনিক উর্দু কবিতা মোটামুটি তারই হাতেই তৈরি হয়েছে। তিনি একাধারে যেমন ছিলান রোম্যান্টিক ও মানবতাবাদী অন্যদিকে তেমনই বিদ্রোহী ও সাম্যবাদী ভাবধারা দেখিয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয়তম কবিতার মধ্যে “বোল কি লাব আজাদ হ্যাঁয় তেড়ে (তোমার যখন ঠোঁট খোলা আছে, বলে ফেল)”, “ইয়ে দাগ দাগ উজ়লনা ইয়ে শব গ়জিদা সেহের (গোধূলি লগ্নে এই আলোআঁধারি খেলা)” বা “হাম দেখেঙ্গে (আমরা দেখে নেব)” বিখ্যাত। যা কালক্রমে গানে রূপান্তরিত হয়েছে।

১৯৭৯ সালে পাকিস্তানী জেনারেল জিয়া-উল-হকের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে “হাম দেখেঙ্গে” কবিতা রচিত হয়েছিল। জেনারেল জিয়া-উল-হক এর জবাবে ফৈজের সব সাহিত্য নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তার বইগুলি স্বহস্তে পুড়িয়েছিলেন। রাজরোষ থেকে বাঁচতে তাকে প্রতিবেশী দেশ ইরানে পালাতে হয়েছিল, সেখানে অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়ে অবশেষে ১৯৮৪ সালে ফৈজ় মারা যান।

তার মৃত্যুর পর ফৈজের ওপর সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই কালো শাড়ী পড়ে পাকিস্তানী গায়িকা ইকবাল বানু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বিদ্রূপ করে প্রায় ৫০,০০০ লোক ভর্তি লাহোর অডিটোরিয়ামে তার নাজম (কাব্যগীতি) উচ্চারণ করেছিলেন।

সে থেকে পাকিস্তানে যে কোনও রাজনৈতিক প্রতিবাদের সময়ে ফৈজের লেখা নাজম আওড়ানো পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের কাছে ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়। ২০১৪ সালে পারভেজ মুশারফের বিরুদ্ধে আজাদি পদযাত্রার সময়ে “হাম দেখেঙ্গে” নাজম আউড়েছিলেন সেদেশের আইনজীবীরা।

এখন প্রশ্ন হল সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যে নাজম আওড়ানো হয়, তাতে এদেশের হিন্দুত্ববাদীরা আপত্তি জানাচ্ছেন কেন? কেনই বা নাজমের বক্তব্য তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করছে? নাকি তারা না জেনেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নাজমের বিরুদ্ধে? এসবের উত্তর পেতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে তার নাজমে ঠিক কি কি পঙক্তি আছে?

মুকবিল আহমার ফৈজের কবিতার অনুবাদ করেছেন। সেটা নিম্নরূপ –

 

১।  “হাম দেখেঙ্গে লাজিম হ্যাঁয় কে হাম ভি দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে

ওহ দিন জিস্কা ওয়াদা হ্যাঁয়, জো লৌহ-এ-আজাল পে লিখা হ্যাঁয়, হাম দেখেঙ্গে।”

 

আমরা সাক্ষী থাকব। নিশ্চিতরূপে আমরা সবকিছুর সাক্ষী থাকব

যতক্ষণ না সব শাশ্বত কিছুর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হচ্ছে।

 

২ “জব জুলম-ও-সিতম কে কোহ-এ-গিরাঁ, রুই কি তরহ উড় জায়েঙ্গে

হাম মহকুমোঁ কে পাও তলে, ইয়ে ধরতি ধড় ধড় ধড়গেকি

ঔর আহল-এ-হাকাম কে সর উপর, জব বিজলি কড় কড় কড়গেকি, হাম দেখেঙ্গে।”

 

যখন অত্যাচারের পর্বত তুলোর মত উড়ে যায়

যখন আমাদের পায়ের তলায় মাটি সরতে থাকে এবং আমরা কাঁপতে থাকি

যখন অপশাসকের ওপর অন্যায়ের শাস্তি হিসাবে বজ্রপাত হবে, আমরা সে মধুর জিনিসের সাক্ষী থাকব।

 

৩। “জব আরজ-এ-খুদা কব সে, সব বুত উঠায়ে জায়েঙ্গে

হাম আহল-এ-সাফা মরদুদ-এ-হারাম, মসনদ পে বিতায়ে জায়েঙ্গে

সব তাজ উছলে জায়েঙ্গে, সব তখত গিরায়ে জায়েঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে।”

 

যখন কাবা থেকে মিথ্যের বোঝা স্বরূপ মূর্তিগুলি সরে যাবে

তখন আমরা পবিত্র হয়ে সেখান থেকে হারাম জিনিস সরিয়ে দিয়ে সিংহাসনের জায়গা ফাঁকা রাখব

তখন রাজমুকুটগুলি শূন্যে উড়বে আর সিংহাসনগুলি চুরমার হবে

 

