মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, আগে তো পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যপুস্তকে নেতাজীর নাম আনুন, তারপর জাতীয় দিবস! 

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

 

দিন কয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নেতাজীর সুভাষচন্দ্র বসুর নামে জাতীয় দিবসের ছুটির দাবী করেছেন। নেতাজী বাঙালীর বড়ো প্রিয় আপনজন। নেতাজীর নাম করলেই বাঙালীর আবেগ জেগে ওঠে। নিন্দুকেরা প্রশ্ন করছেন, হঠাৎ এতদিন বাদে এই নেতাজী ভক্তি কেন এতটা জেগে উঠল। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী গত দশ বছর ধরে বাঙলার মসনদে আছেন। এতদিন তো নেতাজী ভক্তি তেমন দেখা যেত না। এইবার বিরোধীদের দাপট অন্যবারের চেয়ে বেশী। বিশেষতঃ বিজেপি ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল। তাই জন্য এবার বিজেপির উপর দোষারোপ করার জন্যই নাকি এই রকম এক দাবী ।

 

২৩শে জানুয়ারী হোক অমর দেশপ্রেম দিবস

যা হোক, একজন বাঙালী ও নেতাজীভক্ত হিসাবে আমি এই দাবীকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছি। নেতাজী ছিলেন ভারতের প্রথম জাতীয় সরকারের প্রধান। (রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের সরকারকে ধরলে দ্বিতীয়। তবে অনেকেই মহেন্দ্রপ্রতাপের  সরকারের সাথে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের আজাদ হিন্দ সরকারকে তুলনা করার বিরুদ্ধে।) তাই নেতাজীর নামে জাতীয় দিবস করাটা নিশ্চয়ই প্রয়োজন। 

তবে এত বড় কর্মবীরের জন্মদিনকে কিছু সরকারী কর্মচারীর ভাতঘুমের দিন করার চেয়ে একে পালন করা হোক অমর দেশপ্রেম দিবস রূপে। আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান হিসাবে তিনি দেশবাসীর কাছে দেশের জন্য ত্যাগ ও বলিদান চেয়েছিলেন। দেশকে ভাঙ্গিয়ে খেতে বলেন নি। আমার মনে হয়, তাঁর নামাঙ্কিত দিনে দেশবাসীর কাছে দেশের জন্য ত্যাগ আহ্বান করা হোক। যাঁরা দেশের জন্য ত্যাগ করেছেন সেই সব দেশবাসীকে এই দিনে সম্মানিত করা হোক।

 কিন্তু শুধু নামে কি কিছু যায় আসে? যদি আজকের প্রজন্ম তাঁর সম্বন্ধে অবগত না হতে পারে, তাহলে শুধু তাঁর নামে একটি জাতীয় দিবস গড়ে কি হবে?  দেখা দরকার  শিক্ষায় তাঁর সম্বন্ধে আমরা তরুণমতি ছাত্রদের কি কি শেখাচ্ছি?  

ভারতের স্বাধীনতায় নেতাজীর ভূমিকা

সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাজীবনে সবচেয়ে বেশি পরিণত অবস্থায় ইতিহাস শিক্ষালাভ করে নবম ও দশম শ্রেণীতে। আমি বাম আমলে সেই ইতিহাস বই পড়েছিলাম। তাতে নেতাজীর নিয়ে কয়েকশো পাতার বইতে ছিল মাত্র দুটি পাতা। স্বাভাবিক বলেই জানতাম। কারণ নেতাজীকে তোজোর কুকুর বলা কমিউনিষ্টরা নিশ্চয়ই তাঁকে খুব বেশী গুরুত্ব দেবেন না, নমো নমো করেই সারবেন।  অবশ্য এ কথা তাঁরা সামনে স্বীকার করবেন না — গীতাপাঠী কালীভক্ত কমিউনিজমের নামটিও না শোনা ক্ষুদিরাম আজকাল প্রচারের ভাষায় “কমিউনিষ্ট” হয়ে যাচ্ছেন, নেতাজী তো কোন ছাড়!

মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে ভাবলাম কমিউনিষ্টদের তীব্র বিরোধী বাঙালী নেত্রী (যাঁকে আজকাল তাঁর অনুগামীরা নেতাজীর সাথেই তুলনা করছেন) নিশ্চয়ই নেতাজী সম্বন্ধে প্রকৃত ইতিহাস বাঙালী ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারকেই কেন্দ্র করে ভারতে সেনাবাহিনীতে ১৯৪৬ সালে বিদ্রোহ দেখা দেয়। কবি সুকান্ত তাঁর অনবদ্য ভাষায় সেই দিনগুলিকে তুলে ধরেছেন,

আজকে যখন স্বাধীন হবার শেষ লড়াইয়ের ডঙ্কা

উঠেছে বেজে, কোনোদিকেই নেইকো কোনো শঙ্কা;

জব্বলপুরে সেপাইদেরও উঠছে বেজে বাদ্য

নতুন ক’রে বিদ্রোহ আজ, কেউ নয়কো বাধ্য,

(সিপাহী বিদ্রোহ, সুকান্ত ভট্টাচার্য)

ভাবলাম, নিশ্চয়ই আজ বাঙালী ছাত্ররা সেরা ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের (বাংলা দেশের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড, ৩৯৭ পৃষ্ঠা) মত জানতে পারছেন যে 

“১৯৪৬ সনের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ভারতীয় নৌবাহিনী বিদ্রোহ করে। ঠিক তাহার পরদিনই বিলাতে পার্লিয়ামেণ্টে ব্রিটিশ মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে, স্বাধীন ভারতের নূতন সংবিধান গঠন-সম্বন্ধে চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য মন্ত্রীসভার তিনজন সদস্য (CABINET MISSION) ভারতে যাইয়া ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করিবেন। …ইহাও বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, জাপানী সৈন্য রেঙ্গুন অধিকারের চারিদিন পরেই ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির দূত হিসাবে ক্রীপসকে (CRIPPS) ভারতে পাঠাইবার ঘোষণা করা হইয়াছিল। যাঁহারা মনে করেন মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিল তাঁহাদের মনে রাখা দরকার যে ১৯৩৩ সনে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত হওয়ার পরে গান্ধী ভারতের মুক্তি সংগ্রামে আর কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন নাই। অপর দিকে সুভাষচন্দ্র কর্তৃক ‘আজাদ হিন্দ্ ফৌজ’ গঠন ও সমগ্র ভারতবর্ষে স্বাধীনতার অগ্রদূত বলিয়া ইহার সম্বর্ধনায় ইংরেজ যখন বুঝিতে পারিল যে, যে ভারতীয় সিপাহীদের সাহায্যে তাহারা ভারতবর্ষ জয় করিয়াছিল এবং এই বিশাল সাম্রাজ্য বিদেশীয় আক্রমণ ও স্বদেশীয় বিপ্লবের হাত হইতে এতদিন রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল, সেই সিপাহীদের উপর আর নির্ভর করা চলে না, সেই দিনই সর্বপ্রথম তাহারা ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিবার প্রতিশ্রুতি দিল এবং তাহার জন্য ব্যবস্থা আরম্ভ করিল।”

 কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শ্রীফণীভূষণ চক্রবর্তী ভারতকে স্বাধীনতা দেবার সময় যিনি বৃটেনের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন সেই ক্লিমেন্স অ্যাটলীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন

“Quit India আন্দোলন তো ১৯৪৭ সালের বহু পূর্বেই মিয়াইয়া গিয়াছিল, ১৯৪৭ সনে এমন কোন পরিস্থিতি বর্তমান ছিল না যাহার জন্য ইংরেজদের তাড়াহুড়া করিয়া এদেশ ছাড়িয়া যাওয়ার প্রয়োজন ঘটিয়াছিল–তবে তাহারা গেল কেন? উত্তরে অ্যাটলি কয়েকটি কারণের উল্লেখ করিয়াছিলেন। সেগুলির মধ্যে প্রধান ছিল নেতাজী সুভাষ বসু কর্তৃক ভারতের স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীযুক্ত দেশীয় সেনানীদের ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তি শিথিল করিয়া দেওয়া। আলোচনার শেষের দিকে আমি লর্ড অ্যাটলিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম ইংরেজদের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্তে গান্ধীর কার্যকলাপের প্রভাব কতটা ছিল? এই প্রশ্ন শুনিবার পর অ্যাটলির ওষ্ঠদ্বয় একটা অবজ্ঞাসূচক হাস্যে বিস্তৃত হইল এবং তিনি চিবাইয়া চিবাইয়া বলিলেন mi-ni-mal!”  

