পর্তুগিজদের গোয়া ইনকুইজিশন: সন্ত জেভিয়ারের চরিত্র কতটা মহৎ ছিল?

0
2228

নিবান সাধ

পর্তুগিজদের গোয়া ইনকুইজিশন সেকুলার ভারতীয় ঐতিহাসিকদের দ্বারা প্রায়ই বিস্মৃত ও অনুক্ত একটি ঘটনা- যেখানে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য কেবলমাত্র হিন্দুদের পলায়নের প্রতি নির্দেশ করে তা নয়, এটি নির্দেশ করে যে ইহুদিরা কেন মধ্য ইউরোপ থেকে পালিয়ে ভারতে এসেছিল আশ্রয় গ্রহণের জন্য।গোয়ার পর্তুগিজ ইনকুইজিশন শুরু হয়েছিল যখন ভাস্কো-ডা-গামা আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ মারফত ভারতে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করে  ফিরে গিয়েছিলেন। ১৫১০ সালে তাঁর পর্তুগালে প্রত্যাবর্তনের পর গামা পর্তুগিজ রাজন্যবর্গদের ভারতের অনাবিষ্কৃত পথের কথা বলেছিলেন। এর ফলে পর্তুগিজদের ভারতের পশ্চিম উপকূল, বিশেষত গোয়ায় উপনিবেশ বিস্তার করতে সুবিধা হয়েছিল।

পোপ পঞ্চম নিকোলাস অত্যন্ত শীঘ্র একটি ডিক্রি জারি করেন। যার ফলে আবিষ্কৃত অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর বলপূর্বক খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয়। এশিয়ায় রোমান ক্যাথলিক সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্য করার একচ্ছত্র অধিকার পেয়েছিলেন পর্তুগীজ রাজন্যবর্গরা। এর অব্যবহিত পরেই পর্তুগিজরা গোয়ার একটি অংশ দখল করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল।

হিন্দুদের স্থানীয় ঐতিহ্য দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার ফলে পর্তুগিজরা খ্রিস্টধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীর মানুষ দেখলেই রেগে উঠছিলেন এবং তাদের বসতির মধ্যে সকল মন্দির বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটিই রক্তক্ষয়ী গোয়া ইনকুইজিশনের প্রারম্ভ, যার ফলে ব্যাপক হারে মানবাধিকার উল্লঙ্ঘিত হয়েছিল এবং স্থানীয় হিন্দু, ইহুদী ও মুসলিম জনসাধারণের গণহত্যা করা হয়েছিল।

১৫৪১ সালে গোয়ার পর্তুগিজ বসতিতে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রায় ৩৫০ এর থেকে বেশী মন্দির পর্তুগিজ সৈন্যরা ধ্বংস করেছিল। স্পষ্টতঃ সরকারিভাবে ঘোষিত হয়েছিল যে গোয়ার অধিবাসীবৃন্দের জন্য রোমান ক্যাথলিক ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের অনুরাগী হওয়া নিষিদ্ধ।

সন্ত(?) জেভিয়ার

১৫৪২ সালে কুখ্যাত ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স এবং মার্টিন আলফানসো-কে রাজা তৃতীয় জন গোয়ায় পাঠিয়েছিলেন গোয়ার বাসিন্দাদের রোমান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করার পদ্ধতি শুরু করার জন্য। গোয়ায় পৌঁছনোর পর তারা নব্য খ্রিস্টানদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন, যাঁরা গোপনভাবে তাঁদের ধর্ম পালন করছিলেন (হয় ইহুদি ধর্ম, হিন্দু ধর্ম বা ইসলাম) এবং তাঁরা হিন্দু মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের পালন করেছিলেন। এতে বিরক্ত হয়ে ১৫৪৬ সালের ১৬ ই মে ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স  রাজা তৃতীয় জনকে চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তিনি গোয়ার বাসিন্দাদের ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ ও তাঁদের ক্যাথলিক ধর্ম পালন করতে চেষ্টা করেন।