৪। বস নাম রহেগা আল্লাহ কা, জো গায়েব হ্যাঁয় হাজির ভি

জো মঞ্জর ভি হ্যাঁয় নাজির ভি, উঠেগা আনা-ই-হক না নারা

জো ম্যাঁয় ভি হুঁ ঔর তুম ভি হো, ঔর রাজ করেগি খালক এ-খুদা,

জো ম্যাঁয় ভি হুঁ ঔর তুম ভি হো

হাম দেখেঙ্গে লাজিম হ্যাঁয় কে হাম ভি দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে।”

 

তখন শুধু নামগুলো টিকে যাবে, যা দৃশ্যমান হোক বা অদৃশ্য

যা দর্শকের কাছে তাত্পর্য মনে হবে, এবং সত্যের ক্রন্দন উত্থিত হবে

সেখানে শুধু আমি আর তুমি থাকব, এবং আল্লাহের সৃষ্টি টিকে থাকবে।

শুধু আমি আর তুমি থাকব।

 

আমরা কবিতার চতুর্থ পঙক্তিতে দেখতে পাচ্ছি যে ‘কমিউনিস্ট’ সেজে বসে থাকা ফৈজ় কিন্তু কিরকম ধার্মিক হইলেন এবং একনায়কতন্ত্রকে হঠাবার নামে কিভাবে প্রতিমা ভঙ্গের পক্ষে সওয়াল করে চলছেন। একজন শিক্ষিত মানুষ হিসাবে ফৈজের জানা উচিত ছিল এই অন্ধতম প্রতিমাভঙ্গের মানসিকতা কিভাবে ইসলামকে বহু সভ্যতা ধ্বংস করার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি রূপক অর্থে একনায়কতন্ত্রকে হঠাবার কথা ব্যবহার করলেও তার মধ্যে একটা জিহাদি মনোভাব ঠিকই লক্ষ্য করা যায়, যিনি কাবার নাম করে মূর্তিপূজকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে উস্কাচ্ছেন।

অনেকে বলতে পারেন পাকিস্তানী কবি আল্লামা ইকবাল বা মির্জা গালিবও তো অনেকটা এই ধরণের কবিতা লিখেছেন। তাহলে দোষ শুধু ফৈজকে দেওয়া হচ্ছে কেন? কারণ আছে।

ফৈজ ব্যক্তিগত জীবনে একজন সমাজতান্ত্রিক ছিলেন বটে, কিন্তু কিভাবে সবদিক ভারসাম্য করে চলা যায়, সেটা ভালই জানতেন। স্বাভাবিক, কেননা তিনি এককালে ব্রিটিশ আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন। এমনকি পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সাথে ব্যবসায়িক অভিযানে আমেরিকাও গিয়েছিলেন।

তিনি এরপর ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলে ভাষণ দেন। দেশে ফিরেই তিনি গ্রেফতার হন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কেননা তার বিরুদ্ধে জেনারেল আকবর খানের সাথে হাত মিলিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই জেনারেল খান একজন উন্মত্ত দেশপ্রেমিক ছিলেন, যিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তরফে কাশ্মীর দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।

বাংলাদেশের বহু শিক্ষিত মানুষ ফৈজের নাম শুনলেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তরফে বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার সময়ে তিনি আশ্চর্য নীরবতা পালন করেছিলেন। তার বিদ্রোহী চরিত্রের সাথে এই ব্যাপারটা একেবারেই বেমানান যে, তিনি এত বড় ওয়ার ক্রাইমস, গণহত্যার সময়ে একেবারেই চুপ ছিলেন। এমনকি কবিতা লেখেননি এর প্রতিবাদ জানিয়ে বা সরকারী পদ থেকে ইস্তফাও দেননি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, তিনি “হাম দেখেঙ্গে” বা “হাম কে তেহরেয় আজনবি” গোছের যে নাজম লিখেছিলেন, তা কি প্রিয়বন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ জেনোসাইডের জন্য অভিযুক্ত হওয়া বা জিয়া-উল-হকের অত্যাচারের জন্য? কোন কারণে তিনি হঠাৎ এভাবে সরব হলেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

ফৈজের আচরণ দেখে হতাশ ও ক্রুদ্ধ বাংলাদেশী লেখক আনোয়ার চৌধুরী লিখেছেন, “ঠিক কবে থেকে ফৈজ কবিতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিল? আর কবে থেকেই বা ফৈজ কমিউনিজম ছেড়ে খাঁটি পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠল?”

এব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এই ফৈজই করেছিলেন। অথচ তার কবিতা জুড়ে অসংখ্যবার আল্লাহের নামোল্লেখ পাওয়া গেছে, যা আপাত ভাবে নাস্তিক্যের পক্ষে প্রচারণা চালানো একজন কমিউনিস্টের পক্ষে একেবারে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ মনে হতে পারে। এখন প্রশ্ন হতে পারে তিনি কিভাবে এমন একজন ঈশ্বরের উপাসনাকারী হতে পারেন, যিনি অন্য ধর্মকে ধ্বংসের পাশাপাশি প্রতিমাচূর্ণকারী হতে শেখান?