(সূত্র: তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ, নেতাজী সংখ্যা, ১৮০৩ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭)

 দেখাই যাচ্ছে নেতাজীর জন্যেই এসেছিল ভারতের স্বাধীনতা, অন্য কারুর জন্য নয়।  

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নেতাজী


নবম শ্রেণীর ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায়গুলি

দশম শ্রেণীর ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায়গুলি

নেতাজীর এই যথার্থ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ দেখার আশা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ মধ্য়শিক্ষা পর্ষদের Secondary Curricula and Syllabi (West Bengal Board of Secondary Education, 2015) বইটি খুললাম।  দেখে হতাশ হলাম বললেও কম হবে। নবম শ্রেণীর বইতে কেবল ইউরোপীয় ইতিহাস। আমাদের দেশ কোথাও নেই। এ যেন কোন ইউরোপীয় দেশের ইতিহাসের বই পড়ছি। তাতে ভারত থাকবে পাদটীকায়। আর দশম শ্রেণীর বইতে জাতীয়তাবাদ নিয়ে কিছুই নেই। বামপন্থী আন্দোলন নিয়েই বইটি ব্যস্ত। দুই মিলিয়ে পৌনে তিনশো পাতার বইতে একটিবার নেতাজীর নামটি দেখলাম। সেখানেও নেতাজী নেই শুধু আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনীর উপরে একটি ছোট অনুচ্ছেদ। 

নেতাজী ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেসের সভাপতি এবং প্রখর জাতীয়তাবাদী। সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কোথায় ফুটে উঠেছে এই পাঠ্যপুস্তকে? শুধু নেতাজী নন, অশ্বিনী কুমার দত্ত, বিপিন চন্দ্র পাল, মাতঙ্গিনী হাজরা কোথায় এঁদের নাম উপযুক্তভাবে আছে এই পাঠ্যপুস্তকে?

শুধু নেতাজীই বাদ নয়, বাংলার প্রধান বিশেষত্ব ছিল বিপ্লবী আন্দোলন। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্য সেন, এরকম কত শত নাম। সেই বিপ্লবী আন্দোলনের ছবি কোথায় এই পাঠ্যপুস্তকে?

যদি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পরবর্তী প্রজন্মকে নেতাজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে চান, তবে আশু প্রয়োজন এই ইতিহাস বইয়ের সংশোধন। সে কাজ যদি তিনি করে তারপর কেন্দ্র সরকারের কাছে জাতীয় দিবস করতে বলেন, তবেই তাঁর সদিচ্ছা প্রমাণিত হবে। নইলে তাঁর দাবী নির্বাচনী বৈতরণী উতরানোর হাতিয়ার মাত্র, নিন্দুকদের এই কথাটি জোর পাবে।

 

ভাষা শিক্ষার বইতে নেতাজী?

আচ্ছা ইতিহাস ছেড়ে দিয়ে ভাষার বইগুলিতে আসা যাক। নেতাজীর বক্তৃতাগুলি ছিল অদ্ভূত আবেগ ও যুক্তির সমাহার। বাংলা পাঠ্যপুস্তকে লিও তলস্তয় বা পাবলো নেরুদা বা পান্নলাল প্যাটেলের অনুবাদিত লেখা দেখলাম, কবিতা সিংহের কবিতা বা শ্রীপান্থের লেখা দেখলাম, কিন্তু নেতাজীর তরুণের স্বপ্ন থেকে একটি লেখাও দেখলাম না। ইংরেজীতেও একই গল্প। নয়নতারা সেহগল বা মহাত্মা গান্ধীর স্থান আছে, নেতাজীর  The Indian Struggle, 1920–1942 বইটির স্থান নেই।

 

পুনশ্চ

 কংগ্রেস ও কমিউনিষ্টদের কাছে নেতাজীভক্তদের আশা কম, আশঙ্কা বেশি। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠা দিবস প্রথমবার উদযাপন করে এবং নেতাজী সম্বন্ধে সরকারী নথিপত্র প্রকাশ্যে এনে আশার সঞ্চার করেছেন। তাঁর কাছেও একই দাবী রইল, পাঠ্যপুস্তকে জাতীয়তাবাদ ও সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদানকে সামনে আনার দাবী।