এই ইনকুইজিশন রোমান ক্যাথলিক ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুত্ব, ইহুদীধর্ম অথবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ নিষিদ্ধ করে।কোঙ্কনী, মারাঠী, সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় লিখিত বই বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছিল। গোয়ার বসতিতে কোঙ্কনীর  ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল।

এই ইনকুইজিশন বিশেষভাবে ইউরোপের ইহুদি সম্প্রদায় থেকো ধর্মান্তরিত নব্য খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল- এঁরা স্পেনীয় ইনকুইজিশনের সময় বলপূর্বক খ্রিস্টানধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে বাস করছিলেন। তাঁরা একটি সম্মানজনক জীবনের সন্ধানে এখানে এসেছিলেন, যেখানে তাঁরা প্রকাশ্যে ইহুদি ধর্ম পালন করতে পারবেন এবং একজন খ্রিস্টান হওয়ার ভান করে নিজের ধর্ম লুকোতে হবে না। সমস্ত বিশ্বের মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যা বিশেষত হিন্দু শাসনের অধীনে ইহুদিদের স্বাধীনভাবে তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করতে দিয়েছিল।

গোয়ায় ইনকুইজিশনের পর হিন্দুদের জীবন একেবারে নরক হয়ে গিয়েছিল- ধর্ষকামী খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের নির্দিষ্ট করে গণহত্যা চালাত। খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের ‘অসভ্য’ ও ‘মূর্খ’ বলতেন যাঁরা রাক্ষসের মত দেখতে কালো মূর্তির পূজা করতেন; খ্রিস্টানরা হিন্দুদের ধর্ম ত্যাগ করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন এবং বলপূর্বক খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেখানে একটি ইনকুইজিশন দপ্তর ও গড়ে তোলা হয়েছিল যার উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব, তত পরিমাণ হিন্দুদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা।

হিন্দুদের কোনো গণদপ্তরের অধিকার এবং পৈতৃক সম্পদের উপর অধিকার এবং বিচারালয়ে স্বাক্ষ্যের অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদি কোনো হিন্দু শিশু ঔপনিবেশিকদের চোখে অনাথ হয়, তবে যিশুর সমাজ তার ওপর থাবা বসায় (আবিষ্কৃত হয়েছিল অ- সন্ত ফ্রান্সি জেভিয়ার কর্তৃক) এবং জোর করে তার ধর্ম পরিবর্তন করা হত। সামাজিক জীবনে বৈষম্য স্পষ্ট প্রতীত হচ্ছিল। হিন্দুরা কেবলমাত্র খ্রিস্টান হলেই গণতথ্যগুলিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য ছিল এবং গ্রাম্য দফতরগুলিতে তারা করণিকের পদ পেত না। ১৫৬৭ সালে উক্ত বসতিতে খ্রিস্টানদের কোনো হিন্দুকে নিয়োগ না করার আইন বলবৎ হয়েছিল ( সূত্র: টেটেনিও আর ডি সুজা, দ্য পোর্তুগিজ ইন গোয়া, পৃষ্ঠা ২৮-২৯)।

 

ইনকুইজিশন স্থানীয় দপ্তর

স্থানীয় বাসিন্দা, যাদের তারা সন্দেহ করত যে তারা তাদের পূর্ববর্তী ধর্ম গোপনে পালন করছে, তাদের জেরাও করত। প্রায় ২১৪ বছরেরও (১৫৬০-১৭৭৪) বেশি সময় ধরে ১৬,১৭২ জন স্থানীয় বাসিন্দাকে জেরা করা হয়েছে এবং রোমান ক্যাথলিক ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পালন করলে তাদের উপর প্রায়শই অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে। ইনকুইজিশন দপ্তর কর্তৃক জেরার মুখোমুখি হবার জন্য গোপনে মূর্তি পূজা চালিয়ে যাওয়া অথবা হিব্রুমন্ত্র উচ্চারণ করার গুজব মিশনারি কর্তৃক স্থানীয় দপ্তরে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