ফৈজের চিন্তাভাবনা ও লেখনী সত্যি বলতে কি অত্যন্ত ভীতিপ্রদ, শুধু একজন অমুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়; মানবতার দিক থেকেও। নাজমগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে তথাকথিত একজন মুসলিম লিবারেল অমুসলিমদের প্রতি কি ধরণের ঘৃণ্য চিন্তাভাবনা পোষণ করেন।

তবে ফৈজের পক্ষাবলম্বনকারীরা তার হয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেন, তার মত একজন সত্যিকারের একনায়কের বিরোধী, মানবতার পূজারীকে এভাবে কালিমালিপ্ত করা মোটেই ঠিক নয়। তাকে নাকি বুঝতে ‘ভুল’ করা হচ্ছে।

বাস্তবটা মোটেও এত সহজ নয়। তার নাজমের চতুর্থ পঙক্তি ভাল করে পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি মনেপ্রাণে একজন কুৎসিত প্রতিমাভ ঙ্গকারী মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে “শুধু আমি আর তুমি থাকব।” বাক্য থেকে বোঝা যায়, তার মনোজগতে মূর্তিপূজকদের জন্য অপরিসীম ঘৃণা বরাদ্দ আছে।

একজন অমুসলিম হয়ে এটা দেখা সত্যিই কষ্টকর যে, ‘কট্টর ইসলামিক মৌলবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াই লড়বেন একজন ‘অবিশ্বাসী’; সেটা এমনকি মুসলিম লিবারেলরা চান না। তাদের কাছে অমুসলিমদের কোনও অধিকারই নেই ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার। সে একজন ‘কাফির’ এবং তার বা তাদের বিরুদ্ধে হাজার কুবাক্য বললেও একজন মুসলিম লিবারেলই থাকবেন, যদি তিনি কমিউনিস্ট হন।

নতুবা বাংলাদেশে হিন্দুদের জেনোসাইড করা হচ্ছে, জেনেও তিনি চুপ ছিলেন কেন; সেটা কোনও যুক্তিতেই পরিষ্কার নয়। তার নীরবতার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে – তিনি অমুসলিমদের মানুষ হিসাবে গণ্য করতেন না। কাজেই তারা মরল কি বাঁচল, তাতে তার সম্ভবত কিছু এসে যায় না। সম্ভবত এই কারণে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বা ১৯৭১ সালের হিন্দু জেনোসাইড : তার কাছে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল না। আর তাই তিনি এই দুই মর্মন্তুদ ঘটনার সমালোচনা করে কোনও নাজম লেখেন নি।

এইসব কারণে ফৈজের শব্দবন্ধনীকে ব্যবহার করে কেউ যদি তাকে মনেপ্রাণে একজন ইসলামিষ্ট বলে খুব একটা দোষ দেওয়া যায়না। তার নাজম থেকে যেকোনো সভ্য জগতের মানুষের মনে এই ধারণাই হবে – তিনি প্রতিমা ভঙ্গকারী হিসাবে গর্ববোধ করেন।

এই ব্যাপারে তার সাথে আশ্চর্য ভাবে মিল পাওয়া যায় যে দুজন কবির সাথে, তারা হলেন – আমির খুসরু (ছাপ তিলক সব ছিনি তসে নয়না মিলা কে) এবং আল্লামা ইকবাল (তারান-এ-মিললি)। দুজনেই ইসলাম যেভাবে তরবারির মাধ্যমে অবিশ্বাসী নিধন করে সাম্রাজ্যবাদ স্থাপন করা হয়েছে, তার জন্য গর্ববোধ করেন, তাদের কাছে ইসলাম একমাত্র খাঁটি ও বিশুদ্ধ ধর্ম; ইসলামের কোনও ভুল নেই – থাকতে পারেনা।

আহল-এ-সাফা অংশেও ফৈজ় একইভাবে কাফির শব্দটা শত্রু রূপে রূপকার্থে ব্যবহার করলেও তার মনোভাব বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয়না। তিনি ঐ অংশে অমুসলিমদের মুসলিম জগত থেকে পৃথকীকরণ করেছেন নিজস্ব শৈলীতে।

ফৈজ় এভাবে পাকিস্তানে যেভাবে ধর্মীয় আধিপত্য এবং প্রতিমাচূর্ণকারিতার পক্ষে সওয়াল করে তাকে জনপ্রিয় করেছেন, তা চিন্তাজনক। আরও চিন্তাজনক হল তার চিন্তাধারাকে পরবর্তী উর্দু কবিগণ আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন খারিজ করার বদলে। ফৈজ়ের চিন্তাধারা শুধুমাত্র পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

আর ঠিক এসব কারণে যখন প্রতিবাদের নামে ফৈজের অমুসলিম বিরোধী বাক্যগুলি স্লোগানগুলি চালানো হয়; তখন চিন্তিত হতেই হয়। ভুললে চলবে না যে, যেখানে তার নাজম ব্যবহৃত হয়েছে, ঠিক সেখানেই এই স্লোগানও উঠেছে – “হিন্দুয়োঁ সে আজাদি”, যা কট্টর ইসলামিক মৌলবাদের লক্ষণ।

 

লেখক উদ্যোগপতি। স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন সদানন্দ গৌড়াপ্পা।