অপর ধর্মের পালনকারী দোষীদের ভয়ানক শাস্তি দেওয়া হত- যার মধ্যে ছিল গণপ্রহার, তাদের নির্যাতন করা, ধাতু নির্মিত স্থানে রেখে পোড়ানো, রক্তপিপাসু মিশনারী কর্তৃক কারো নখ, চোখ নষ্ট করে দেওয়া ইত্যাদি। কিছু ক্ষেত্রে যে সমস্ত নারী ও শিশুদের দাস হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, তাদের সহ সমস্ত গ্রামও জ্বালিয়ে দেওয়া হত। বড় বড় চাকা ব্যবহার করা হত অত্যাচার করার জন্য, এগুলির সাথে দোষীদের যারা হিন্দুধর্ম ও ইহুদি ধর্ম পালন করত, তাদের বেঁধে দেওয়া হত ও সেগুলিকে গড়িয়ে দেওয়া হত- নির্দোষ হিন্দু অথবা ইহুদির দেহের প্রতিটি অস্থি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেত।

হিন্দু শিশুদের কখনও কখনও তাদের পিতামাতার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত এবং তাদের পিতামাতার সামনেই তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত- তাদের পিতামাতাদের বেঁধে রাখা হত এবং তাদের শিশুকে জীবন্ত পুড়ে মরে যেতে দেখতে বাধ্য করা হত, যতক্ষণ না তারা খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত হতে রাজি হচ্ছে। প্রায় ৪,০০০ অ-খ্রিস্টানরা এই ইনকুইজিশনের সময়কালে এ ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। মুসলিম আক্রমণকারীদের অনুপ্রেরণায় মিশনারীরা হিন্দুদের উপর জেন্ডি কর চাপিয়ে দিয়েছিল যা জিজিয়া করের সমতুল্য। (সূত্র: সরস্বতীর সন্তান: ম্যাঙ্গালোরের খ্রিস্টানদের ইতিহাস, অ্যালান মাচাদো প্রভু, আই জে এ পাবলিকেশন, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা- ১২১)

পর্তুগিজ ইনকুইজিশনের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র সারস্বত ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী ঔপনিবেশিক পর্তুগিজ আক্রমণকারীদের থেকে লুকোতে পেরেছিল এবং কুশস্থলীর কর্তালিম গ্রামে প্রকৃত জায়গা থেকে তারা বিখ্যাত শিবমূর্তি- মঙ্গেশী শিবলিঙ্গ চুরি করে চালান করেছিল এবং প্রায়োল গ্রামে বিখ্যাত মঙ্গেশী মন্দির স্থাপন করেছিলেন, যেটি সোণ্ডে হিন্দু রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পর্তুগিজরা স্থানীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের উপর বিদেশি ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় আক্রমণকারীরা ধর্মান্তরিত করার জন্য বারবার হিন্দুদেরই লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছিল। ইউরোপীয়দের এই বর্বরতা সত্ত্বেও ভারতীয় সভ্যতা থেকে হিন্দুত্বকে মুছে দেওয়ার অপপ্রয়াস বানচাল হয়ে যায় এবং ১৯৬১ সালে ভারত সরকার দ্বারা গোয়া মুক্তিলাভের পর হিন্দুধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল।

গোয়ার ইনকুইজিশন গোয়ার অধিবাসীদের নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে খুবই অস্বস্তিজনক স্মৃতি উসকে দেয় এবং আমাদের পূর্বপুরুষ কর্তৃক আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি সংরক্ষণের কাহিনীকে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে।

অপইণ্ডিয়ায় প্রকাশিত মূল নিবন্ধটি থেকে অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত, বঙ্গদেশের নয়।